মোস্তফা মোহাম্মদ
সুবোধের দুই হাতে দুই মুঠি সোনা,
কচুরি আর পানা,
জলডুবিভেঁটফুল মিলনের ছল,
ভস্তার বিলের জল শুধু কলকল,
সারারাত লুটোপুটি গজারবোয়াল ছানা,
অমৃতের পদাবলি মিলনের হানা;
তপ্ত লোহার উপর ডিঙার ঠিকানা,
খাড়িভরা শিঙমাগুরকই,
ফাগুনের দখিন হাওয়ায় করে হইচই,
বাড়িভরা অতিথির স্মৃতির নহর,
ভোজবাজি-ভানুমতি গমগম স্বর,
মুড়িমুড়কিদইখই শতবাহানা;
মুক্তির মিছিল শুধুই,
স্রোত আর মোহনার জ্বালা,
পরাভব খরতাপ জেলের তালা,
মিলনের মহাসুখ আইড়বোয়ালরুই,
নতুন জলের দিশায় বড়ই উতলা,
তিরোহিত তিক্ত-বিরহের ছলা;
–মুক্তি কুণ্ডুর প্রেম আর জেদের কাছে শ্যাম কুণ্ডুদের উদার না হয়ে কী আর কোনো পথ আছে? মুক্তির মা আর জ্যাঠতুতো ভাই যামিনী ডাক্তারের খানিকটা মৌন সমর্থন, কিছুটা প্রচ্ছন্ন সহায়তা আছে মুক্তি-সুবোধের সম্পর্কের বেলায়; এই সমর্থন জুটেছে সুবোধের দেশপ্রেমসঞ্জাত একনিষ্ঠ স্বাধীনতা সংগ্রামী চেতনার জন্য। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী সুবোধ লাহিড়ী শেরপুর ডিজে হাইস্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্র থাকা অবস্থাতেই দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশ সরকারের টেলিগ্রামের তার কেটে দেওয়ার অভিযোগ মাথায় নিয়ে হুলিয়া আসামির জ্বালায় জ্বলেপুড়ে জেলে যাওয়ার পর থেকেই অত্র এলাকার মানুষের মনে সংগ্রামী হিসাবে এবং ভালো মানুষ হিসাবে স্থায়ী আসন গেড়ে বসায় অনেকেই সুবোধের মায়ের সঙ্গে কথা বলে ধন্য হওয়ার চেষ্টা করলেও চালচুলোচাকরিব্যবসাহীন ভাদাইম্যা পাত্রের সাথে নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনার দুঃসাহস কেউ দেখায় নাই। রাজনৈতিক কর্মী কিংবা রাজনৈতিক নেতা অথবা ভালো মানুষ আর ভালো পাত্র সমান নয়; বিবাহযোগ্য পাত্রের ক্ষেত্রে তার পারিবারিক সম্পদ এবং ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রাধান্য পায়। ছেলে স্বাধীনতা সংগ্রামী, নির্ভীক, সাহসী, দেশপ্রেমিক ভালো গুণগুলোর জন্য এলাকার সাধারণ মানুষ ও সুবোধের গৃহিণী মায়ের পাশাপাশি স্কুলশিক্ষক পিতা তারক লাহিড়ীও সবার অলক্ষ্যে গর্ববোধ করতো বৈকি! সমাজবাস্তবতার নিরিখে বৈরি রাজনৈতিক বাস্তবতায় সুবোধের মধ্যে একটা নায়কোচিত মনোভাব যাকে বলে হিরোইজম দেখা দেওয়ায় উঠতি যুবক-যুবতীর কাছে, ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সুবোধের সম্পর্কে একটা আকর্ষণ লক্ষ করা যায়; সেইখানে, সেই সমাজে মুক্তি তো প্রেমে পড়তেই পারে, মানবমনের সহজাত প্রবৃত্তির চাহিদায় প্রেমে পড়াটা দোষের কিছু নয়; এই প্রেম, এই সান্নিধ্য লাভের আকুলতার সাথে রাজনৈতিক আদর্শ-সহায়ক-সান্নিধ্য প্রাচীন মূল্যবোধাক্রান্ত সামাজিক গোয়ার্তুমির বিপরীতে মানসিক সংযোগ-সেতু পার হয়ে দুই পরিবারের মুরুব্বিদের সমাজসিদ্ধ-রীতিপ্রসিদ্ধ প্রস্তাবনার বৈতরণী বেয়ে করতোয়ার ঘাটে নৌকা ভিড়াতে বিশু চৌধুরী আর ইসমাইল মণ্ডলের বন্ধুত্বপ্রবণ কর্তৃত্বদায়িত্বজ্ঞান দক্ষিণা পবনের মতো কাজে দেয়।
