কামরুল হাসান
কবি ফারুক মাহমুদ সত্তর দশকের অন্যতম প্রধান কবি।
বহুবছর ধরেই গুঞ্জন শুনি এবার কবিতায় বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাবেন ফারুক মাহমুদ। আগে যেমন শুনতাম এবছর বাংলা একাডেমি পুরস্কার পাচ্ছেন কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন। তারও আগে শুনতাম এবছর একাডেমি পাচ্ছেন কবি আবিদ আজাদ। অপেক্ষার প্রহর আর শেষ হয় না। একের পর এক অকবি বা দুর্বল কবি এসে রাজনৈতিক পরিচয়ে পুরস্কারটি বাগিয়ে নিয়ে যায়, প্রকৃত কবিরা থাকে উপেক্ষিত। একবুক অভিমান নিয়ে এ পৃথিবী ও পুরস্কারের তামাশা থেকে নিজেদের অন্য পৃথিবীতে সরিয়ে নিয়ে গেছেন কবি আবিদ আজাদ ও কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন। সৌভাগ্য কবি ফারুক মাহমুদ বেঁচে আছেন, পঞ্চাশ, ষাট পেরিয়ে সত্তরের মাইলফলকে পৌঁছালেন। তাঁর কবিতার ভক্ত পাঠকগণ আশায় বুক বেঁধে আছেন, রাজনৈতিক পরিচয়কে নয়, কবিতাকেই পুরস্কৃত করবে বাংলা একাডেমি, কবি ফারুক মাহমুদকে প্রাপ্য মর্যাদা দিবে।
কবি ফারুক মাহমুদের কর্মজীবন কেটেছে সংবাদপত্রের জগতে, তার প্রিয় সাহিত্যের পাতায়। তিনি একের পর এক অনেকগুলো দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন, এর অর্থ হলো তার হাত দিয়ে অনেক নবীন কবি ও কথাশিল্পীর প্রথম লেখাটি মুদ্রিত হয়েছে। সে যুগে লেখা প্রকাশের জন্য ফেসবুক বা অনলাইন সাহিত্য পত্রিকা ছিল না, ছিল দৈনিকের সাহিত্য পাতা ও লিটল ম্যাগাজিন। লিটল ম্যাগাজিনগুলো বছরে একটি বা দুটি বেরুত (এখনো তাই), এস্টাব্লিশমেন্ট বিরোধীরা সেইসব স্বল্প প্রচারিত পত্রিকা ঘিরেই লেখা প্রকাশ করত, সে জগতে আছে তীব্র গোষ্ঠীবদ্ধতা। যারা দ্রুত পরিচিতি চাইত বা চাইত লেখা ঘনঘন প্রকাশিত হোক, তারা দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীর পাতায় লেখা ছাপাত। দৈনিক পত্রিকা ও লিটল ম্যাগাজিনের মাঝামাঝি ছিল, এখনো আছে, কিছু সাপ্তাহিক বা মাসিক কিংবা ত্রৈমাসিক পত্রিকা। এগুলো কিছু সাহিত্যের, কিছু পাঁচমিশালি। এমনি একটি সাহিত্য ত্রৈমাসিক ছিল 'পূর্ণতা'। যদিও সম্পাদক হিসেবে ছাপা হতো লতা হোসেনের নাম, কেননা তিনি ছিলেন মালিক, সব কাজ করতেন কবি ফারুক মাহমুদ। যতদূর মনে পড়ে তার সাথে আমার প্রথম দেখা হয় পান্থপথের এই পত্রিকা অফিসে। পান্থ হয়ে একদিন সে পথে গেলাম, দেখা হলো টকটকে ফর্সা সুদর্শন এক পুরুষের সাথে। জানলাম ইনিই ফারুক মাহমুদ। পরে শুনেছি তিনি লতা হোসেনের তলা ভবনটির নির্মাণ প্রকল্পেরও দায়িত্বে ছিলেন। লতা হোসেন বিশ্বস্ত হাতেই প্রকল্পটি ছেড়ে দিয়েছিলেন।
