- তারিক সামিন
কবি রফিক রুদ্র কানাডা এসেছে আজ প্রায় ছয় বছর । টরেন্টোর যে ফ্ল্যাটটাতে সে থাকে সেটি বেশ বড়। গাছ, ফুল, পেন্টিং ছাড়া তেমন কোন আসবাবপত্র নেই। বুক সেলফ আর বইগুলো ছড়িয়ে আছে পুরো বাড়ী জুড়ে।
দরজার টুং-টাং শব্দ করে ডোর বেল বেজে উঠলো। দরজা খুলে দেখে স্কারলেট। তার সেই স্নিগ্ধ হাসি। কালো ওভার কোর্ট এর উপর তখনো তুষার লেগে আছে।
ফরাসিতে ‘বন্ জুহ’, বাংলায় যাকে বলে ‘শুভ সকাল’ সেটি বলে দরজার একপাশে ঘুরে দাঁড়ালো রুদ্র।
‘শুব সোকাল’ আদুরে বাংলায় বলে ফের মিষ্টি হাসলো স্কারলেট।
ওভার কোর্টটা খোলার পর, ঠিক যেন স্বর্গ থেকে আসা কোন দেবী এসে দাঁড়ালো রুদ্রের সামনে। একটা লাল আর ঘিয়া রং এর ঢাকাই জামদানি পরেছে স্কারলেট । ওর সোনালী চুল। উজ্জ্বল দুধে আলতা গায়ের রং, নীল চোখ। কালো সরু বাঁকানো ভ্রু। লম্বা গ্রীবা, তীক্ষ্ণ চোখা নাক আর স্মিত হাসি। শাড়ীতে দীর্ঘাঙ্গীনী এই কানাডিয়ান শ্বেতাঙ্গ নারীকে ঠিক স্বর্গের দেবী মতোই লাগছিল রুদ্রের। রুদ্রের মিউজিক প্লেয়ারে তখন সতিনাথ মুখোপাধ্যায় এর “মরমিয়া তুমি চলে গেলে, দরদি আমার কোথা পাবো, কারে আমি এ ব্যথা জানাবো” বাজছিল।
খুব্ সুন্দর! কার গান? প্রশ্ন করলো স্কারলেট।
সতিনাথ মুখোপাধ্যায়, বললো রুদ্র।
‘সোটি-নাত মুকো-পাধ্যায়’ খুব সুন্দর করে বললো স্কারলেট ।
স্কারলেটকে মৃদু আলিঙ্গন করে রুদ্র বললো -তুমি এসে আমার বিষণ্ণ সকালটা একেবারে সুন্দর রৌদ্র উজ্জ্বল করে দিলে।
তুমি চাইলে, আমি তোমার সারাটা জীবন সুন্দর করে দিতে পারি। আরো সুন্দর করে হেসে বললো স্কারলেট।
স্কারলেটের ভালবাসার জন্য নিজেকে কোন মহামান্য বাদশা, ধনকুবের মতো ভাগ্যবান মনে হয় রুদ্রের।
স্কারলেট তার কোন সহকর্মী কোন কবি বা সাহিত্যিক নয়। আজ থেকে ছয় বছর আগে ও যখন এদেশে প্রথম এসে ফরাসি ভাষা কোর্সে ভর্তি হয়। তখন তার সহপাঠী হিসেবে পরিচয় এই আমেরিকান তরুণীর সাথে। এখন আমেরিকা ছেড়ে কানাডায় স্থায়ী বসবাস করছে স্কারলেট। বাংলাদেশে কোন দিন কোন মেয়ের সাথে প্রেম হয়নি রুদ্রের। স্কারলেটই তার প্রথম ও একমাত্র প্রেমিকা।
অনেক কানাডিয়ানই ফরাসি ভাষায় কথা বলে। ফ্রেন্স এদেশের দ্বিতীয় সরকারি ভাষা। স্কারলেটের হঠাৎ আগ্রহ ফরাসি ভাষার প্রতি। তখন থেকে ইংরেজির চাইতে ফরাসিতে ওরা কথা বলে বেশি। ঠিক বাংলার মতোই মিষ্টি এই ভাষা।
