ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
প্রারম্ভকথা
অর্পিতার সাথে আমার পরিচয়টা কাকতালীয়ভাবেই বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের কলকাতা কার্যালয়ে। ‘কথা কম, কাজ বেশি’ টাইপের পার্সোনালিটি অর্পিতা। যখনই দেখা হয়, শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইডের অন্যতম ট্রাস্টি বলেই নয়, যতদূর বুঝি বাংলা ওয়ার্ল্ড ওয়াইডটা তার ধ্যানে-জ্ঞানে, রক্তেও।
সাধারণত খুব বেশি কথা হয় না, তবে শেষবারে হলো। সংগঠনটির কনভেনর বন্ধুবর সৌম্য, কথায় কথায় অর্পিতার বাবার প্রসঙ্গটি টেনে আনতেই আমার নড়ে-চড়ে বসা এবং অতঃপর আমার পীড়াপীড়িতে অর্পিতার মুখ খোলা। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ আর ত্রিপুরা যখন মিলে-মিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল, যখন বাংলাদেশ আর ত্রিপুরার শহীদের মিলিত রক্তধারায় লাল হয়েছিল গোমতির ধারা, তখন সেই বিস্তৃত ক্যানভাসে যে অসংখ্য শিল্পীর তুলির আঁচড়ে আজকের বাংলাদেশের বিজয়গাথার রচনা, তাদেরই একজন অর্পিতার বাবা।
একজন কুলেশপ্রসাদ চক্রবর্তী
অর্পিতার বাবা কুলেশপ্রসাদ চক্রবর্তী, জন্ম অবিভক্ত ভারতের ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত তৎকালীন মহকুমা, আজকে স্বাধীন বাংলাদেশের জেলা কিশোরগঞ্জের গঙ্গাটিয়া গ্রামের একটি অভিজাত জমিদার পরিবারে। তার পিতা গয়াপ্রসাদ তার জন্মের অনেক আগে ১৯০৫ সালে পাড়ি জমান সে সময়কার দেশীয় রাজ্য ত্রিপুরায়। ত্রিপুরার মহারাজা গয়াপ্রসাদের পিতা, কলকাতা হাইকোর্টের আইনজীবী ও পরে বিচারপ্রতি দ্বারিকানাথ চক্রবর্তীকে আজকের বাংলাদেশের সিলেট সংলগ্ন ত্রিপুরার তৎকালীন খোয়াই মহকুমায় যে জমিদারি প্রদান করেছিলেন তার দেখভালের দায়িত্ব পড়েছিল গয়াপ্রসাদের ওপর।
কুলেশপ্রসাদের জন্ম খোয়াইতে ১৯২৪-এ। তার পিতা-মাতার পাচ পুত্র আর দুই কন্যার মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি কুমিল্লায় সে সময়কার নামি প্রতিষ্ঠান ঈশ্বর পাঠশালায়। গয়াপ্রসাদ তার সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করার তাগিদ থেকে কুমিল্লায় চলে এসেছিলেন। কিন্তু তার আগেই দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়ে তার মৃত্যু হলে গয়াপ্রসাদের পরিবার আবার খোয়াইয়ে ফিরে আসেন। সেখান থেকেই কুলেশপ্রসাদ প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করে কলকাতায় আশুতোষ কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন।
সময়টা ছিল ১৯৪১ সাল। চারদিকে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা। কলকাতায়ও পড়ছে জাপানি বোমা। দলে দলে লোক তখন কলকাতা ছাড়ছে। কুলেশপ্রসাদকেও কলকাতা ছেড়ে ফিরে আসতে হয় খোয়াইয়ে। পরের বছর একজন প্রতিবেশীর সাহায্যে ভর্তি হলেন আজকের বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জের একটি কলেজে। কিন্তু বাংলা জুড়ে ততদিনে শুরু হয়েছে মনন্তর। পথেঘাটে অসহায়ভাবে মরছে মানুষ। কুলেশপ্রসাদ এ সময় অসুস্থ হয়ে পড়লে আবারো তাকে ফিরে যেতে হয় খোয়াইয়ে। অনেক চেষ্টায় সুস্থ হয়ে উঠলে এরপর তাকে ভর্তি করা হয় ময়মনসিংহে। সেখান থেকেই ১৯৪৭-এ স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন কুলেশপ্রসাদ।
এ সময় চক্রবর্তী পরিবার আর্থিক দুর্দশার মধ্যে পড়লে অনেকটা বাধ্য হয়ে জীবিকার তাগিদে কুলেশপ্রসাদ ত্রিপুরার মহারাজা সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ১৯৪৯ সালে সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। ছয় মাস প্রশিক্ষণের পর তার প্রথম পোস্টিং হয় কুমিল্লা জেলায় চাকলা-রোশনাবাদে ত্রিপুরার মহারাজা এস্টেটে সহকারী ম্যানেজার হিসেবে। কিন্তু এর মধ্যেই মহারাজার সাথে ভারতীয় ইউনিয়নের চুক্তি কার্যকর হওয়ায় ত্রিপুরা রাজ্য ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে আর কুমিল্লা চলে আসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। কুলেশপ্রসাদও দায়িত্ব পান মহকুমা প্রশাসকের। এর পরের কটি বছর তিনি ত্রিপুরার চারটি মহকুমা এবং উত্তর প্রদেশের আগ্রা সদর মহকুমার অতিরিক্ত মহকুমা প্রশাসকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০ সালে তার পোস্টিং হয় আগরতলা সদর মহকুমায়, মহকুমার প্রশাসক হিসেবে। ১৯৭৬ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত কুলেশপ্রসাদ ডেপুটেশনে দিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে চাকরি করেন। ১৯৮৩ সালে তিনি ত্রিপুরা সরকারের সচিব হিসেবে অবসরে যান।