পরে আরেকদিন কবিতা দিতে গিয়েছিলাম আরেকটি দৈনিকের অফিসে, সেখানে গিয়ে আবিস্কার করি সম্পাদক হলেন কবি ফারুক মাহমুদ। আমার যা স্বভাব, সম্পাদকদের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর কোনো চেষ্টাই না করা, কেননা, বিশ্বাস করতাম লেখা ছাপা হবে লেখার মেরিটে কবির সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্কের ভিত্তিতে নয়। সেসব ইন্টারনেট-অনাবিষ্কৃত দিনে, যখন কবিতা পাঠানোর উপায় ছিল পোস্টাপিস বা নিজে গিয়ে দিয়ে আসা, তখন সম্পাদক ফারুক মাহমুদের সাথে আমার কোনোরূপ ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠেনি। দশকের ও বয়সের, কবিতার জগতে প্রতিষ্ঠার পার্থক্য ছিল, আমি কাছে ভিড়িনি, তিনিও কাছে টানেননি।
কবি ফারুক মাহমুদের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা তৈরি হলো তিনি যখন একটি নতুন দৈনিকের একেবারে গোড়া থেকে একজন সিনিয়র সম্পাদক হিসেবে যোগ দিলেন। কেবল সাহিত্যপাতা নয়, আরো বড়ো পরিধির সম্পাদনা যার একটি হলো সম্পাদকীয় পাতা। পত্রিকাটির নাম দৈনিক সকালের খবর, বায়তুল মোকাররমের খুব কাছে নবনির্মিত আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর র্যাংস ভবনে পত্রিকার অফিস। পল্লীগীতির কালজয়ী শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের ভিটার পাশে, নাকি সে ভিটাতেই, এই নতুন ধনীর ঝকঝকে প্রাসাদ। জায়গাটি আরেক কারণে বিখ্যাত। এখানেই ছিল কবি সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত কিংবদন্তি সাহিত্যপত্রিকা 'সমকাল' এর কার্যালয়। দৈনিক সকালের খবর পত্রিকাটির মালিক ছিল র্যাংস গ্রুপ। আমি তখন কবি ও প্রাবন্ধিক রাজু আলাউদ্দিনের প্ররোচনায় বাংলাদেশের প্রথম অনলাইন পত্রিকা বিডিনিউজ২৪.কমে বিভিন্ন সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে কলাম লিখতে শুরু করেছি। সেটা ২০১১ সাল।
একটি দৈনিক পত্রিকাকে পূর্ণপ্রকাশের আগে কিছুদিন ডামি সংস্করণ প্রকাশ করে প্রেস কাউন্সিলে জমা দিতে হয়। এগুলো হলো তাদের পত্রিকা প্রকাশের সামর্থ্য প্রমাণের নমুনা। পত্রিকার ডিক্লারেশন পেতে ওসব লাগে। সেসময় তারা নিজেদের ও বিভিন্ন উৎস থেকে সংবাদ ও অন্যান্য লেখা সংগ্রহ করে পৃষ্ঠা ভরে তুলছিলেন। আমার অজান্তেই বিডিনিউজ২৪.কম থেকে কিছু নিবন্ধ নিয়ে কবি ফারুক মাহমুদ সকালের খবরের উপসম্পাদকীয় পাতায় মুদ্রিত করেন। শুধু আমার নয়, আরও কয়েকজনের লেখা নিয়েছিলেন। ওই করতে করতে আমার লেখা তার পছন্দ হয়ে যায়। তিনি আমাকে উন্মুক্ত অফার দিলেন প্রতিসপ্তাহে একটি করে লেখা দেওয়ার। আমি পুরনো যুগের মানুষ, অনলাইন পত্রিকার চেয়ে পছন্দ করি মুদ্রিত পত্রিকা, ভার্চুয়াল বইয়ের চেয়ে ছাপানো বই (ভার্চুয়াল গোলাপের কথা না হয় নাই বলি)। আমি কবি ফারুক মাহমুদকে বলেছিলাম, আমি তো প্রতিসপ্তাহে লেখা দিতে পারব না। তিনি বলেছিলেন, তাহলে প্রতি পনেরদিনে একটি দিন। একজন সিনিয়র কবি ও সম্পাদক বলছেন, আমার লুফে নেওয়া উচিত, কিন্তু আমি তো আমার সীমাবদ্ধতা ও ব্যস্ততার পরিধি জানতাম। আমি বললাম, ফারুক ভাই, আমি কোনো কমিটমেন্ট করতে পারব না, তবে লেখা তৈরি হলে দিব। তিনি রাজী হলেন। আমি ধীরে বিডিনিউজ২৪.কম থেকে সরে গেলাম দৈনিক সকালের খবরে। যে নতুন নিবন্ধ লিখি, তা পাঠিয়ে দেই ফারুক ভাইয়ের কাছে আর দেখি পরদিনই বা বড়োজোর দু-তিনদিন পরেই লেখাটি সকালের খবরের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় উপসম্পাদকীয় জোনে ছাপা হয়েছে । তিনি আমার লেখা কাটছাট করতেন না, প্রায় অবিকল ছবিসহ ছাপতেন।