নারাণ ঘোষের মিষ্টির দোকানের আড্ডা সেরে বংকুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ইসমাইল সুবোধের মায়ের বাড়ির গেটের কড়া ঝাঁকায়। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের কড়ার ঝাঁকুনিটা একটু জোরেই হয়ে যায় বলে দরোজা খুলে কাকী দাঁড়াতেই ইসমাইল ক্ষমা প্রার্থনা করে আদাব-সালাম জানিয়ে বলে: ‘কাকীমা সুবোধ কোথায়? আজ সুখবর নিয়ে এসেছি কাকীমা–কুণ্ডুবাড়ির লোকজন মুক্তির সাথে সুবোধের বিয়ের প্রস্তাব হাসিমুখে গ্রহণ করে বিয়ের ব্যাপারে সম্মতি জ্ঞাপন করেছেন; আসছে ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহের কোনো একদিন বিয়ে হবে; ওরা এবং আমরা মিলেই দিনক্ষণ ঠিক করে নিবো।’
–ইসমাইল এক নিঃশ্বাসে সুবোধের মায়ের কাছে এই ফিরিস্তি দিতেই সুবোধ স্নান সেরে কলপাড় থেকে গা মুছতে মুছতে ভেজাচুলে ইসমাইলের চোখে চোখ রেখে বলে: ‘আয় বোস, কখন এসেছিস?’
–দুইবন্ধু বারান্দায় পাতানো চেয়ার-টেবিলে বসে সুবোধের মায়ের হাতের লুচি আর আলুর দমে তৃপ্তি মেটায়। নাস্তা শেষে চায়ের টেবিলে সুবোধ, ইসমাইল আর সুবোধের মা পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণপূর্বক আলোচনা শুরুর কালেই সিদ্দিক, সাত্তার আর নিতাই এসে হাজির হয় কাকীর ডেরায়। সকলের উপস্থিতির জোয়ারে সুবোধের বিয়েপূর্ব প্রস্তাবনার ঘটকালিপ্রসূত আনন্দ-বচন এক মহামিলনঘন মোহমুক্তির দিশায় উত্তীর্ণ হয়ে বাড়িটার আগের শূন্যতাকে দূরে ঠেলে দিয়ে আগামী ফাল্গুন মাসে সুবোধের দ্বিগুণ হবার আকাঙ্ক্ষায় দুলতে থাকে; মনে হয় যেন বসন্তের সাজানো বাগান, বিশুষ্ক মরুময় প্রান্তরে ফুটে ওঠা গোলাপ-বকুল। কাকীর উপস্থিতিতে গতকাল বিকাল বেলায় ভোলা ঘোষের দোকানের আড্ডা এবং সুবোধের বিয়ের ব্যাপারে বন্ধুদের দেয়া প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে কাকীর সামনে পুনর্বার উপস্থাপন করায় কাকীমা কিছুটা দুশ্চিন্তামুক্ত এবং নির্ভার হয়ে গভীর মনোযোগ দিয়ে পুত্র সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
কাকীর কৃতজ্ঞতার বাণীর অন্তরালেই ইসমাইলের বুকের বীণায় বেজে ওঠে মিলন আর বিরহের সুর–মিলন বলতে সুবোধের সাথে মুক্তির মিলন যাকে বলে বিয়ে, দীর্ঘ বিরহের পর মধুর মিলন; আর বিরহের সুর বলতে মরিয়মের সাথে ইসমাইলের বিয়ের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষার পালা। ইসমাইল চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে সুবোধের দিকে তাকায়, মনে মনে জানতে চায় কিছু কথা–বিবাহ এবং যৌন মিলন সুন্দর, সৃজনশীল এবং পূর্ণতার নিমিত্তে প্রজন্ম সৃষ্টির উল্লাসে কারো সাথে ধর্মীয়-সামাজিক-সহমর্মিতায় আচরিত জীবনবাস্তবতায় কারো বুকে বুক রেখে ফেনিল সাপের বিষ উগরে দেওয়ার আনন্দখেলা। সুবোধের বাসর ঘর, কিছু আলো কিছুটা অন্ধকার। লতাপাতাফুলপাখির আলোকসজ্জার নীরবতা ফুঁড়ে বেরিয়ে আসছে গান: ‘আমার মুক্তি আলোয় আলোয়….।’