২৯শে মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ১৫ই চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:০২ পূর্বাহ্ণ, জুন ৪, ২০২০
কামরুল হাসান
বাংলাদেশের সংবাদপত্র জগতে মাহমুদ হাফিজ পরিচিত এক নাম, অথচ তার সাথে পরিচিত হওয়া দূরে থাক, আমি তার নাম কখনো শুনিনি। পরিচিত হবার পরে জানলাম তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। সরকার আমিনের কেবল সহপাঠী নন, ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মঙ্গলসন্ধ্যা কবিগ্রুপের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, অথচ কখনো দেখা হয়নি- এটা আশ্চর্য! আরো জানলাম তিনি কবিতা লেখেন। সংবাদপত্রের পাতায় আমার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হলো সাহিত্য সাময়িকীর পাতা। তিনি কবি হলেও সে পাতায় তার নাম দেখেছি বলে মনে পড়ে না, কিংবা দেখলেও মনে গেঁথে থাকেনি।
তবে ওইসব পরিচয় নয়, মাহমুদ হাফিজের সাথে আমার জানাশোনা হলো ভ্রমণের সূত্রে। তার আরেকটি পরিচয় তিনি একজন বিশ্ব ভ্রামণিক এবং ‘বাতাস বালিকা’ নামে একটি ভ্রমণগ্রন্থের লেখক। কিছু কিছু মানুষ আছেন যারা দ্রুত বন্ধু হতে পারেন, সে স্বভাবটি তার মধ্যে পুরোমাত্রায় আছে। আর বন্ধুত্বের জন্য যে রসায়ন দরকার হয়, বিদেশিরা বলে ‘ক্লিক’ করতে হয়, ঠিক সেটাই ঘটল আমাদের বেলায়। দিলখোলা ও প্রাণবান মানুষটিকে ভালো লাগে আমার। দ্রুতই আমরা ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠি।
আমাদের এই ঘনিষ্ঠতার বড়ো ফোরাম হলো ‘ব্রেকফাস্ট আড্ডা’ নামের ভ্রমণবিদ ও ভ্রমণ লেখকদের অনিয়মিত আড্ডা, যা শুরু করেছিলাম আমরা দুজন ও সৈয়দ আবু জাফর। বস্তুত সাংবাদিক ও কবি এই দুই পরিচয়ের পরেই মাহমুদ হাফিজের তৃতীয় পরিচয় -তিনি ভ্রামণিক। দুনিয়ার কিছু কম পঞ্চাশটি দেশে গেছেন, ঘুরেছেন দেড়শর বেশি নগরীতে। সাংবাদিক হিসেবেই তার পৃথিবীর পথে বেরিয়ে পড়া, পরে পৃথিবীর পাঠশালায় পড়তে গিয়ে দেখলেন (আমার) ছেলেবেলার পরেই ভ্রমণের চেয়ে আনন্দময় কিছু নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তার যে রেজাল্ট ছিল তাতে শিক্ষকতায় যোগ দিতে পারতেন, কিন্তু তাকে আকর্ষণ করল সাংবাদিকতা। মন যে কাজ ভালোবাসে,তা করতে যেমন আনন্দ, তেমনি তাতে সফলতা পাওয়া যায়। মাহমুদ হাফিজ সাংবাদিক হিসেবে অত্যন্ত সফল। জনকণ্ঠ যখন দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক, অর্থাৎ এক নম্বর, তখন সিনিয়র দশকর্তার একজন ছিলেন তিনি। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে একই সঙ্গে পত্রিকা প্রকাশের যে উদ্ভাবনী ধারণাটি -তার সাথেও ছিলেন যুক্ত। এখন যে টকশো দেখি বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে তা প্রথম তিনিই চালু করেছিলেন ‘একুশে টেলিভিশনে’। এ দাবী নিয়ে বিতর্ক হতে পারে বিধায় একথা নির্বিঘ্নে বলা যায় তিনি টকশোর একজন পাইওনিয়ার। সাংবাদিক হিসেবে তার সফলতা একটি উদাহরণেই বোঝা যাবে, তিনি নিউজ কাভারেজ করতে তিনবার জাতিসংঘের সদর দপ্তরে নিউইয়র্কে গিয়েছেন। তার ফেসবুক প্রোফাইলে দীর্ঘদিন ধরে যে ছবিটি রয়েছে তাতে দেখছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তিনি সাংবাদিকতার মেডেল গ্রহণ করছেন। তরুণকাল তাকে বলা যাবে না, তবে তরুণতর কালে পুরস্কারদাতা ও পুরস্কারগ্রহীতা দুজনেই তারুণ্যপ্রভায় দীপ্ত ছিলেন। অনুমান করি সে ছিল মাহমুদ হাফিজের উড্ডয়নকাল।
কেন জানি না, তিনি আমাকে বেশ পছন্দ করেন। তাই গতবছর তিনি যখন সপরিবারে মেঘালয় বেড়ানোর চিন্তা করলেন, তখন আমাকে যুক্ত করলেন সে চিন্তার সুতোয়। আমার তো পায়ের নিচে শর্ষেদানা, ‘ওঠ ছেড়ি, তোর বিয়া’ বললেই নেচে উঠি, আমরা গেলাম তামাবিল ছাড়িয়ে ডাউকি, অর্থাৎ মেঘের রাজ্য মেঘালয়ে। বাড়ির পাশে আরশিনগরটি কেন যে এতকাল দেখিনি – সে এক জিজ্ঞাসা, তবে Scotland of the East মেঘালয় দেখে অভিভূত আমি মাহমুদ হাফিজকে অজস্র ধন্যবাদ দিলাম। এরপরে তিনি যেখানেই যাওয়ার পরিকল্পনা করেন সেখানেই আমাকে রাখেন তালিকায়। দ্বিতীয় বিদেশ ভ্রমণে আমরা গেলাম হলদিয়া কবিতা উৎসবে। মেঘালয় ভ্রমণে তার সাথে ছিল তার ছোট ছেলে তুসু, হলদিয়া ভ্রমণে আমি সঙ্গে নিলাম আমার ছোট ছেলে প্রান্তকে। দুটি ভ্রমণেই লক্ষ্য করি তিনি একজন সংবেদনশীল, সবদিকে খেয়াল রাখা, সমব্যথী মানুষ। তার নেটওয়ার্ক সুবিস্তৃত এবং তিনি অন্যকে খুশি রাখতে আগ্রহী। মেঘালয়ে দেখেছি শিলংয়ের নর্থ ইস্টার্ন হিল ইউনিভার্সিটির সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন ড. স্ট্রিমলেট ডেকার, শিলং শহরে বাস করা বাঙালি কবি ফাল্গুনী মুখোপাধ্যায় তার পূর্বপরিচিত শুধু নয়, ঘনিষ্ঠ। সে সুবাদে আমাদের মেঘালয় ভ্রমণ হয় স্বচ্ছন্দ ও সুখময়। আমরা একদিন ঢুঁ মারতে যাই আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে, সেখানেও মাহমুদ হাফিজের নেটওয়ার্ক আমাদের নিয়ে তোলে এক কবিতাসভায় যেখানে আমরা বিশেষ অতিথির মর্যাদা পাই। বাংলাদেশী কবিদের নৈশ আপ্যায়নে হলদিয়াতেও তাকেই দেখেছি দরাজদিল হতে।
আমরা একসঙ্গে দেশের ভিতরেও ভ্রমণ করেছি। আমার বৌয়ের বান্ধবী ডালিয়া হোসেন, যিনি একটি ট্রাভেল এজেন্সি চালান, আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী থানার জালালাবাদ গ্রামে নির্মিত ইকো রিসোর্টে। চতুর্থ ব্যক্তি আর কেউ নন- সৈয়দ আবু জাফর। আমরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম যশোর গ্রামীণ সাহিত্য উৎসব ও টাঙ্গাইলের বাংলা কবিতা উৎসবে। মজার ব্যাপার হলো উৎসবের আয়োজকরাও আমাদের একসঙ্গে রাখেন। পরিকল্পনা ছিল আমরা যাবো পশ্চিমবঙ্গের ‘বকখালি কবিতা উৎসবে’। কিন্তু এক ঘূর্ণিঝড় এসে বকখালি ও কবিতা উৎসবের পরিকল্পনা- দুটোকেই লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গিয়েছিল। আর এখন তো করোনাকাল।
