এইচআইভি সংক্রমণ ও মৃত্যু : একটিও নয় আর

প্রকাশিত: ৫:০৪ অপরাহ্ণ, ডিসেম্বর ১, ২০২০

এইচআইভি সংক্রমণ ও মৃত্যু : একটিও নয় আর

মুসলিমা খাতুন

রাজধানীর পুরোনা ঢাকার রিক্সাচালক বেলালের বয়স ৩৫ বছর। টোকাইদের সাথে শিরায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক নিতো বেলাল। ২০১৬ সালে হঠাৎ অসুস্থ্ হয়ে পড়ে। রক্ত পরীক্ষায় এইডস ধরা পড়ে বেলালের। এইডস আক্রান্তের খবর শুনে স্ত্রী-সন্তান তাকে ছেড়ে গেছে। আতœীয়রাও ত্যাগ করেছে। তাকে বাড়িতে থাকতে দেয় না কেউ। সেই থেকে রাজধানীর সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতালেই বসবাস বেলালের। চিকিৎসক, নার্সদের সেবা নিয়ে অনেকটা সুস্থ এখন সে।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার ফাতেমা বেগম। বয়স ৩৭। সৌদি প্রবাসী স্বামীর কাছ থেকে এইচআইভি সংক্রমণ ঘটেছে তার। দুই বছর আগে এইচআইভি সংক্রমন হয়ে এইডসে মারা যান তার স্বামী। এরপর শ্বশুর বাড়ি থেকে বের করে দেয়া হয়েছে ফাতেমাকে। ভাইয়েররাও তার সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেছে। অসুস্থ্তার জন্য প্রতি মাসে ১৫ থেকে ২০ দিন হাসপাতালে থাকতে হয় তাকে। সে সময় মা ছাড়া পাশে আর কাউকে পান না তিনি। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে তার দুই সন্তানের জীবন এবং পড়াশুনা।

বেলাল এবং ফাতেমাদের মতো একাকী জীবন কাটে দেশের অধিকাংশ এইডস রোগীদের। সমাজ এখনো স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেনি এইডস রোগীদের। এইডস শনাক্ত হওয়ার পরই থেমে যায় এদের স্বাভাবিক জীবন, যদিও সরকারি বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান এইডস রোগীদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

দেশে ১৯৮৯ সালে প্রথম এইচআইভি/এইডস রোগী শনাক্ত হয়। চিকিৎসকরা বলছেন, এইডস আক্রান্ত হলেই মৃত্যু, এমন ধারণা সঠিক নয়। যথাযথ চিকিৎসায় এইডস নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবনযাপন করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের মতে, সহায়ক পরিবেশ ও সুযোগ পেলে এইডস রোগীরাও স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারে। এমনকি তারা বিয়েও করতে পারে এবং নন ইফেকটেড সন্তান জন্ম দিতে পারে। এইডস রোগীদের শুধু ওষুধ আর চিকিৎসার ব্যবস্থা করলেই হবে না। তাদের একাকীত্বের খোঁজ নিতে হবে। তাদের জন্য কাজের ব্যবস্থা, ক্লাব গঠন, খেলাধুলা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারের একার পক্ষে তা সম্ভব নয়, এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাসমূহের এগিয়ে আসা উচিত। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এইডস রোগীদের স্বাভাবিক জীবনযাপনের উপযোগী পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব।

এইডস শুধু একটি রোগ নয়, বিশ্বব্যাপী সামাজিক এক সমস্যা হিসেবেও এটি চিহ্নিত। পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই কম বা বেশি মাত্রায় এইচআইভি সংক্রমই এবং এইডস বিস্তার লাভ করেছে। আফ্রিকা মহাদেশের সাব-সাহারা দেশগুলোতে এইচআইভি/এইডস মহামারি আকার ধারণ করেছে। সাম্প্রতিক দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে নারী ও পুরুষের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেসব দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষ করে মাদক ব্যবহারকারী এবং ভাসমান জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশি, তাদের মধ্যে এইচআইভি বেশি ছড়িয়ে পড়ছে এবং সংক্রমণের হার উল্লেখযোগ্য। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এইচআইভি সংক্রমিত হয়েছে যৌন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। তবে ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীদের মধ্যেও এইচআইভি/এইডস সংক্রমণের হার কম নয়।

এইচআইভি হলো হিউম্যান ইমিউনো-ডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস। এই ভাইরাস সংক্রমণের ফলে মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এক সময় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। এর ফলে নানাবিধ রোগে আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যু হয়। এইচআইভি সংক্রমণ ঘটতে একজন রোগীর ১ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এখনো পর্যন্ত এইডসের কোনো প্রতিষেধক, টিকা বা পরিপূর্ণ কার্যকর চিকিৎসা আবিষ্কৃত হয়নি। কিছু ঔষধ রয়েছে, যা এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর জীবন দীর্ঘায়িত করে। তবে কিছু নিয়ম মেনে চললে এ রোগ প্রতিরোধ করা যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রবাসে অবস্থানরতদের ঝুঁকিপূর্ণ যৌন সম্পর্ক বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান না থাকা এবং বিদেশে যাওয়ার আগে এ বিষয়ে পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং না হওয়ার ফলে এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে। বিদেশে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে ফেরা ব্যক্তিদের মাধ্যমে তাদের স্ত্রী ও সন্তানরাও এতে আক্রান্ত হচ্ছেন।

