এসবিএন ডেস্কঃ বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা হ্যাক করে ফিলিপাইনে নেওয়া কেলেঙ্কারিতে কারা জড়িত তা তদন্ত শুরু হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে বাংলাদেশেরও সংঘবদ্ধ একটি চক্র এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে গোপনে জড়িয়ে রয়েছে। সরকারের একাধিক সংস্থা তদন্তে নেমেছে। চেষ্টা চলছে জড়িত দেশি-বিদেশি চক্র শনাক্ত করার।
নিউইয়র্কে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা থাকা বাংলাদেশ ব্যাংকের ৮০০ কোটি টাকা ক্যাসিনো ক্লাবে জুয়া খেলার মাধ্যমে মেরে দিয়েছে জালিয়াত চক্র। কৌশলে নিউইয়র্ক থেকে ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ডলার।
এর পেছনে বাংলাদেশি একটি সংঘবদ্ধ চক্রও জড়িত বলেই মনে করা হচ্ছে। এ চক্রই ঢাকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তথ্য সংগ্রহ করে হ্যাকারদের কাছে দিয়েছে। বাকি কাজ সেরেছে হ্যাকাররা। বাংলাদেশী এ চক্রের সদস্য কারা তার তদন্তে নেমেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক নিজেও তদন্ত করছে। বিশ্বব্যাংকের সাবেক আইটি প্রধান রাকেশ আস্তানার তদন্তেও বাংলাদেশের জড়িতদের তথ্য উঠে আসতে পারে।
তবে এ জন্য অপেক্ষা করতে হবে ২ সপ্তাহ। সক্রিয়ভাবে মাঠে নেমেছে র্যাবের তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও। অন্য আরও ২ শীর্ষ গোয়েন্দা সংস্থাও শুরু করেছে তদন্ত।
ইতিমধ্যেই বাংলাদেশ ব্যাংক কর্মকর্তাসহ কয়েকজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের রাখা হয়েছে কঠোর নজরদারিতে। অপরদিকে, হ্যাকারদের কাছ থেকে উদ্ধার করা টাকার একটি অংশ আবারও যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে জমা করা হয়েছে।
শ্রীলঙ্কায় পাচার করা হ্যাকারদের ২০ মিলিয়ন ডলার সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক জব্দ করে। পরে বাংলাদেশকে তা ফেরত দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যার ১৯ দশমিক ৯০ মিলিয়ন ডলার ফেরত পায়।
যা পুনরায় নিউইয়র্কের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। তথ্য প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হ্যাকিং সম্পন্ন করার আগে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। হ্যাকাররা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকেই জেনেছে কীভাবে অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধ পাঠানো ও অনুরোধের পরের যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়।
এসব কাজ ঢাকা থেকেই বাংলাদেশিদের পক্ষেই করা সম্ভব। আইটি বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ প্রশ্ন তুলেছে, কোনো ম্যালওয়ারের বা কম্পিউটার ভাইরাস পাঠিয়ে যদি হ্যাকিংয়ের কাজ সম্পন্ন করা হতো তাহলে কোনো নির্দিষ্ট সময় পর তা বন্ধ হয়ে যেত না। এখনো অটোমেটিকভাবেই অর্থ স্থানান্তরের অনুরোধ পাঠানো হতে থাকত।
কিন্তু তা যেহেতু হচ্ছে না, সুতরাং অভ্যন্তরীণ কোন না কোন ব্যক্তি এর মধ্যে জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, হ্যাকিংয়ের ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের তিনটি আইডি ইতিমধ্যে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ আইডিগুলোর মাধ্যমে ফিলিপাইনের হ্যাকাররা টাকা পেমেন্টের অর্ডার দেয়। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বাংলাদেশের কাছে পেমেন্টের বিষয়ে জানতে মেইল করে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি। উত্তর না দেওয়ায় ১ দিন পর তারা টাকা পেমেন্ট দেয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম বিভাগের মাধ্যমে ওইসব আইডি ব্যবহূত হয়। যেসব কর্মকর্তা ওইসব আইডি ব্যবহার করতেন তাদের বিষয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
সূত্রে জানা গেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পেমেন্টের বিষয়ে জানতে মেইল আসার কথাও ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কিছু জানানো হয়নি। শ্রীলঙ্কা কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন সে দেশে পাচার হওয়া অর্থ জব্দ করে ও বাংলাদেশ ব্যাংককে জানায় তারপরই বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই বিভাগের একাধিক কর্মকর্তাই এখন নজরদারির মধ্যে রয়েছেন।
তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ও যাবতীয় সম্পদেরও খোঁজ নিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভাগের তিন কর্মকর্তা গত এক বছরে ইউরোপ ও আফ্রিকাসহ একাধিক দেশে কয়েকবার সফর করেছেন। তাদের সফর নিয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ঘটনার তদন্ত, করণীয় ও অগ্রগতি নিয়ে গতকাল বাংলাদেশ ব্যাংকের চার ডেপুটি গভর্নর আবুল কাশেম, আবু হেনা মো. রাজী হাসান, এস কে সুর চৌধুরী ও নাজনীন সুলতানার সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব এম আসলাম আলম।
