মাথার উপর থেকে বড় ছাতাটা সরে গেলো

প্রকাশিত: ৯:৫৯ পূর্বাহ্ণ, মে ১৫, ২০২০

মাথার উপর থেকে বড় ছাতাটা সরে গেলো

শাকুর মজিদ

আনিস স্যারের সাথে যেদিন আমার প্রথম খুব কাছাকাছি যায়গা থেকে দেখা সেদিনও তাঁর সাথে আমার দুইবার হ্যান্ডশেক করা ছাড়া কথা হয় নি। কথা বলার সাহসও ছিলো না, সুযোগও না। যদিও যে অনুষ্ঠানটি ছিলো আমারই এবং আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচনের।

ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্রদের প্রথম বছরের কাহিনী লিখেছি- ক্লাস সেভেন ১৯৭৮। আমার প্রথম আত্মজৈবনিক বই। বইটি ছাপার আগে কয়েকজনকে পিডিএফ পাঠিয়েছিলাম। তখন থেকেই হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। ছাপার খবর পেয়ে এই কলেজের প্রাক্তন ছাত্রদের সংগঠন ওফা ঠিক করলো শেরাটন হোটেলে এর একটা প্রকাশনা অনুষ্ঠান করবে। তারিখ ঠিক হয়ে গেল, ২০০৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। অনুষ্ঠানে আমাদের কলেজের প্রাক্তন শিক্ষকেরা থাকবেন। লেখকদের মধ্যে সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম, ইমদাদুল হক মিলন থাকবেন আর প্রধান অতিথি এমিরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

৯ ফেব্রুয়ারি ২০০৮। মোড়ক উন্মোচন হচ্ছে -‘ক্লাস সেভেন ১৯৭৮’ বইটির
আমি বাকি লেখকদের চিনি, আনতেও পারবো, কিন্তু আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে আমার কোন পরিচয় নাই। উনি কি আসবেন ?

ওফা ঢাকা চ্যাপ্টারের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার ভাই। তিনি বললেন- স্যারের সাথে আমার কথা হয়েছে। তুমি কার্ডে নাম দিয়ে দাও, আর এক কপি বই আমার কাছে দিয়ে দাও, আমি উনার বাসায় পৌছাই দিব।

যথারীতি আগের রাতে তাঁর বাসায় বই পৌছানো হলো এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি ঠিক সময় মতোই এসেও গেলেন।

এই প্রথম এতো কাছ থেকে তাঁকে দেখা এবং বক্তৃতা শোনা।

আমি যে বিষয়টা লক্ষ করলাম, তা ছিলো তাঁর কথা বলার পরিমিতি । তিনি যে আমার বইটি সম্পূর্ণ পড়ে এসেছেন তা নিশ্চিত হলাম এটুকু শুনে – যে কথাগুলো বলার জন্য ১২০ পাতার ক্লাস সেভেন ১৯৭৮ বইটি লিখেছিলাম ঠিক সেই সেই কথাগুলোই তিনি উদৃত করছেন। যে বন্ধুটাকে নিয়ে রসিকতা করেছিলাম, ঠিক তাঁর কথাটাই তিনি বলছেন, যে কারনে বইটা ছাপাতে চেয়েছিলাম, দেখি ঠিক সেই কারনটাই তিনি বলছেন। আমার সাথে তো তাঁর কোন কথা হয়নি, দেখাও হয়বি, আলাপও নাই। অথচ এক রাতের মধ্যে বইটির আদ্যোপান্ত পড়ে নির্যাসটুকু বলে দিচ্ছেন মাত্র ৫ মিনিটের বক্তৃতায়।

এই ভিডিও ক্লিপটি ছোট করতে গিয়ে দেখি ফেলে দেয়ার মতো একটা বাক্যও নাই আবার মনের মনে এই আফসোসটাও নাই যে স্যার আমার বইএর এ কথাগুলো বললেন না। তখনই বুঝেছিলাম, তিনি এমনি এমনি আনিসুজ্জামান হননি।

২০০৮ সালের পর আস্তে আস্তে তাঁর সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। বছর চারেকের মাথায় তাঁর সঙ্গে আড্ডা দেয়ার ও আহার-বিহার করার আমণত্রণ পেয়ে যাই এবং নান রসিকতা ও ঢং তামাশা করার উপলক্ষও পাই।

একবার আমি বলেছিলাম, স্যার ৫ বছর আগে আপনি আমার একটা বইয়ের মোড়ক খুলেছিলেন, আপনার কি মনে আছে?

তিনি বইয়ের নামটাও বলে দিলেন।

রাতের দাওয়াতে যেখানে স্যারেরও আসার কথা তিনি এসে পৌছাতেন সবার শেষে। আমরা হয়তো জানতে চাইতাম, এটা ৪ নং না ৫ নং অনুস্টান করে এলেন ?

বলতেন, না আজ কম ছিলো, তিনটা। কমিয়ে দিচ্ছি। আর পারবো না।

বলতাম, স্যার, আপনার পরে তো আর লোক নাই। আমরা কারে নিয়া অনুষ্ঠান করবো ?

হাসতেন।

বলতেন- কারো জন্যে কিছু থেমে থাকে না। ঠিকই সব কিছু চলবে।

আমাদের দলের কেউই তাঁর ছাত্র নই, কিন্তু আমরা সবায় তাঁকে স্যার বলে ডাকতাম।

প্রায় সকল আড্ডা শেষ একটা গ্রুপ ছবি তোলা হতো। এই আড্ডার দুইজন এখন কেবলই স্মৃতি হয়ে গেলেন
আনিসুজ্জামান স্যারের সাথে আমাদের সম্পর্ক খুব মিশ্র। আমরা সিগারেট খাওয়ার জন্য তাঁর সামনে থেকে চলে যেতে চাইলে বসিয়ে দিতেন। বলতেন- এখানে বসে খাও। তাঁর সাথে আলাপ করা যেতো জগতের যে কোন বিষয় নিয়ে। কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি।

অনেক কাছে থেকেই দেখেছিলাম তাঁকে। এ ছবিটি স্যারের জন্মদিনে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
আজকে স্যারের মৃত্যু সংবাদের সময় তাঁর জন্মসালের হিসাব পেলাম। দেখি আমার বাবা আর তাঁর জন্ম একই বছরে ছিলো। ৪৮ বছর বয়সে আমার বাবা মারা না গেলে হয়তো এখন দেখতে আনিস স্যারের মতো হতেন।

বাবা মারা যাবার পর মনে হয়েছিলো বড় ছাতাটা মাথার উপর আর নাই।

আনিসস্যারের মৃত্যু সংবাদ শুনেও মনে হলো, আমাদের মাথার উপর থেকে বড় ছাতাটা সরে গেলো।

শাকুর মজিদলেখক , নাট্যকার ও স্থপতি

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

April 2024
S M T W T F S
 123456
78910111213
14151617181920
21222324252627
282930