প্রায় সাড়ে তিনবছর নিবন্ধ লেখার পরে আমি তা ছেড়ে দেই। সরকারের রক্তচক্ষু তো আছেই, মৌলবাদীদের খড়গও শাণিত। তবে সেসব ভয় নয়,
আমি মেতে উঠি ভ্রমণসাহিত্য নিয়ে। সাড়ে তিনবছরে লেখা ৪৭টি নিবন্ধ মলাটবদ্ধ করি 'প্রহরের প্রস্তাবনা' বইতে। বইটি যথার্থরূপেই উৎসর্গ করি কবি ফারুক মাহমুদ ও কবি রাজু আলাউদ্দিনকে। দৈনিক সকালের খবরের সাথে আমার মধুচন্দ্রিমার অবসান ঘটে। সবটাই সুখের, কেবল একটি অস্বস্তি, মোট ৩১টি প্রবন্ধ লিখেছিলাম সকালের খবরে, একটি টাকাও পাইনি সম্মানী হিসেবে। ভেবেছি অতবড়ো বাণিজ্যিক গ্রুপ, তেলের উপর ভাসে আর পেঁয়াজ খায়, তাদের কাছে তো ওই টাকা নস্যি। কিন্তু আমাদের ব্যবসায়ীরা সবাইকে পেমেন্ট করেন, লেখকদের ছাড়া। আমার নিবন্ধ লেখা ছাড়ার সেও এক কারণ। এতো কার্ল মার্ক্সের উদ্বৃত্ত মূল্য আত্মসাৎ নয়, পুরো মূল্যটাই চুরি। বিডিনিউজ২৪.কম কিন্তু সম্মানী দিয়েছে। ফারুক ভাই চেষ্টা করেও একটি টাকা বের করতে পারেননি। তেল-পিঁয়াজ কোম্পানির কাছে আমার কমপক্ষে ৩১ হাজার টাকা পাওনা আছে, আর এ দাবী আমি আমৃত্যু ছাড়বো না। দেখি তারা কত টাকা নিয়ে মর্ত্যলোক পাড়ি দেয় আর অমর্ত্যলোকে গিয়ে কী প্রাসাদ বানায় (শেষেরটা অবশ্য দেখতে পাব না)।
ফারুক মাহমুদ আমার মনোলোকে ঠাঁই করে নেন যখন তিনি কবি শামীম রেজা সম্পাদিত দৈনিক আজকের কাগজের সাময়িকী 'সুবর্ণরেখা'য় আমার কাব্য 'রূপচৈত্রের অরণ্যটিলায়' নিয়ে রিভিয়্যু লেখেন। এদেশে সিনিয়ররা জুনিয়রদের ব্যপারে নীরব থাকাকেই ধর্ম বলে মনে করেছে। কিছু কিছু ব্যতিক্রম অবশ্য আছে, এটিও সেরূপ। তিনি আমাকে নিয়ে যান পুরানা পল্টনে সুপরিচিত চিটাগাং হোটেলের উপরতলায় এ্যাডর্ন পাবলিশার্সের অফিসে তাদের নিয়মিত আড্ডায়। একটি সরু প্যাসেজ, সরু সিঁড়ি আর সরু করিডোর (সেখানে সবকিছুই সরু) একটি চারিদিকে কেবল বই আর বইয়ের (প্রকাশকের মাথার বোঝা) আলোকিত দুনিয়ায়। সেখানে আসতেন কবি বিমল গুহ, কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু, কথাসাহিত্যিক নুরুল করিম নাসিম ও কথাসাহিত্যিক আতা সরকার প্রমুখ। এ্যাডর্ন পাবলিশার্সের সৈয়দ জাকির হোসেন ছিলেন হোস্ট। কোণার মিটিংরুমে বসে আমরা মুড়িমাখা, পেঁয়াজু, কখনো সিঙাড়া বা সমুচা সহ চা খেতাম। মনে আছে জাগৃতি পাবলিশার্সের দীপন ও টুটুল যেদিন ঘৃণ্য মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হলো সেদিন সন্ধ্যায় আমরা ওই আসরে বসে মর্মান্তিক সংবাদটি পাই। আমরা বাংলাদেশের ভবিষ্যত অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখে শিউড়ে উঠেছিলাম।
