শিশু

প্রকাশিত: ১১:৪০ অপরাহ্ণ, জুলাই ১৭, ২০২০

শিশু

সালেহা চৌধুরী

এয়ারহোস্টেস আয়শা দম্পতির দিকে চাইলেন। বুঝতে পারলেন দুজনেরই বয়স হয়েছে। সাদা সিল্কের বাঙ্কেটে মোড়ানো শিশুটিকে যে ভাবে বুকের সঙ্গে লাগিয়ে রেখেছেন তাতে মনে হয় দীর্ঘদিনের প্রার্থনার ধন এই শিশু। হ্রদয়ের সঙ্গে লাগিয়ে মা শান্তিতে ও বাবা স্বস্তিতে আছেন। বাবাটিও সিট খোঁজার ফাঁকে যে ভাবে দিকে বার বার দেখছেন তাতে মনে হয় কত শত বছরের প্রার্থনার ধন এই সোনা মানিক। হোস্টেস আয়শাও তার মা বাবার প্রার্থনার ধন। ওর বাবা মা এ হেন দরগা বা মাজার নেই যেখানে একটি সšতানের জন্য কাঁদা কাটি করেন নি। মানত করেছেন, মোমবাতি দিয়েছেন, কোরবানি দিয়েছেন আজকের আকাশের পাখি আয়শার জন্য। এসব গল্প ও অনেকবার শুনেছে। কিন্তু আয়েশার জেদের কাছে হার মেনে তাকে এয়ারহোস্টেস হতে অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা। আয়শার এই আকাশের বলাকা জীবন ওদের পছন্দ নয়। ওরা যখন সিট খুঁজছে আয়শা এগিয়ে যান বলেন Ñ আমি বেবিকে ধরছি। আপনারা সিটে ভাল হয়ে বসুন। প্রায় চিৎকার করে ওঠে দুজনে Ñ না না। ধরতে হবে না। আয়শা শেষপর্যšত ওদের সিটটা দেখিয়ে বলেন Ñ একেবারে সামনের সিট আপনাদের। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে একটু হাসেন। বলেন Ñ ঠিক হয়ে বসুন। কিছু লাগলে বলবেন। বাচ্চা সম¯ত শরীর ঢাকা বলে কেবল তার কুচকুচে চুলের মাথাটি কেবল দেখা যায়। মুখটি ঢেকে রাখা। ভদ্রমহিলা বলেন Ñ ওর চোখে আলো পড়লে ঠিকমত ঘুমাতে পারে না। জন্মের পর থেকেই এমন। আয়েশা এয়ারহোস্টেসের স্বাভাবসুলভ হাসিতে বলেন Ñ অনেক বাচ্চাই এমন।
ভদ্রলোক কোট খুলে রাখেন। তারপর শিশুটিকে কোলে নেন। তারপর স্ত্রী কোট খোলে। কোট খুলে রেখে মুখটা একটু মোছে। আয়না বের করে চুলটা একটু গুছিয়ে নেয়। বাচ্চা সামলাতে সামলাতে একটু এলোমেলো চেহারা তার। হয়তো হাতও ধরে গেছে। ঠোঁটে একটু লিপস্টিক মেখে সিটে বসেন গুছিয়ে। মহিলা বসবার পর তার স্বামী শিশুটিকে কোলে তুলে দেন। এয়ারহোস্টেস আয়েশা একটি সুন্দর ক্যারিকট সামনে এনে বলেন Ñ এখানে বাচ্চাকে শুইয়ে দেন। ওরা অসংখ্যবার ধন্যবাদ জানায়। আয়েশা চলে যায়। আয়েশা চলে গেলে বাচ্চাটিকে ধীরে ধীরে ক্যারিকটে শুইয়ে দেন সেই মহিলা। ভালমত শরীর ঢেকে দেন। চুলে হাত বুলিয়ে দেন। মাথা মুখ ঢাকা। মুখে আলো পড়লে ঘুমাতে পারে না তাই এমন সাবধানতা।

