১৮ই এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | ৫ই বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৪৩ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২০
সুমন সুপান্থ
উনিশশো পঁচানব্বুই ছিয়ানব্বুই। স্বপন নাথের সরকারী ডেরা জনমিলন কেন্দ্র লাগোয়া। তখন এই ভবন এমন ঝকঝকে নয়। পড়োপড়ো। আহমেদ মিনহাজ ওরফে পারভেজ ব্যাংকে চাকুরী নিয়ে মৌলভীবাজার এলো । পারভেজ মৌন আর ঋদ্ধ এক যুবক। ব্যাপক তার পড়াশোনা। কত শত দরজা সে খুলে দিতে থাকে একেক বিকেলে! কতো অচেনা নাম! মার্কেস, রুলফো হয়ে রুশদীর স্যাটানিক ভার্সেসের উত্তাপ। নাইপলের উইট, আর কুণ্ডেরার হিউমারের সন্ধান মিলতে থাকলো আমাদের যৌথ পদযাত্রায়। গীর্জাপাড়া মোড় থেকে ডিসির বাংলোর সামনে। পথে পথে শীতের রোদ আর তার বালিহারি ভাব! হাওয়া দেয়। মৃদুমন্দ। আমরা গায়ে মেখে স্বপন দা`র কাছে আড্ডা দিতে যাই। সেসব আমাদের উসকায়। পারভেজকে। আমাকে । পারভেজ পড়ুয়া। পারভেজ মৃদুভাষী। পারভেজের পোষাকি নাম আহমদ মিনহাজ। উল্টো রথের মানুষ। পরে বের হওয়া তার উপন্যাসের নামও এটিই। হাঁটতে হাঁটতেই কবিতা গল্প, গদ্য, আড্ডা, আলোচনা। অমিয়ভূষণ থেকে অসীম রায়। হাসান থেকে ইলিয়াস। ফেরলিঙঘেটি, অ্যাশবেরি, তরুণতম বদরে মুনীর থেকে রণজিৎ দাস। উপলব্ধি বনাম অনুভূতি। ইন্ট্রোস্পেকশান ও ইন্সপেকশান। গোটা বাংলা সাহিত্যের জগত যেন কথার তোড়েই এই কুপোকাত হলো বলে!
তারও আগে টিটোর দা`র বইয়ের দোকান। ‘উৎসর্গ’। নদীর পাড়ে। পোস্টফিসের সামনের বিল্ডিং। যাই। আড্ডা দিই। সারা দেশ থেকে আসা লিটলম্যাগ হাতড়াই। নতুন লেখা পড়ি। বিস্মিত হই। আন্দোলিত। ভেতর ভেতর। টিটো দা মানে কবি সৌমিত্র দেব; তাঁর সঙ্গে অনেকেরই দারুণ যোগাযোগ তখন। বগুড়ার। চট্টগ্রামের। ঢাকার তো বটেই। সেইসব দিন, মোবাইল ফোন তো দুর অস্ত, টিএন্ডটির ফোনই দুর্লভ। সব যোগাযোগ চিঠি লিখে লিখে। ডাকে। ডাকেই আসে সব লিটলম্যাগাজিনগুলো। আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করি, ছোটকাগজ পড়তে হবে। দৈনিকের সাময়িকী পড়ে নিজেকে তৈরি করা যাবে না। পয়সা জমিয়ে ছোট কাগজ কিনি। যা আসে। যা পাই। দ্রষ্টব্য।লিরিক। চালচিত্র। জীবনানন্দ। আরো কতো, এখন নাম মনে না করতে পারা সব কাগজ।
কিন্তু ছোটকাগজের আসল জগৎ খুলে দেয় আহমাদ মিনহাজই। দেশের তো বটেই, পশ্চিমবাংলার সব ঋদ্ধ কাগজ নিজ থেকেই পড়তে দেয়। হাওয়া৪৯। কৌরব। বিজ্ঞাপনপর্ব। এবং মুশায়েরা। সন্দীপনের লেখার হদিশ মিলে। বিজনের রক্তমাংসের তেতো স্বাদ নির্ঘুম করে ফেলে রাতকে। আর কোথাও একটা স্বপ্নের বীজ বোনা হয় অজান্তে। ভাবি, একটা কাগজ যদি বের করা যেতো! এমন সব সমৃদ্ধ লেখা দিয়ে!
