মেলার পরিবেশ ছিল ঠিক যেমনটা আমি চাই

প্রকাশিত: ৯:২৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯

মেলার পরিবেশ ছিল ঠিক যেমনটা আমি চাই

জেসমিন চৌধুরী

গতকালকের মেলার পরিবেশ ছিল ঠিক যেমনটা আমি চাই। বাতাসে ধূলার মেঘ নেই। মাথার উপরে আকাশটা স্বচ্ছ নীল। হালকা পাতলা ভীড়। বিকালের ঝকঝকে রোদে হেঁটে যেতে যেতে পরিচিত কোনো মুখের দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার উপায়টুকু নেই।

পিচ্চি বন্ধু মম আগে থেকেই এসে বসে ছিল। যাদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলে মনে শান্তি পাওয়া যায়, আর ছাড়তে মন চায় না, মম তাদের একজন। অসাধারণ ছবি তোলে মেয়েটা, শর্ট ফিল্ম বানায়, দেশ-বিদেশে একা ঘুরে বেড়ায়। আবার বলে আমি নাকি ওর উড়ে বেড়ানোর ডানার নিচের হাওয়া যুগাই। অথচ আজ পর্যন্ত জড়িয়ে ধরা ছাড়া ওর জন্য আর কিছুই করতে পারিনি বা করিনি। আমার অসাধারণ কিছু ছবি তুলে দিলো সে।

আমাদের ফটো সেশনের মধ্যেই দুই বন্ধুকে নিয়ে হাজির হলেন ফেসবুকে পরিচিত বিলেত প্রবাসী শাহজাহান ভাই। এই প্রথম চাক্ষুষ দেখা, বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি ভাবলাম, যেসব পুরুষ নারীকে লুকিয়ে নির্যাতন করে তারা এভাবে প্রকাশ্যে একজন নারীকে জড়িয়ে ধরতে পারে না। আমার দুটো বই তিন কপি করে নিয়ে গেলেন। বলে গেলেন তার নিজের কপি ইউকে গিয়ে আন্তর্জাতিক মূল্য দিয়ে নেবেন।

ফেসবুকে আমার প্রিয় শত্রু মাহবুবুল আলম শামীমকে দেখে স্টল থেকে বেরিয়ে এলাম। যাদের সাথে প্রায়ই দ্বিমত ঘটে কিন্তু আনফ্রেন্ড বা ব্লক ঘটে না তাদের মধ্যে একজন শামীম আমার খুব প্রিয় মানুষ। বেশিরভাগ সময় সঠিক কথাটা বলতে পারে ছেলেটা। নীরবতা আমার নতুন লজ্জা বইটির সর্বশেষ আর্টিকেল ‘একজন অভিমানবিদ্ধ পুরুষের জন্য’ শামীমের অনুরোধে লেখা।

নালন্দার স্টলে বসে ফেসবুকে গুতাগুতি করছিলাম। হঠাৎ মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি দাঁড়িয়ে আছে মুক্তা। গতবছর একবার একনজর দেখা হয়েছিল। সত্যিকারের দেখা এই প্রথম। হাতের ব্যাগ থেকে একের পর এক বের করতে লাগল- ফুলের রিং, পুলি পিঠা, মুগ পাক্কন পিঠা। এতোকিছু উজাড় করে দেয়ার সময় তার মুখে কিন্তু এতোটুকু হাসি নেই। বুঝলাম নার্ভাস বোধ করছে। আমার সাথে এরকম বোধ করার প্রয়োজন নেই বুঝতে হয়ত ওর আরো সময় লাগবে, তবু বলল- আজ আমি কোথাও যাব না, সারাটা সময় তোমার সাথে থাকব’। বইমেলায় সারাটা সময় আমার সাথে থাকা খুব বিরক্তিকর হতে পারে। কেউ না কেউ জুটে যায়, আমি গল্পে মেতে যাই, পাশের সবচেয়ে আপন মানুষটার কথা কিছুক্ষণের জন্য মনে থাকে না। এইটুকু যে মেনে নিতে পারে সে আমার আরো কাছের হয়ে যায়।

আবার দেখা হয়ে গেল রেজা ঘটক ভাইয়ের সাথে। আজ তিনি গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে মেলায় ঘুরছেন। আমারও কয়েকটা ছবি তুলে দিলেন। অনেকদিন ধরে যার শুধুই নাম শুনে এসেছি সেই রত্নগর্ভা লেখক জুলফিয়া ইসলামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন ওসমান গনি ভাই। একজন মানুষ এতো উচ্চমানের লেখা এতো বেশি পরিমাণে কীভাবে লিখে যেতে পারে তা একটা বিস্ময়।

আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত তরুণ চলচ্চিত্র নির্মাতা শাহাদাত রাসেলকে চিনতে একটু সময় লাগল। বাস্তবে সে ছবির চেয়ে অনেক বেশি হ্যান্ডসাম। ‘হিমুরা কি আজকাল সবুজ পাঞ্জাবী পরছে?’ সে দৃঢ়তার সাথে বলল, ‘হিমু ছিলাম না কখনো’। খুব ভালো লাগলো শুনে। হিমুদের যুগ গেছে। ভাবনার সাথে সাথে কর্মে পটু একটা প্রজন্ম চাই এখন। শরীরটা ততক্ষণে হাল ছেড়ে দেবার তালে আছে, তবু উঠে গিয়ে তার সইসহ বর্ণে বর্ণে বাঙ্গালি বইটির দুটো কপি কিনে আনলাম। এই বইটির বহুল প্রচার এবং প্রসার ঘটানো প্রয়োজন। আপনারা যারা এই লেখাটা পড়ছেন তাদের সবাইকে অনুরোধ করব বইটির একটি কপি সংগ্রহ করুন, শিশুদেরকে পড়ান, নিজের ইতিহাস জানতে আগ্রহী করে তুলুন। এই বই সম্পর্কে পরে আলাদাভাবে আরো বিস্তারিত লিখব।

তৃষ্ণাকে দেখে হাল ছেড়ে দেয়া শরীর যেন আরো হাল ছেড়ে দিল। খুব আপন লোকদের দেখলে আজকাল আমার এমনটা হয়। একদম নেতিয়ে গিয়ে তাদের বুকের ভেতর ঢুকে বসে আদর খেতে ইচ্ছে হয়। খুব আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ি। অনেকটা সময় জড়িয়ে ধরে থাকল তৃষ্ণা। মেলা বেশ নীরব হয়ে এসেছে, বাসায় যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। মুক্তা নামের লক্ষ্মী মেয়েটা পরম ধৈর্য্যের সাথে তখনো দাঁড়িয়ে আছে। আমার এযাবৎ প্রকাশিত চারটি বইয়ের একটি করে কপি কিনেছে সে, অনেকদিন ধরে টাকা জমিয়েছে বইগুলো কেনার জন্য। অনেকে শুনলে বলবেন, ‘তাকে বই উপহার দেয়া উচিৎ ছিল আপনার’। আমি নিজে এধরণের পেট্রোনাইজিং এ বিশ্বাসী নই। কষ্ট করে টাকা জমিয়ে কেনা বই পড়ার এক অন্যরকম সুখ, তা থেকে মুক্তাকে বা যে কাউকে বঞ্চিত করব কেন? ওকে বললাম একদিন বাসায় আসতে, একসাথে বসে ডাল দিয়ে ভাত খাব।

মেলা থেকে বেরিয়ে দোয়েল চত্বরের কাছাকাছি চলে গেছি প্রায়, এমন সময় কল এলো স্টল থেকে। ফেসবুক বন্ধু বেবী এসেছেন। এই প্রথম শরীরের কথা অগ্রাহ্য করে মেলায় ফিরে গেলাম কারণ আমি জানতাম কতটা মমতা নিয়ে এসেছে এই মানুষটা। মেলায় ঢোকার সময় গেটে দেখা হয়ে গেল মার্জিয়া নাঈমের সাথে, ফেসবুকের আরো একটা প্রিয় নাম। এই প্রথম দেখা, উজ্জ্বল দৃষ্টির মেয়েটার মুখের দিকে তাকালেই মনে হয় এই মেয়ে অনেক কিছু করতেই এই পৃথিবীতে এসেছে, না করে ফিরে যাবে না।

সবাই মিলে গেলাম শব্দশৈলীর স্টলে। বই কেনা, সই করা, জড়িয়ে ধরা, ছবি তোলা সব হলো। ভালোবাসার চেতনায় শরীর আবার খানিকটা চাঙা হয়ে উঠল। এইভাবে বুকে জড়িয়ে ধরে কখনো কাউকে চাংগা করে দিই, কখনো বা নিজে হই। আমি একজন বিশিষ্ট মুন্নাভাই এমবিবিএস এ পরিণত হয়েছি যার কাছে ‘যাদু কা ঝাপ্পি’ ছাড়া আর কিছু নেই।

এরপর তৃষ্ণা বাড়ি পৌঁছে দিল, প্রতিদিনই কেউ না কেউ দেয়। রিক্সায় যেতে যেতে আমার নতুন লব্ধ সবটুকু আবেগিক এবং মানসিক দুর্বলতা ধরা পড়ে গেল তৃষ্ণার কাছে। এর সবটুকু এখানে বলব না। তবে একটা কথা না বললেই নয়। এই অসুস্থতার পর মায়ের মমতা নিয়ে আমার সেবা শুশ্রূষা করেছিল আমার ছেলে, পেটের ছেলে করতেই পারে। সিলেটে বড়বোন আর ছোটভাবীর কাছে একই রকমের মমতা পেয়েছি, তারাও করতেই পারেন। কিন্তু ঢাকায় আসার পর শুধুমাত্র ফেসবুকের সূত্রে পরিচিত যেসব লোকজন পরম মমতায় আমার মাথায় হাত রেখেছে, তারাই আমার পরমাত্মীয়। বিভিন্ন লেখায় তাদের নাম এসেছে, ভবিষ্যতেও আসতেই থাকবে। তৃষ্ণার নাম আজ এই তালিকায় তোলা হলো।

আরো একটা সোনার ফ্রেমের দিন কাটল বইমেলায়।

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31