বাংলাদেশ ও কুলেশপ্রসাদ
১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রায় ১৪ লাখ মানুষের রাজ্য ত্রিপুরা হয়ে ওঠে ১৬ লাখ বাংলাদেশী শরণার্থীর আশ্রয়স্থল। কুলেশপ্রসাদ সে সময় প্রমোশন পেয়ে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলার জেলা প্রশাসকের দায়িত্বে। দক্ষিণ ত্রিপুরায় ছিল বাংলাদেশের শরণার্থীদের বেশ কয়েকটি বড় বড় শরণার্থী শিবির। সে সময় দক্ষিণ ত্রিপুরার প্রধান নির্বাহী হিসেবে বাংলাদেশের এই শরণার্থীদের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন কুলেশপ্রসাদ। বলাই বাহুল্য সীমিত সম্পদ নিয়েও তিনি সেই গুরু দায়িত্বটি পালন করেছিলেন পরম নিষ্ঠায়।
তবে বাংলাদেশের সাথে কুলেশপ্রসাদের যোগাযোগটা এরও ঢের আগে ষাটের দশকের শুরুতে। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী সে সময় ছিলেন শচীন্দ্রলাল সিংহ। ১৯৬৩ সালে বঙ্গবন্ধু প্রায় দশজন সঙ্গী নিয়ে গোপনে আগরতলায় যান।
তাদের অন্যতম ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া। বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় ভারতের সমর্থন আদায়। তার এই গোপন ত্রিপুরা সফরের একমাত্র জীবিত সাক্ষী কুলেশপ্রসাদ। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ আগে থেকেই বঙ্গবন্ধুর এই সফরের বিষয় জানতে পেরেছিলেন। তার নির্দেশে বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মীদের রিসিভ করেন কুলেশপ্রসাদ। সাথে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই উমেশপ্রসাদ। চরম গোপনীয়তার মধ্যে তাদের আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়। আগরতলায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে গভীর রাত হয়ে গিয়েছিল। দুটো জিপে করে বঙ্গবন্ধু ও তার সমকর্মীদের আগরতলায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। গোপনীয়তার জন্য বঙ্গবন্ধুকে রাখা হয় আগরতলা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে। বঙ্গন্ধুর অন্য সহকর্মীদের থাকার ব্যবস্থা হয় অন্যত্র।
এই চিকিৎসা কেন্দ্রেই পরদিন সন্ধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্ররায় সিংহের সাথে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎ হয়। মুখ্যমন্ত্রী বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল ছিলেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর সাথে বঙ্গবন্ধুর প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা করেন। কিন্তু চীনের সাথে মাত্রই এতবড় একটা যুদ্ধের ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই এতবড় আরেকটা ঝুঁকি নিতে নেহেরু রাজি হননি। আগরতলায় প্রায় ১৫ দিন অবস্থান করে বঙ্গবন্ধু সোনামুড়া দিয়ে ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। তবে মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ বঙ্গবন্ধুকে সবরকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেনে।
উপসংহার
কুলেশপ্রসাদের বয়স এখন নব্বই প্লাস। থাকেন দক্ষিণ কলকাতায় একটি ফ্ল্যাটে। প্রায় শয্যাশায়ী কুলেশপ্রসাদের সাথে স্মৃতি এখনও প্রতারণা করেনি। একটি শতাব্দীর তিন-চতুর্থাংশ আর পরবর্তী শতাব্দীর আরও প্রায় এক-চতুর্থাংশ অতিক্রম করে এসে তিনি এখন একটি বিশ্বযুদ্ধ, একাধিক দাঙ্গা আর মন্তত্বর, দেশভাগ, স্বাধীনতা, রাজতন্ত্রের অবসান, গণতন্ত্র, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, জরুরি অবস্থা আর বদলে যাওয়া চারপাশ, বদলে যাওয়া সমাজ আর বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাক্ষী হয়ে বেঁচে আছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসের এই মহান সাক্ষীর প্রতি সশ্রদ্ধ প্রণাম।
লেখক: ডিভিশন প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
সংবাদটি শেয়ার করুন