২৯শে মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ২:১৯ অপরাহ্ণ, জুলাই ২১, ২০২০
শামীম আজাদ
আমরা তখন নারায়নগঞ্জে আমলা পাড়ায় লালবাবুর পুকুর পাড়ে থাকতাম । সারা পুকুর ভরা বেগুনী ফুল। আর আমার বয়স বারো। মর্গান বালিকা বিদ্যালয়ে রানী ভবানী হাউস থেকে নাচ আবৃত্তি ও অনবরত গলপ বলার কান্ডকীর্তি শেষে কিন্তু ঐসব কান্ডের প্রমান দিয়েই নারায়নগঞ্জ গার্লস স্কুলে ভর্তি হবার সুযোগ পেলাম। বাসার কাছেই স্কুল। জননীর প্রতিনিধি আমার বুজানের হাত ধরে হেঁটে স্কুলে যেতাম।
স্কুলের হেডমিস্ট্রেস সিলেটের বিপ্লবী কন্যা হেনা দাস। দেখতে দৃঢ়চেতা ও দীর্ঘ, পরনে সাদাসিধা সুতি শাড়ি, কনুই অবধি ব্লাউজের হাতা।
তাঁর দুইকন্যা। দীপা ও চম্পা। বড় কন্যা দীপার ডাক নাম বুলু। দেখতে শ্যামলা ও আপার মত তার ঘন ভুরু জোড়া দেখে যে কেউ তাকে হেনা দাস আপার কন্যা আর আমার বিস্তৃত ললাট ও কান থেকে কান হাসি দেখে সবাই তরফদার সাহেবের কন্যা বলে সনাক্ত করে নিতে পারত। আমরাও সিলেটি।
আব্বা আবু আহমদ তরফদার তখন নারানগঞ্জের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত ছিলেন বলে আমার বাবা মার সঙ্গেও তাঁর একটা বন্ধুত্ব ছিল। আব্বা নারায়ণগঞ্জ রাইফেল ক্লাবের সংস্কৃতি সম্পাদক ছিলেন বিধায় তাঁদের স্থানীয় কিছু উদ্যোগ একেবারে কাছ থেকে দেখে ও পেয়ে বড় হয়েছি।
তরুন স্মৃতিময় বন্দোপাধ্যায় আমাদের কবিতা আবৃত্তি শেখান, সাহিত্য সংযোগে আসেন সরদার জয়েনউদ্দিন, সফল ব্যবসায়ী জয়নুল আবেদীন চাচা আমাদের সব পুরস্কার স্পন্সর, বাদল কাকার স্টুডিওতে বিনামূল্যে আলহেলাল মুকুল মেলার তাবৎ ছবি তোলাতুলি, লোকমান হোসেন ফকির ও কানাই শীল আমাদের বাড়িতে গাইতে আসছেন আর আম্মা মনাভাইকে দিয়ে চা- হালুয়া পাঠিয়ে দিচ্চ্ছেন। হেনা আপাকে বাড়িতে দেখে আমি মহা উত্তেজিত হয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করে করছি। সবই আজ স্মৃতি।
বুলু আমার এক ক্লাশ নিচে পড়লেও আমার খুব বন্ধু। স্কুলের পেছনে আপার কোয়ার্টার। দীপা আর আমি যখন তখন গেইটের আংটা খুলে খেলতে যেতাম আসতাম। দু’ধারে ছোট্ট বাগান। তাতে এক পাশে টুকটুকে লাল জবা। অন্যদিকে দুধের সরের মত পরত পাতা ডাবল টগর, কানফুলের মত জুঁই, বেলী- সব সাদা ফুল। বর্ষায় সেই ছোট্ট বাগানটা সুগন্ধে ম ম করতো।
ঘরের ভেতর কংক্রিটের দেয়ালের জায়গায় বইয়ের দেয়াল। বেতের আসবাব। সুজনী দিয়ে ঢাকা বিছানা। আর যখনি তাদের বাসায় যেতাম, দেখতাম বুলুর বাবা রোহিনী দাস ঝুঁকে বই পড়ছেন। মাঝে মাঝে বাগানে এসে দাঁড়াতেন।
আপা স্কুলে গার্লস গাইড শুরু করেছেন। ঢাকা গাইড হাউস থেকে মালেকা আপা এসেছেন। বুজান আগেই ছিল। এবার আমি এ্যানরোল্ড হলাম। তাঁর প্রণোদনায় আমি গার্ল গাইডিং এ প্রবেশ করি।উচ্চকন্ঠ বলে ১৪ আগস্টের বিশেষ মার্চপাস্টে বড় মেয়েদের বাদ দিয়ে আমিই স্কুলের লিড হয়ে সচিৎকারে স্যালুট দেবো এ সিদ্ধান্তও তাঁরই ছিল।
আব্বা জামালপুর বদলী হয়ে এলে বুলু বেড়াতে এসেছিল। ক’দিন শুকনো কুড়ি ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে দৌড়াদৌড়ি ও বকুল তলায় বকুল কুড়ানোর পর আমরা ওর মামাবাড়ি শেরপুরে গেলাম। কী বিশাল নিয়োগী বাড়ি! সে বার কি বৃষ্টি কি বৃষ্টি। দুপুর বেলা ভাত খেয়ে আমি আর বুলু জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম কিভাবে সে বাড়ির ঘন সবুজ শ্যাওলার গা বেয়ে বেয়ে এঁকেবেঁকে নেমে যাচ্ছে রূপালী জলধারা।
হেনা দাস ১৯২৪ সালে ১২ ফেব্রুয়ারি সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। নারী জাগরণে যে ক’জন নারী তাদের সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে বিশেষ অবদান রেখেছেন তিনি তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন। ব্রিটিশ-বিরোধী-আন্দোলন, নানকার কৃষকদের আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের সকল ক্রান্তিলগ্নে তিনি সক্রিয় ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের প্রথম কুদরতে খুদা শিক্ষা কমিশনেরও অন্যতম সদস্য ছিলেন।
অনেক মনে করি সে বিদ্যাদায়িনীকে। ষাটের দশকের দূর্দান্ত, সৃষ্টিশীল ও দূর্বার একটি কিশোরীর জীবনে সে এক পরম ভাগ্য! বাবা-মার পর আর যাঁরা আমার দিকদর্শন হয়েছিলেন- তাঁরা আমার শৈশবের শিক্ষকগন। তাদের হাতে যে জীবনের হাতে খড়ি হয়েছিল তাতেই এই আজকের আমি।
আপা আজ আপনার প্রয়ান দিবস ।আমার বিনীত প্রণাম আপনার চরণে।
শামীম আজাদ
২০.৭.২০
লন্ডন
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com