ফরিদ কবির
১৯৭৯ কি ৮০ সাল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢোকার অল্পদিনের মাথায় এক কবিবন্ধু তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় বলেছিলেন, ফরিদ, ইনি তুষার দাশ। কবি।
আমি তখন অল্পবিস্তর কবিতা লিখি। কবিমাত্রই তারা আমার কাছে বিশেষ সম্মানের। আমি পরম আগ্রহে তার সঙ্গে হাত মেলালাম!
সেদিন টিএসসিতে ডাকসুর কোনো অনুষ্ঠান চলছিলো। আমার সহপাঠীরা অডিটোরিয়ামের ভেতরে ঢুকে গেছে। আমিও ঢুকতে যাবো, তুষার দাশ বললেন, ফরিদ কলম আছে আপনার কাছে?
বললাম, আছে।
কলমটা দিন তো। তিনি কলমের জন্য হাত বাড়ালেন।
আমি পকেট থেকে কলমটা বের করে তার হাতে দিলাম।
কিন্তু কলমের কাজটা শেষ করে সেটা আমাকে ফেরত দেয়ার বদলে তিনি কী একটা বিষয় নিয়ে আলী রীয়াজের সঙ্গে কথা চালিয়ে যাচ্ছিলেন!
আমি যে কলমের জন্য অপেক্ষা করছি সেটা তিনি এক রকম ভুলেই গেলেন!
আমার সহপাঠী ও বন্ধুরা ভেতরে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে! মিনিট দশেক কেটে যাওয়ার পরেও যখন তিনি কিছুতেই কলমটা ফেরত দিচ্ছিলেন না, তখন আমি কিছুটা অস্থির হয়ে পড়লাম।
কলমটা জার্মানী থেকে আমার এক মামা পাঠিয়েছেন! ঢাকায় এমন কলম দেখা যায় না। ফলে সেটা আমার জন্য বিশেষ কিছুই।
বললাম, তুষার দা, আমার কলমটা…
তুষার কিছুটা বিরক্ত, যেন তার কলমটাই চাইছি আমি। বললেন, আরে ভাই, আপনার কলমটা আমি মেরে দেবো না। আপনি ভেতরে যান, আমি ভেতরে এসে কলমটা দিয়ে দেবো।
কী আর করা! সিনিয়র কবি বলে কথা। আমি কলম না নিয়েই ভেতরে চলে গেলাম। নিশ্চয়ই তিনি কলমটা ফেরত দিয়ে দেবেন।
না। সেদিন তিনি আমার কলমটা হারিয়ে ফেলেছিলেন! কলমটা আমার এতোই প্রিয় ছিলো যে সেটা হারানোর কথা জেনে আমি খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম।
আমাকে শান্ত করতে সেদিন তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেছিলেন, একটা সামান্য কলমের জন্য আপনি এমন করছেন কেন? আমি একটা কলম কিনে দেবো আপনাকে!
এমন লোকের সঙ্গে কোনো রকম সম্পর্ক আমার না হবারই কথা। কিন্তু নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে বারবার এই মানুষটার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বেড়েই চললো। এতোটাই যে এক সময় কলমটা ফেরত নেয়ার বিষয়টা মুখেই আনতে পারলাম না!
সাঁইত্রিশ বছর আগে সেই যে তার সঙ্গে আমার দেখা এরপর আমাদের সম্পর্কে উত্থান ছাডা কোনো পতন ঘটেনি। বরং অবস্থা এমনই হয়েছে, আমার সকল আনন্দ ও বেদনার সাক্ষী হয়েছেন, বিপদে পাশে থেকেছেন, এমনকি তিনি আমার এতোটাই পরীক্ষিত বন্ধু হয়ে উঠেছেন যে, তার সঙ্গে জীবনের যে কোনো বিষয় নিয়েই দ্বিধাহীন আলাপ করতে পারি। তার সহায়তা চেয়ে পাইনি এমন কখনো ঘটেনি। ঘটেনি যে এতে এটা বুঝতে অসুবিধে হয় না, তিনিও কিছুটা ভালোই বাসেন আমাকে। কিছুটা। কিংবা হয়তো অনেকটাই।
কিন্তু তাকে আমার ভালো না বেসে উপায় নেই। কারণ আমার কাছে তিনি ভাইয়ের চাইতেও বেশি, বন্ধুর চাইতেও বেশি কিছু।
আজ তুষার দাশের জন্মদিন।
আজ এটাই সর্বান্তকরণে প্রার্থনা- প্রিয় তুষার দা, অনেকদিন বাঁচুন আপনি।
আমার বয়স থেকে ধার দিতেও আমি রাজি, তবু আপনি আমার চাইতে একদিন হলেও বেশি বাঁচুন, যাতে জীবনের শেষ দিনটিতেও কোনো বিপদে আপনার সাহায্য থেকে বঞ্চিত হতে না হয়।
শুভ জন্মদিন, প্রিয় তুষার দা।
(কলমের দাবি কিন্তু কোনো অবস্থায় ছাড়ছি না!)
সংবাদটি শেয়ার করুন