স্বর্ণদ্বীপের নিরুপমা
পর্ব : ১
প্রায় হাজার বছর আগে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে একটা ভূখণ্ড জেগে উঠেছিলো। কোনো এক পরিব্রাজক এটা আবিষ্কার করেন। কালক্রমে সেখানে বসতি গড়ে ওঠে। বর্তমানে এটা একটা ডিজিটাল সমৃদ্ধ নগরীতে পরিণত হয়েছে। নগরের অধিবাসীরা একে নিঝুমদ্বীপ বলেই ডাকে।
বন্ধুরা, আজ তোমাদের সেই নিঝুমদ্বীপের গল্পই বলছি, শোন।
নিঝুমদ্বীপের বাদশাহ ছিলো আকবর আলী। তাঁর মৃত্যুর পর বাদশাহ হলেন, তাঁর উত্তরসূরী একমাত্র পুত্র হিকমত আলী।
##########################
বিশ পঁচিশ বছরের যুবক শিক্ষক পার্থ সুর করে করে ক্লাশে পড়াচ্ছেন। তার সাথে সাথে ক্লাশের ছেলেমেয়েরা তার সাথে সুর করে বলে ওঠছে :
সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি
সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।
বেশ কয়েকবার বলার পর পার্থ বলে: সবার মুখস্থ হয়েছে?
ছেলেমেয়েরা সমস্বরে চিৎকার করে বলে : জি স্যার।
পার্থ অনেকটা হাসি মুখে জিজ্ঞেস করে: এবার বলো তো, গতকাল সারাদিনে কে কয়টা ভালো কাজ করেছো?
ক্লাসের সব ছেলেমেয়েরা পার্থের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।
পার্থ আবারও জিজ্ঞেস করে : কী? তোমরা সবাই চুপ করে আছো কেন? তোমরা কি গতকাল সারাদিনে একটাও ভালো কাজ করোনি?
সবাই নিশ্চুপ। যেন পিনপতন নীরবতা!
পার্থ মিলার দিকে তাকিয়ে বলে : মিলা?
মিলা স্থানীয় এক আইনজীবীর মেয়ে। ও যে এক স্বচ্ছল পরিবারের মেয়ে পোশাকআশাক দেখেই বুঝা যায়।
মিলা মাথা নিচু করে জবাব দেয় : না স্যার।
পার্থ হাসি মুখে বলে: গতকাল সারাদিনে একটা ভালো কাজও করোনি?
মিলা চুপ করে থাকে। দু'হাত একত্র করে কচলাতে থাকে।
পার্থ এবার জীর্ণ শীর্ণ পোশাক পরা মালতির দিকে চোখ রেখে বলে : মালতি?
সে উঠে দাঁড়িয়ে বলে : জি স্যার।
পার্থ : গতকাল কোনো ভালো কাজ করেছো? আমি তো তোমাদের সবাইকে ডেইলি একটা করে ভালো কাজ করতে বলেছিলাম।
মালতি ক্লাশের ছেলেমেয়েদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে একবার দেখে নিয়ে বলে: জি স্যার। করছি।
সবাই ওর দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।
মালতি সাধারণ পরিবারের মেয়ে।
মিলা মনে মনে বলে : মালতির মতো মেয়ে ভালো কাজ করেছে? কী ভালো কাজ করলো? ভাবে ভালো কাজ করলো? একটা ডাহা মিথ্যা কথা বলে ফেললো স্যারকে?
পার্থ : কি করেছো?
মালতি অনেকটা দ্বিধাগ্রস্থ কণ্ঠেই বলে: গতকাল সন্ধ্যায় আমার মায়ের ভীষণ মাথা ব্যথা করছিল। আমি আমার মায়ের মাথা টিপে দিয়েছি।
সবাই সমস্বরে হেসে ওঠে : হা হা হা হা ....
পার্থ টেবিলে ডাস্টার দিয়ে সজোরে আঘাত করে বলে: স্টপ! কীপ সাইলেন্ট!
ছেলেমেয়েরা মুহুর্তেই চুপ হয়ে যায়।
মিলা মালতির দিকে তাকিয়ে বলে: এটা আবার ভালো কাজ হলো না কি?
মালতি ততক্ষণে দ্বিধা কাটিয়ে ওঠে। দৃঢ়তার সাথে পার্থের দিকে তাকিয়ে বলে: স্যার, এটা ভালো কাজ না?
মিলা ঠোঁট বাঁকিয়ে মালতির দিকে আড়চোখে তাকায়।
পার্থ নিজেকে সামলে নিয়ে বলে: ভেরি গুড জব। ফ্যান্টাস্টিক জব। এরচেয়ে ভালো কাজ তো আর হতেই পারে না!
শাহেদ এবার ঝটপট দাঁড়িয়ে বলে: স্যার?
পার্থ শাহেদের দিকে তাকিয়ে বলে : হুঁ। শাহেদ বলো।
শাহেদ হাসিমুখে বলে : স্যার, গতকাল স্কুল থেকে ফেরার পথে দেখি একটা ছোট বাচ্চা দৌড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছিল। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তাকে তুলে দিয়ে একটু আদর করে দিতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। সে দৌড়ে বাড়ি চলে গেল। এটা কি ভাল কাজ?