কবি ফারুক মাহমুদ মেঘনাপাড়ের ছেলে, তার বাড়ি ভৈরব, যে ভৈরব কিশোরবয়স থেকে আমার কল্পনাকে উসকে রেখেছে তার রেলসেতু আর মেঘনা নদী দিয়ে। যতবার ট্রেনে করে চট্টগ্রামে গিয়েছি ততবার আশুগঞ্জ আর ভৈরবের রেলসেতু আর নিচে প্রবাহিত নদী দেখতে জানালায় উৎসুক চোখ রেখেছি; তারা আমাকে মুগ্ধ রেখেছে। বিশেষ করে ভৈরবে মেঘনা ছিল পূর্ণরূপে। ১৯৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার ক্ষণে ১৬ই ডিসেম্বরে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনের এক সপ্তাহ পরে, এই মেঘনা নদী বেয়েই নৌকায় চড়ে ফারুক মাহমুদ শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা পার হয়ে ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছেছিলেন। ২৪ ডিসেম্বর রওয়ানা হয়ে আড়াইদিন পরে ঢাকায় পৌঁছেছিলেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে তখন সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিপর্যস্ত, নদীপথই ছিল একমাত্র যাতায়াতের মাধ্যম। কবি হওয়ার বাসনা নিয়ে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে তিনি সেই যে রাজধানীতে এলেন আর (সেভাবে) ফিরে গেলেন না। সে ছিল সত্তর দশকের কবিদের মফস্বল থেকে রাজধানীতে আসার কাল। কেবল ফারুক মাহমুদ নন, রাজধানীতে এসেছিলেন কবি আবিদ আজাদ, কবি মাসুক চৌধুরী।
ষাটের যে কবির সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন সত্তরের একদল নতুন কবি তিনি হলেন সিকদার আমিনুল হক। সত্তরের এই কবিরা হলেন, ফারুক মাহমুদ, মিনার মনসুর, কবি শিহাব সরকার প্রমুখ। দিনের পর দিন, সন্ধ্যা থেকে রাত অবধি তাদের তুমুল আড্ডা হতো এলিফ্যান্ট রোডে সিকদার আমিনুল হকের বাড়িতে। (আহা, কেউ যদি সেসব লিখে রাখতো)। উদার ও মুক্তপ্রাণ কবি সিকদার আমিনুল হকের গৃহের সস্নেহ ও অকৃপণ পরিবেশে তাদের স্মরণীয় দিন কেটেছে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন এই কবিদের ছায়াবৃক্ষ; বোধিবৃক্ষও বলা যায় কেননা সিকদার আমিনুল হকের বৈদগ্ধ্য তাদের ঋদ্ধ করেছিল। তারা কবিতার নতুন সম্ভাবনা ও দিগন্ত দেখতে পেতেন, বিশেষ করে বিদেশি সাহিত্যের জগৎ। তাদের আরেকটি আড্ডা হতো গ্রীনরোডের 'নেমন্তন' রেস্তোরাঁয়, যা ছিল কবি ও প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দের বাড়ির সমুখে আর আড্ডার মধ্যমনি ছিলেন আবদুল মান্নান সৈয়দই। নেমন্তনের আড্ডা হতো প্রতি শুক্রবার আর সেই শুক্রবারেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে সন্ধা থেকে রাত অবধি আড্ডা বসাতেন।