২৬শে এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৩ই বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১০:৪৩ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৩১, ২০২০
✎ মাহমুদ এইচ খান, সিনিয়র রিপোর্টার ▏
সমাজের যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ ‘পেশা’র কথা বললেই পুরুষ চরিত্রকে আমরা বুঝি। ক্ষেত্র বিশেষ কোনো পেশায় নারী আসীন হলে আমাদের সংযুক্তি দিয়ে বলতে হয় নারী পুলিশ অফিসার, নারী জেলা প্রশাসক, নারী ম্যাজিস্ট্রেট, শিক্ষিকা, ইত্যাদি। এতো গেল বড় পদমর্যাদার পেশার কথা। কিন্তু কৃষক নারী হলে তাকে কৃষাণী বলা তো যায়?
কৃষাণী কিংবা নারী কৃষক শব্দটি আমরা বছরে একবার হলেও শুনি না হয়তো, যদিও পেশার কোনো লিঙ্গ থাকার কথা ছিল না। কৃষক শব্দটি উচ্চারণ করলেই আমাদের চোখে ভেসে ওঠে পুরুষের চেহারা। কিন্তু আমাদের কৃষি খাতের ৬৫-৮০ শতাংশ কাজই করছেন নারী। প্রতিনিয়ত কৃষিতে নারীর অবদান বেড়ে চলছে। কিন্তু তার স্বীকৃতি পাচ্ছেন নারীরা?
দেশে প্রথমবারের মতো ১৯৯৫-৯৬ সালের শ্রম জরিপে নারীকে কৃষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কৃষিতে নারী শ্রমিকের সংশ্লিষ্টতার এটিই ছিল প্রথম স্বীকৃতি। তবে সেটির সমমূল্য কোথাও উল্লেখ করা হয়নি। গবেষণায় দেখ গেছে ২১ ধরনের কৃষি খাতে ১৭ ধরনের কাজেই গ্রামীণ নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে।
২০১৬ সালে ক্যাম্পেইন ফর সাসটেইনেবল রুরাল লাইভলিহুডের (সিএসআরএল) প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষি খাতের ৮০ শতাংশ কাজই করছেন নারী। ফসলের প্রাক-বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে বীজ সংরক্ষণ, ফসল তোলা, প্রক্রিয়া ও বিপণনের কাজও রয়েছে এর মধ্যে। কিন্তু এত কাজের পরও নারীদের এসব কাজের অর্থমূল্য জিডিপিতে প্রভাব রাখলেও জাতীয় বাজেটে তা হিসেবের বাইরে। সর্বোচ্চ কৃষিতে নারীর অবদানকে মৌখিক স্বীকার করা হয়েছে।
২০০৫-০৬ সালের শ্রম জরিপে বলা হয়, ১৫ বছরের ওপরের জনশক্তির ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ কৃষিতে নিয়োজিত। ওই জনশক্তির ৪২ শতাংশ পুরুষ এবং ৬৮ শতাংশ নারী। এসব নারীরা প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ কিংবা সরাসরি কৃষি কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পূর্বের ওই জরিপ অনুযায়ী কৃষিতে নারীর অবদান পুরুষের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি বলা হয়।
২০০৮ সালে বিশ্বব্যাংকের আরেক জরিপের তথ্য থেকে জানা গেছে, দেশের কৃষিতে নারীর অবদান ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ। তবে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) নারী শ্রমিকের অবদান অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাদের নিয়ে নেই আলাদা কোনো পরিসংখ্যানও। কৃষি ক্ষেত্রে কর্মরত নারী শ্রমিকেরা একই পরিশ্রম করে মজুরি পায় অর্ধেক।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ কৃষি মজুরিভিত্তিক জরিপ থেকেও জানা যায়, একজন পুরুষ যদি কৃষি মজুরি হিসেবে পান ১০০ টাকা, সেখানে নারী পেয়ে থাকেন ৭৫ টাকা।
