২৮শে মার্চ ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৪ই চৈত্র ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৯:৩৪ অপরাহ্ণ, মার্চ ১৫, ২০২৩
বিমল বিশ্বাস
বৃটিশ-ভারতের নড়াইল মহকুমার নড়াইল থানার গোবরা গ্রামের দক্ষিণ পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন আমার শৈশবের স্বপ্নের নায়ক ডা. জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা
কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা সম্পর্কে কিছু বলার পূর্বে তাঁর নিজ গ্রাম গোবরা সম্পর্কে কিছু বলতেই হয়-কারণ প্রতিটি মানুষকে তার বস্তুগত পরিবেশ দিয়েই মূল্যায়ন করলে সেটিই হয় যথার্থ। গোবরা গ্রামটি আয়তনে উত্তর দক্ষিণ ও পূর্ব পশ্চিমে একবর্গ মাইল। শ্রদ্ধেয় জ্ঞানদা’র পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের পাতানো সূত্রে ছিল আত্মীয়তার সম্পর্ক। যে সম্পর্ক ছিল অনেকটা রক্তের বাঁধনের সম্পর্কেরই মতো।প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাড়া থেকে দক্ষিণ পাড়ায় যাওয়ার জন্য কোনো ভালো কাঁচা রাস্তা পর্যন্ত ছিল না। দায়ি ভিটা থেকে কখনো নৌকা, কখনো তাল গাছের ডোঙ্গাযোগে যাতায়ত করতে হতো। এমনকি কোনো কোনো সময় কর্দমাক্ত পথেও যেতে হতো।শৈশবে মাত্র ২দিনই জ্ঞানদা’দের বাড়িতে গিয়েছি। জ্ঞানদা’ তখন ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়তেন। সেকারণে তাঁর সাথে এমবিবিএস পাশ করে গোবরা বাজারে চেম্বার নেওয়ার আগপর্যন্ত দেখা সাক্ষাত, কথা বার্তা হতে পারেনি।
১৯৪৬ সালে নড়াইলে তেভাগা আন্দোলন গোবরা অঞ্চলের জনগণকে এক লড়াকু মনোভাবের শিক্ষায় দীক্ষায় উন্নীত করেছিল। বৃটিশ সরকার গোবরা বাজারে ১৪৪ ধারা জারি করে তেভাগা আন্দোলনের সমস্ত প্রচারের পথকে রুদ্ধ করতে চেয়েছিল। গোবরা অঞ্চলের লড়াকু কৃষক জনগণ ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে আন্দোলনে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। ১৯৪৬ সালে অবিভক্ত ভারতবর্ষে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গঠিত সর্ব ভারতীয় ছাত্র ফেডারেশনের নড়াইল মহকুমার নেতা ছিলেন কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা। ঐবছরই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ পেয়েছিলেন। জ্ঞান’দারমেট্রিকপাশের সময়কালেগোবরা গ্রামে তাঁর অন্য কোনো সহপাঠী ছিল না।গোবরা গ্রামে তখন হাতে গোনা কয়েকজনই শিক্ষিত মানুষ ছিলেন। নড়াইল মহকুমার হাতে গোনা যে কয়টি প্রতিষ্ঠিত গ্রাম ছিল তার মধ্যে গোবরা গ্রাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। গোবরা থেকে নড়াইল সদর ছিল ৮ কিলোমিটার দূরে। যাতায়াতেরজন্যভালকোনকাঁচারাস্তাওছিলনা।বর্ষাকালেপ্রায় ৬মাস বীড়গ্রাম থেকে নড়াইলে কখনো নৌকা অথবা ডোঙ্গায় যাতায়াত করতে হতো। কখনো কখনো কর্দমাক্ত পানি ভেঙেও যাতায়াত করতে হয়েছে। এই ধরনের একটি গ্রামে কিভাবে নড়াইল সদর মহকুমার হাসপাতালটি গড়ে উঠেছিল তা আমার বোধগম্য নয়। অনুমান করতে পারি গোবরা গ্রামের শ্যামলাল চক্রবর্তী যিনি ছিলেন কুচবিহার স্টেটের সরকারি কলেজের দর্শনের প্রতিভাবান অধ্যাপক। তাঁর বড় ছেলে প্রমথ ভূষণ চক্রবর্তী ছিলেন কুচবিহার