-তারিক সামিন
মানুষকে বন্দি করে রাখা, তাদের শাস্তি দান ইত্যাদির জন্য জেলখানার যে ব্যবস্থা তাকে সভ্যতার অভিশাপ মনে করেন জব্বার সাহেব। যদিও তিনি কখনো জেলখানায় যাননি কিংবা নিকট আত্মীয় কাউকে যেতে দেখেননি, তবুও মানুষের এই নিষ্ঠুরতা অসহ্য লাগে তার কাছে।
পুরাতন ঢাকার বংশাল জেল সদ্য স্থানান্তর হলো জিঞ্জিরার বড় খোলামেলা স্থানে। খবরটা শুনে মনটা ভাল লাগছে তার। তিনি মহৎ মানুষ, কাউকে কষ্ট দিতে; বা কারো কাছ থেকে কষ্ট পেতে আগ্রহী নন। তবুও ছয় বছরের মেয়ের আবদার আর টেলিভিশন বেশি না দেখার শর্তে, মেয়ের জন্য একটা মাছের অ্যাকুরিয়াম কিনতে গেলেন জব্বার সাহেব। দুই দিন অবসর সময়ে হেঁটে হেঁটে এলাকার সব মাছ, পাখি বিক্রির দোকান ঘুরে ঘুরে অবশেষে তিন হাজার পাঁচশত টাকায় তিন-ফুট সাইজের একটা অ্যাকুরিয়াম কিনলো সে।
-স্যার, লস হয়ে গেল আর পাঁচশো টাকা দেন, বললো দোকানের সেলস-ম্যান।
কিছুটা অবাক হয়ে দোকানের সেলস-ম্যানের দিকে তাকালো সে। এত দামাদামির পর বিক্রি! চারটা এক হাজার টাকার নোট দিয়েছেন যুবক বিক্রেতাকে। পাঁচশত টাকা ফেরত দিতে চাচ্ছে না!
-এটা কেমন কথা দামাদামি করে, দাম ঠিক করার পর আবার বাড়তি চাইছো। কিছুটা ক্ষুব্ধ হলেন তিনি।
– হে: হে: স্যার দুইশো টাকা বেশি রাখি।
-না! না! পাঁচশো ফেরত দাও, না হলে রাখো তোমার অ্যাকুরিয়াম। এবার একটু উত্তেজিত দেখালো জব্বার সাহেবকে । দোকানের সেলস-ম্যান হাসতে হাসতে পাঁচশো টাকা ফেরত দিল তাকে।
তারপর বললো, স্যার মাছ লাগবে না। গোল্ড ফিস, গেরামী, ব্ল্যাক মলি, গাপ্পি, টাইগার বার্ব আরো অনেক রকম মাছ আছে। সস্তায় দিব স্যার নেন।
অ্যাকুরিয়ামে মাছের ছুটোছুটি দেখতে দেখতে বিমোহিত হয়ে গেলেন জব্বার সাহেব। নিবেন, কি নিবেন না? ভাবছেন। কোনটা কি খাবে, কিভাবে পরিচর্যা করতে হয় কিছুই জানেন না তিনি। তবুও ছয়টা মাছ কিনলেন তিনি। অনেক ঘুরাঘুরি করে নিশ্চিত হয়েছেন, এই দোকানের দামই সবচেয়ে কম। তিন জোড়া মাছ সাড়ে তিনশো টাকায় কিনলেন তিনি। খুশি মনে বাসায় ফিরলেন একটা রিকসা ভ্যান করে।
ইন্টারনেটের যুগে কোন কিছুই মানুষের অজানা নয়। ‘Frist time Aquarium setup’ লিখে গুগলে সার্চ দিলে হাজার হাজার তথ্য দেখায়। একুরিয়ামের তলায় পাথরগুলো ভালভাবে ধুয়ে পরিষ্কার করে, পানি ঢাললেন। তারপর লবণ আর দোকান থেকে কেনা হরেক রকমের ভিটামিন, ঔষধ, প্রতিষেধক ঢাললেন পানিতে। বিশ মিনিট পর মাছগুলো ছেড়ে দিলেন। বা! সুন্দর ছুটাছুটি করছে।
