আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছিলেন একজন কালজয়ী সাহিত্যস্রষ্ঠা ।
জীবনের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলা বাংলাদেশের একজন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক। ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক জ্ঞান, বাস্তবতার আলোকে নিপুণ চিত্রন তথা গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও সূক্ষ্ম কৌতুকবোধ যেনো তাঁর রচনাকে এক ব্যতিক্রমী সুষমা প্রদান করে। তিনি বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক প্রশংসিত বাংলাদেশী লেখকদের একজন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে সমাজবাস্তবতার অনন্যসাধারণ রূপকারও বলা হয়।
জন্ম ও শৈশব জীবনের বিবরণ, Birth and childhood life
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্ম ১৯৪৩ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের গাইবান্ধা জেলার গোটিয়া গ্রামে নিজের মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পুরো নাম আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস এবং ডাক নাম মঞ্জু। ইলিয়াসের পৈতৃক বাড়ি ছিল বগুড়া জেলায়। তাঁর বাবার নাম বদিউজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস যিনি পেশায় পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (১৯৪৭-১৯৫৩) এবং মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি ছিলেন; মাতার নাম বেগম মরিয়ম ইলিয়াস।
শিক্ষাজীবন, Education
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বগুড়া জিলা স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। উক্ত বিদ্যালয় থেকে ১৯৫৮ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন; এরপর ১৯৬০ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন।
কর্মজীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা, Career
আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াসের কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মাধ্যমে। প্রথমে তিনি জগন্নাথ কলেজে প্রভাষক পদে যোগদান করেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি মিউজিক কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে নিযুক্ত হন, অতঃপর প্রাইমারি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিচালক পদের দায়িত্ব পান, এছাড়াও ঢাকা কলেজের বাংলার প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে নিষ্ঠা সহকারে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে তিনি মফিজউদ্দিন শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর পরিচিত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন এবং গোপনে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন। তাঁর লেখা ‘প্রতিশোধ’, ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’, :খোঁয়ারি’, ‘মিলির হাতে স্টেনগান’, ‘অপঘাত’, ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’, ‘রেইনকোট’ প্রভৃতি গল্পগুলোতে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে তুলে ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধপরবর্তী রাজনৈতিক এবং সামাজিক বাস্তবতার ছবি। পরবর্তী সময়ে, ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠিত হলেও তিনি সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে বাকশালে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেয়েও যোগ দেন নি।
দাম্পত্য জীবন, Married Life
প্রখ্যাত সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৭৩ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। দাম্পত্য জীবনে সঙ্গী হিসেবে পেয়েছিলেন সুরাইয়া তুতুলকে।
শিক্ষকতার পাশাপাশি সাহিত্যচর্চা, Teaching as well as literary practice
শিক্ষকতার পাশাপাশি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ছোটগল্প, প্রবন্ধ এবং উপন্যাস ইত্যাদি লেখার কাজে সক্রিয় ছিলেন। কবিতার প্রতিও বিশেষ ঝোঁক ছিলো তাঁর, লিখেছিলেন বেশ কিছু কবিতা, তবে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কবিতা কখনো প্রকাশ করা হয়নি। ১৯৭৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ প্রকাশিত হয়েছিল; কিন্তু আখতারুজ্জামানের বাচনশৈলী সাধারণ পাঠকদের কাছে প্রথমদিকে বেশ দুর্বোধ্য লেগেছিলো।
১৯৮৭ সালে তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘চিলেকোঠার সেপাই’ প্রকাশিত হয়েছিলো। এছাড়াও আলোড়ন সৃষ্টিকারী আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অন্য একটি উপন্যাস হল ‘খোয়াবনামা’। এই ‘খোয়াবনামা’কে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি বলা হলেও আখতারুজ্জামানের ইলিয়াসের ছোটগল্পগুলোও সমালোচকদের প্রভূত প্রশংসা কুড়িয়েছিল। তাঁর রচনাগুলো ছিল বিশ্লেষণধর্মী। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর বইগুলি-তে রাজনীতির স্বাদ পাওয়া যায় এবং নিজের লেখার মাধ্যমে তিনি সমষ্টি ও ব্যক্তিকে সমান মর্যাদা দিয়েছিলেন।
সাংগঠনিক তৎপরতা, Organizational activities
