এসবিএন ডেস্ক:
ফুটন্ত কড়াইয়ে এক ফোঁটা পানি পড়লে যা হয়, ছ্যাঁত করে ওঠে। ম্যাচ ফিক্সিং-স্পট ফিক্সিং সংক্রান্ত প্রশ্ন উঠতেই তেমন অবস্থা বোর্ড কর্তাদের, ‘সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছাড়া স্রেফ সন্দেহের ভিত্তিতে এসব বলা ঠিক না!’
সাংবাদিকতা পেশারও এটাই মূলমন্ত্র—অভিযোগের সঙ্গে তথ্য-প্রমাণও জুড়ে দেওয়া। কিন্তু ক্রিকেট এমনই শুভঙ্করের ‘খেলা’ যে নগদ তথ্য-প্রমাণের অভাবে ক্রিকেট জুয়ায় জড়িত অনেক সন্দেহভাজনকেও শাস্তি দিতে পারছে না খোদ আইসিসি। বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার মল্লিকের দেওয়া সূত্রমতে, ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ পর্যবেক্ষণের পর ১১২ সন্দেহভাজনের তালিকা জমা পড়েছে দুবাইয়ের আইসিসির হেড কোয়ার্টারে। বিশ্বের নানা প্রান্তেই যে ক্রিকেটে বুকমেকিং হয়, হচ্ছে এবং হবে—সেটিও বিশদ জানেন বোর্ড কর্তারা। তবু কেন যে ঘরের খবর নিতে গেলেই ওভাবে জ্বলে ওঠেন, তা এক রহস্য বটে!
কাল অবশ্য ব্যাখ্যা দিতেই সপারিষদ সংবাদ সম্মেলন করেছেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন এমপি। সঙ্গে দিয়েছেন বিপিএলের তৃতীয় আসরের খতিয়ান। আগের দুটি বিপিএলের সঙ্গে তুলনায় এবারের আসরটি নিঃসন্দেহে সফলতর হয়েছে। তবে ক্রিকেটে এতগুলো চোরাপথ সৃষ্টি হয়েছে যে, এখনই অকাতরে এ আসরকে শতভাগ বিশুদ্ধ আখ্যা দেওয়া যাচ্ছে না। এটাই বাস্তবতা। বিসিবি সভাপতির কণ্ঠেও তারই অনুরণন, ‘ম্যাচ পাতানো কিংবা স্পট ফিক্সিং নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ জমা পড়েনি। তবে পত্রপত্রিকার কিছু অভিযোগ নিয়ে নিশ্চয় বিসিবি নিযুক্ত আকসু (দুর্নীতি দমন বিভাগ) কাজ করছে, তেমন কিছু পেলে অবশ্যই আমরা জানব।’ এবং এটাই ক্রিকেট জুয়া প্রতিরোধের সর্বোত্তম পন্থা, বোর্ড সভাপতি যেটাকে বলেছেন, ‘চলমান প্রক্রিয়া।’ তত দিন অপেক্ষা না করে এখনই ‘ফিক্সিং হয়নি’ বলে জোর দাবি কেন? অবশ্য সবশেষ বিপিএলের পরও কর্তাব্যক্তিদের তরফ থেকে একই দাবি তোলা হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাক্রম আমরা সবাই জানি।
এবারের বিপিএলের সেরা সাফল্য নিঃসন্দেহে আর্থিক দিকটি। খেলোয়াড়রা পাওনা পেয়ে খুশি, এমনকি টুর্নামেন্টের মাঝপথে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া সিলেট সুপারস্টারসের ক্রিকেটারদের মনেও আর কোনো খেদ নেই। আর নিজেদের ভাণ্ডারে প্রত্যাশার সবটুকু জমা হওয়ার উচ্ছ্বাস তো সভাপতির দু’পাশে বসা পরিচালকদের আত্মবিশ্বাসী অভিব্যক্তিতেই পড়া যাচ্ছিল। দূরের মানুষদের প্রত্যাশা, সে অর্থের বিনিয়োগটা যেন ঠিকঠাক হয়।
বিসিবির বিপিএল পর্যালোচনায় কাল পুরনো এবং তর্কাতীত নয় এমন একটি ব্যাপার তুলে ধরা হয়নি। বিপিএল বাজারে নামানোর আগে জোর দিয়ে বলা হয়ে থাকে, এমন আসর উঠতি ক্রিকেটার তৈরি করে। এ দাবিটা সারা বছর ক্রিকেট থেকে হাজার মাইল দূরে থাকা ফ্র্যাঞ্চাইজিদেরই অবশ্য বেশি! যা-ই হোক, বিপিএল থ্রি অনেক তরুণ ক্রিকেটারের জন্ম দিয়েছে—এমন কোনো দাবি করেননি বিসিবি সভাপতি। তবে জমজমাট ম্যাচ হয়েছে এমনকি, লো স্কোরিং ম্যাচও বিনা বাধায় কোনো দল জেতেনি। সবশেষ রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল এবারের আসরের ‘আইসিং অন দ্য কেক’। তবে একশর নিচে ম্যাচের পর ম্যাচ ইনিংস গুটিয়ে যাওয়া মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। এর জনপ্রিয়তম সমাধানের পথটা অবশ্য চেনা নাজমুল হাসানের, ‘ভেন্যুর সংখ্যা বাড়াতে হবে।’ এতে কিছু আর্থিক ক্ষতির বিনিময়ে দুটি লাভ হবে; ভালো উইকেটে ভালো ক্রিকেট হবে এবং দর্শকও বাড়বে।
