২৯শে মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:০৯ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১২, ২০২০
ড জাহিদা মেহেরুন্নেসা
বাংলাদেশের একজন অসাধারণ মেধাবী পুলিশ অফিসারকে হত্যা করা হল, যার মধ্যে মানসিক রোগের কিছু সমস্যা ধরা পড়েছিল । আনিসুল করীম । তিনি বাংলাদেশের পুলিশ বিভাগে থেকে দেশের সেবা করার জন্যই একমাত্র একটি ক্যাডারকে চয়েজ দিয়ে ৩১তম বিসিএস পরীক্ষার ভাইভার ২০০ নম্বরের মধ্যে ১৯৪ নম্বর পেয়ে সে বিসিএস পরীক্ষায় প্রথম হয়ে বি সি এস পুলিশ ক্যাডারে জয়েন করেছলেন । তিনি একজন মেধাবী পরিবারের সন্তান। পুলিশ বিভাগে চাকরি করতে আসার আগে তার শারীরিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং মানসিক দক্ষতা ছিল ঈর্ষণীয় । পুলিশ বিভাগে জয়েন করার পরে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় সেই প্রশিক্ষণের সার্বিক অবস্থান কেমন ছিল সেটাও তার মানসিক দক্ষতার পরিচায়ক হিসেবে কর্তৃপক্ষ খুঁজে দেখতে পারেন । এ রকম একজন মেধাবী অফিসারের মানসিকতায় কেন পরিবর্তন শুরু হল সেটা এখন ভেবে দেখার বিষয় । সেটা কি পেশাগত চাপের কারণে মানসিক চাপ না কি তার ব্যক্তিগত জীবনের কোনো হতাশা জনিত মানসিক সমস্যা ? এই বিষয়গুলি জানা দরকার বিশেষ কয়েকটি কারণে । আমাদের দেশের মেধাবি সন্তানেরা যখন বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে জয়েন করেন তখন তাদের পেশাগত বিষয় , চাকরির দায়িত্বের বিষয়, ব্যক্তিগত সমস্যা , পারিবারিক সমস্যা এবং তার যদি শারীরিক মানসিক সমস্যা থাকে তাহলে কর্তৃপক্ষের বিশেষ তত্ত্বাবধানে তাদের চিকিৎসার নিয়মিত খেয়াল রাখা । এতে দেশের ভবিষ্যৎ তৈরি করা সম্পদকে এভাবে যাতে হারাতে না হয় , বাংলাদেশ সরকারের এ রকম একজন মেধাবী পুলিশ অফিসার আমাদের দেশের অনেক বড় সম্পদ । ভিডিও ফুটেজে যা দেখলাম তা আমাদের কাছে অসহনীয় । তাকে যেভাবে এতগুলি লোক কিলিয়ে গুতিয়ে হত্যা করে তার শরীরকে নিথর করে দিয়েছে সেই দৃশ্যটি অত্যন্ত মর্মান্তিক । দেশের এত বড় একজন মেধাবী অফিসারের এভাবে মৃত্যু দেখে আমরা খুব হতাশ হয়ে পড়ি । শুধু মেধাবীদের মৃত্যুই নয় , যে কারো এ রকম হত্যাকাণ্ড দেখলে আমরা বেদনায় নীল হয়ে যাই ।
মানসিক রোগ হবার পরে পারিবারিকভাবে তাকে মাইন্ড এইড নামে একটি প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে ভর্তি করানো হয় । এখানে চিকিৎসা নিতে এসে এই হত্যাকান্ডটি ঘটেছে । এই ঘটনাটি ঘটার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ে গেল আমার নিজের চোখে দেখা সেই পুরোনো অভিজ্ঞতার কথা। আমার একটা ভাই মানসিক সমস্যায় ভুগছিল । এই ভাইটির চিকিৎসার জন্য প্রথমে আমরা বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে ভর্তি করেছিলাম, এখানে তাকে ২৩ দিন চিকিৎসা দেওয়া হল, কিন্তু সম্পূর্ণ সুস্থ হবার আগেই কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল থেকে তাকে ছুটি দিয়ে দিল। কারণ হিসেবে উল্লেখ করল, অনেক রোগী থাকায় তারা এর থেকে বেশী দিন হাসপাতালে রাখতে পারবে না, সেই অনুমতি তাদের নেই । এতে আমি খুব অসহায় বোধ করেছিলাম । বুঝলাম মানসিক রোগীকে এ দেশের মানসিক চিকিৎসা বিভাগ খুব একটা সাপোর্ট দিতে পারছে না । ওরা কিছু চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র দিয়ে আমার ভাইকে ছেড়ে দিয়েছিল ।