রাতের খাবারের মেনু দেখে একইমত খাবার অর্ডার করেন দুজনে। দুজনেই কথা বলে আরবিতে। ওরা উঠেছে আর্মসটারডাম থেকে। প্লে¬ন চলেছে আটলান্টিক পাড়ি দিয়ে নিউইয়র্কের দিকে। সারারাত জার্নি। খাবারের পর আলো কমিয়ে সবাই ঘুমাতে চেষ্টা করে। কেউ কেউ সিটের উপর বাতি জ্বালিয়ে বই পড়ে। মহিলা একবার প্লে¬নের কিচেন থেকে ফ্লাস্ক ভরে পানি নিয়ে আসেন শিশুটির দুধ বানানোর জন্য। বলে সে Ñ আর একবার খাইয়ে দিলে সারারাত বিরক্ত করবে না। আয়েশা জানায় Ñ খুব শাšত আপনার বাচ্চাটি। Ñ আল্লাহ মেহেরবান বলেন সেই মহিলা। তারপর আপনমনে বোতল ভরে দুধ বানিয়ে শিশুর মুখে ধরেন। আয়শার মনে হয় মধ্যপ্রচ্যের কোন এক জায়গা থেকে এসেছে ওরা। একসময় মহিলা বাচ্চাটিকে কোলে করে থাবড়ে থাবড়ে ঘুম পাড়িয়ে ক্যারিকটে শুইয়ে দিয়ে নিজের সিটে বসেন। গরম পানিতে ফর্মুলা মিশিয়ে দুধ বানিয়েছেন তিনি। তারপর নিজের পায়ের উপর কম্বল চাপা দিয়ে সিটে মাথা রাখেন। স্বামীটিও তাই করেছেন অনেকক্ষণ আগে। ওদের পাশে যারা বসেছে তাদের একজন বই পড়ছে। অন্যজন চোখ বন্ধ করে আছে। ঘুমিয়ে পড়বে এখনই। স্বামীটি চোখ খুলে তাকায়। তারপর কি সব গল্প করে। পাশের জন আরবি জানে না। জানলেও ওদের কথা শুনবার চাইতে বই পড়তে তার আনন্দ বেশি। কি এক সায়েন্স ফিকশনে চোখ তার। তবু মনে হয় পাশের এই দম্পতির ভাব ম্যালা। যে ভাবে স্ত্রীর মাথা নিজের কাঁধে টেনে নেয় তাতে সায়েন্স ফিকশনের পাঠকের এমন মনে হয়। তারপর মনে হয় স্ত্রী একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছে। বাচ্চা ঘুমানোর ফাঁকে। স্বামীটি চোখ খুলে একটা ম্যাগাজিন বের করেছেন ব্যাগ থেকে। তার মেহেদি রঞ্জিত দাঁড়িতে আলো পড়েছে। কেমন এক নুরানী চেহারা তার। বেশ এক সম্ভ্রান্ত চেহারায় গম্ভির মনোযোগিতায় পড়ছেন তিনি। হয়তে মধ্যপ্রাচ্যের কোন রাজপরিবারের একজন। ভদ্রমহিলা তার মাথার রুমাল একবার চুল আঁচড়ানোর সময় খুলেছিলেন তারপর আর খোলেননি। মনে হয় ভদ্রলোক হয়তো সিটে বসে এশা সেরে নেন ইশারায়। দুজন পুণ্যবান মানুষ খোদাতালার এই দানকে কি করে শোকরাণা জানাবেন ভেবে পান না। পাশ দিয়ে যেতে যেতে আয়শার তা মনে হয়। নুরানী চেহারার রাজপরিবারের লতাপাতায় জড়ানো যুবরাজ তাকে পানি দিতে বলেন। আয়েশা ভাবে এদের প্রথম শ্রেণীতে মানাতো ঠিক।
এক এক করে সব আলো কমে যায়। প্রায় সকলেই ঘুমিয়ে। কেবল দুএকজন এখানে সেখানে বই পড়ছে, ল্যাপটপে কি করছে। একজন দুজন সিনেমা দেখছে। ভদ্রলোক একবার উঠে দুহাত উপরে তুলে ক্লাšিত দূর করতে চেষ্টা করেন। মনে হয় কোন কারণে তিনি ঘুমাতে চান না। এমনই হয় যখন বেশি বয়সে সšতানের বাবা হয় কেউ। প্রাণাধিক শিশুকে রেখে ঘুমাতেও আপত্তি তার। আয়শা দু একবার যেতে যেতে লক্ষ্য করে। তিনি গিয়ে কিছুক্ষণ ক্যারিকটের পাশে দাঁড়ান। ব্ল¬াঙ্কেট ঠিকঠাক করেন। শিশুটি আরামে ঘুমিয়ে আছে। তিনি সেই শিশুর মুখ পানে চেয়ে দেখছেন। আলোআঁধারীতে শিশুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা বোধহয় তার অভ্যাস আছে। তারপর সিটে ফিরে আবার ম্যাগাজিনে চোখ রাখেন। ঠিক ভোর ছটায় প্লে¬ন ল্যান্ড করবে। তিনি হয়তো সারারাতই ঘুমাবেন না। তার মাথার উপরের ছোট আলোটা জ্বলছে। ঘড়িতে রাত এগারোটা। আরো সাত ঘন্টা তিনি কি জেগে থাকবেন? না কি দুজনে পালা করে ঘুমাবেন কে জানে। এবার স্ত্রীর গায়ের কম্বলটা ঠিক করেন। আরবিতে ঘুম চোখে প্রশ্ন করেন স্ত্রী Ñ রাত কত?
এগারোটা দশ।
স্ত্রী আর কিছু না বলে স্বামীর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েন। একটু একটু নাকও ডাকে তার। ভদ্রলোক একটা বই বের করেন।