সম্ভবত আগের দুটি আসরের ‘নির্মম’ অভিজ্ঞতার কারণেই একটি বিষয়ে সর্বোচ্চ মনোযোগ ছিল বিসিবির—পাওনা পরিশোধ নিয়ে যেন গড়িমসি না করে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। মনোযোগী হলে সুফল মেলে; সেটির প্রমাণ বিপিএল থ্রি। ফ্র্যাঞ্চাইজি ফি আগেই পেয়েছে বিসিবি, ব্যাংক গ্যারান্টি থাকায় খেলোয়াড়দের পাওনা পরিশোধ নিয়েও কোনো জানা-অজানা আশঙ্কা নেই।
তবে বোর্ড সভাপতির আরেকটি উপলব্ধিই সবচেয়ে আকর্ষক, ‘শুধুই টাকার জন্য আমরা টুর্নামেন্টটা করিনি। মূল বিষয় ক্রিকেট।’ কোনো টুর্নামেন্ট শুরু হয়ে গেলে আয়োজকদের নিয়ন্ত্রণে থাকে শুধু আইন-কানুন, যে অর্থে ‘ক্রিকেট’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন বোর্ড সভাপতি, সেটির নিয়ন্তা আসলে অংশগ্রহণকারী দলগুলো। আর এটা তো সত্যি যে, ক্রিকেটের প্রতি প্রবল ভালোবাসা আর ক্রিকেটের অলিগলি চেনা এক বস্তু নয়। ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে সংকটটা হয় এখানেই। মালিকরা অঢেল ব্যয় করেন কিন্তু স্রেফ সঠিক প্রয়োগের অভাবে বিফলে যায় সব চেষ্টা। হাই প্রোফাইল কোচ এনে ডাগ আউটে গ্ল্যামার বাড়ানো যায়, কিন্তু কার্যকর হয় না। অবশ্য টাকা ফ্র্যাঞ্চাইজির, তাই ব্যয় করার পূর্ণ স্বাধীনতাও রয়েছে মালিকের।
এ যুক্তিতেই কিছুটা বিস্ময় জাগে মনে যে, একজন ক্রিস গেইলকে কেন বরিশাল বুলস ফাইনালে ওঠার ম্যাচে খেলায়নি, তা নিয়ে তদন্তের পরিকল্পনা করেছে বিসিবি! ক্লাব মালিক কাকে খেলাবেন আর কাকে খেলাবেন না, এ তো একান্তই তাঁর ব্যক্তিগত ইচ্ছা বলেই সারা বিশ্ব জানে। যাঁরা বিপিএলে সন্দেহজনক কিছু হয়েছে কি না, জানতে চাইলেই ছ্যাঁত করে উঠছেন, তাঁদের মনেও তাহলে সন্দেহ আছে! অবশ্য এক অর্থে এটা ভালোই। এ যুগের ক্রিকেটে কোনো কিছুই ‘আনচ্যালেঞ্জড’ ছেড়ে দেওয়া বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়।
গেইলের না খেলা নিয়ে উচাটন বিসিবি অবশ্য প্রশ্ন তোলেনি কেন প্রায় ৪৯ ঘণ্টা বিমানভ্রমণের পর ঘণ্টা দেড়েকের বিশ্রাম নিয়ে ম্যাচ খেলতে নামলেন সাকিব আল হাসান? দুবাইয়ে রাতে ম্যাচ খেলে ঢাকা হয়ে হেলিকপ্টারে উড়িয়ে এনে কোন যুক্তিতে ম্যাচে নামিয়ে দেওয়া হলো উমর আকমলকে? ক্লান্তির জের ধরে বড় ইনজুরিতে পড়তে পারতেন দুজনই। পুরোদস্তুর ক্রিকেটীয় এ প্রশ্ন দুটি ‘গেইল-ষড়যন্ত্র’ অনুসন্ধানে ব্যস্ত কর্তারা সংশ্লিষ্ট ফ্র্যাঞ্চাইজিদের করেছেন বলে জানা যায়নি।
আর্থিক সাফল্যের সঙ্গে এ জাতীয় বিষয়গুলোতেও বিসিবির নজরদারি জরুরি। নইলে বিপিএল মানেই টাকা, দেনা-পাওনা, জুয়া আর নানা কাহিনীর দৃশ্যায়ন হয়ে থাকবে, বিশুদ্ধ ক্রিকেট হবে না।
সবশেষে আরেকটি প্রশ্ন। আচ্ছা, বিপিএল নিয়ে কাল যতটা ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন হলো ঘরোয়া অন্য আসরগুলোর পরও কি মহাসমারোহে ব্রিফিং দেবেন বোর্ড সভাপতি, তাঁর চারপাশে কি এতজন পরিচালক থাকবেন?
সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটতে পারে শুধুমাত্র বোর্ডের আরেকটি ঘটা করে করা সংবাদ সম্মেলন যেটিতে সবাই পেয়ে যাবেন তাদের সব প্রশ্নের উত্তর।
সংবাদটি শেয়ার করুন