স্টেটের মন্ত্রী । অনেকেরই জানা নেই তিনিই নড়াইলের প্রথম মন্ত্রী। শ্যামলাল চক্রবর্তীর দ্বিতীয় পুত্র মম্মথ ভূষন চক্রবর্তী (খোকা চক্রবর্তী) যিনি ছিলেন বৃটিশ ভারতের সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন। কোলকাতা পিজি মেডিকেল কলেজের সার্জনও বটে। ছোট ছেলে বিনয় ভূষণ চক্রবর্তী ছিলেন কোলকাতা স্কটিশার্চ কলেজের ছাত্র। যিনি নেতাজি সুভাষ বসুর সহপাঠি ছিলেন। বিনয় ভূষণ চক্রবর্তীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠেছিল গোবরা পার্ব্বতী বিদ্যাপীঠ। শ্যামলাল চক্রবর্তীর পরিবার যদি গোবরা গ্রামে প্রতিষ্ঠিত না হতেন তাহলে ঐযুগে ঐ সময়ে গোবরার যে উন্নতি তা হওয়া আদৌ সম্ভব ছিল না বলে আমার ধারণা। কারণ পাশের গ্রামের কলোড়ার জমিদারেরা ভূ-সম্পত্তিরমালিক হলেও শিক্ষা দীক্ষায় অনেকখানি পিছিয়ে ছিলেন।সত্তরের দশকের প্রায় শেষ ভাগে নকশাল পন্থীদের দমনের জন্যে কাঁচারাস্তাটি রুপান্তরিত হয়েছিল ইট বিছানো পাকা রাস্তায়। তাহলে বৃটিশ ভারত থেকে শুরু করে ইট বিছানো রাস্তা হওয়ার আগ পর্যন্ত গোবরা গ্রাম কি অজপাড়া গাঁয়েরই অংশ ছিল?
ঘটনার অন্যদিক হচ্ছে গোবরা গ্রামটি চিত্রা নদীর পাড়ে অবস্থিত থাকার কারণে খুলনা থেকে মাগুরা পর্যন্ত ঐ সময়কার বিশাল বিশাল ইস্টিমারও লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করতো।এসব কারণে গোবরা বাজারটি ছিলএকটি বন্দরের মত।ঐ সময়ে গোবরা বাজারে সরকার অনুমোদিত যৌনকর্মীদের একটি আবাসস্থল ছিল। গোবরা বাজার সংলগ্ন হাসাপাতালটি ভারত বিভক্তির পরপরই নড়াইল সদরেই স্থানান্তরিত হয়েছিল। ৪০-এর দশকে গোবরা গ্রামের অজিত রায় ছিলেন বিএ পাশ, প্রফুল্ল শিকদার ছিলেন মেট্রিক পাশ বনমালী বিশ্বাস ছিলেন এলএমএফ পাশ ডাক্তার। অন্য কেউ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। ডা. জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। গোবরা গ্রামের এই বর্ণনার মূল কারণ হচ্ছে তেভাগা আন্দোলনের সময় ডা. জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা ছাত্র নেতা হিসেবে যে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন তা অনেকেরই অজানা। উল্লেখ্য তিনিই হচ্ছেন গোবরা গ্রামের প্রথম কমিউনিস্ট। ঐ যুগে ঐ সময়ে শ্রমিক শ্রেণীই হচ্ছে অগ্রণী শ্রেণী ও শ্রমিক শ্রেণীর পার্টি কমিউনিস্ট পার্টি পুঁজিবাদের কবর খননের মধ্য দিয়ে নতুন সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে বিকাশমান করে মানবসভ্যতা ও প্রকৃতিকে অগ্রগতির পথে এগিয়ে নেবে এই উপলব্ধিতে পৌঁছাতে পারার কাজটি খুব সহজ ছিল না। জ্ঞান’দার মতো একজন বিজ্ঞানমনস্ক মানুষের পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল। এসব কারণেই জ্ঞানদাকে আমি গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতাম। তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিনয়ী, ভদ্র, নম্র স্বভাবের মানুষ। আদর্শবান কমিউনিস্ট হতে গেলে উল্লিখিত গুণাবলী খুবই প্রয়োজন। যে গুণাবলী আজ অনেকের মধ্যেই অনুপস্থিত।
