দুর্যোগ প্রশমন ও আমাদের সচেতনতা

প্রকাশিত: ১২:২০ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৯, ২০২০

দুর্যোগ প্রশমন  ও  আমাদের সচেতনতা

ইয়াসমীন রীমা

জলবায়ূ পরিবর্তন বিশ্বের সব মানুষের জন্য আজ উদ্বেগের বিষয়। জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। লঙ্ঘিত হচ্ছে মানুষের মৌলিক অধিকারগুলি। সমুদ্রপৃষ্টে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, উষ্ণতার কারণে বরফ গলে যাচ্ছে। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ব্যাপক হারে। সমুদ্রের উচ্চতা বেড়ে গিয়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় চাষাবাদ, জীবনধারণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, নিরাপদ পানি, সামাজিক অধিকারসহ মৌলিক অধিকারগুলি প্রতিনিয়ত লঙ্ঘিত হচ্ছে।

পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে স্বাভাবিক জলবায়ূর পরিবর্তন হচ্ছে। ঋতু চক্রের আবর্তন ব্যাহত হচ্ছে, বন্যা জলোচ্ছ্বাস, সুনামি, ভূমিকম্প, আইলা, সিডর, আম্ফানের মতো প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চলগুলি লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। জলবায়ূ পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্টে পানির উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে লবণাক্ত পানি আবাদি জমিতে ঢুকে পড়ছে। মাটির লবনাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ বছর ঘূণিঝড় আম্ফানের আঘাতে সারাদেশে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আনুমানিক ২৩ জনের মতো মানুষ মারা গেছে। ঘূর্ণিঝড়ের পুর্বাভাস মাইকে প্রচার শুনে ভোলা জেলার বাসিন্দা ছবুরা খাতুন ও কুদ্দুস মিয়া দম্পতি তার দুই সন্তানকে নিয়ে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের এর হাত থেকে বাঁচতে ঘরবাড়ি ছেড়ে সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথেই গাছের বড় একটি ডাল ছবুরা খাতুনের মাথায় পড়লে সাথে সাথেই তার মৃত্যু হয়।

২০১৮ সালে ৩০ শে মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ বাংলাদেশ উপকূলে আঘাত হানে। প্রায় ৬ ঘন্টা ‘মোরার’ তান্ডবে লন্ডভন্ড হয়ে যায় উপকূলীয় এলাকা। ঘূর্ণিঝড়ের সময় ঘরের দেয়াল, গাছ চাপা এবং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে নারী শিশুসহ ৮ জন নিহত হয় প্রায় ৩০ জন। ট্রলার ডুবিতে নিখোঁজ হয় প্রায় ২১ জন। ২০ হাজার ঘরবাড়ি বির্ধ্বস্ত হয়। ১৩৫ কিলোমিটার বেগে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেয়া হয়। প্রথমে বঙ্গোসাগরে সৃষ্ট নি¤œচাপটি আস্তে আস্তে ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নেয়।

গত ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে সিডর। যার ঘন্টায় গতিবেগ ছিল ২১৫ কিলোমিটার। ২০০৯ সালের ২৫ শে মে আঘাত হানে আইলা। যার গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১২০ কিলোমিটার। সিডর ও আইলার সময় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছিল। আট বছর পর ঘূর্ণিঝড় মোরা আবার আঘাত হানে এবারও ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেয়া হয় আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে। সিডরের আঘাতে প্রাণ হারায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ আর আইলার আঘাতে প্রাণ হারায় ৩২৫ জন। নিখোঁজ হয় আরও অনেকে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সময়মতো প্রস্তুতি গ্রহণ, উপদ্রুত এলাকার লোকজনকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে আসার কারণে ক্ষয়ক্ষতি কমতে শুরু করেছে। এতে বোঝা যায় বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলায় ভালো সক্ষমতা অর্জন করেছে।

ভৌগোলিক কারণেই পৃথিবীর দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। বন্যা, খরা, নদীভাঙন, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিয়মিত মোকাবেলা করতে হয়। ভৌগোলিক অবস্থান, বর্ধিত জনসংখ্যা ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে এমনিতেই দেশটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। তার ওপর জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগগুলো আরো জটিল করে তুলেছে। বিগত বছরগুলোতে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষ করে বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ব্যাপক হারে। এসব দুর্যোগের কারণে প্রতি বছর বিপুলসংখ্যক মানুষের জীবন-জীবিকা হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে। সেই সঙ্গে অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক সম্পদও বিনষ্ট হচ্ছে।

বিশ্বে সবচেয়ে বেশি দুর্যোগপ্রবণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। দুর্যোগ ও পরবর্তী সংকটময় পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিমূলক ব্যবস্থা নিয়ে বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সফল হয়েছে এবং ঘূর্ণিঝড় ও বন্যাদুর্গত বহু মানুষের জীবন বাঁচাতে সমর্থ হয়েছে। এ ক্ষেত্রে নারী ও শিশুদের প্রতি আরো বেশি মনোযোগ দিতে হয়। জনসংখ্যার এই অংশটি বিভিন্ন ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকে। সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে কন্যাশিশু ও নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত সকলকে এগিয়ে আসতে হবে।

