স্মৃতিতে আমার বাবা সৈয়দ মহসীন আলী

প্রকাশিত: ৩:৪৬ পূর্বাহ্ণ, নভেম্বর ১২, ২০১৭

স্মৃতিতে আমার বাবা সৈয়দ মহসীন আলী

 

সৈয়দা সানজিদা শারমিন

সৈয়দ মহসীন আলী। একটি নাম। একটি ইতিহাস। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৭১ সালে ২৩ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের ভরসাস্থল ছিলেন তিনি। প্রতিটি বক্তৃতায় মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করতেন এবং দেশাত্মবোধক গান গেয়ে নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতেন।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ ও অনন্য ভূমিকা রাখায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে ‘স্বাধীনতা পদক’ ২০১৭ মরণোত্তর প্রদান করেন। ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রাপ্তি কিন্তু এক বিরল সম্মানের বিষয়। খুব কম আর ভাগ্যবান মানুষই এ পদক পান। মৃত্যুর মাত্র এক বছরের মধ্যে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান পেয়ে অনন্য উচ্চতায় চলে গেলেন তিনি।

যেদিন আম্মা প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে আব্বার পদক নেন, সেদিন সারাদিন চোখে ঝরেছিল আনন্দঅশ্রু। শুধু মনে হয়েছিল- ইশ! পদকটা যদি তিনি নিজ হাতে গ্রহণ করতে পারতেন।

আসলে এখন কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। এত বিশাল মনের মানুষ। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন। আমার এখন আফসোস হয়, কেন যে আব্বার সাথে আরও বেশী সময় কাটাতে পারলামনা। আব্বাকে নিয়ে আমরা খুব কম সময় নিজেদের মতো সময় কাটাতে পেরেছি। উনি তো সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে ব্যস্ত থাকতেন। একসাথে চা খাওয়া বা দুপুর রাতের খাবার খাওয়ার কথা তো চিন্তাই করা যেত না। পিতার সাথে সন্তানদের যে সম্পর্ক সেটা পাইনি।

এখন মনকে এই বলে বুঝ দেই যে, মহসীন আলী তো মানুষের জন্য জন্মেছিলেন। আমরা না হয় বঞ্চিতই হলাম। মানবসেবা আর সমাজসেবার কারণেইতো ২০১৪ সালে তিনি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হয়েছিলেন। নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে রাজনীতি করে গিয়েছেন। দামী গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন নি। আজকালতো মানুষ রাজনীতি করে কোটি কোটি টাকা কামাচ্ছে। মহসীন আলী এই ক্ষেত্রে বিরল নজির সৃষ্টি করে গেলেন। নিজের সরকারি বাসভবনেও গরীব মানুষদের থাকার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলেন।

বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সৈয়দ মহসীন আলী অনেক ক্ষেত্রেই যোগ্যতার অসাধারণ স্বাক্ষর রেখে গেছেন। রান্না করতে পারতেন। প্রায়ই নিজের হাতে ‘নেহারী’ রান্না করতেন। ভোজনরসিক ছিলেন। কারও রান্না ভালো লাগলে কাছে ডেকে প্রশংসা করতেন। নিজে বাজার করতে ভালবাসতেন। সবজি থেকে গৃহস্থালী দ্রব্যাদি, সবই কিনতেন নিজে। একজন সৌখিন মানুষ ছিলেন আমার বাবা। আতর সংগ্রহ করতেন এবং যারা আতর চিনতেন তাদেরকে আতর লাগিয়ে দিতেন। শিল্প-সাহিত্যের প্রতি প্রচ- ঝোঁক ছিল। গভীর রাতে বই পড়তেন। বিশেষ করে কবিতার বই। মন খারাপ হলে গুনগুন করে গান গাইতেন। মৌলভীবাজারবাসীর গর্ব মহসীন আলী মন্ত্রী হওয়ার পর সারাদেশ চিনেছিল। আব্বা জনপ্রিয় সাংবাদিক মুন্নী সাহার সাথে ‘Newsic’ নামে একটি সুন্দর অনুষ্ঠান করেছিলেন। আমি সেই অনুষ্ঠানের সিডি আনতে মুন্নী সাহার কাছে গিয়েছিলাম। তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন “ইশ! কেন যে মহসীন ভাইকে আরো পাইনি। তাকে মানুষের সামনে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারতাম।”

আব্বার সাথের একজন মুক্তিযোদ্ধা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আমাকে বলেছিলেন “তুমি একজন গর্বিত পিতার সন্তান।” আব্বা তাকে বলেছিলেন, “আমি জানি, আমি আমার পরিবারকে বঞ্চিত করছি। মানুষকে সাহায্য করতে পারলে যে আমার মন খুশিতে ভরে উঠে।” মুক্তিযোদ্ধা ভাতা আব্বা যা পেতেন তার বেশিরভাগই খরচ করতেন মানুষের জন্য।

একজন সৈয়দ মহসীন আলী হয়ে উঠতে ৫০ বছরের সাধনা করতে হয়েছে। কখনও অন্যায়ের সাথে আপস করেননি। আজ তিনি এমন এক উচ্চতায় পৌঁছেছেন যা রীতিমতো বিস্ময়কর। সততার অনন্য উদাহরণ তিনি। আমি একজন গর্বিত পিতার গর্বিত সন্তান।

 

সৈয়দা সানজিদা শারমিন : নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ অনলাইন মিডিয়া এসোসিয়েশন

 

এ সংক্রান্ত আরও সংবাদ

লাইভ রেডিও

Calendar

March 2024
S M T W T F S
 12
3456789
10111213141516
17181920212223
24252627282930
31