বৈঠকে বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর ও ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রাজী হাসান বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের ডিউ ভিলিজেন্সের বিষয়টি পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকে পেমেন্টের বিষয়ে যেসব অ্যাডভাইস গেছে, তার কিছু অ্যাডভাইসের বিষয়ে তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছেও জানতে চেয়েছিল। যে ৫টি অ্যাডভাইসের বিপরীতে পেমেন্ট দেওয়া হয়েছে তার বিষয়েও জানতে চাওয়া হয়েছে, কিন্তু আমাদের দিক থেকে কোনো উত্তর দেওয়ার আগেই পেমেন্ট করা হয়েছে।
এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে কোনো অ্যাডভাইস দেওয়া হয়নি জানিয়ে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের কাছে বলা হলে বাকি অ্যাডভাইসগুলো তারা আটকে দেয়। যার জন্য বেশির ভাগ অ্যাডভাইসের পেমেন্ট স্টপ করা হয়। এখন আমরা এ বিষয়গুলো নিয়েই তদন্ত করছি। তদন্তের পর বিস্তারিত জানা যাবে।
তিনি আরও বলেন, হ্যাকিংয়ে ঘটনাটি কোন পর্যায়ে হয়েছে বিষয়টি তদন্তাধীন। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হয়েছে না বাইরে থেকে হয়েছে তা তদন্তের বিষয়। আমরা এফবিআইয়ের সম্পৃক্ততা আশা করছি। কারণ এফবিআইয়ের সাইবারবিষয়ক একটি শক্তিশালী ইউনিট আছে।
বিশ্বব্যাপী কোথায় কী হচ্ছে তা তদন্ত করার ক্যাপাসিটি তাদের আছে। আমাদের বোর্ডসহ সরকারের অন্যান্য সংস্থাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যথাযথ প্রক্রিয়াতে এগোচ্ছি। এ সময় ব্যাংকিং সচিব এম আসলাম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে রক্ষিত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইটি নিরাপত্তায় অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংকের আইটি নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল। এতে কোনো সন্দেহ নেই। এটি আইটিনির্ভর কাজ। আমরা এটাকে এখন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ শুরু করেছি।
এ ঘটনার মাধ্যমে আমরা এখন বুঝতে পারলাম আমাদের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি আইটি নিরাপত্তা। এখানে সবার সঙ্গে আমি কথা বলেছি। যেটা জানতে পারলাম বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৯৫১ মিলিয়ন ডলার চুরির চেষ্টা হয়েছিল। ফিলিপিনসের অ্যান্টি মানি লন্ডারিং টিম সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টগুলো ফ্রিজ করেছে। সেখান থেকে ৬৮ হাজার ডলার ফেরত পাওয়া গেছে। বাকি টাকা ফেরত পাওয়া যায়নি।
তবে ফিলিপিনস কর্তৃপক্ষ উদ্যোগ নিচ্ছে। ব্যাংকের যেসব সিস্টেমস আছে সেগুলো তারা পরীক্ষা করছে। এটার কাজ এখনো চলমান। বাংলাদেশ ব্যাংক ফরেনসিক এক্সপার্ট নিয়োগ করেছে। আরও কিছু দিন সময় লাগবে সব কম্পিউটার পরীক্ষা করার জন্য। ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাদের জানানো হয়নি।
২৩ ফেব্রুয়ারী বাংলাদেশ ব্যাংকের বোর্ড মিটিং হয়েছে। ২৮ ফেব্রুয়ারী ও ১ মার্চ অডিট কমিটির বৈঠক হয়েছে, সেখানে এটা তারা (বাংলাদেশ ব্যাংক) এজেন্ডাভুক্ত করেনি। কেন করেনি সেটা জানতে চেয়েছি।
তারা বিষয়টি তদন্ত করে পুরো চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের চলতি হিসাবে (কারেন্ট অ্যাকাউন্ট) নিয়মিত লেনদেনের জন্য রাখা বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থের পুরোটাই চুরির চেষ্টা করা হয়েছিল।
এ জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘অথেনটিক’ ব্যবস্থা থেকে গত ৫ ফেব্রুয়ারি ৩৫টি অনুরোধ পাঠানো হয়। এর মধ্য থেকে পাঁচটি পরামর্শ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হয়ে যাওয়ায় তাতে ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কায় ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার চলে যায়।
এর মধ্যে একটি অনুরোধে শ্রীলঙ্কায় যাওয়া ২০ মিলিয়ন বা ২ কোটি ডলার উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। আর ফিলিপাইনে স্থানান্তরিত ৮ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলারের মধ্যে ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার দেশটির জুয়ার আসর ক্যাসিনোতে ঢুকেছে। পরে অবশ্য সেই অর্থ হংকংয়ে পাঠানোর তথ্যও উঠে এসেছে তদন্তে। ফিলিপাইনের রিজাল ব্যাংকের এমডি লরেন্স ট্যান, সংশ্লিষ্ট শাখা ম্যানেজার মায়া সান্তোস ডিগুইতো ও সন্দেহজনক হিসেবে চিহ্নিত হ্যাকার কিম অং তদন্তের আওতায় আছেন।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com