নিপু ভাইকে পাকড়াও করে মাঝে মাঝে আরো গহীনের দিকে হাঁটতে থাকি আমরা। পিটিআই ক্যাম্পাস… বনশ্রী.. একটু নেমে গিয়ে শালবনের দিকে। স্বপন দা, মিনহাজ সিগারেট ফুঁকে চলে। নিপু ভাই কাজান জাকিসের নাম বলেন এক বিকেলে। শ্রাবণ রাজা, কার যেন অনুবাদে পড়ি। অনেক কিছু বদলাতে শুরু করে। আমি আর মিনহাজ মিলে ষড়যন্ত্র করে আড্ডার ছলে নিপু ভাইর সাক্ষাৎকার নেবার ধান্ধা করি। নিপু ভাই তখন দু হাতে লিখে চলেছেন। গল্পের প্রথম বই বেরিয়েছে। জলদাসের মৎস্যঘ্রাণ। একদিন স্বপন দা, না কি দীপংকর মোহান্ত , মনে নেই আজ আর, একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসেন। নিপু ভাইর সঙ্গে আমরা বাকীরা কথা বলে যাই। মনে আশা, যদি কোনোদিন স্বপ্নের কাগজটা হয়, এটা ছাপা হবে তখন।
২০০০-এর শেষে দেশে ছাড়ি। এক সামন্তবাদগ্রস্ত পশ্চিম-দেশে পাড়ি; কালচারাল শক, নতুন কাজের চাপ, ব্যক্তিগত পারিবারিক সব স্ট্রেস ঊর্ধ্বগামী — দেশ ছাড়ার বেদনা — লেখালিখি ছেড়ে দিই। ভাবি, যেভাবে নিজেকে নিঙড়ে লিখতে হয়, তা আর পারছি কই! কোথাও একটা সংকোচ কাজ করতে থাকে। নিজেকে মূল্যহীন মনে হতে থাকে। লেখার জগতের সমস্ত বন্ধুত্ব থেকে সরে আসি। সেই সময়ই হঠাৎ যোগাযোগ হয় মুজিব ইরম এ’র সঙ্গে। মুজিব ইরমের বাস নগর বার্মিংহামে। আমি আরো দক্ষিনে, অক্সফোর্ড-ঘেঁষা স্যুইণ্ডনে।
মুজিব ইরম ততোদিনে লিখতে শুরু করেছেন তার “আউটবই” বারকি। আমারও জমানো স্বপ্ন সম্ভাবনার দিকে একটু একটু করে এগোয়। আমিনা শেলি এগিয়ে আসেন। বলেন প্রচ্ছদ অলংকরণ আমি করছি । তোমরা লেখার দিকটা দেখো। সাহস বাড়ে। নামটা মাথায়ই ছিলো। বহু বছর বয়ে বেরিয়েছি। চিঠি লিখে লিখেই যোগাযোগ হতো এই বৈদেশ থেকে দেশে। তখনো আন্তর্জাতিক ফোন কল অতো সহজলভ্য নয়। দাপ্তরিক ঠিকানায় চিঠি লিখে লিখে দারুণ এক ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়ে যায় শহীদুল জহিরের সঙ্গে। এক চিঠিতে জিজ্ঞেস করি, নামটা কেমন? উনি বলেন, খুব অর্থবোধক। সুন্দরও। আজ এসব মুল্যবান স্মৃতি। কিংবা উৎপল কুমার বসুর সঙ্গে মাতাল সব সন্ধ্যায় ফোনে কথা বলা। কৈশোর মাত করে রাখা রহুচন্ডালের হাড়’র লেখক অভিজিত সেনে’র সঙ্গে সখ্য— সবই সেই প্রবাস জীবনের প্রারম্ভিকেই।
স্রোতচিহ্ন প্রথম সংখ্যা বেরুয়। বাংলাদেশের প্রথম ছোট কাগজ, যারা উপন্যাস ছাপে।
পরের সংখ্যায় নিপু ভাই, আকমল হোসেন নিপুর উপর বর্ধিত অংশ নিয়ে বিশেষ সংখ্যা। সেই সাক্ষাতকার ছাপা হয়। এই সংখ্যায়ও উপন্যাস যায় দুটো।
এর পরের সংখ্যা কলেবরের দিক দিয়ে বিশাল। ৮০ আর ৯০ দশকের গুণ বিচারের চেষ্টাসমেত।
এই গল্প এভাবেই বলবার নয়। এই কাজের ফাঁকে ফাঁকে। ্মুজাহিদ আহমেদের চাপের কাছে নতি স্বীকার করে যা বেরুলো, তার কোরাস’র জন্যে, স্রোতচিহ্ন জন্মের কিয়দংশ ব্যথাও প্রকাশ করতে পারলো না সেটা।
কোনও সম্পাদকই তা পারেন বলে মনে হয় না। তাও কাগজটা থাকে তার নিজস্ব আশ্রয় হিসেবে। পুনঃজন্মের স্বপ্নটাও থেকে যায়।
গানের মতো, চিরসখা হে…
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com