যেকোনো দুর্যোগে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হয় অন্তঃসত্ত্বা নারী। তাদের একটা বড় অংশ গর্ভকালীন জটিলতায় আক্রান্ত হয়। গর্ভকালীন জরুরি সেবার অভাবে সন্তান প্রসবকালে অনেক মা ও শিশুর মৃত্যু হয়। আবার অনেকে দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় আক্রান্ত হয়। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক জাতিসংঘের প্রতিবেদনে দেখা যায়, জলবায়ু পরিবর্তনের সর্বোচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ হবার কারণে নারী ও শিশুরা নির্মম শিকারে পরিণত হচ্ছে। দুর্যোগকালীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৮৭ শতাংশ নারী পরিবারের সদস্যদের খাদ্য, পানীয় জল, গবাদি পশু ও ফসল ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পালন করে থাকে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া নারীদের ওপর গৃহস্থালি কাজের চাপ বৃদ্ধি পায় এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণের হার কমে যায়।

ইউএনএফপিএর তথ্য অনুসারে, গর্ভবতী নারী এবং কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। দুর্যোগের সময় পুরুষের তুলনায় নারীর মৃত্যুঝুঁকি ১৪ গুণ বেশি। ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলায় আক্রান্তদের ৭৩ শতাংশই ছিলেন নারী। দূর্গত অঞ্চলে খাবার পানির সংকট বৃদ্ধি পাওয়ায় অনেক দূর থেকে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এ কাজটি নারীরাই করে থাকে। দুর্যোগের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে পরিবার পরিকল্পনা ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবায়ও ঘাটতি দেখা দেয়। বন্যা ও জলোচ্ছ্বাসে চারদিক প্লাবিত হওয়ায় নারীরা চরম স্যানিটেশন সংকটে পড়ে। দুর্যোগের ফলে আয় উপার্জন বন্ধ হয়ে যায়। পরিবারের আয়ক্ষম পুরুষ সদস্য কাজের খোঁজে বিভিন্ন এলাকায় অভিবাসিত হয়। এ সময় সন্তান ও পরিবার নিয়ে নারীরা নিরাপত্তাহীন জীবনাযাপন করে।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও ১৩ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক দুর্যোগ প্রশমন দিবস-২০২০’ পালিত হয়েছে। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো ‘দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে সুশাসন, নিশ্চিত করবে টেকসই উন্নয়ন’। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ বছরের প্রতিপাদ্যটি খুবই প্রাসঙ্গিক। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীন দেশে প্রথম ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে জানমাল রক্ষায় ‘মুজিব কিল্লা’ নির্মাণ করেন। জাতির পিতার দেখানো পথ ধরে বর্তমান সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। পূর্বপ্রস্তুতি নিশ্চিত করার কারণে আজ প্রাকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি নূন্যতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি সম্পদ সম্ভাবনাকে বিবেচনায় নিয়ে প্রণীত একশত বছরের দীর্ঘমেয়াদী ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

বর্তমান সরকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন- ২০১২, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০১৫ এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নীতিমালা-২০১৫ প্রণয়ন করেছে। জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিল গঠন করেছে। ন্যাশনাল ইমার্সেন্সি অপারেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। সরাদেশে ২৩০ টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং আরো ৪২৩টি বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। উপকূলীয় ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ ৬০টি উপজেলায় ১০০টি বহুমূখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ নির্মাণ করা হয়েছে, আরো ২২০টির নির্মাণ কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। উপকূলীয় অঞ্চলে ৩ হাজার ৮৬৮টি বহুমুখী সাইক্লোন শেল্টার নির্মিত হয়েছে, আরো ১ হাজার ৬৫০টি নির্মাণ করা হবে। বর্তমানে ৫৬ হাজার প্রশিক্ষিত স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। প্রায় ২৪ লক্ষ আনসার-ভিডিপি, ১৭ লক্ষ স্কাউটস, ৪ লক্ষ বিএনসিসি এবং গালর্স গাইডের ৪ লক্ষ সদস্য যে কোনো দুর্যোগ মোকাবিালায় প্রস্তুত হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রশিক্ষণ একাডেমি স্থাপন করা হয়েছে। সরকারি এতসব উদ্যোগের ফলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেলে পরিণত হয়েছে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ আমাদের নিত্যসঙ্গী। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা যেমন বেড়েছে তেমনি বাড়ছে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও। এ অবস্থা থেকে উত্তোণের জন্য সরকার বিভিন্ন স্থাপনা নির্মানের পাশাপাশি বৃক্ষ রোপণ কার্যক্রম জোরদার করে সবুজ বেষ্টনী গড়ে তুলতে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে সরকার উপকূলীয় অঞ্চলে বেশি করে তালগাছ রোপনের উদ্যোগ নিয়েছে। প্রকৃতিক দুর্যোগ রোধ করতে না পারলেও এর ক্ষয়ক্ষতি আমরা কমিয়ে আনতে পারি। এর জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে। সরকারের উদ্যোগেই পাশাপাশি আমাদের সচেতনতা প্রকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31