–গানের শেষে জুঁই ফুলের গন্ধ, জানালার ফাঁক গলে কুয়াশামাখা ফাল্গুনী চাঁদের আলোয় মুক্তি আর সুবোধের লুকোচুরি খেলা। গানের তালে নৃত্যের দোলায় দুলে ওঠে মন, বেজে ওঠে মুক্তির কাঁকন আর নূপুরের নিক্কণ। মোমের আলোয় মুক্তির প্রতিমা-সদৃশ মুখে চুম্বন করে সুবোধ বলে ওঠে: ‘আমায় উদ্ধার করো মুক্তি, আমি যে বড়ই অধম।’–চায়ের কাপে চুমুক দিয়েই আবার সম্বিত ফিরে পায় ইসমাইল। ইসমাইলের মাঝে মাঝে চিন্তার ভেতর কেন যে এমন হয়, ভেবেচিন্তে নিজের কাছে নিজেই লজ্জা পায়। ইসমাইল ভাবে মানুষ মাত্রেই কী ঈর্ষাপরায়ণ! আড্ডা-আলোচনার মধ্যেই নিঃসঙ্গতার ধূম্রজাল আচ্ছন্ন করে ফেলে গোটা পরিবেশ। চেতন-অবচেতন জগতের কলুষিত ঈর্ষার জাল ছিন্ন করে দ্রুত বেরিয়ে আসে ইসমাইল। সিদ্দিক আর সাত্তারের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলে ওঠে: আসছে ফাল্গুনের প্রথম কী দ্বিতীয় সপ্তাহে তোমাদের দায়িত্ব অনেক, বিয়ের ঝামেলা–সুবোধের বিয়ে বলেই কথা। ইসমাইলের মুখে সুবোধ লাহিড়ীর বিয়ের পাকাপোক্ত খবর শুনে সুবোধের রাজনৈতিক কর্মী এবং যোগ্য হাতিয়ার সিদ্দিক আর সাত্তার খুশিতে আটখানা; দীর্ঘদিনের অপেক্ষার পর চাতকের মুখে একফোঁটা বৃষ্টির জল পড়লে যে তৃপ্তির ঢেউ ওঠে তার বুকে, ঠিক তেমনি সুবোধের আর মুক্তির মিলনের সুর শোনার পর তাদের হৃদয়ের তন্ত্রীতে সুর ওঠে যেন যমুনার ঢেউ। সুবোধের মা আসন্ন বিয়ের খরচাপাতির ব্যাপারে কিছুটা চিন্তিত হলেও মোটেও বিষণ্ন নয়। ইসমাইল, বিশু, ভোলারা যেহেতু বন্ধুর বিয়ের দায়িত্ব নিয়েছে, সেহেতু অনুষ্ঠান আয়োজন করার ক্ষেত্রে কাকীর অনুমতি পেতে বেশি বেগ পেতে হলো না ইসমাইলের। আরেকবার চা খেয়ে সুবোধের সাথে হাঁটতে হাঁটতে ইসমাইল, সিদ্দিক আর সাত্তার ভোলা ঘোষের কাপড়ের দোকানে এসে হাজির হয়।
সুবোধের অনুপস্থিতিতে ভোলা ঘোষের দোকানের আড্ডা জমলেও আজকের দিনের মতো প্রাণবন্ত আড্ডা অনেকদিন হয় নাই; একথা সকলে অনুধাবন করলেও ইসমাইলের চোখে আর মুখে তার উজ্জ্বলতার ছাপই শুধু নয় , মুখ ফুটে বেরিয়ে যায় ফুটন্ত প্রলাপ: ‘নাও ভোলা, শোনো বিশু তোমাদের রসের নাগররে ধরে বেঁধে নিয়া আসলাম; দ্যাখো কী করা যায়, কী করা হবে, কী করলে ভালো হয়–এই বুড়োটার আসন্ন বৈবাহিক কর্ম সম্পাদনের বেলায়।’
–ইসমাইলের হাল্কা-টিপ্পনি-মাখানো মধুর বাক্য মাটিতে পড়ার আগেই ছোঁ-মেরে ঠোঁটে তুলে নিয়ে বিশু চৌধুরী বলে: ‘কী আর করবা বন্ধু, চলো সক্কলে মিলে এই বুইড়াটারে কুণ্ডুবাড়ির ঘাটে করতোয়ার জলে ভাসাইয়া দেই; দেখি ওর মার্ক্সস-লেনিন-এঙ্গেলস আর আমাদের শ্রীমান ভগবান কৃষ্ণ কে কী করেন!’