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। সেখানে জমা হতো প্রচুর লেখক। তিনি সবাইকে ডিনার খাইয়ে আপ্যায়ন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ ও সংগ্রাম সত্তর দশকের কবিদের কবিতায় রাশিরাশি শ্লোগান ও চীৎকার ভরে দিয়েছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বিধ্বস্ত অর্থনীতি, অব্যবস্থাপনা ও খাদ্যাভাব কবিদের হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা আরও ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠে, সে আগুনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে কবিতায়। তারা কেউ কেউ বিদ্রোহী মিছিল ছেড়ে প্রেমের কাননে গিয়ে স্বস্তি খুঁজে পান। সত্তরের কবিতার তাই প্রধান দুটি ধারা হলো প্রেম ও বিদ্রোহ। ষাটের শেষার্ধের কবিদের পল্লবিত হয়ে ওঠার কাল ছিল সত্তর দশক। নির্মলেন্দু গুণ এই বিভাজন ও একই সঙ্গে ঐক্যকে ঠাঁই দিলেন তাঁর কাব্য ' না প্রেমিক না বিপ্লবী' তে। ফারুক মাহমুদ মূলত প্রেমিক ঘরাণার, তাই তার কবিতা নম্রকোমল; রাগী বা উচ্চকিত নয়। ছন্দ ও শব্দের সতর্ক ব্যবহারে তিনি একজন পরিশীলিত কবি। তাঁর কবিতার ভুবনটি বহুধাবিস্তৃত না হলেও তিনি কবিতাই লেখেন, অকবিতা নয়। প্রেমের ভুবনটি তিনি সম্প্রসারিত করে চলেছেন মহাভারতের নায়িকাদের অন্তর্ভুক্ত করে, নর-নারীর এমনকি সমলিঙ্গের প্রেমকে অন্তর্ভুক্ত করে। এখানে পরিস্ফুট তাঁর কুসংস্কারমুক্ত মন ও সাহস।
কবি ফারুক মাহমুদ একজন পুরোদস্তুর কবির জীবনই কাটিয়েছেন। কবিতাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান, কবিতার দেবীই আরাধ্য। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তিনি গদ্যের পথে যাননি। তার কবিতাগ্রন্থের সংখ্যা কুড়িটি হলেও গদ্যের বই মাত্র একটি।
যিনি বিজয়ের লগ্নে রাজধানী এসেছিলেন, তিনি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে রয়ে গেলেন ভাড়া বাসায়, নিজের একখণ্ড জমি বা একটি বাড়ি হলো না। তিনি যে বিত্ত গড়ার দিকে ভ্রুক্ষেপহীন ছিলেন, অসততা ও আপোষের পথে যাননি - তা এ থেকেই সুস্পষ্ট। এ সমাজ শুধু উদ্বৃত্ত মূল্য চুরি করে না, পুরো মূল্যটাই পকেটে পোরে। এখানে কবি গৃহহীন, লেখক উদ্বাস্তু, শিল্পী চিকিৎসাহীন, নাট্যকর্মী ঋণে জর্জরিত। অথচ কবি ফারুক মাহমুদ ইচ্ছে করলেই একখণ্ড জমির মালিক হতে পারতেন। প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান ছিলেন ভৈরব শহরে ফারুক মাহমুদের একই এলাকার, প্রতিবেশি। রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে তিনি ফারুক মাহমুদকে বেশ কয়েকবার তাঁর সাথে দেখা করতে বলেছিলেন। তিনি যাননি। সে হয়তো এক বোকামি, কিন্তু আমি দেখেছি কবি ফারুক মাহমুদের ব্যক্তিত্বে একটা দৃঢ়তা আছে; তিনি নত হতে চান না, ধর্না দিতে জানেন না। এটাই কি আটকে রাখল তাঁর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি? কিন্তু তাঁর মতো মেধাবী ও প্রকৃত কবির অবশ্যই রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়া উচিত। সত্তর দশকের এ কবি আজ সত্তর বছর বয়সে পা দিলেন।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com