পার্থ : অফকোর্স। ইট ইজ গুড এ্যা জব। এই বয়সে তোমার জন্য এর চেয়ে ভালো আর কী কাজ থাকতে পারে তা আমার জানা নাই। খুব ভালো কাজ করেছো।
অরুণ দাঁড়িয়ে বলে : স্যার, আমি আমার বাবার সাথে বিকালে মাঠে গরুর জন্য ঘাস কাটতে গেছিলাম।
এভাবে একে একে অনেকেই বলতে থাকে। মিলা ড্যাবড্যাব করে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
পার্থ : হুঁ। লিসেন টু মি। মা-বাবাকে তাদের দৈনন্দিন কাজে হেল্প করা, সেগুলোও অবশ্যই ভালো কাজ। বাড়ির বাইরেও এমন অনেক ছোটখাট ভালো কাজ করার আছে। আর এভাবেই তোমাদের মধ্যে আস্তে আস্তে ভালো কাজ করার মানসিকতা গড়ে ওঠবে।
মিলা বেশ গর্ববোধ করে বলে : আমাদের তো কাজের লোক আছে। ওরাই সবকাজ করে ফেলে। আমাদের আর কিছু করতে হয় না। মাম্মির অসুখ হলে ডাক্তার আঙ্কেলকে ফোন দিলেই চলে আসে।
মালতি মিলার দিকে একবার আড়চোখে তাকায়। এরপর পার্থের দিকে তাকিয়ে বলে: অনেক সময় কাজের লোকের কষ্ট হবে ভেবে নিজের কাজ নিজে করে ফেলাটাও ভালো কাজের মধ্যে পড়ে, তাইনা স্যার?
মিলা মালতির দিকে কটাক্ষ করে তাকিয়ে থাকে।
পার্থ গম্ভীর কণ্ঠে বলে : হুঁ। অফকোর্স। সেটাও ভালো কাজ। সবসময় পর মুখাপেক্ষী না হয়ে মাঝেমধ্যে নিজের কাজ নিজে করে ফেলাই ভালো। তোমরা অবশ্যই প্রতিদিন কিছু না কিছু এরকম কাজ করবে। তাইলেই তোমাদের ভালো কাজ করা হয়ে যাবে। মনে থাকবে?
ক্লাশের সব ছেলেমেয়ে সমস্বরে বলে: জি স্যার। মনে থাকবে।
পার্থ: ওকে। আসো, এবার আমরা গতকালের পড়াগুলো...।
স্কুল ছুটির পর পার্থ বাড়ির দিকে হাঁটা দেয়। কিছু দূর আসতেই সে শুনতে পায় দু'জন লোক যেতে যেতে বলছে ।
প্রথম জন : জানো ভাই, আমাদের উত্তুরের পাহাড়ে না কি সোনার খনি পাওয়া গেছে? আমাদের রাজ্য না কি এখন অনেক ধনী হয়ে যাবে?
দ্বিতীয় জন : কে বললো তোমারে?
প্রথম জন : ঐ যে, বাদশাহর লোকেরা বলাবলি করছিল। সেখান থেকেই তো শুনলাম।
দ্বিতীয় জন : তাই নাকি?
প্রথম জন :হুম! এবার যদি আমাদের দুঃখ ঘোচে। দ্বিতীয় জন: আমাদের বাদশাহর ছেলে বাদশাহ হইছে। তাঁর সাঙ্গপাঙ্গরা রাজ্যটারে একেবারে রসাতলে ডুবাইয়া দিল! দুর্নীতির আখড়া বানাইয়া দিল! দুর্নীতির আখড়া বানাইব না? শুনছি, বাদশার ছেলে বাদশাহ না কি জলসা ঘরে মদ খাইয়া ঘন্টার পর ঘন্টা পইড়া থাকে।
প্রথম জন: থাকুক পইড়া। এসব রাজা-বাদশাহরা করেই। আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা হইলাম, আদার ব্যাপারি। আমাদের কী দরকার জাহাজের খবর লওয়েনের? এবার আল্লাহ যদি আমাদের দিকে চোখ তুইলা চায়। স্বর্ণ তুলতে হইলে অনেক লোকের দরকার হইব। তখন যদি কিছু কাজের সুযোগ আসে। কাজের বদলা স্বর্ণ পাওয়া যাইব।
প্রথম জনের চোখমুখে খুশির আভাস দেখা যায়।
পার্থ সামনে এসে দাঁড়ায়।
পার্থ : হুম! আর সেই খুশিতে তোমাদের পেটটা একেবারে ঢোল হয়ে গেছে, তাই না? তোমরা ভাবছো, বাদশাহ তোমাদের স্বর্ণ দিয়ে মুড়িয়ে দেবে? বাদশাহ তোমাদের কেজি কেজি স্বর্ণ বিলোবে আর তোমরা চাকা চাকা স্বর্ণের খণ্ড মাথায় নিয়ে নাচবে?
