দেশের চিত্রকলার বিকাশে অসামান্য অবদান শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের। জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জে। জয়নাবুন্নেছা ও তমিজউদ্দিন আহমেদের ছেলে জয়নুল মায়ের সোনার মাদুলী বিক্রির টাকায় চারুশিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন কলকাতায়। দেশের চিত্রশিল্পের নান্দনিক যাত্রা শুরু হয়েছিল যাঁর নিরলস প্রচেষ্টা আর তুলির আঁচড়ে তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন। তার হাত দিয়েই বিশ্বঅঙ্গনে পরিচিতি পায় দেশের চিত্রকলা। মহান এই শিল্পীর ১০৩ জন্মদিন আজ।
নিজের শিল্প-দক্ষতার গুণে ছাত্রজীবনেই সর্বভারতীয় পর্যায়ে সুনাম অর্জন করেন জয়নুল আবেদিন। পরবর্তী কয়েক বছরে আধুনিক ভারতীয় শিল্পীর নামের তালিকায় জায়গা করে নেন জয়নুল। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় চারুকলা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা তাঁর জীবনের এক মহান কীর্তি। শুধু ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা নয়, শিল্পশিক্ষার একটি উন্নত প্রতিষ্ঠান হিসেবে একে গড়ে তুলতেও নিরলস কাজ করছেন তিনি। সমগ্র জাতির মধ্যে তিনি শিল্পশিক্ষার যে বীজ বুনেছিলেন তা আজ পরিণত মহীরুহে। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন। আর মৃত্যু অবধি দেশের চিত্রকলার নেতৃত্বে ছিলেন জয়নুল। ১৯৭৬ সালের ২৮ মে ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন কিংবদন্তি এই শিল্পী।
সংক্ষিপ্ত জীবনিঃ জয়নুল আবেদীন (জন্ম: ২৯ ডিসেম্বর, ১৯১৪ – মৃত্যু: ২৮ মে, ১৯৭৬) একজন বিখ্যাত বাঙালি চিত্রশিল্পী। তিনি শিল্পাচার্য নামে পরিচিত ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত চিত্রকর্মের মধ্যে রয়েছে- দুর্ভিক্ষ-চিত্রমালা, সংগ্রাম, সাঁওতাল রমণী, ঝড় এবং আরো অনেক ছবি। ১৯৭০ সালে গ্রাম বাংলার উত্সব নিয়ে আঁকেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ তাঁর বিখ্যাত ছবি নবান্ন। জন্ম ও শিক্ষাজীবন : জয়নুল আবেদিন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার বর্তমানে কিশোরগঞ্জ জেলার কেন্দুয়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের দারোগা। মা জয়নাবুন্নেছা গৃহিনী। নয় ভাইবোনের মধ্যে জয়নুল আবেদিন ছিলেন সবার বড়। পড়াশোনার হাতেখড়ি পরিবারের কাছ থেকেই। খুব ছোটবেলা থেকেই তিনি ছবি আঁকা পছন্দ করতেন। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফলসহ আরও কত কি এঁকে মা-বাবাকে দেখাতেন। ছেলেবেলা থেকেই শিল্পকলার প্রতি তার গভীর আগ্রহ ছিল। মাত্র ষোল বছর বয়সে বাড়ি থেকে পালিয়ে তিনি বন্ধুদের সাথে কলকাতায় গিয়েছিলেন শুধু মাত্র কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখার জন্য। কলকাতা গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস দেখে আসার পর সাধারণ পড়াশোনায় জয়নুল আবেদিনের মন বসছিল না। তাই ১৯৩৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষার আগেই স্কুলের পড়ালেখার বাদ দিয়ে কলকাতায় চলে যান এবং মায়ের অনুপ্রেরণায় তিনি গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টস-এ ভর্তি হন। তাঁর মা জয়নুল আবেদিন আগ্রহ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করে ছেলেকে কলকাতার তখন আর্ট স্কুলে ভর্তি করান। পরবর্তীতে ছেলে জয়নুল আবেদিনও মায়ের সেই ভালবাসার ঋণ শোধ করেছেন দেশের স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। জয়নুল আবেদিন ১৯৩৩ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত কলকাতার সরকারি আর্ট স্কুলে পড়েন। ১৯৩৮ সালে কলকাতার গভর্নমেন্ট স্কুল অব আর্টসের ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিং ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবন : বাংলাদেশের প্রথম প্রজন্মের শিল্পীদের মধ্যে প্রথমেই যার নাম বলতে হয় তিনি হলেন জয়নুল আবেদীন। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে একটি শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুভূত হয়। জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালে পুরান ঢাকার জনসন রোডের ন্যাশনাল মেডিকেল স্কুলের একটি জীর্ণ বাড়িতে মাত্র ১৮ জন ছাত্র নিয়ে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউটের যাত্রা শুরু হয়। জয়নুল আবেদীন ছিলেন এ প্রতিষ্ঠানের প্রথম শিক্ষক। ১৯৫১ সালে এটি সেগুনবাগিচার একটি বাড়িতে স্থানান্তরিত হয়। ১৯৫৬ সালে গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউট শাহবাগে স্থানান্তর করার পর ১৯৬৩ সালে এটি একটি প্রথম শ্রেণীর সরকারী কলেজ হিসেবে স্বীকৃতি পায়। তখন এর নামকরণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে এবং স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ চারু ও কারুকলা মহাবিদ্যালয় নামে। তিনি ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত এ প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর এই সরকারী কলেজটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভূক্ত হয়। জয়নুল আবেদীন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে লোকশিল্প যাদুঘর ও ময়মনসিংহে জয়নুল সংগ্রহশালা গড়ে তোলেন।
সংবাদটি শেয়ার করুন