নাদেজদা ফাতেমা শিখা,উপ-সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রেস
ময়মনসিংহ শহরটা আমার প্রিয়, খুব প্রিয়। আমার জীবনের যা কিছু ভালো অর্জন, তার সবটাই এই শহরের মানুষদের ভালোবাসায়।এই শহর এবং শহরের মানুষদের কাছে আমি ঋণী। প্রিয় এই শহর ছেড়েছি প্রায় তেইশ বছর। এই বিচ্ছেদকে সাময়িক বলেই জেনেছি, আজো তাই বিশ্বাস করি।
তেইশ বছর আগে আমি যে শহরকে ছেড়ে এসেছিলাম, তা ছিলো সাম্প্রদায়ীক সম্প্রীতির শহর।অন্যায়ের কাছে মাথা না নোয়ানোর মানুষদের শহর।এ শহর ছিলো মানুষে মানুষে ভালোবেসে মিলেমিশে থাকার শহর। সাহসী,সৎ মানুষের শহর। কিন্তু আজ আমি নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে লজ্জিত বোধ করছি। এ কোন শহর? এই শহরকে তো আমি চিনি না! এটা কেমন কথা? একজন মানুষের কালোটাকা নেই বলে, মানুষটা সন্ত্রাসী নয় বলে কিংবা মানুষটা তথাকথিত সংখ্যালঘু বলে তাকে তার পুর্বপুরুষদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হবে? জাল দলিল তৈরী করে পেশী শক্তির বলে তাদেরকে বাড়ি থেকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করা হবে?
আইন বলে কি কিছুই নেই? টাকার জোড়ে যা ইচ্ছা করার লাইসেন্সটা কোথায় পাওয়া যায়? বিক্রেতাই বা কারা, তা জানাটা আজ খুব জরুরী হয়ে পরেছে। টলমলে মাটিতে শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আর একবার চিৎকার দিতে চাই। মানব জন্মের ঋণ শুধতে চাই ঈশ্বরের কাছে। মানুষের কাছে নতজানু হয়ে বলতে চাই,”আসুন বাঁচি মানুষকে নিয়ে, মানুষের জন্য।”
আসুন, সত্যের জন্য, ন্যায়ের জন্য আমরা একে অন্যের হাতটা শক্ত করে ধরি। তার আগে একটা ঘটনা বলছি শুনুন।ফেব্রুয়ারীর এগার তারিখ, redtimes.com.bd নামের পত্রিকায় প্রকাশিত একটা লেখা আমার এক বন্ধু আমাকে পাঠায়। লেখাটার শিরোনাম’ ময়মনসিংহে ‘ হিন্দু সম্পত্তি দখল’ এবার ভিকটিম আমাদের পরিবার’। লেখক স্নেহাশীষ চৌধুরী। লেখাটা পড়ে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।জানতে পারি যে, ৯ নং মহারাজা রোডের উনাদের বসত বাড়িটা দখলের চেষ্টা চলছে। প্রায় নিঃস্ব এই বনেদী পরিবারটি এখন ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে উদ্বাস্তু হওয়ার অপেক্ষায়।মন কেমন করা লেখাটা আমার বিবেককে নাড়া দিয়েছে প্রচন্ড ভাবে।আহারে! কত কত মধুর স্মৃতি আমার এই বাড়িকে ঘিড়ে।পলাশ এই বাড়ির ছেলে, নির্লোভ সংস্কৃতি কর্মী। দীর্ঘদিন কাজ করেছি ওর সাথে। মানিক ‘দা।এলাকার শ্বশান বন্ধু।আমাদের ভালোবাসার দাদা।প্রয়োজনে,অপ্রয়োজনে মানুষকে বিনে পয়সায় ছবি তুলে দিতে, তার জুরি মেলা ভার। আর একজন শিলু ‘দা। আহারে দাদা, কত লোককে বিনে পয়সায় হাত দেখে তাদের আগামীটা তুমি সুন্দর করে দিতে, অথচ তোমার আজকের অসম্মানগুলো আমরা ঠেকাতে পারছি না গো।এদের মা ক্ষনা মাসীমা বেঁচেছেন মরে গিয়ে। নইলে এক সময় সমাজের প্রতিকুলে গিয়ে গান গেয়ে যে মানুষ, সভ্যতার চাকাকে সামনে নিয়ে গিয়েছিলেন,তার পক্ষে এ অপমানটা সহ্য করা হয়ত সম্ভবি হতো না। এই বাড়ির মানুষগুলো আমার বড় আপন।কত নিঃস্বার্থ ভালোবাসা আমি পেয়েছি উনাদের কাছ থেকে। মানুষ হবার শিক্ষাও তো তাদেরি হাত ধরে। তাই যখন স্নেহাশীষ কাকা তার অসহায় পরিবারের পাশে কাউকে দাঁড়ানোর জন্য ডাক পাঠালেন, তখন ‘ মানুষ’ আমি সাড়া দিলাম।
যোগাযোগ করলাম উনাদের সাথে।সেই পুরোনো কেচ্ছা। যা ময়মনসিংহে প্রায়ই ঘটছে। ভুয়া বিক্রেতা বানিয়ে জাল দলিল তৈরী করে জমি আত্নসাত।তাদের রয়েছে অঢেল টাকা, রয়েছে পেশী শক্তি।শোনা যায় তাদের রাজনৈতিক খুটির জোড়টাও নাকি শক্ত। কেউ কেউ বলেন, এ সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সম্মিলিত কোন প্রতিরোধ না গড়ে উঠার পেছনেও উপরোক্ত কারণগুলোই নিয়ামক হিসাবে কাজ করে।