গোবরার পশ্চিম পাশের গ্রাম খলিশাখালী জ্ঞানদা’দের বাড়ি থেকে কয়েকশত গজ দূরেই ছিল। খলিশাখালীর মেঘনাদ বিশ্বাসের ছেলে জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাসও ছিলেনকমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। ভারত বিভক্তির পর জ্ঞানেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ভারতের নদীয়া জেলায়ই থেকে গিয়েছিলেন। তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নদীয়া জেলার কোনো একসময়ের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ছিলেন।
৪০-এর দশকে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে গোবরা গ্রামের সৈয়দ আবুল কাশেম কবিরত্ন ছিলেন একজন প্রগতিশীল মানুষ। ডা. জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা ছাত্রাবস্থায় নাটকেও অভিনয় করতেন। একবার শ্রীকৃষ্ণের ভূমিকায় অভিনয় করতে দেখেছিলাম। অদ্ভুতভাবে শ্রীকৃষ্ণের গায়ের রংয়ের সাথে জ্ঞানদা’র গায়ের রংয়ের চমৎকার মিল ছিল। তেভাগা আন্দোলনের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়ার সময়ে বহুবার গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। তাই এমবিবিএস পাশ করতে জ্ঞানদার অনেক সময় লেগেছিল।
১৯৫৮ সালে আমি যখন চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র তখন আমার বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম জ্ঞানদা’র ডাক্তারি পাশ করতে এত সময় লাগছে কেন?বাবা আমাকে বললেনগ্রেফতার এড়াতে গিয়ে তাকে পালিয়ে বেড়াতে হয়। আমি বললাম কেন?বাবা বললেন জ্ঞানবালা তো কমিউনিস্ট পার্টি করে। আমি বাবাকে অত্যন্ত আগ্রহের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম কমিউনিস্ট পার্টির কাজ কী? বাবা বললেন কমিউনিস্টরা ধনী দরিদ্র্য সবাইকে এক করে ফেলতে চায়। মনে মনে ভাবলাম জ্ঞানদা তো ভালো কাজই করছেন। ঐ যে আমার শৈশবে কমরেড জ্ঞানবালাকে স্বপ্নের নায়ক হিসাবে পেলাম যা পরবর্তীতে কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত হতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র তখন সম্প্রদায় আভিজাত্য ও সম্পদ আভিজাত্যের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য সচেতন ভাবে চেষ্টা করতে থাকি। বাস্তবে আমি কিন্তু তখন কমিউনিস্ট আদর্শ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। কলোড়ার জমিদারদের বিরুদ্ধে আমার বাবার লড়াই ছিল তাদের একচেটিয়া কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে।কিন্তু আমার লড়াইটি ছিল সম্পদ আভিজাত্য ও সম্প্রদায় আভিজাত্যের বিরুদ্ধে। জ্ঞানদা এমবিবিএস পাশ করেই গোবরা বাজারে ১৯৬০ সালে চেম্বার নিয়ে রুগি দেখা শুরু করে দেন। প্রতিদিন বিকেল বেলায় জ্ঞানদার চেম্বারে যে মানুষ গুলো একত্রিত হতেনতার মধ্যে আমার শিক্ষক এলাহী বক্স, প্রফেসর হরিপদ বিশ্বাস (নলদীর চর), আমার আরেকজন শিক্ষক সন্তোষ কুমার মজুমদার (বাকড়ি), হরিপদ বিশ্বাস নড়াইল কলেজ ছাত্র সংসদের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক (গোয়াইলবাড়ি) ও ভবেশ চন্দ্র বিশ্বাস। ঐ চেম্বারের বিপরীতে ছিল ডা. নিরোদ বিহারী বিশ্বাসের চেম্বার। তিনি ছিলেন একজন হোমিওপ্যাথির ডাক্তার। ডা. নিরোদ বিশ্বাসের চেম্বারেই ছিল আমার উঠাবসা। যিনি আমাকে গোপন কমিউনিস্ট পার্টির সাথে সম্পর্কিত হতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিলেন। পাকিস্তান আমলে বেআইনী ঘোষিত পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাথে উপরে উল্লিখিত ব্যক্তিবর্গ সকলেই ছিলেন সম্পর্কযুক্ত।
