সড়ক দুর্ঘটনা : কারণ ও প্রতিকার

প্রকাশিত: ১০:১৯ অপরাহ্ণ, আগস্ট ৩, ২০১৮

সড়ক দুর্ঘটনা : কারণ ও প্রতিকার

রমিজ উদ্দিন
সড়ক দুর্ঘটনার দেশ বাংলাদেশ বা সড়ক যেন মৃত্যুকূপ। জরিপে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ২৬ জন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় এই দেশে। পত্রিকার পাতা খুললে প্রতিদিন চোখে পড়ে অসংখ্য তাজা মৃতদেহের ছবি, ক্ষত-বিক্ষত দেহ রাস্তায় পড়ে আছে, ঝড়ে যায় কত তাজা প্রাণ অকালে। অনেকেই আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে আজীবনের অভিশপ্ত জীবন যাপন করছে। তাই, অনেকেই একে সড়কে মৃত্যুর মিছিল নামে অভিহিত করেছেন। আর এই মৃত্যুর মিছিল এদেশে নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা হিসেবে পরিগণিত।

একটা সময় ছিল যখন সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে সাধারণ মানুষ এগিয়ে আসত, প্রতিবাদ করত, প্রশাসন জেগে উঠত, সাধারণ মানুষের মনে গভীর রেখাপাত তৈরি করত, মানবাধিকার কর্মীরা ছুটে আসত। আর এখন দুর্ঘটনার সংখ্যা এত বেশি বেড়েছে যে কারো যেন ভ্রুক্ষেপ করা সময় নাই। দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ও দুর্ঘটনা ক্ষতিগ্রস্থরা নিজেদের মধ্যে ক্যাশ লেনদেনের মাধ্যমে সবকিছু দফারফা করছে যার যার সাধ্যনুযায়ী নিজেদের মত করে, প্রশাসনের সাথে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে। বাংলার মানুষ যেন সড়কে মৃত্যুকে তাদের নিষ্ঠুর নিয়তি হিসেবে মেনে নিয়েছে। হয়তোবা এমন দিন আসবে সড়ক দূর্ঘটনার মৃত্যুকে একটি স্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে মেনে নেওয়া হবে।

জাতিকে এ করুণ পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে অবশ্যই সচেতন নাগরিক সমাজকে জেগে উঠতে হবে, প্রশাসনকে সজাগ হতে হবে, সড়কের আইন-কানুনগুলোর প্রয়োগ শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।

১। সঠিক আইন ও আইনের প্রয়োগ না থাকা ঃ যুগোপযোগী ও সঠিক আইন না থাকাই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। তারপরেও যে আইনগুলো রয়েছে সেগুলোর সঠিক প্রয়োগ নেই বলেলেই চলে, ফলে চালকদের মধ্যে আইনের প্রতি অশফা উদাসীনতা চরমভাবে লক্ষ্যনীয়। ফলে তারা বেপরোয়া গতিতে যান চালায়, অহেতুক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং ঘটায় মারাত্মক দূর্ঘটনা, ঝড়ে যায় কিছু প্রাণ অকালে, আর এক্ষেত্রে প্রশাসনের দূর্নীতি নির্লিপ্ততা ও অবহেলা অনেকাংশে দায়ী।

২। জড়িত প্রশাসন : সড়ক মহাসড়কে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রশাসন এবং বি আর টি সি প্রশাসনের চরম দূর্নীতি সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এসব দুর্নীতির কারণে অযোগ্য ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক মানুষ চালকের লাইসেন্স পায়, ফলশ্র“তিতে দূর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া ও সড়কে ঘুষ গ্রহণের মারাত্মক প্রবণতা প্রচলিত রয়েছে। যা একটি মারাত্মক অপরাধ। তাছাড়াও অযথা জনসাধারণকে অনভিপ্রেত হয়রানীর অভিযোগ অহরহ। অবৈধ টাকা লেনদেনের মাধ্যমে দোষী ব্যক্তিদের নির্দোষ বা শাস্তি কমানোর ঘটনা মহামারী আকার ধারণ করেছে। শহরাঞ্চলে রয়েছে প্রশাসনের টোকেন বাণিজ্য এ টোকেন বাণিজ্যে গুটিকয়েক অসাধু পরিবহণ ব্যবসায়ী বা চালকের উপকার হলেও ক্ষতির সম্মুখীন হয় পুরো শহর এবং দেশ।