পাশের যাত্রিটি ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠে বাথরুমে যাবে বলে ঠিক করে। বাথরুম থেকে ফিরে এসে দেখে নুরানী চেহারির সম্ভ্রাšত মানুষটিও ঘুমে অচেতন। ঘুমের কাছে হার মেনেছেন। ভদ্রলোক একবার সেই শিশুর দিকে তাকায়। ভাবে এমন করে মুখ ঢাকা বাচ্চাটির তো নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে। তিনি কম্বলটা সরাতেই ফুটফুটে ডল পুতুলের মত এক মাথা কালো চুলের একটি শিশুটিকে দেখেন। তারপর মুখটাকে অনাবৃত রেখে নিজের সিটে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। যদিও তার প্লে¬নে ভাল ঘুম হয় না তবু একসময় ঘুম অধিকার করে। তিনি বেঁচে যান।
এয়ারহোস্টেস আয়শা পেছনের এক বৃদ্ধার বেলের আওয়াজে সেখানে দ্রুত হেঁটে যান। দেখতে অনেকটা তার মায়ের মত, বুক ব্যথায় একটু কষ্ট পাচ্ছেন। সঙ্গের ওষুধ আর পানি পান করিয়ে বেশ একটু সঙ্গ দান করেন সেই বৃদ্ধার। তিনি বলেন Ñ তার বোধহয় জ্বর আসছে।
আসলেও চলে যাবে। দুটো প্যারাসিটামল খেয়েছেন। ঠিক হয়ে যাবে। বৃদ্ধা আয়শার হাত ধরে বলেন Ñ তুমি আমাকে ফেলে যেয়ো না। আয়শা খানিকটা সময় বৃদ্ধার হাত ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। বলে ও Ñ নিউইয়র্কে আপনাকে রিসিভ করতে কে আসছে?
আমার ছেলে। আয়শা ঘড়ি দেখে। মাত্র আর চার ঘন্টা। Ñ এরপর ছেলেকে দেখলে জ্বর, ব্যথা সব চলে যাবে। তিনি বলেন Ñ এবার মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলের বাড়ি চলেছি। আয়শা বলে Ñ লাকি মা আপনি। ভদ্রমহিলা খুশী হন। আয়শা বুঝতে পারে তিনি এখন খানিকটা ভালবোধ করছেন। আয়শা আর একটা কম্বল চাপিয়ে দেয় তার গায়ে। বলেন Ñ এবার চোখ বন্ধ করে ঘুমাতে চেষ্টা করেন। তিনি আয়শার হাত ছেড়ে দেন। ছেলেমানুষীতে একটু লজ্জিত। আয়শা বলে Ñ আমার মাও আপনার মত।
তিনি হাসেন। আয়শা এবার ফিরে আসতে চায়। আসতে আসতে চোখে পড়ে খোলামুখের পুতুলের মত কাল চুলের মেয়েটিকে। একটু দাঁড়িয়ে ভালমত মেয়েটিকে দেখতে দেখতে তার মনে হয় Ñ বাচ্চাটির বোধহয় নিঃশ্বাস পড়ছে না। সে ভাল করে দেখে। তারপর সেই দম্পতিকে না জাগিয়ে বাচ্চাটিকে কোলে করে নিজের জায়গায় ফিরে আসে। ওদের একজন ভাল ফার্স্টএইড জানে। তার সঙ্গী সেই হোস্ট তখন কেবল দুপা চেয়ারে তুলে এক কাপ চা পান করবে বলে ঠিক করেছে। আয়শা বলে Ñ ভাল করে দেখতো। বাবা মা ঘুমে অচেতন। আমার মনে হচ্ছে কোন কারণে বাচ্চাটির নিঃশ্বাস প্রশ্বাস ঠিকমত চলছে না।
চায়ের কাপ রেখে সেই ডাক্তারি জানা হোস্ট ওঠে। বলে Ñ কোন কারণে জ্ঞান হারিয়েছে হয়তো। মা বাবা কোথায়?
ঘুমাচ্ছে। বেশ টায়ার্ড দুজনে। তাই ডাকিনি।
দুজনে কাপড় চোপড় খুলে খুব ভালমত বাচ্চাটিকে পরীক্ষা করতে গিয়ে চমকায়। মনে হয় আজ্ঞান নয় শিশুটি মারা গেছে। আর্তনাদ করে ওঠে দুজনে। আর একজন এসে দাঁড়ায় সেখানে। ওরা তিনজন তিনজনার মুখের দিকে তাকায়। তারপর যা বুঝতে পারে সে এই Ñ বুঝতে পারে এই শিশুর পেট ভর্তি আর কিছু নয় কেবল হেরোইন। কয়েক লাখ ডলারের হিরোইনের কারণে শিশুর পেটের নাড়িভুড়ি বের করে সেখানে হিরোইন ঢোকানো হয়েছে।
স্মাগলার দুজন ঘুমিয়ে। ঘুমাবো না এমন সংকল্প রাখতে পারে নি। মুখে আলো। এখনো মনে হয় রাজপরিবারের যুবরাজ এবং রাণী। না হলে বিশেষ কোন অভিজাত ও সম্ভ্রাšত ঘরের দম্পতি।

কবে কখন শিশুটির প্রাণ ছিল সে কথা জানা যাবে পরে। মিলিয়ন ডলারের হিরোইনের কাছে একটি শিশুর প্রাণ এমন কি!

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31