সরেজমিনে দেশের উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় দেখা যায় কৃষির প্রায় ৭০% কাজ করছেন নারীরা। সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার বারুহাস গ্রামে আমন ধানের মাঠেও নারীদের কাজ করতে দেখা গেছে। এছাড়া বাড়িতে বীজ প্রস্তুত করা, হালচাষের প্রাণীদের দেখাশোনা করা, ফসল মাড়াই, ফসল শোকানো, সংরক্ষণসহ অন্তত ১৫ প্রকার কাজ করতে নারীদের দেখা গেছে।
এই গ্রামের কৃষক আলেয়া আক্তার রেডটাইমসকে বলেন- ‘ভোরে ঘুম থেকে উঠেই মাঠে চাষের যাওয়ার জন্য গরুর হাল বের করি, তাদের খাইয়ে হাল প্রস্তুত করে দেই। এর পরই বিভিন্ন সবজির চাষের কাজে লেগে যাই, আমার স্বামী তখন বোরো ধানের বীজ তলায় কাজ করেন। সকাল ১০টার মধ্যে ধান শুকাতে দেই, তারপরই দুপুরে রান্নাবান্না সেরে মাঠ থেকে তুলে আনা ফসলের মাড়াই শুরু করি। সেগুলো আবার সংরক্ষণ করতে হয় আমাকেই। বিকেলে স্বামী হাটে গেলেও আমার কাজ শেষ হয় না রোধে দেয়া ফসল আমাকেই উগারে (বিশেষ সংরক্ষণ পদ্ধতি) তুলতে হয়। সন্ধ্যার সাথে সাথে আবার মাঠ থেকে গরু-বাছুর আমাকেই বাড়ি নিয়ে আসতে হয়।
৪২ বছর বয়সী আলেয়ার বিয়ের বয়স ২৬ বছর। তিনি আরও বলেন- সংসার সামলানোর কাজের চেয়ে কৃষি কাজেই আমাদের দিনের ৮-৯ ঘণ্টা ব্যয় করতে হয়। স্বামীর সংসারে এসে এই কাজ বেশি হলেও বাপের বাড়িতে থাকা অবস্থায় আমরা ৩ বোন কৃষি কাজই করতাম।’
কৃষক আনোয়ার মিয়া বলেন- ‘আমাদের কৃষিকাজের অর্ধেকের বেশি কাজ বাড়িতে নারীরা করেন। আমরা মাঠে কাজ করলেও কৃষিকাজের মূল কাজ বাড়িতেই হয়। ফসল আবাদ করার আগে বীজ প্রস্তুত, সার প্রস্তুত করা, গরু-মহিষের হাল রক্ষণাবেক্ষণ, বীজ-ফোঁটানো সবই নারীরা করেন। আবার ফসল কেটে বাড়িতে রাখার পর বাকিসব কাজ নারীরাই করেন।’
দেশের দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটে কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি দেখা যায়। এখানে সবজি আবাদ, গরু-ছাগল পালন, মৎস্য খামার পরিচালনা, হাঁস-মুরগি পালন, ফসলের ক্ষেত নিড়ানি, মাঠের ফসল ঘরে তোলা ইত্যাদি কাজে অসংখ্য নারীদের দেখা যায়। সেখানে মাঠের পুরুষের গদবাধা অনেক কাজই নারীরা করে থাকেন। বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে, মই টানা ও চারা রোপণের মতো কাজও দিনভর করেন নারীরা। এর মধ্যে কিছু নারী দিনমজুর হিসেবে অন্যের ক্ষেতেও কাজ করেন। বিশেষ করে ধানের মৌসুমে তারা মজুরি ভিত্তিতে কাজ করেন। তাদের একজন গোপা গোয়ালা।
তিনি রেডটাইমসকে বলেন- কৃষিতে এখন ঘরে বাইরে নারীরা কাজ করছেন। আমরা ১২ জনের একটি টিম আছি। বোরো মৌসুমে আমরা দিনমজুর হিসেবে ধান রোপণ করি। এজন্য দৈনিক ১৫০ টাকা পাই। আমাদের স্বামীর সাথে নিজেদের জমির কাজ শেষে আমরা কিছু টাকায় আয় করার জন্য এই পেশাকে বেছে নিয়েছি।
রোজগারের টাকা দিয়ে কী করেন? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন- ‘যা আয় করি তা গৃহস্থের (স্বামীর) হাতে তুলে দেই। কয়েক বছর ধরে মাঠে ভালো ফসল হচ্ছে না তাই সংসারের খরচ চালাতে এই টাকা দরকার হয়।’ আমরা এতো কাজ করি কিন্তু সংসারে আমাদের কোনো মূল্য নেই মন্তব্য করেন গোপা।
বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের বক্তব্য- ‘গ্রামে কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণ কোনোভাবেই পুরুষের চেয়ে কম না। বরং, কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষকে ছাপিয়ে নারীর অংশগ্রহণই মুখ্য। কিন্তু , মূল্যায়ন করা হয়নি তাদের এই শ্রম। মেলেনি নারীর স্বীকৃতি ও মর্যাদা।’
