আমার গুরুগণ: ষাট

প্রকাশিত: ১:৩৯ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৩

আমার গুরুগণ: ষাট

মোস্তফা মোহাম্মদ

 

‘ভজ গৌরাঙ্গ, কহ গৌরাঙ্গ, লহ গৌরাঙ্গের নাম হে’
—বলতে বলতে মরালাশ বাঁশের চাটাই দিয়ে পেঁচিয়ে কাঁচাবাঁশের চাঙ্গারিতে শুইয়ে ঢোল-করতাল বাজিয়ে ঘোষপাড়ার ভেতর দিয়ে দত্তপাড়ার শিবেন দত্তের লাশ ঘাড়ে করে একদল মানুষ শ্মশানের দিকে ছুটছে দেখে ইসমাইল কিছুটা থমকে দাঁড়ায় বেজি ঘোষের বাড়ির বারান্দায়।
একেতো তেকানিকে হারিয়ে তার বউ দিশাহারা হয়ে সারাদিন মণ্ডলদের পুকুর পাড়ে বসে বসে চোখের জল ঝরায়। অন্যদিকে জলিল আর নিতাইয়ের বাড়ির লোকজন দুই পাণ্ডাকে খুঁজতে খুঁজতে ইসমাইলের কাছে ক্ষুধার জ্বালায় বিচার দেয়; আরেকদিকে বন্ধু-সংগ্রামী সুবোধ লাহিড়ীর সান্নিধ্যবঞ্চিত হয়ে ইসমাইলের মন এখন ভীষণ আউলা-ঝাউলা বিষণ্ন-ক্লান্ত।

তেকানি ফকিরের গ্রাম থেকে উধাও হওয়ার খবর বিদ্যুৎগতিতে এলাকার চারিদিক ছড়িয়ে পড়ায় এলাকা সরগরম। হাট-বাজার-মাট-ঘাট উত্তাল তেকানির নিখোঁজের বাওয়ায়: ‘শালার চুদির ভাইদের খায়াপর‍্যা আর কুনু কাম নাই। আতদিন ২৪ ঘণ্টায় খালি তেকানি, আর তেকানি কর‍্যা কর‍্যা সময় কাটায়। মাঙ্কুচোদাদের আর কুনুই কাম নাই, দাদা’
—ঘোষপাড়ার মোড়ে বেজি ঘোষের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে ঘোড়ার পিঠে ওঠার সময় দহপাড়ার ইদ্রিসের চোখে চোখ পড়ায় গতকালের কথার রেশ টেনে ইদ্রিস ইসমাইলের কানে তেকানি ফকির বিষয়ক আগুনের হল্কা অর্থাৎ গ্রামীণ ফুসুরফাসুর-নুসুরফুসুর গুঞ্জরনের এই খবর ব্যাখা করিয়ে বুঝিয়ে দেয়।

শেরপুর শহর এবং ফুলবাড়ি থেকে তেকানির গানের দল উধাও হলেও এলাকায় থেকে যায় দবির মাস্টার আর তার সাঙ্গপাঙ্গ।
দবির মাস্টার, জগজ্যোতি আর দবির মাস্টারের ছেলে কাশেম—এদের একটা গানের দল সারা শেরপুর থানার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গান গায়, বাঁশি বাজায়।
এলাকার সঙ্গীতামোদী মানুষের মাঝে নিজেদের সাঙ্গীতিক জ্ঞানগম্যি ছড়িয়ে বেড়ায়। একদিকে পায় মনের সুখ, অন্যদিকে অর্থসুখ; উপরন্তু, জনমানুষের সান্নিধ্য তাদেরকে নতুন করে বেঁচে থাকার শক্তি ও সাহস যোগায়। ঢোল-ড্রাম-সাইটড্রাম বাজানোর শারীরিক শক্তি এবং ফ্লুট-করোনেট বাঁশি বাজানোর শ্বাসপ্রশ্বাসজনিত হৃদয়জ দম—যাকে বলে অবারিত উদ্দীপনা তারা লাভ করে সুরের নেশার ধোঁয়ায়।

হিন্দু-সম্প্রদায়ের বিয়েবাড়ির বরযাত্রীদের আগমন-অভিবাদন অথবা পূজাপার্বণ কিংবা নবজাতকের অন্নপ্রাশন অথবা মুসলমানের ছেলেপুলেদের মুখেভাত এবং নুনুকাটা; যাকে বলে সুন্নাত কিংবা খাৎনা—নানান উৎসব-আয়োজনে খ্যাপ খাটার মাধ্যমে নিজেরা বাঁচে, অন্যদেরকেও প্রাণিত করে রাখে সর্বক্ষণ।
এছাড়াও ফুটবল-হাডুডু-দাঁড়িয়াবাঁধা-গোল্লাছুট ইত্যাদির বাৎসরিক আয়োজন তো লেগেই থাকে। উপরন্তু, স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের বার্ষিক পুরস্কার বিতরনীর দিনে ঢোল-করতাল-বাঁশি ইত্যাদির বাজনার আমোদিত আবহ শেরপুর থানার গণ্ডি পেরিয়ে পশ্চিমের নন্দীগ্রাম, পুবের ধুনট, দক্ষিণের রায়গঞ্জ-সিরাজগঞ্জের বাতাসকে মুখরিত করে দেয়। মধুময় জ্যেষ্ঠ মাসের কেল্লা-পশির মেলায়; যাকে বলে মাদারীপীরের মেলা; অথবা আষাঢ়-শ্রাবণের বর্ষণমুখরিত দিনে করতোয়ার কাশিয়াবালায় বাঙ্গালি নদীর সঙ্গমস্থলে অথবা ভস্তার বিল এলাকায় কিংবা ঝাঁজোর খেয়াঘাট এলাকার সাংবাৎসরিক নৌকাবাইচের দিনেও দবির মাস্টারের গান ও বাঁশির দল; বিশেষত, ব্যন্ডপার্টির দলের উপস্থিতি অনিবার্য হলেও তেকানি ফকির-জলিল-নিতাই—এদের চর্চা ও মনন-জগত আলাদা; ঈশ্বরচিন্তা, ভক্ত ও ভগবত আরাধনা এদেরকে আচ্ছন্ন করে রাখে সর্বক্ষণ।

