২৯শে নভেম্বর ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই অগ্রহায়ণ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১২:৫৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২১, ২০২৩
মোস্তফা মোহাম্মদ
তুমি আকাশ হলে,
আমি বৃষ্টির জল হই,
গড়-গড়িয়ে লুটাই তোমার পায়ের ধুলায়;
স্বার্থের দুনিয়ায়,
নির্মল আকাশ-বাতাস কই,
নির্মাল্য বৈরাগী আজ দুধের পসরা সাজায়,
বসে থাকে ঘাটে, রাধার অপেক্ষায়;
—তেকানি ফকির আর জলিল উধাও; মাসখানেক যাবত এই দুই পাণ্ডার খোঁজ-খবর নাই। হাতরাইয়াও পাওয়া যাচ্ছে না দশদিক।
তেকানি আর তার স্ত্রীর মণ্ডলদের খিলের ভিটার পাটক্ষেতের গহীনের দিনদুপুরের প্রেমলীলাবিষয়ক গল্প এখন ফুলবাড়ির আকাশ-বাতাসের মৌাতাত; বর্ষাকালে বাসন্তি ফুলের গন্ধে চারদিক-মৌমৌ।
‘মাইনসের আর কোনো কাম নাই! ওই শালার তেকানি কী করলো? জলিল শালার-ব্যাটা দুপুর আতোত বাঁশি বাজায়া বাজায়া বাড়িত ফির্যা আসে ক্যা? ক্যাংকা কর্যা পাটক্ষ্যাতোত তেকানি লিজের বউয়ের উপর হাঁটু মারলো!—এই গ্রামের জাউরা চোদারা বালের কথার রসালো গল্প চোদায় দাদা’
—দহপাড়ার ইদ্রিসের দেখা পেয়ে শ্মশানঘাট বরাবর জুলের জমির আউস ধান নিড়ানির সময় ইসমাইলের তেকানিবিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে ইদ্রিস ক্ষোভ প্রকাশপূর্বক উত্তর দেয়।
—গ্রামের মানুষের হাতেনাতে প্রেমের ফাঁদে ধরা খেয়ে তেকানি ইসমাইলের শাসনের যতটুকু-না-ভয়, তার চেয়ে চক্ষুলজ্জায় আজ গ্রামছাড়া, উধাও; তার সাথে দহপাড়ার জলিল আর মুচিপাড়ার নিতাই।
জলিলের কাজই শুধু মণ্ডলদের, মোল্লাদের আর আকন্দদের বাঁশের আড়া যাকে বলে বাঁশঝাড়ের তল্লাবাঁশের সরলসোজাদীঘল আগা আর কঞ্চি খুঁজে খুঁজে কাটা আর বরশির ছিপ বানানো আর বাঁশি তৈরি করা। এই বদ-অভ্যাসের জন্য আকন্দবাড়ির বড়কর্তা খয়েজউদ্দিন আকন্দ বহুবার জলিলের পিঠে বেদম প্রহার করেও এই কুঅভ্যাস থেকে ফিরাতে পারেনি। বাঁশিতৈরি, বাঁশিবাজানো আর মাছমারা—এই তিনের সমন্বিত প্রয়াসই জলিলের জীবন। আর মুচিপাড়ার নিতাই মরাগরুর চামড়া খুলে, জুতা সেলাই করে, ঢোল বাজিয়ে দিন চালায়।
শেরপুর ডি.জে হাইস্কুলের গেটে বসে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত জুতা সেলাই, জুতা-স্যান্ডেলের কারিকুরিতে আর কত আয় করে নিতাই! মাঝে মাঝে ফুলবাড়ির মাঠে আর করতোয়া মহিপুরের চরে গ্রামের মানুষের গরুর পালের চড়েবেড়ানো ঘাসবিছালি লক্ষ্য করে বিষটোপ দিয়ে গরু মারার এবং পরবর্তীতে চামড়া খুলে বিক্রি অথবা জুতা-ব্যাগ-স্যান্ডেল বানানোর কথা ভেসে বেড়ায় মুচিপাড়ার নিতাইদের বিরুদ্ধবাতাসের বিছায়। নিতাই বলি আর জলিল বলি; গণেশ বলি আর তেকানি ফকিরের নামই বলি-না-কেন, সকলেই পেটের দায়ে এই সমস্ত অপকর্মে লিপ্ত।