–বিশুর কথায় গমগম করে ওঠে ভোলা ঘোষের দোকানের গদিঘর। কেউ একজন বলে ওঠে: ‘কুণ্ডুবাড়ির সামনে মিউনিসিপালিটির ঘাটে স্বজ্ঞানে জলে ডুব্যা মরবা তুমি, আর বাঁচাতে আসবে দার্শনিক অথবা অবতার! কথা শুন্যা এক্কেবারে চান্দি গরম হয়া যায়।’–শুরু হয় বন্ধুদের হাসি-আড্ডা-তামাশা যার কেন্দ্রবিন্দুতে সুবোধ আর মুক্তি কুণ্ডুর আসন্ন বিবাহ কার্যের প্রবল চৈতালি-তাপ। তাপভাপচাপলাভপ্রভাব যা-ই বলি-না-কেন একটা শুভাশুভের আমেজ বয়ে যেতে থাকে শেরপুর সকাল বাজারের মাথার উপর ছাতার মতোন দাঁড়িয়ে থাকা বয়সী পাকুড় গাছের প্রকাণ্ড বুকের ভিতর কিংবা সুবোধ লাহিড়ীর অন্তহীন প্রতীক্ষার আগামাথাডগাপাতার ভিতর। সুবোধের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ইসমাইল আর বিশু শ্যাম কুণ্ডুদের বাড়িতে যাওয়ার পর কুণ্ডুদের আতিথ্যের পরশে সিক্ত হয় দুইবন্ধুর হৃদয়। সুবোধের চালচুলোহীন রাজনৈতিক জীবনের সকল দায়ভার এত সহজেই কুণ্ডুরা মেনে নিবে এই কথার দিশামিশা খুঁজে পাচ্ছিলো না ইসমাইল আর বিশু। মুক্তি কুণ্ডুর মা এবং মুক্তির জ্যাঠতুতো ভাই যামিনী ডাক্তারের নির্দেশ অমান্য করার তাগুদ নাই শ্যাম কুণ্ডুর; উপরন্তু মুক্তি কুণ্ডুর সাহস খুব সহজেই বিয়ের ব্যাপারে প্রথাগত সমাজবাস্তবতাকে তুড়ি মেরে আকাশের নীলে উড়িয়ে দেয় এক নিমিষেই। ব্যক্তিক প্রেম বলি আর দেশপ্রেমই বলি-না-কেন তার জন্য প্রয়োজন সততানিষ্ঠাঐকান্তিকতা– সততা আর নিষ্ঠাহীন রাজনৈতিক বোলচাল লুণ্ঠনের জন্য সহায়ক হলেও প্রকৃত দেশ গড়ার কাজে লাগে না, মানুষের মুক্তি মেলে না। শোষিত শ্রেণির হাত থেকে ভারতীয় ভূভাগের মানুষের মুক্তির পাশাপাশি গোটা দুনিয়ার মজদুরের আর্থিক-মানসিক মুক্তির লড়াইয়ের সাথে নিজেকে একীভূত করতে গিয়েই সুবোধের চারিত্রিক দৃঢ়তার গুণেই মুক্তি কুণ্ডুর মন জয় করতে পেরেছিলো সুবোধ। রাজনৈতিক কর্মী থেকে ঘরণীতে পরিণত হবার ক্ষেত্রে আর মাত্র কয়েক দিনের অপেক্ষা মাত্র। ভোলা ঘোষের কাপড়ের দোকান আজ নতুন মহিমায় সমুজ্জ্বল; প্রদীপকাসরঘণ্টা বেজে ওঠার জন্য শুভলগ্নের প্রতীক্ষা মাত্র কয়েকদিন–এইসব আলাপ, খুনসুটির ফাঁকে ফাঁকে গরুর ঘনদুধের চায়ের পরে পানজর্দার মাদকতায় নির্ভার প্রাণোচ্ছল সকলের মন। একটা ঘোরলাগা আলোচনার গতি আরও বেড়ে যায় সিদ্দিক আর সাত্তারের কথায় –সিদ্দিক আর সাত্তারের এদিক আসার সময় যামিনী ডাক্তার রাস্তায় ডেকে বলে: ‘ইসমাইল আর বিশুকে দ্রুত আমার ডিসপেনসারিতে পাঠিয়ে দিও, মুক্তি আর সুবোধের বিয়ের দিনক্ষণ পাকা করে ফেলেছি; ওদের জানিয়ে দিবো পরবর্তী করণীয় বিষয়াদি কী কী।’