১৯৬২ সাল থেকে আমি তাঁদের নজরে পড়ে যাই। আমাদের গ্রামের মেম্বার অজিত দত্তের গম চুরিকে ধরে ফেলি এবং এই ঘটনার বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ সংগঠিত করেছিলাম। আগেই উল্লেখ করেছি কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা তিনি ৪০-এর দশক থেকে অবিভক্ত ভারতবর্ষের পার্টির সদস্য ছিলেন এবং ছাত্রনেতা ছিলেন। ঐসময়কালে বৃহত্তর যশোর জেলার কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতা কমরেড শান্তিময় ঘোষ(বাচ্চু ঘোষ), কমরেড অমল সেন, কমরেড নুর জালাল, কমরেড হেমন্ত সরকারসহ ঐসময়কার কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতাদের সাথে ছিল জ্ঞানদার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। পরবর্তীকালে খুলনার কমরেড শচীন বসু, কমরেড রতন সেন, কমরেড নজরুল ইসলাম তাদের সাথেও তিনি ঘনিষ্ঠ ছিলেন।
১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি কমরেড রণদীভের বাম হঠকারী লাইন গ্রহণ করলে কমরেড জ্ঞানবালা ওই লাইনের বিরোধিতা করেছিলেন। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাথে যুক্ত ছিলেন। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মহাবিতর্ককে কেন্দ্র করে কমিউনিস্ট আন্দোলন তথাকথিত মস্কো-পিকিং ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা তিনি তথাকথিত পিকিংপন্থী লাইনের অনুসারী ছিলেন। গোবরা অঞ্চল থেকে খুলনায় চলে যাওয়ার পর তিনি খুলনা জেলার ডা. মাহবুবুর রহমান, ডা. ইয়াসিন সাহেবদের সাথে সম্পর্কিত থেকে মূলত ডাক্তারদের সাথে মিলে সেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করতেন। পার্টির গোপন কাঠামো সেলের সাথে ছিলেন সম্পর্কিত । ঐসময়ই গোবরা গ্রামের ব্যাংকার আব্দুস সাত্তারকে কমিউনিস্ট আদর্শে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছিলেন। বৃহত্তর যশোর জেলার শুড়ো বাগডাঙ্গা থেকে শুরু করে সুন্দরবন সংলগ্ন চালনা, বাজুয়া,লাউডোব, হরিণটানা,কালিকাবাড়ি,খুটাখালী, চুনকুড়ি, কাকড়াবুনিয়া পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি ছিলেন খুবই জনপ্রিয় ব্যাক্তি। বিনা পয়সায় রুগি দেখা থেকে শুরু করে গোবরা অঞ্চলসহ বিস্তীর্ণ এলাকার গরীব মানুষেরা ডাক্তার জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালার অকৃত্রিম সেবা পেয়েছেন।
১৯৭১ সালে পাক সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের উপর আক্রমণ শুরু করলে কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা গোবরা অঞ্চলে চলে আসেন। গোবরা অঞ্চলের মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্কিত ব্যক্তিরা গোবরা অঞ্চলে লুটপাটের উদ্যোগ নিলে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি এমএলের নেতা কমরেড সারোয়ারজান মোল্লার (আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রথম রিক্রুট) নেতৃত্বে ঐ অঞ্চলের পার্টির সহযোগিতায় গণপ্রতিরোধ গড়ে উঠে। ১৯৭১ সালে ২৪ শে এপ্রিল ভোর রাতে পাক রেঞ্জার ও রাজাকারেরা