মাহমুদ হাফিজ কাজ ছাড়া থাকতে পারেন না। নিরন্তর সৃজনশীল ও কর্মতৎপর মানুষটির ভ্রমণকে ঘিরে সাম্প্রতিক ভাবনা সৃষ্টি করেছে ভ্রমণবিষয়ক পত্রিকা ‘ভ্রমণগদ্য’। বাংলাদেশে ভ্রমণবিষয়ক সাহিত্য পত্রিকা এই প্রথম। ইতিমধ্যে তিনি চারটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ সংখ্যা প্রকাশ করেছেন। এ পত্রিকাকে ঘিরে জড়ো হচ্ছে দুই বাংলার প্রখ্যাত ভ্রমণলেখকগণ। এবছর একুশে বইমেলায় তিনি ভ্রমণগদ্যের স্টল নিয়েছিলেন যেখানে প্রতিদিন আড্ডা বসাতেন লেখক কবি ভ্রামণিকদের। করোনাকালেও তিনি বসে থাকার মানুষ নন। ঘরে থেকেই অনলাইন পত্রিকা বার্তা ডট কম-এর সাথে যুক্ত হয়ে উপস্থাপন করছেন ‘মুগ্ধতার মহাসঙ্গ’ নামের এক প্রাণবন্ত অনুষ্ঠান- যার কেন্দ্রে রয়েছে ভ্রমণলেখক, ভ্রমণবিদ ও ভ্রমণ। সঞ্চালক হিসেবে তিনি হয়তো নিঁখুত নন, কিন্তু আন্তরিক এবং সাংবাদিকের স্বভাবজাত শক্তিতেই স্বচ্ছন্দ ও প্রত্যুৎপন্নমতিসম্পন্ন; উপরন্তু বাংলার ছাত্র ও কবি হওয়ার সুবাদে তার ভাষা সুললিত, যেমন তিনি বলেন, ‘করোনাকরুণ দিনে নিদারুণ এই ঘরে বসে থাকা।’
তার প্রিয় আড্ডার জায়গা, অনুমান করা কঠিন নয়, জাতীয় প্রেসক্লাব। পরিচয় হবার পরে তার সাথে যতবার প্রেসক্লাবে গিয়েছি, আগে সবমিলিয়ে ততবার সেখানে যাইনি। নিজ গ্রামে ফিরে গেলে যেমনটা হয়, সকলেই চেনা, সকলেই কুশল জিজ্ঞেস করেন। সেখানে গিয়ে আবিষ্কার করি তিন হাফিজ, তিনজনেই কবি, হেলাল হাফিজ, হাসান হাফিজ ও মাহমুদ হাফিজ কাব্যবৈরী নন, কাব্যবন্ধু। বন্ধুত্বের চেয়েও গভীর তাদের পারষ্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার বন্ধন। অগ্রজ কবি হেলাল হাফিজ বাকি দুই হাফিজকে বলেন, ‘মায়ের পেটের ভাই’।
আরেকটি জিনিষ না বললেই নয়, মাহমুদ হাফিজ অত্যন্ত দায়িত্বশীল ও স্নেহশীল পরিবারকর্তা। তিনি স্ত্রী ও সন্তানদের নিয়ে বিদেশে একাধিক ভ্রমণ করেছেন। তার ঝুলিতে অনেক কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনী আছে, যার কয়েকটি হলো সদ্য স্বাধীন পূর্ব তিমুরে গিয়ে ভিসার কারণে আঁটকে থাকা, এপার্টমেন্টে পাসপোর্ট রেখে আসার কারণে নিউইয়র্ক থেকে লন্ডনগামী বিমানকে এক ঘণ্টা লেট করিয়ে দেওয়া ইত্যাদি।
করোনাকাল অতিক্রান্ত হলে আর বেঁচে থাকলে, ধারণা করি, আমাদের অনেক ভ্রমণ একসঙ্গে হবে। তিনি বলেন, আমরা কোথাও একসঙ্গে বেড়ানো হলে যে লাভটি হবে তা হলো বাংলা ভাষার পাঠকগণ দুটি নতুন ভ্রমণকাহিনী পাবেন। আমার লেখার নিরন্তর উৎসাহদাতাদের তিনি একজন। ফেসবুকে তিনি নিয়মিতভাবে আমার লেখা পড়েন, দীর্ঘ প্রতিক্রিয়া জানান আর অন্যদের অনুপ্রাণিত করেন পড়তে। আমি নিজেই যথেষ্ট অনুপ্রাণিত হই লিখতে। এই প্রশংসাখরা, উৎসাহমহার্ঘ, ভালোবাসারিক্ত দিনে এ বড়ো বেশি পাওয়া, অনুরাগের ফুল ও চন্দন। তাকে অফুরন্ত শুভেচ্ছা।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com