–এই কথা বলা মাত্রই সকলের অনুমতি নিয়ে ইসমাইল আর বিশু ছুটে যায় যামিনী ডাক্তারের ডেরায়। বিবাহের পাত্র মাত্রই অবোধ, অবোধ হলেও নির্বোধ নয়; অবস্থানদৃষ্টিভঙ্গিসময়ের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় রেখে শিক্ষিত-বুদ্ধিমান-সচেতন সুবোধ লাহিড়ীও আজ ভরা বরষায় নির্বাক–বন্ধুদের আড্ডায়-আলোচনায় নিজের বিবাহের তরণী বেয়ে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ইসমাইল, ভোলা, বিশুদের মতের উপরই সুবোধ বিশ্বাসী; কারণ এরকম এক দঙ্গল ভালোবন্ধু পাওয়াটা কপালের ব্যাপার!
যামিনী ডাক্তারের ডিসপেনসারির ভেতরে ঢুকেই বিয়ের দিনক্ষণ নির্ধারণের আলোচনার জন্য যামিনী ডাক্তারের ডাকে সাড়া দিয়ে আসা শ্যাম কুণ্ডুর সাথে চোখাচোখি হয় বিশু আর ইসমাইলের। শ্যাম কুণ্ডু আগে থেকেই বসেছিলো সুবোধের বন্ধুরূপী ঘটকদের অপেক্ষায়। সকলের উপস্থিতি টের পেয়ে যামিনী ডাক্তার রোগী বিদায়ের পর এসে যোগ দেয় বিবাহের আলোচনায়। শ্যাম কুণ্ডুর সাথে মোলাকাত করে চেয়ারে বসার পর ইসমাইল ভাবে: ‘মানুষ আসলে দুই সময়ে খায় এক. আনন্দউৎসবে আর দুই. বিরহবেদনায়–আনন্দ বলতে বিবাহঅন্নপ্রাশনজন্মদিন; আর বিরহবেদনা বলতে মৃত্যুজ্বরাক্ষয়ভয়রোগশোক ইত্যাদি; অর্থাৎ সকল বিষয়ের সাথেই বাঙালি সমাজের গড়নের বেলায় খাবারের বিষয়টা ওতপ্রোতভাবে জড়িত।’
–এই ভাবনার ডালপালার অবসান ঘটিয়ে ইসমাইল বিশু আর যামিনী আর শ্যাম কুণ্ডুর দৃষ্টি আকর্ষণপূর্বক সুবোধের বিবাহের দিনক্ষণ ঠিক করার কথা বৈঠকে ছেড়ে দেয়। এই কথা শোনার পর যামিনী ডাক্তার আর শ্যাম কুণ্ডু আগামী ফাল্গুন মাসের প্রথম সপ্তাহের শনিবার সন্ধ্যায় বরাগমন থেকে রবিবার তিথি শুরুর শেষ থেকে রবিবার দুপুরের প্রীতিভোজ পর্যন্ত ১০০ জন বরযাত্রীর সংখ্যা বলেই কথার ক্ষান্ত দিয়ে চা-মিষ্টির প্লেট এগিয়ে দেয়। মিষ্টির রসে মন ভরলেও ১০০ জন বরযাত্রীর সংখ্যা বেঁধে দেওয়ায় দ্বিমত পোষণ করে ইসমাইল। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ঘটকালির সহযাত্রী বন্ধু বিশুর চোখে চোখ রেখে বলে ওঠে: ‘সবকথা মেনে নিলাম বেশ; কিন্তু বরযাত্রীর সংখ্যা ২০০ জনের ব্যবস্থা করতে হবে, কারণ বিয়েটা সুবোধ লাহিড়ীর–সুবোধ সাধারণ ব্যক্তি নয়; একজন প্রকৃত রাজনীতিবিদ। রাজনীতি করার ফলে শেরপুর-ধুনট-নন্দীগ্রাম তথা সমগ্র বগুড়া জেলার সাম্যবাদী তথা কম্যুনিস্ট পার্টির প্রথম সারির অন্তত ৫ জন করে নেতা গোছের মানুষ বরযাত্রী হিসাবে দাওয়াত না পেলে ভীষণ খারাপ দেখায়! কী বলিস বিশু?’
–ইসমাইলের এই প্রস্তাবে বিশু সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানোর সাথেই বিষধর গোমা সাপের মতো ফণা তুলে ফোঁস করে ওঠে শ্যাম কুণ্ডু: ‘এইডা কী রাজনীতির সভা যে সারা জেলার মানুষকে দাওয়াত খাওয়াতে হবে; চাল নাই, চুলা নাই বারদুয়ারি হাটের মতো ঠাঁট; ভেবেছিলাম একমাত্র বোনটার সুখের জন্য একটা ব্যবসায়ী ছেলের হাতে ওকে তুলে দিবো, তাতো আর পারলাম না; শেষমেশ কিছু যৌতুক যেমন খাটপালঙ্কতৈজসপত্র দিয়ে মায়ের বাড়িটা সাজিয়ে ওদের উঠিয়ে দিবো; সে আশায় গুড়ে বালি।’
–শ্যাম কুণ্ডুর অবজ্ঞাসূচক কথা শুনে ইসমাইলের চান্দি গরম হয়ে যায়। কুণ্ডুদের বেনেগিরি এবং কঞ্জুসকুটিলহিসাবিজটিল স্বভাব এই তল্লাটের সকলেরই জানা। ইসমাইল যামিনী ডাক্তারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে: ‘বিয়ের ব্যাপারে কোনোপ্রকার যৌতুক গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হবে; পার্টির নির্দেশ। মুক্তি কুণ্ডু আপনাদের একমাত্র ছোটবোন, তাকে আপনাদের মায়ের নামে কেনা মিউনিসিপালিটির পাশের বাড়িতে থাকতে দিবেন, কথাটা শুনে খুশি হলাম; তবে এই বাড়িটি দিবেন আপনার বোনের সংসার যাত্রার প্রথম প্রথম গুছিয়ে ওঠার জন্য–চিরদিনের জন্য নয়, শ্রেণিহীন সমাজ কাঠামো নির্মাণের একজন যোদ্ধার জন্য সহযোগিতার হাত বাড়ানোর মতো বিষয়টিকে আমরা স্বাগত জানাই; তবে বরযাত্রী ২০০ জনই আসবো প্রস্তুত থাইকেন–চল বিশু আজ যাই, কাজ আছে অনেক।’
–ইসমাইল আর বিশু আলোচনা শেষে উঠে দাঁড়ালে যামিনী ডাক্তার বিদায় জানিয়ে বলে দেয়: ‘ঠিক আছে মশায় শ্যামের কথায় কিছু মনে নেবেন না; শ্যাম আমার ছোটভাই, বরযাত্রী ২০০ জনই পাশ, আসুন দেখা হবে; ভগবান সহায়।’
সংবাদটি শেয়ার করুন