৩। মাদকাসক্ত চালক/ চালকদের মাদকাসক্তি : মাদক গ্রহণের প্রবনতা আগে গুটিকয়েক দূর পাল্লার যান-চালকদের মধ্যে থাকলেও এখন তা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পরেছে সব শ্রেণীর চালকদের মাঝে বিশেষ করে ইয়াবা সেবন একটি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়েছে। একটি ভ্রান্ত ধারণা তাদের মাঝে প্রচলিত রয়েছে যে, ইয়াবা তাদেরকে দীর্ঘসময় সজাগ থাকতে এবং সচল থাকতে সহায়তা করে, অথচ উত্তেজক বড়িটি সেবকনের কারণে অতিরিক্ত উত্তেজনা বশতঃ চালক অহরহ দূর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি যমুনা টিভির এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে চালকদের মদ, গাঁজা ও ইয়াবার প্রতি আসক্তির চরম চিত্র। মদকাসক্তিই তাই সড়ক দূর্ঘটনার আরেকটি বিশেষ কারণ।

৪। সড়কের ভগ্নদশা এবং গর্ত : জরীপ অনুযায়ী সর্বাধিক খরচে নির্মিত এদেশের রাস্তাঘাটগুলো সর্বনিম্ন সময় অবধি টিকে থাকে। সামান্য বৃষ্টি হলে বা বন্যায় এ রাস্তা-ঘাটগুলো তলিয়ে যায়। ফলে সৃষ্টি হয় ছোট-বড় অসংখ্য গর্তের। আর দ্রুতগামী যানগুলোর চালকগণ গর্তের মধ্যে পরে বা গর্ত এড়াতে গিয়ে ঘটায় মারাত্মক সব দূর্ঘটনা। ইদানিং এই কারণে দুর্ঘটনায় মৃত্যের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এক্ষেত্রে এসব দূর্ঘটনার দায় কেউ নেয় না। নেই কোন জবাবদিহি, ফলে অকাল মৃত্যুর কোলে ঢলে পরছে অনেক প্রাণ।

৫। চালকদের অতিরিক্ত ডিউটি ও অসচেতনতা : ছোট-বড় পরিবহণ মালিকরা চালকদের উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ দিয়ে দেয়, ফলে চালকরা পরিমাণমত বিশ্রাম নিতে পারে না এবং ক্লান্ত শরীরে আবারও চালকের আসনে বসতে বাধ্য হয় এবং ঘটায় মারাত্মক সব দূর্ঘটনা।

৬। নির্দিষ্ট চিহ্ন ছাড়া যত্রতত্র স্পীড ব্রেকার : বিশেষ করে শহরাঞ্চলে এ সমস্যা প্রকট। শহরের রাস্তাগুলোই দেখা যায় প্রচুর পরিমাণে স্পীড ব্রেকারের উপস্থিতি এবং এইসব স্পীড ব্রেকার কাছে না আসা পর্যন্ত বোঝা যায় না যে, এগুলো স্পীড ব্রেকার কারণ এতে নেই কোন সাদা-কালো ডোরাকাটা চিহ্ন বা কোন ধরনের সংকেত বা সতর্ক বার্তা। ফলে এসব স্পীড ব্রেকারগুলো বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে বিভিন্ন ছোট বড় দূর্ঘটনা ঘটাতে নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

৭। অসচেতন পথচারী : সড়ক দূর্ঘটনার জন্য চালক ও প্রশাসনের পাশাপাশি অসচেতন পথচারীও দায়ী। মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হওয়া বা কানে হেডফোন লাগিয়ে রাস্তা-ঘাটে চলাচল করার প্রবনতা পথচারীদের মাঝে খুব বেশী। অবস্থায় তারা যান চলাচলের গতিবিধি ও হরনের আওয়াজ শুনতে পায় না এবং ঘটে দূর্ঘটনা, অকাল মৃত্যু বা আজীবনের পঙ্গুত্ব বরণ। এদেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ রাস্তা ঘাটে চলাচলের নিয়ম-কানুন মেনে চলে না।