আর ইসমালের বন্ধু সুবোধ লাহিড়ী ব্রিটিশদের শাসনের বিরুদ্ধে মিছিল-মিটিং করার কালে এই ক্ষুধার্ত শ্রেণিকেই কাছে পায়। ঘোষপাড়া কিংবা দত্তপাড়া, সান্ন্যালপাড়া অথবা সাহাপাড়া থেকে হাতেগোনা কয়েকজন আসে শুধু। আর আসে ফুলবাড়ির গ্রস্মের দিক থেকে ইসমসিলের সহচরগ্ণ। ব্যবসায়ীরা সুবোধের কাজ মহাবিরক্ত; কুলিন-ব্রাহ্মণ কিংবা মাইটা জমিদার কিংবা দত্তপাড়ার অথবা ঘোষপাড়ার ব্যবসায়ীরা লালচোখে তাকায় সুবোধের দিকে৷ তারা বলে: ‘শেরপুর ডিজে হাইস্কুলের হেড মাস্টার উপেন্দ্র লাহিড়ীর ছেলেডা গোল্লায় গেলো। পড়ালেখা বাদ দিয়া সারাদিন শুধু সমান অধিকার নিয়া মাথা ঘামায়।’
এই মুচি নিতাই তেকানি, সুবোধ আর জলিলের খপ্পরে পড়ে জুতা সেলাই বাদ দিয়া ঢোল বানায়, ঢোল বেচে, ঢোল বাজায়—এইভাবে কিছুটা আয়ের মুখ দেখে নিতাই; উপরন্তু তেকানি ফকিরের গানের দলে জলিলের বাঁশির সুরে নিজেকে আবিষ্কার করে নতুনভাবে। তেকানি হরিবাসরের সন্ধ্যায় কিংবা দুর্গাপূজার আরতির অথবা শ্মশান-কালিপূজার কালে গান গাওয়ার ডাক পায়, সাথে জলিল আর নিতাইকে নিয়া শেরপুর শ্মশানের পাকুড় তলায় সন্ধ্যাকালে গানের মহড়া দেয়, যাকে বলে রিহার্সাল। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, রামপ্রসাদী-টপ্পার সাথে তেকানি আর জলিল আর নিতাইয়ের মুখে মুখে বানানো গানের সুরে ভগবান আর ভগবতচিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে শেরপুরের ঘোষ আর দত্ত আর সান্ন্যাল আর ব্রাহ্মণ্যধর্মের মানুষজন চোখ বুজে হরিবোল হরিবোল নামজপ করতে করতে প্রায় স্বর্গের সিড়ি ছুঁয়ে ফেলে। স্বর্গের সিঁড়ি ছুঁয়েও পরক্ষণেই মঞ্চের পেছনে মাটির কলসে রাখা তালের রসে গলা ভিজে এসে আবার গানে তাল দেয়।
নিখোঁজ ফেরারী তেকানি ফকির যাবার কালে সাথে করে নিয়া গেছে বাঁশিয়াল জলিল আর নিতাই ঢোলবাদক।
সেই যে, গেলো আর খোঁজ পাওয়ার বালাই নাই। হঠাৎ গতকাল ভবানিপুরের বিখ্যাত রাণিভবানির মন্দিরের পূজারী-ব্রাহ্মণ ইন্দর ঠাকুরের সাথে ঘোষপাড়ার রাস্তায় দেখা হলে সে খবর দেয়, গতপরশু মন্দিরের বেদীতলে তেকানি ফকির আর বংশীবাদক জলিলকে দেখা গেছে মরমী গানের সুরের দোলায়।
(চলবে)
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com