মিলে বড়েন্দার গ্রামে আক্রমণ শুরু করে এবং ব্যাপকহারে রকেট লাঞ্চারের টিয়ার শেলিং নিক্ষেপ করে। সাইফ হাফিজুর রহমান খোকন, বট্ট, তার ভাই হাফিজুর রহমান, ইমরান, সুধাংশু রায় ও আমি মিলে ১৩ জন শক্তিশালী রেঞ্জারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের কেউ মৃত্যুবরণ না করলেও আমরা পিছু হটে রামনগর চর স্কুল মাঠে পৌঁছেছিলাম। পাক রেঞ্জারের আক্রমণে ওই সময় নিহত হয়েছিলেন কলোড়ার হেমন্ত বিশ্বাস ও গোবরার নগেন্দ্রনাথ বিশ্বাস। রামনগর চর মাঠে গিয়েই আমরাপেলাম কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা, প্রফেসর হরিপদ বিশ্বাস, কমরেড ভবেশ চন্দ্র বিশ্বাসসহ অনেককে। আমরা ওখানেই আলোচনার মধ্য দিয়ে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম যেহেতু এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের হিন্দু সম্প্রদায়সহ জনগণকে মুসলিম লীগ ও শান্তি কমিটির আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারবো না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম ঐদিন রাতেই আমরা ঐ অঞ্চলের জনগণ নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে যাতে ভারতে পৌঁছাতে পারে এই দায়িত্বটুকু আমাদের পালন করতে হবে। পথিমধ্যে বাহিরগ্রামের শান্তি কমিটির লোকেরা আমাদের গ্রামের অজিত দত্তের সুন্দরী মেয়েকে ধরে নিয়ে ধান ক্ষেতে শ্লীলতাহানীর চেষ্টা করে। আমরা এগিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ঐ পৈশাচিক প্রবৃত্তির মানুষগুলো পালিয়ে যায়। আমরা সামনের দিকে কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর কলোড়ার জমিদার পরিবারের বিনয় মিত্রের দুইজন সুন্দরী মেয়েকেও বাহিরগ্রামের লোকেরা রেখে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল। আমরা সশস্ত্র ১৩ জন এই হাজার হাজার মানুষের কাফেলাকে নিরাপত্তা দিয়ে বাঘারপাড়া উপজেলার বোয়ালিয়া গ্রাম পর্যন্ত পৌঁছে দেই। আমাদের পার্টির বোয়ালিয়া গ্রামের বিজনের নেতৃত্বে রায়পুরা পর্যন্ত পৌছে দেয়। পরবর্তীতে রায়পুরা থেকে সাত মাইল ও বারোবাজারের মধ্য দিয়েকোটচানপুরে পৌঁছে দেয়। কোটচানপুর থেকেমহেষপুরের গরীবপুর বর্ডার দিয়ে ভারতে পৌছাবার ক্ষেত্রে আমাদের পার্টি সাহায্য করেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ঐ সময়কালে ভারতগামী শরণার্থীরা কি কষ্টকর জীবন যাপন করেছে তা সর্বজনবিদিত। ১৯৭১ সালের ৫ই নভেম্বর নুর মোহাম্মদ ভাই, আবু বকর জাফরুদ্দৌলা দীপু, কমরেড বিষ্টু দর্জি, সুধাংশু রায় ও আমি পশ্চিম বাংলার নদীয়ায় পৌঁছাই। আমি মুর্শিদাবাদে আমাদের ঐ অঞ্চলের যারা ছিলেন তাদের মধ্যে প্রফেসর হরিপদ বিশ্বাস, সন্তোষ কুমার মজুমদার, ভবেশ চন্দ্র বিশ্বাসসহ অনেকের সঙ্গে সাক্ষাত করেছিলাম। ১৯৭০ সালে ইপিসিপি এম-এল শ্রেণীশত্রু খতমের লাইন গ্রহণ করলে কমরেড জ্ঞানেন্দনাথ বালা ঐ লাইনকে তীব্রভাবে বিরোধিতা করেছিলেন। কমরেড অমল সেন, কমরেড নজরুল ইসলামসহ কাজী জাফর রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটি ও কমরেড নাসিম আলীর নেতৃত্বে হাতিয়ার গ্রুপ ও কমরেড হাজী দানেশসহ আরও অনেকে মিলে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (লেনিনবাদী) গঠন করেন। কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা লেনিনবাদী পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন।
কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা খুলনা শহরের লেনিনবাদী পার্টির শাখা কমিটির একজন সদস্য ছিলেন। আমি ১৯৭২ সালে আত্মগোপন অবস্থায় আমার চিকিৎসার জন্য কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালার সাথে সাক্ষাত করেছিলাম এবং ঐ রাতে তাঁর বাসায়ই ছিলাম। পরবর্তীতেও ধর্মসভার কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালার চেম্বারে কয়েকবার আমি গিয়েছি। কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা ৭০ ও ৮০ এর দশকে মূলত ডাক্তারদের সংগঠন নাটাবের সাথে সম্পর্কযুক্ত থেকে পার্টির দায়িত্বপালন করেছেন। আমার সাথে কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালার আত্মগোপন জীবনেও ঘনিষ্ঠ সংযোগ ছিল। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা ডাক্তারদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে ভুমিকা নিয়েছিলেন। ১৯৮৭ সালে কমরেড অমল সেন ও কমরেড নজরুল ইসলামের নেতৃত্বের বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির সাথে আমাদের পার্টিবাংলাদেশের কমিউনিস্ট লীগ মিলে যশোরের বেজপাড়ায় ঐক্য সম্মেলনের মাধ্যমে এক পার্টি গঠন করি। যে পার্টির নাম ছিল বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ। অনেকদিন পর আবার একপার্টিতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম। ১৯৯২ সালে রাশেদ খান মেননের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টি খন্দকার আলী আব্বাসের নেতৃত্বে সাম্যবাদী দল এমএল ও সাধারণ সম্পাদকবিমল বিশ্বাসের নেতৃত্বের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ মিলে পুনর্গঠিত হয় বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টিসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল দল, শ্রেণী-গণসংগঠন, ব্যক্তি, শক্তি মিলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ঘাতক দালাল নির্মূল ও জাতীয় সমন্বয় কমিটি। এই আন্দোলনে কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা খুলনার বুদ্ধিজীবীদের শামিল করবার জন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। খুলনার প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা কমরেড রতন সেনকে স্বাধীনতা বিরোধীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। ঠিক ওই একই সময়ে ঘাতকেরা ডা. জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালাকে হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠায়। কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা ওই চিঠি নিয়ে খুলনা জেলার ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃবৃন্দের সাথে যেমন আলোচনা করেছিলেন তেমনিভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সাথেও আলোচনা করেছিলেন।কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালার পরিবারের প্রচণ্ড চাপ ছিল দেশত্যাগের। শেষ পর্যন্ত পারিবারিক চাপে অন্যদিকে বৃদ্ধ বয়সের কথা চিন্তা করে এক অনিশ্চিত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে গিয়ে কী যে কষ্টকর জীবন কাটিয়েছেন তা বর্ণনা করতে গেলে আমার চোখে পানি চলে আসে। আমি জানি স্বারক গ্রন্থে আরও অনেকে লিখবেন। এই অংশটুকু তারাই বিস্তারিত ভাবে লিখবেন বলে আমার বিশ্বাস। পার্টির প্রয়োজনে আমি যতবারই পশ্চিম বাংলা বা ভারতে গিয়েছি কমরেড বালাকে জানিয়ে যেতাম এবং তাঁর সাথে স্বল্প সময়ের জন্য হলেও দেখা করতাম। যদিও কমরেড জ্ঞানবালার মৃত্যুর কিছুদিন আগে আমি ভারতে গেলেও ঐ সময়ে সাক্ষাত করতে যেতে পারি নাই।
২০১৭ সালে কমরেড আজিজুর রহমান ও তাঁর পুত্র অনিন্দ্য আরিফ উত্তর প্রদেশের শাহরানপুরের নাগলমাফি গ্রামে অল ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন অব ফরেস্ট ওয়ার্কার্সের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ১১ ই এপ্রিল তারা দেশে ফিরে আসেন। ঐসময়ে কমরেড আজিজুর রহমান কমরেড জ্ঞান’দার সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলে বলেছিলেন বিমল বিশ্বাস পশ্চিম বাংলায় আসলে অবশ্যই যেন আমার সাথে সাক্ষাৎ করে। কমরেড আজিজুর রহমান ফিরে এসে আমাকে এই খবর দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০১৭ সালের ২৮শে মে আমি গভীর কুমা থেকে বেঁচে যাই। তারপর আর কলকাতা যাওয়া হয়নি। তাই মৃত্যুর আগে কমরেড জ্ঞানবালার সাথে আমার আর সাক্ষাৎ হয়নি।
১৯৪৬ সালের পার্টি সদস্য কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা ও খুলনা জেলার ছাত্র ইউনিয়নের মেনন গ্রুপের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক কমরেড রণজিত দত্ত। যিনি ৬৮/৬৯ সালে পার্টির সভ্যপদ পেয়েছিলেন। পরবর্তীতে খুলনা পার্টির জেলা কমিটির সদস্য হিসেবেও কমরেড রণজিত দত্ত দায়িত্ব পালন করেছিলেন। প্রায় একই সময়ে কমরেড রণজিত দত্ত দেশত্যাগ করেছিলেন। কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা ও কমরেড রণজিত দত্তের সদস্যপদ দেওয়ার ব্যাপারে আমাদের পার্টির পক্ষ থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসবাদীর পশ্চিম বাংলার রাজ্য কমিটিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে চিঠি দিয়েছিলাম। তাছাড়া আমি নিজেই পশ্চিম বাংলা রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড অনিল বিশ্বাসের সাথে আলোচনা করেছিলাম। তাঁরা বারাসাত অঞ্চলের পার্টি কমিটিকে সভ্যপদ দেওয়ার ব্যাপারে বলার পরেও কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা ও কমরেড রণজিত দত্তকে সভ্যপদ দেয়নি। কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা পরিণত বয়সেই মৃত্যুবরণ করেছেন কিন্তু তাঁর আজীবন লালিত স্বপ্ন শোষণমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নেতৃত্বদায়ী শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির সভ্যপদ থেকে বঞ্চিত হওয়ার যন্ত্রণা নিয়েই মৃত্যুবরণ করেছেন। এটা আমাদের ও আমার জন্য বেদনাদায়ক ঘটনা। কমরেড জ্ঞানেন্দ্রনাথ বালা বাংলাদেশের মাটিতে বিশেষ করে গোবরা অঞ্চল ও খুলনায় কমিউনিস্ট আন্দোলনের মাঝেই বেঁচে থাকবেন বলে দৃঢ় ভাবে বিশ্বাস করি।
বিমল বিশ্বাস: রাজনীতিবিদ ও লেখক
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com