৮। রাস্তা ও ফুটপাত বেদখল : সড়ক মহাসড়ক বিশেষ করে শহরাঞ্চলে রাস্তা ও ফুটপাত অবৈধভাবে দখল করে অবৈধ ব্যবসা করার প্রচলন অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। এক শ্রেণীর অসাধু ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন, প্রশাসন ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে ব্যবসা পরিচালনা করে, ফলে জনসাধারণকে রাস্তায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করতে হয়। ফলে অনেক সময় ঘটে যায় মারাত্মক দূর্ঘটনা। এ ধরনের দূর্ঘটনায় মৃত্যুর অনেক নজীর রয়েছে। তারপরেও প্রশাসন বা রাজনীতিবিদদের মধ্যে কোন রকম দায়-বদ্ধতা লক্ষ্য করা যায় না যা অত্যন্ত লজ্জাস্কর একটা বিষয়।

৯। যানবাহনের হেডলাইট ও ধূলা-বালির উপস্থিতি : সড়ক মহাসড়কে চলমান যানগুলোর রাতের বেলা হেডলাইট জ্বালিয়ে রাখে যা বিপরীত দিক থেকে আসা যান-চালকদের সরাসরি চোখে পরে, ফলে তারা স্বাভাবিক যান চালানোতে বাধাগ্রস্থ হয় এবং ঘটে মারাত্মক দূর্ঘটনা। এ বিষয়ে যদিও হেডলাইটের অর্ধেক কালো রংয়ে ঢাকা থাকার আইন থাকলেও অনেকেই তা মানে না। তাছাড়া, রাস্তা ঘাটে ধুলা-বালির পরিমাণ বেশী হওয়ার ফলে যানের সামনের কাঁচে ধুলা জমে চালক কে স্পষ্ট দেখায় বাধাগ্রস্থ করে। এসব কারণেও সড়কে মারাত্মক সব দূর্ঘটনা ঘটে।

এছাড়াও আরো অনেক ছোট বড় কারণ রয়েছে এদেশে ঘটমান সব সড়ক দূর্ঘটনার পেছনে। আর এসব কারণগুলোকে চিহ্নিত করে এর প্রতিকারে সবাইকে একযোগে এগিয়ে আসতে হবে।

প্রতিকার :
ক) যুগোপযোগী ও কঠোর আইন প্রণয়ন ও আইনের শতভাগ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
খ) দোষী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বা প্রয়োগকারী সংস্থার দোষী সদস্যদের কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও প্রতিটি দূর্ঘটনার জবাবদিহি এবং দোষীদের পদত্যাগ নিশ্চিত করতে হবে।
গ) মাদক নির্মূল করতে হবে, চালকদের মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, প্রয়োজনে ডোপটেস্টের সিস্টেম চালু করতে হবে।
ঘ) অনুন্নত রাস্তা-ঘাট নির্মাণে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় এনে কঠোর শাস্তির বিধান করতে হবে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ামুক্ত উন্নয়ন কর্মকান্ড নিশ্চিত করতে হবে, স্বচ্ছ জবাবদিহিতার প্রচলন করতে হবে।
ঙ) ড্রাইভারদের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে আরো বেশী কড়াকড়ি আরোপ করতে হবে, ঘুষ প্রথার বিলুপ্তি অবশ্যম্ভবী এবং চালকদের মাঝে সচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের পরিমাণ মত বিশ্রাম নিশ্চিত করতে হবে।
চ) ¯প্রীড ব্রেকার বা গতি রোধক স্থাপনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করতে হবে এবং এর উপর প্রয়োজনীয় চিহ্নসমূহ সবসময় থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
ছ) পথচারীদের কেউ আইন ভঙ্গ করার ক্ষেত্রে কাঠোর শাস্তি ও জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে, সচেতনতা তৈরি করতে হবে।
জ) রাস্তা ও ফুটপাত অবৈধ দখল মুক্ত করে এর সাথে যুক্ত সকল অবৈধ ব্যবসায়ী প্রশাসন ও রাজনীতিবিদদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।
ঝ) রাস্তা-ঘাটের পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে এবং যানের হেডলাইটের উপর কালো রং অবশ্যই থাকতে হবে।
ঞ) সড়ক দূর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির পরিবারকে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ ক্ষতিপূরণ নির্দিষ্ট সময়ে প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিকারের এসব বিষয়গুলোর উপর কঠিন নজরদারীসহ সটিক বাস্তব প্রয়োগ নিশ্চিত করতে পারলে আশা করি সড়ক দূর্ঘটনা অনেকাংশে কমে আসবে।

পরিশেষে বলবো, মুক্তিপাক সাধারণ মানুষ, সড়কে অকাল মৃত্যুর হাত থেকে, ভালো থাকুক বাংলাদেশের মানুষ আর প্রিয় বাংলাদেশ।