উনারা জানালেন যে, বাড়িটা ছেড়ে দেওয়ার জন্য প্রকাশ্যে তাদেরকে হুমকি দেয়া হচ্ছে। চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে আছেন তারা। তাদের কাছ থেকেই জানলাম যে, বিষয়টি সর্ম্পকে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার, এডিশনাল পুলিশ সুপার সহ অনেকেই অবহিত আছেন। প্রশাসন তাদেরকে নিরাপত্তার আশ্বাস দিয়েছে। মাঝে দুইদিন একটু খবরা খবর নেয়ার চেষ্টা করলাম। শুনলাম কবি নির্মলেন্দু গুণ নিজে কথা বলেছেন অসহায় পরিবারটির জন্য প্রশাসনের সাথে।কিন্তু আজ হঠাৎ ফোন এলো। ওদের বাড়িতে বে- আইনি ভাবে অনুপ্রবেশ করেছে কিছু গুন্ডা। তারা উনাদেরকে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য করতে চাইছে। ফোন দিলাম স্নেহাশিষ কাকুকে। অসহায়ত্ব উনার কণ্ঠে। অপমানে প্রায় বুজে আসা কণ্ঠে উনি জানালেন যে, বাড়ির একজন অংশীদার মানিক তার পরিবারকে বাঁচানোর জন্য ওদেরকে বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছে। ওরা আপাতত চলে গেছে।
ফোন দিলাম মানিক’দা কে।বিপদে আমাদেরকে সাহস যোগানো মানুষটার ক্ষোভ, অসহায়ত্ব, আর অপমান আমাকে বিবেকের তাড়নায় জর্জড়িত করছিলো।নিজেকেই নিজের কাছে অপরাধী মনে হচ্ছিল।মনে হচ্ছিলো আমিই ওদের সম্পত্তি গ্রাস করছি। ওকে বললাম মনে জোড় আনতে।
বললাম যে আমরা তো পাশে আছি। ও কোন কথাই শুনতে চাইছিল না।উল্টো আমাকে প্রশ্ন করেছিল ওদের জান মালের কোন ক্ষতি হলে তার দায় কি আমি নেব? নকি সে ক্ষতি কেউ পুষিয়ে দেবে তখন? কি বলবো আমি? নিশ্চুপ ছিলাম
নিশ্চুপ ছিলাম লজ্জায় আর ঘেন্নায়।। ওকে কি করে বোঝাই যে সবার সমন্বিত প্রতিরোধে এখনো সব অন্যায় মাটিতে মিশে যায়। দেশটা এখনো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের হাতেই। আমরা এখনো যে কোন অন্যায়কে রুখে দিতে পারি।
দেখলাম ওর বিশ্বাসের ভীতটাই নড়ে গেছে। ওরা বিশ্বাস করে যে সংখ্যালঘু বলে ওদের পাশে কেউ থাকবে না। কি করে ওদেরকে বোঝাই যে ঐ সব অসৎরাই সমাজে সংখ্যালঘু।
জোট বদ্ধ বলে ক্ষমতা দেখায়। আমরাও যুথবদ্ধ হলে ওদেরকে ঠিক রুখে দিতে পারি। ইতিহাস সবসময় সত্যের পক্ষেই থাকে। তারপর সারাদিন যোগাযোগ করলাম অনেকের সাথে।এডিশনাল পুলিশ সুপার আমায় কথা দিয়েছেন, বিষয়টার সুরাহা উনি আইন মেনেই করবেন। উনাকে তো তা করতে হবেই কারণ ঐসব গুন্ডারা যে প্রশাসনকেও বৃদ্ধাংগুলি দেখিয়েছে।
স্নেহাশীষ চৌধুরীর লেখার একটা অংশ তুলে ধরছি-“” সবাই দেখছে যে আমরা শত বছরের পুরানো বাড়িটা ছেড়ে বেরিয়ে আসছি। আমার প্রায় ৮০ বছরের জীবনে এমন অপমান শরীরটা আর নিতে পারছে না; অসুস্থ শরীরেও পরিবারের নিকটজনদের নিয়ে নামছি রাস্তায়; গন্তব্য অজানা। সবাই চুপ- সবার মুখ কি বন্ধ করে রাখা হয়েছে?এও সম্ভব?”
না, এটা যে সম্ভব না আসুন না আমরা সবাই মিলে চিৎকার করে তা জানিয়ে দেই।অসহায় সব মানুষদেরকে আমারা জানাই যে কেউ আমাদের মুখ বন্ধ করে রাখেনি।আসুন আমরা নীরবতা ভাংগি, কথা বলি অন্যায়ের বিপক্ষে।সত্যের পক্ষে। কথা বলি নিজের জন্য কথা বলি অন্যের জন্য। আসুন সবাই মিলে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটা যুদ্ধ জারী করি।
আমাদের এই সোনার দেশটাকে লুটেরাদের হাত থেকে বাঁচাই, শোধ করি মুক্তিযোদ্ধাদের ঋণ।
আসুন বাঁচি ভালোবাসায়,মনুষ্যত্বের অহংকারে।
সুত্র ঃ বাংলাদেশ প্রেস
সংবাদটি শেয়ার করুন