প্রথিতযশা সহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বেশ কিছু সময়ের জন্য বাংলাদেশের এক অন্যতম প্রধান প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বাঙলাদেশ লেখক শিবির”- এর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এছাড়াও ১৯৮৪ সালে ‘সাহিত্য শিবির’ নামে একটি প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংঠনের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।
গ্রন্থতালিকা, List of books
মুক্তমনা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস শুধুমাত্র তাঁর সাহিত্যিক গুণমাণের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করেননি, বরং লেখার মানের দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন। তাঁর সাহিত্যকর্মে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, দারিদ্র্য, শোষণ এবং বঞ্চনার মতো বিষয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। তিনি উক্ত বিষয়গুলির মাধ্যমে সমগ্র মানবজীবনকে বোঝার চেষ্টা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সূক্ষ্ম মানসিক প্রবণতা চিত্রিত করার ক্ষমতার জন্য বহুবার প্রশংসিত হয়েছেন।
উপন্যাস
● চিলেকোঠার সেপাই (১৯৮৭)
● খোয়াবনামা (১৯৯৬)
ছোটগল্প সংকলন
● অন্য ঘরে অন্য স্বর (১৯৭৬)
● খোঁয়ারি (১৯৮২)
● দুধভাতে উৎপাত (১৯৮৫)
● দোজখের ওম (১৯৮৯)
● জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল (১৯৯৭)
প্রবন্ধ সংকলন
● সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু (১৯৯৮)
ছোট গল্প তালিকা
● প্রেমের গপ্পো
● রেইনকোট
● জাল স্বপ্ন, স্বপ্নের জাল
● ফোঁড়া
● কান্না
● নিরুদ্দেশ যাত্রা
● যুগলবন্দি
● ফেরারী
● অপঘাত
● পায়ের নিচে জল
● দুধভাতে উৎপাত
● সন্তু
● ঈদ
● মিলির হাতে স্টেনগান
● কীটনাশকের কীর্তি
অপ্রকাশিত লেখা
● করতোয়া মাহাত্ম্য
সম্মাননা, Recognition and honour
সাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সম্পর্কে সমসাময়িক একজন কথাশিল্পী শওকত আলীর লিখেছেন,
“ আখতারুজ্জামানের রচনা পাঠ সাহিত্যামোদীর কাছে সততই আনন্দময় অভিজ্ঞতা।… তাঁর লেখার ভেতর দিয়ে আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাপনের জগৎটির মধ্যেই যে আরও নানান দেখবার ও বুঝবার দিক আছে আমরা তা নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি।”
ইলিয়াসের সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন,
‘ইলিয়াসের উপন্যাস প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বমানের, নোবেল পুরস্কার পেয়ে থাকেন যেসব কথাসাহিত্যিক, তিনি ছিলেন সেই মাপের লেখক।’
পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবী বলেছেন,
“কী পশ্চিম বাংলা কী বাংলাদেশ সবটা মেলালে তিনি শ্রেষ্ঠ লেখক।” তিনি আরো লিখেছেন, “ইলিয়াস-এর পায়ের নখের তুল্য কিছু লিখতে পারলে আমি ধন্য হতাম।”
ইমদাদুল হক মিলন বলেন:
“গত ১৫-২০ বছরের মধ্যে তাঁর এ দু’টি উপন্যাস বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস।”
পুরস্কার প্রাপ্তি, Awards
● হুমায়ুন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৭)
● বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮৩)
● আলাওল সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৭)
● আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৬)
● সা’দত আলি আখন্দ সাহিত্য পুরস্কার(১৯৯৬)
● কাজী মাহবুবুল্লাহ স্বর্ণপদক (১৯৯৬)
● একুশে পদক (মরণোত্তর) (১৯৯৮)
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কিছু কাজ অন্য ভাষায়ও অনূদিত হয়েছে এবং কিছু কাজের অনুবাদ এখনও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ছোটগল্প “রেইনকোট” অবলম্বনে “মেঘমল্লার” (২০১৪) নামক চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে। এছাড়া “খোয়াবনামা” উপন্যাস ভিত্তিক একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছে।
মৃত্যুর সাথে দীর্ঘদিনের লড়াই, A long struggle with death
১৯৯৬ সালের ১৩ই জানুয়ারি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ক্যান্সার রোগ ধরা পড়ে। রোগটি অনেক দেরিতে ধরা পড়ার কারণে তাঁর শারীরিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। একই বছরের ২০ মার্চ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ক্যান্সারে আক্রান্ত ডান পা-টি পুরোপুরিভাবে কেটে বাদ দিয়ে দিতে হয়েছিল। বেশ কিছুদিন উক্ত রোগে শারীরিকভাবে অসুস্থতায় ভোগেন তিনি। অবশেষে ক্যান্সারজনিত কারণেই ১৯৯৭ সালের ৪ঠা জানুয়ারি ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
উপসংহার, Conclusion:
কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তি নিজের অবদানের মাধ্যমে মৃত্যুকে অম্লান করে বেঁচে থাকে আমাদের স্মৃতির মাঝে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাঁদেরই একজন। এই বিখ্যাত লেখককে শব্দ কিংবা বাক্যের কলেবরে পরিমাপ করা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার, তিনি নিজের লেখার গুণগত ব্যাপ্তি দিয়েই নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন। তাই সাহিত্য জগতে কথাসাহিত্যিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের অবদান চিরস্মরণীয়।
সংবাদটি শেয়ার করুন