এতে ওর রোগ তো ভাল হল না উপরন্তু আরো খারাপ হয়েছিল বলেই ধরে নেওয়া যায় । তারপরে চিকিৎসা চালিয়ে নিতে আমরা দেখতে পেলাম প্রাইভেট ভাবে মানসিক বিভিন্ন ক্লিনিকগুলিতে ভর্তি করা ছাড়া তার আর চিকিৎসার কোনো উপায় নেই । আর এ সমস্ত হাসপাতালগুলির চার্জ এত বেশী যে আমাদের মত মানুষের পক্ষে এ সমস্ত জায়গার খরচ চালানো সম্ভব না। এইসব দিক চিন্তা করে আমাদের পরিবারের সদস্যরা মিলে শেরেবাংলা নগরের মানসিক চিকিৎসার হাসপাতালে নিয়ে গেলাম , দেখলাম সেখানে কোনো ডাক্তার উপস্থিত নেই , কোনো ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে আমার ভাইকে কীভাবে ভর্তি করব কী করবো এইসব বিষয়ে আলাপ করার জন্য একজন ডাক্তারকেও পেলাম না , তারপরেও ওই হাসপাতালের স্টাফের মাধ্যমে ওখানে ভর্তির ব্যবস্থা চূড়ান্ত করেছিলাম । এরপরে দেখলাম সেখানে যারা আমার এই মানসিক রোগগ্রস্ত ভাইটাকে নিচে থকে নিতে এসেছিল তারা প্রায় জোর উপর তলায় নিয়ে যাচ্ছিল যেখানে এদেরকে তালা চাবি দিয়ে রাখা হয় । আমার ভাইটিও অবশ্য এই রকম জায়গায় ভর্তি হবে না বলে খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছিল ।
এরা মানসিক রোগগ্রস্ত বলে এদের থাকার ব্যবস্থাটিকে এতই খারাপ করে রাখা হয়েছে , অর্থাৎ চিকিৎসা ব্যবস্থাকে এতই অবহেলিত এবং অত্যাচারের অব্যবস্থাপনার মধ্যে রাখা হয়েছিল যে সেটা দেখলে কোনো মানুষই তাদের রোগীকে এখানে রাখবে ন। আর মানসিক হাসপাতালের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ডাক্তার থেকে শুরু করে এই ব্যবস্থাটিই টিকিয়ে রেখেছে । ওখানে যে ডাক্তাররা এই চিকিৎসা এবং ভর্তির সাথে যুক্ত তাদের দেখা পাওয়া গেল না । তাদের সঙ্গে টেলিফোনে যখন আলাপ করেছিলাম এখানের কিছু দালালদের মাধ্যমে জানতে পেরেছি এইসব স্টাফ এবং ডাক্তাররা এক একটা প্রাইভেট হাসপাতাল খুলে বসে দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে যারা এই সরকারি হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যবস্থাটাকে পঙ্গু করে রেখেছে । মানসিক হাসপাতালের উপরের তলায় ভাইকে কোথায় রাখা হবে সেটা দেখার জন্য নিজেই ওর জন্য বরাদ্দ রুমটি দেখতে গেলাম, সেখানে এত জঘন্য অবস্থা যে ছারপোকারাই মানসিক রোগীকে আরো পাগল বানিয়ে ফেলতে পারবে। এমন দুর্গন্ধ আর ময়লাভাবে হাসপাতালের বেডগুলিকে খারাপ করে রাখা হয়েছে যে সেখানে খাটের বেডের তোষকগুলো ছেঁড়া আর এর মধ্যে একেবারে পার্মানেন্ট ভাবে ছারপোকারা তাদের পরবর্তী জীবনে র জন্য বাসাবাড়ি ফ্লাট এপার্ট্মেন্ত গড়ে নিয়েছে। খাওয়া দাওয়ার অবথা আরো করুণ । এইসব দেখে এবনফ তারা যা বলেছিল সেটা হল অসবসময় একজন এতেন্ডেন্ট তাদের সঙ্গে রাখতে হবে । এখন সবসময় নিজের পক্ষে এটেন্ডেণ্ট রাখাটা সম্ভব হচ্ছিল না , আর এত ছারপোকা দেখে বুঝলাম মানসিক রোগীদের এখান থেকে তাড়িয়ে নিয়ে এখানের যত স্টাফ আছে তাদের যৌথ প্রচেষ্টায় হাস্পাতালের অপজিটে ঐ সমস্ত প্রাইভেট ব্যবস্থাপনায় ভর্তি করা ছাড়া কোনো উপায় নেই । এই ব্যাপারটা বুঝে নিয়ে ভাইকে ওখান সরকারি ব্যবস্থাপনার