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) তাদের করা গবেষণা ‘রিয়ালাইজিং দ্য ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ট ইন বাংলাদেশ প্রমোটিং ফিমেইল লেবার ফোর্স পার্টিসিপেশন’-এ বের করেছে, জিডিপিতে নারীর ভূমিকা ২০ শতাংশ। এটি একজন নারী বছরে যত কাজ করেন, তার মাত্র ১৩ থেকে ২২ শতাংশের হিসাব। বাকি ৭৮ থেকে ৮৭ শতাংশ কাজের বিনিময়ে কোনো মূল্য পান না তারা। তাই ওই কাজের হিসাব জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয় না। এটি যুক্ত হলে জিডিপিতে নারীর অবদান হতো পুরুষের সমান।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রমশক্তির জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট এক কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের মধ্যে শতকরা ৭৪ শতাংশ, অর্থাৎ প্রায় ৯২ লাখ নারীই কৃষিকাজ, মৎস্য চাষ ও সামাজিক বনায়নের সঙ্গে যুক্ত।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪৯ শতাংশ নারী। তাদের ৮৬ শতাংশই বাস করেন গ্রামে। আর গ্রামীণ এসব নারী দিনের মোট সময়ের ৫৩ শতাংশ সময় ব্যয় করেন কৃষি ও ক্ষুদ্র শিল্পে, যেখানে এসব কাজে পুরুষদের সময় ব্যয় হয় ৪৭ শতাংশ।
নারী অধিকারকর্মী ও নির্মাতা শাহীনূর আক্তার রেডটাইমসকে বলেন- আমাদের সমাজের অগণিত মৌলিক কাজের সাথে নারীরা যুক্ত রয়েছে। কিন্তু পুরুষরা কখনও তাদের স্বীকার করতে চান না। এর একটা নির্দিষ্ট মনস্তত্ব রয়েছে। সরকারের উচিত নারীর এই সাফল্যগুলোকে তুলে আনা একই সাথে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক ধারণা পুরুষের মন থেকে সরাতে কাজ করা।
এই দেশের সমস্ত বড় বড় শিল্পের সাথে নারীরা যুক্ত। কৃষি থেকে শুরু করে পোশাক শিল্প পর্যন্ত। দেশের চা শিল্প তো নারী শ্রমিকদের দ্বারা ঠিকে আছে। তাদের সবাই শ্রমিক হিসেবেই বৈষম্য করেই দেখছে। কিন্তু অর্থনীতির চাকা কিন্তু তারাই ঘোরাচ্ছে অথচ সম্মান পাচ্ছে না। নারীর কৃষিকাজের সমমূল্য বাজেটে নেই, নারীর সাংসারিক কাজের স্বীকৃতি নেই। এভাবে অনেক কিছু থেকেই নারীদের বাদ রাখা হচ্ছে- যোগ করেন শাহীন।
কৃষিকাজে নারীর প্রতি এই বৈষম্যের কথা স্বীকার করলেন সরকারের কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি রেডটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের নারীরা যতটুকু মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করে কৃষিকে উন্নত করছেন, সমৃদ্ধ করছেন; তারা সেভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না।’
তিনি বলেন- ‘কৃষির হালচাষ ও বাজারজাতের কাজটুকুই উল্লেখযোগ্যভাবে পুরুষরা করেন। এর বাইরে ২০টি কাজের মধ্যে ১৯টি কাজই নারীরা করে থাকেন।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বারি) মহাপরিচালক ড. আবুল কালাম আযাদ জানালেন, কৃষিকাজে নারীদের অংশগ্রহণকে সমান মূল্যায়নের জন্য সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করছেন।
তিনি বলেন- ‘আমাদের সভ্যতার শুরুতে নারীদের হাত ধরেই কৃষির উৎপত্তি, অথচ এই কাজে তাদের শ্রমকে আমরা মূল্যায়ন করতে পারিনি এখনও। তাই আমরা চেষ্টা করছি জেলা পর্যায়ে মাঠ দিবসে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে তাদের অর্জনকে তুলে ধরতে। এজন্য সরকার বদ্ধপরিকর।’
রেডটাইমস/এমএইচকে/টিআই
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com