রুদ্রের একটা কাব্য সংকলন অনুদিত হয়েছে ফরাসি ভাষায়। একদিন ক্লাসে রুদ্রের বই থেকে একটা কবিতা পড়ে শিশু বাচ্চার মত কেঁদে ছিল রুদ্রের প্রফেসর সারা বেনসন। এদেশের মানুষ অনেক বই পড়ে। প্রকৃতির তীব্র শীতলতাকে এরা হার মানায় হৃদয়ের উষ্ণতা দিয়ে।
স্কারলেটের কাছে কবিরা হচ্ছে মহান মানুষ। সেই শ্রদ্ধা থেকে; ভালবাসায় রূপান্তরিত হলো স্কারলেট আর রুদ্রের সম্পর্ক। রুদ্র মাঝে মাঝে ভাবে, পৃথিবীর সব চাইতে নিখাদ ভালবাসা বোধকরি পারস্পারিক শ্রদ্ধা থেকে অর্জিত।
যৌবন চলে গেল, পৌঢ়ত্ব ছুঁয়েছে শরীর। দিন দিন খালি হয়ে যাচ্ছে মাথার চুল। সাদা হচ্ছে দাঁড়ি-গোঁফ। একদা অনেক সুদর্শন ছিল রুদ্র। শুধু কবিতা লিখে এই ছিল তার অপরাধ। কোন বাংলাদেশী নারী কখনো তাকে বলেনি ভালবাসি কবি। কোন প্রকাশক কখনো বলেনি, আজ কিছু রয়েলটির টাকা নিয়ে যান কবি। বাংলাদেশে অনেক ভিক্ষুকেরও বাড়ী-গাড়ী আছে। ঘুষখোরেরা সমাজের সব চাইতে সম্মানিত মানুষ। সারা জীবন কোন কাজ না করে, শুধু রাজনীতি, চাঁদাবাজি ও টেন্ডার-বাজি করে কত মানুষ কোটিপতি হয়। শুধু লেখকের কিছু হয় না। যে শিল্পের প্রতি, সাহিত্যের প্রতি, মানুষের প্রতি সৎ থাকে তাকে ধুকে ধুকে মরতে হয় । তদবির আর পদস্খলন হলে তবেই জোটে সাহিত্য পদক। পত্রিকার পাতা জুড়ে থাকে অর্থহীন, দুর্বোধ্য কবিতা ও গল্প। কারণ ওতে মানুষের কথা নেই, মানবতার দাবী নেই। নষ্টরা ভীত নয় সে সব সাহিত্যে। টাকা দিয়ে ছাপাতে হয় বই। ফালতু বই এর স্তূপের নিচে ঢাকা পড়ে যায় কালজয়ী সাহিত্য কর্ম। সরকারি পেশিশক্তি আর উগ্রপন্থির থাবার কবলে প্রতিদিন ছটফট করে সাহিত্যের সৃষ্টিশীলতা। ভেজাল ও নিম্ন মানের সাহিত্য কর্ম, ভেজাল ও নিম্ন মানের খাদ্য দ্রব্যর মতোই সহজলভ্য ওদেশে।
অথচ এদেশে লেখকের কি সম্মান! সরকারী বাড়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের রাইটার্স-ইন-রেসিডেন্স এর ভাল সম্মানী। কত সুযোগ সুবিধা। তাদের কবিতা ভক্ত প্রেমিকা আছে। ব্যাংকে টাকা আছে। কবিতা লিখেও জীবনের সব কিছু সুন্দরভাবে চলে যাচ্ছে।
মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করে রুদ্র, একই পৃথিবীর সবাই আমরা মানুষ অথচ মানুষে মানুষে এত পার্থক্য কেন?
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com