দবির মাস্টার-কাশেমদের চর্চিত জীবনবোধ আর তেকানি-জলিল-নিতাইয়ের সুরালোক সম্পূর্ণ আলাদা হলেও এলাকার মানুষের সার্বিক মনোরঞ্জন এবং কল্যাণের এবং রসবোধের জন্য উভয়েরই দরকার এই কথা ইসমাইল বেজি ঘোষের দইঘরের বারান্দার চেয়ারে বসে বেজি ঘোষের সাথে আলাপের ছলেই ভাবনায় খেলে যায়। কিছুটা অন্যমনস্ক দেখে বেজি ঘোষ জিজ্ঞাসা করতেই ইসমাইল উত্তর দেয়:
‘না কিছু না; ভাবছি সুবোধের কথা—ব্রিটিশ পুলিশের দল সুবোধকে ধরার জন্য রীতিমতো তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে, আর সেই তাড়া খেয়ে পালিয়ে পালিয়ে দিন পার করছে বন্ধু সুবোধ।
ভাবছি আগামি কয়েকদিনের মধ্যেই জামালপুরের দিকে এগিয়ে যাবো; রবি নিয়োগীর সাথে তাকে দেখা গেছে’–একথা সারিয়াকান্দির চানবাড়িয়া গ্রামের ইজতুল্লা সরকারের ছেলে কাশেম ফুলবাড়ির মোল্লাবাড়িত তার ফুফুকে দেখতে এসে বলে গেলো:
‘মিয়াভাই, বাজান পরশুদিন জমির মামলার হাজিরা দিতে গিয়া জামালপুর মহকুমা কোর্টের বারান্দা থিকা নামবার কালে রবি নিয়োগীর সাথে সুবোধের দেখা পাছিলো। আপনার বন্ধু সুবোধ বাজানোক চিনবার পায়া সালাম দিয়া আপনার কথা জিগাছিলো। এখনও ভুলে নাই। ওইযে, আপনার সাথে আমাগোরে বাড়িত গেছিলো সেই কথা এখনও ভোলে নাই।’
—ভোলার কথাও নয়, ইজতুল্লা সরকারের বাড়ির মেহমানদারির কথা, খাওয়া-দাওয়ার কথা সর্বজনবিদিত। আর ইসমাইলের বন্ধু বলে কথা, স্বয়ং ইসমাইলের সাথে বন্ধু সুবোধ; ইজতুল্লা সরকারের মেয়ে মরিয়ম মেহমানদারির কাজে ফারাক রাখবে কেন?—নানাবিধ চিন্তায় আচ্ছন্ন ইসমাইল উঠে দাঁড়ায় বেজি ঘোষের দইবারান্দার চেয়ার থেকে।
বেজি ঘোষের কাছ থেকে দই, ঘি নিয়ে বাড়ির ছোট চাকর মজিবরকে দিয়ে পাঠিয়ে ঘোড়ায় উঠে থানা কাউন্সিলের প্রয়োজনীয়তা বাদ দিয়ে সুবোধের মায়ের বাড়ি উলিপুর মসজিদের দিকে ঘোড়া ছোটাতেই ঘোষপাড়া হয়ে ফুলবাড়ি খেয়াঘাটের দিকে থানার দারোগা লোকমান হাকিম আর তিন সেপাইকে যেতে দেখে ঘোড়ার লাগাম টেনে ঘোড়া থামায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ইসমাইল সম্বিত ফিরে পেয়ে ঘোড়াকে নির্দেশ দেয় সুবোধের বাড়ির পথ ধরার জন্য। মনিবের কথায় একদৌড়ে ঘোড়া গিয়ে থামে কাকীমার বাড়ির দৌড়গোরায়। কড়া নাড়ার শব্দে দরোজা খুলে দিলে ইসমাইল কাকীর পা-ছুয়ে প্রণাম জানিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস কতেই কাকী জানায়: ‘গতরাতে সুবোধ এসেছিলো আমার সাথে দেখা করার জন্য। বেশিক্ষণ দেরি করে নাই। সুবেহ-সাদিকের আগেই বাড়ি থেকে বের হয়ে চলে যায়। জানিয়ে যায়, ফুলবাড়ি হয়ে পূর্বদিকে অজানার উদ্দেশে যাবে, তার গন্তব্য আমার জানা নাই, বাবা।’
—ইসমাইল পুলিশের গতিবিধি সম্পর্কে স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হয়। বিভ্রান্ত ইসমাইল, কিছুটা সুবোধ, কিছুটা তেকানি; অনেকাংশেই তার একাকিত্ব জীবন—চরম বিষাদ আর অসুখী ব্রিটিশ-শাসন তাকে অন্তরে অন্তরে বিদ্রোহী করে নতুন আলোর দিশায় ঘোড়া ছোটায়।

(চলবে)