-বাবা আমি মাছগুলোকে খাওয়াবো, ছোট আদুরে গলায় কথাগুলো বললো তার আদরের মেয়ে টুনটুনি।
-ঠিক আছে মা, তবে খুব অল্প খাবার দিতে হবে। বেশি খাবার দিলে মাছেরা খাবে না। তখন খাবার পচে পানি নষ্ট হলে, মাছ মরে যাবে। ইন্টারটে থেকে শেখা বুলি আওরালেন তিনি।
এক সপ্তাহ হয়ে গেছে। এরই মধ্য চারটে মাছ মরে গেল। ইন্টারনেটে আরো ঘাটাঘাটি করে বুঝলেন তথাকথিত জীবন রক্ষাকারী ভুয়া ঔষধের কারণে মরছে বেশির ভাগ মাছ।
এরপর নতুন এক দোকানে গেলেন মেয়েকে নিয়ে। সেখানে গিয়ে তার চক্ষু চরক গাছ। সাড়ে তিনশ টাকায় যে ছয়টি মাছ কিনেছেন। এখানে তার দাম দুইশো টাকা। অ্যাকুরিয়াম এর দাম সাড়ে তিন হাজার ঠিকই আছে। আজকে কিনলেন দশটা মাছ। দাম চারশো টাক।
লাভ- লোকসান ভুলে মনের আনন্দে মাছ পুষছেন জব্বার সাহেব। গত একমাস গভীর পর্যবেক্ষণের পর তিনি বুঝতে পারলেন। মাছেরা কি নিষ্ঠুর আর বজ্জাত! একজন আরেকজনকে ঠুকরিয়ে তার শরীরের পাখনা লেজ খেয়ে ফেলে। আর পাখনা বা লেজ না থাকলে, যত বড় শক্তিশালী মাছ হোক সাঁতার কাটতে পারে না। তারপর সেই অর্ধমৃত মাঠটাকে ঠোকরাতে ঠোকরাতে মেরে ফেলে; তাকে ধীরে ধীরে ভক্ষণ করে বাকি মাছেরা। কি নিষ্ঠুর, এত সুন্দর সুন্দর মাছদের মধ্যে কি নিষ্ঠুরতা! এসব দেখে তার ছয় বছরের মেয়ের মনে কি সাইকোলজিক্যাল ইফেক্ট হবে ভাবছিলেন জব্বার সাহেব।
-বাবা, বাবা! আমার গোল্ড ফিসটাকে মারছে গোরামী। বাবা, বাবা এবার আমার গোরামীকে মারছে টাইগার বার্ব।
বোঝা যাচ্ছে যে দুর্বল, মার খাচ্ছে তার প্রতি শিশুটির সহানুভূতি বেশী।
মহা যন্ত্রণা অফিস থেকে বাসায় এসে প্রতিদিন মরা মাছের সৎকার করতে হয় তাকে। গভীর পর্যবেক্ষণের পর জব্বার সাহেব বুঝলেন। মাত্র অল্প কিছু মাছ সন্ত্রাসী টাইপের। বাকীরা নিরীহ। তাই ছোট আরো একটা অ্যাকুরিয়াম কিনে তার মধ্যে রেখে দিলেন সেগুলোকে। আশ্চর্য এরপর মাছদের অপমৃত্যু কমে গেল। নিরীহরা সবাই মিলেমিশে শান্তিতে সহাবস্থান করছে। আগ্রাসী, সন্ত্রাসী মাছেরা পরস্পর মারামারি করে ক্লান্ত হয়ে যাচ্ছে।
মাছ পালনের তিন মাস পর; পৃথিবীতে জেলখানা, রাষ্ট্র ও সমাজের গুরুত্ব বুঝতে পারলনে শান্তিবাদী জব্বার সাহেব।
সংবাদটি শেয়ার করুন