জাতীয় এইডস/এসটিডি কন্ট্রোল কর্মসূচির সর্বশেষ হিসেব মতে, দেশে বর্তমানে এইচআইভি/এইডসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৭ হাজার ৩৭৪ জন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এখনও শনাক্তের বাইরে ৬ হাজার ৬২৬ জন। অর্থাৎ আক্রান্ত রোগীর প্রায় অর্ধেকই এখনও শনাক্তের বাইরে রয়েছেন। আর এ পর্যন্ত যারা শনাক্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে ১ হাজার ৪২ জনের ইতোমধ্যে মৃত্যু হয়েছে।

চলতি বছর করোনা মহামারীর কারণে এইচআইভি/এইডস পরীক্ষায় কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। হাসপাতালগুলোয়ও রোগীর সংখ্যাও কমে এসেছে। অনেক সন্দেহভাজন রোগীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পাশাপাশি বাংলাদেশে অবস্থিত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি-এইডস আক্রান্ত রোগীর উচ্চহার রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের এইডস/এসটিডি কর্মসূচির সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, প্রতিবছর আমাদের এইচআইভি পরীক্ষার টার্গেট থাকে। কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে সে পরীক্ষার ক্ষেত্রে চলতি বছর কিছু ঘাটতি হয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হলো বিশ্ব এইডস দিবস। দিবসটি উপলক্ষে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এ বছর বিশ্ব এইডস দিবসের প্রতিপাদ্য ‘সারা বিশ্বের ঐক্য, এইডস প্রতিরোধে সবাই নিব দায়িত্ব’। বর্তমান প্রেক্ষাপটে প্রতিপাদ্যটি অত্যন্ত যৌক্তিক।

সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও টিবি রোগ থেকে এইডস হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। সিরিঞ্জ ও ওরাল ড্রাগের মাধ্যমে মাদকগ্রহণকারীদের এইডসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ৩০ শতাংশ বেড়ে যায়। অনিরাপদ যৌনমিলন, অপরিশোধিত রক্তগ্রহণ, সুঁইয়ের মাধ্যমে মাদকগ্রহণ এইচআইভি/এইডস বিস্তারের ঝুঁকি বাড়ায়। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণেও এইডসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। পার্শ্ববর্তী দেশসমূহে উচ্চমাত্রায় এইচআইভি/এইডস আক্রান্তের হার রয়েছে। পেশাগত ও বিভিন্ন কাজে সেসব দেশ ভ্রমণ, অবৈধভাবে নারী ও শিশু পাচার এইডসে আক্রান্ত হবার ঝুঁকির অন্যতম কারণ।

অনিরাপদ যৌনমিলন, পরীক্ষা ছাড়া রক্ত গ্রহণ অথবা এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তির কোনো অঙ্গ দেহে প্রতিস্থাপন, একই সুঁই বা সিরিঞ্জ বার বার ব্যবহার করলে এইচআইভি/এইডসে সংক্রমিত হতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তির চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত কাঁচি, ব্লেড, ক্ষুর ইত্যাদি যন্ত্রপাতি জীবাণুমুক্ত না করে ব্যবহার করলে; এইচআইভি আক্রান্ত কোনো মায়ের সন্তান, আক্রান্ত মায়ের দুধ পানের মাধ্যমেও শিশুর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ হতে পারে।

যৌন সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী পরস্পরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা; রক্ত গ্রহণের পূর্বে রক্তদাতার রক্তে এইচআইভি আছে কিনা তা অবশ্যই পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া; একই সুই বা সিরিঞ্জ ব্যবহার না করা; বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী সবাইকে এইডস স¤পর্কে তথ্য দিয়ে সচেতন করা; সামাজিক ও ধর্মীয় রীতিনীতি এবং নৈতিকতা শিক্ষার মাধ্যমে সাধারণ জনগোষ্ঠী, বিশেষত তরুণদের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও আত্মপ্রত্যয়ী হিসেবে গড়ে তোলা এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধে করণীয়।

এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে নিজে জানা এবং অপরকে জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একই সাথে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোর জন্য দৃষ্টিভঙ্গি ও আচরণগত পরিবর্তনেও সচেষ্ট হতে হবে আমাদের। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশ থেকে এইডস নির্মূল করতে জাতিসংঘের কাছে বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

এইচআইভি প্রতিরোধে সরকার সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। দেশে এইচআইভি’র নতুন সংক্রমণ, এইডস আক্রান্ত মানুষের প্রতি বৈষম্য এবং এইডসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু শূন্যে নামিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আওতায় জাতীয় এসটিডি প্রোগ্রামের তত্ত্বাবধানে এইচআইভি/এইডস প্রতিরোধ কার্যক্রম সফলভাবে এগিয়ে চলেছে। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন সংগঠন, গণমাধ্যমসহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মানুষের মাঝে এইচআইভি/এইডস সম্পর্কে সচেতনতা, সঠিক ধারণা ও জ্ঞান বৃদ্ধি পেয়েছে। এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকলে অচিরেই এইডসমুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব। আর সে প্রত্যয়েই কাজ করে যেতে হবে আমাদের।
-০০-

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31