মানসিক হাসপাতালের ছারপোকার কারাগার থেকে থেকে মুক্ত করে আনলাম , এর পরে গেলাম ওই হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য । সেখানে গিয়ে দেখলাম এই এখানে কালে ভদ্রে ডাক্তার এসে রোগীকে দেখে এবং বছরের পরে বছর চিকিৎসার নামে যৌথ ব্যবস্থাপনার এইসব হাসপাতালগুলি চলে। এরপরে যাদেরকে দেখেছিলাম তাদের দেখে মনে হল এরা কতগুলি পেশিশক্তির অধিকারী মানুষ। আরো মনে হল এরা বোধ হয় মানসিক রোগীদের মেরে পিটিয়ে ভয় দেখিয়ে এখানে ধরে রাখে, সত্যি কথাও বলতে দেয় না । এইসব দেখে আমাদের ভয় লেগে গেল । আমরা পরিবারের সদস্যদের ধারণা হয়েছিল এদের তত্বাবধানে দিলে ভিতরে এরা কি চিকিৎসা দেয় এবং কীভাবে অসুস্থ মানসিক রোগগ্রস্ত কে চিকিৎসা দিচ্ছে বাইরের মানুষের কাছে তার কোনো জবাব্দিহিতার ব্যবস্থা নেই এবং ভর্তি করে ফেলার পরে আর এখানে ওদের ওপর নির্ভর করা ছাড়া আমাদের কিছুই করা সম্ভব না ; সুতরাং আমার ভাইয়ের একটা সার্বিক ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, এবং এক্ষেত্রে কিছু একটা হয়ে গেলে আমরা কিছুই ব্যবস্থা নিতে পারবো না । এই রকম একটি আশংকা আমাদের মনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল । তাই আমরা নিজেদের টাকা পয়সা দিয়ে ওদের কাছে ভাইয়ের জীবন নিয়ে হেলা ফেলা করতে দিতে পারি না। এর ওপরে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে প্রাপ্য অর্থ থেকেই ওদের এই ব্যবস্থাপনা চালিয়ে যাবার ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে । পরবর্তী সময়ে আমার ওই ভাইটিকে নিয়ে গিয়েছিলাম পাবনার মানসিক হাসপাতালে । যেখানে আমার ভাইটি এক বছরের বেশী সময় ধরে চিকিৎসা শেষে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে নিজেই বাসায় ফিরে আসে।
আনিসুল করীমের মৃত্যুতে আমার ভাইয়ের কথা মনে পড়ে গিয়েছিল । আমার ভাই ও বাংলাদেশ বিমানের একজন দক্ষ অফিসার ছিল । (মানসিক রোগের জন্য পূর্ববর্তী সরকারের আমলে তার চাকরিটি চলে যায় ।) সাধারণত আমরা মানসিক রোগের কথা বলতে চাই না । শারীরিক অসুখের কথা স্বীকার করি কিন্তু মাসসিক রোগের কথা বলতে আমরা লজ্জা পাই । অথচ শরীরে যেমন রোগ হতে পারে তেমনি নানা রকম পেশাগত চাপ, প্রতিযোগিতায় প্রথম হবার জন্য দিনের পর দিন ব্রেনের ওপর নেওয়া চাপ আমাদের কখনো মানসিক রোগগ্রস্ত করে তোলে আমরা টের পাই না বা স্বীকার করি না । সর্বনাশের শেষ সীমায় এসে আমরা এটার জন্য ব্যবস্থা নিতে যাই তখন এই রকম দুর্ঘটনা ঘটে যায় । শারীরিকভাবে অসুস্থ রোগীর চেয়ে একজন মানসিক রোগী আরো অসহায় এবং আরো বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকে। পুলিশ বিভাগের জন্য ভাল হাসপাতাল আছে , সেখানে মানসিক চিকিৎসার জন্য একটা বিভাগ খুলতে পারলে নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে এইসব অফিসারদের চিকিৎসা হতে পারে । আমাদের দেশে সরকারী ব্যবস্থাপনায় যে মানসিক হাসপাতালটি আছে সেটাকে আরো জনবল দিয়ে উন্নত করতে পারলে এইসব ভুঁইফোড় হাসপাতাল্গুলির অব্যবস্থাপনায় এই রকম দুর্ঘটনা হতে পারতো না ।
ড জাহিদা মেহেরুন্নেসা ঃ অধ্যাপক ও লেখক
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com