প্রথম জন মুখ বাঁকিয়ে চলে যায়।
দ্বিতীয় জন : না, মাস্টার মশাই। গরীবের জন্য কিছুই জোটে না। আমাদের মাটি কাইটাই খাইতে হইব। স্বর্ণ কি আর আমরা চোখে দেখব? তবে মনির ভাই বলছিল, কাজ ত একটা জুটব? এর বিনিময়ে...।
পার্থ : যাও, যাও। অত খুশি হওয়া ভালো না। একরত্তি স্বর্ণও তোমাদের ভাগ্যে জুটবে না, এ আমি বলে রাখছি .....। একজন তো আমাকে দেখেই উল্টো দিকে হাঁটা দিলো! বাহ্! তোমরা মনে করো আমি বাদশাহর বিরুদ্ধে কথা বলি। এইটা মোটেও ঠিক না। আমি দেশের মানুষের ভালোর জন্য কথা বলি।
পর্ব : ২
বাদশাহ হিকমত আলি সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁকে ঘিরে তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ চেলা দাঁড়িয়ে আছে। বাদশাহর দু'পাশে মন্ত্রীবর্গ সারিবদ্ধভাবে বসে আছে।
বাদশাহ পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে লক্ষ করে বলেন: মন্ত্রী সাহেব বলুন তো, আজকের আন্তর্জাতিক খবর কী ?
পররাষ্ট্র মন্ত্রী : বাদশাহ নামদার। আমাদের পাশের রাজ্যে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। ওখানে এখন নির্বাচন চলছে। জনগণ ভোটের মাধ্যমে রাজা নির্বাচন করবে। নির্মল চন্দ্র রায় আর সুধীর চক্রবর্তী, এই দুজনের মধ্যে তুমুল ভোটের লড়াই চলছে।
বাদশাহ : হা হা হা হা .....। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা! এইটা ত মূর্খে শাসন। জনগণ ভোটের মাধ্যমে রাজা নির্বাচন করবে! হা হা হা হা....। বলেন তো দেশের কয়টা লোক এসব বুঝে?
মন্ত্রীরা কেউ বাদশাহর কথার জবাব দেয় না।
বাদশাহ একটু থেমে বলেন: হুঁ। তাহলে কে হবে ঐ রাজ্যের অধিশ্বর? মানে .... মানে রাজা আর কী?
এবার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন : নির্বাচনে এখন পর্যন্ত নির্মল চন্দ্র রায় এগিয়ে আছেন। সুধীর চক্রবর্তী অনেক পিছিয়ে আছেন। চক্রবর্তী ঘোষণা দিয়েছেন ভোট গণনায় কারচুপি হয়েছে। তাই তিনি উচ্চ আদালতে মামলা করবেন।
বাদশাহ : এবার বুঝলেন ত, গণতন্ত্র মানে কী? গণতন্ত্র মানেই ঝামেলা। যত্তসব জগাখিচুড়ি কথাবার্তা!
অর্থমন্ত্রী বলেন : সেই ছোটকাল থেকে শুনে আসছি রাজা মরলে তাঁর ছেলে রাজা হয়। আর বাদশাহ মরলে তাঁর ছেলে বাদশাহ হয়।
বাদশাহ বলেন: ঠিক বলছেন। আমার বাবা এই নিঝুম দ্বীপের বাদশাহ ছিল। তিনি গত বছর মারা যাওয়াতে আমি বাদশাহ হইছি। ব্যস। কোনো ঝুট ঝামেলা হয় নাই। কোনো অর্থকড়িও খরচ হয় নাই।
অর্থমন্ত্রী: গণতন্ত্র! সেই দেশের লোক গণতন্ত্র গণতন্ত্র কইরা মইরা যায়! সেইটা আবার কি জিনিস? বাপের জন্মেও তো শুনি নাই!
পররাষ্ট্র মন্ত্রী: শুনবেন কেমনে? আপনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী? দেশের বাইরের কোনো খবর রাখেন? আমাদের দেশে ত রাজতন্ত্র চলে সেই কয়েকশ' বছর ধইরা...।
অর্থমন্ত্রীর মুখ দেখে মনে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কথায় একটু মনক্ষুণ্ণ হলেন।
বাদশাহ: রাজতন্ত্রই হইল আসল দেশ শাসন। নাইলে দেশের মানুষও ঠিক থাকে না আর দেশের উন্নয়নও হয় না।
হঠাৎ বাদশাহের জ্যোতিষীর দিকে চোখ পড়লে বলেন : জ্যোতিষী সাহেব, আপনি আবার ঐখানে বসে কী করছেন?
জ্যোতিষী : বাদশাহ নামদার, আগামী একবছর আপনার কেমন যাবে, সেটা গণনা করে দেখছি।
বাদশাহ সিংহাসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। একটু ভেবে সামনের দিকে এগিয়ে বলেন : কাল থেকে আপনার ছুটি।
অবাক হয়ে জ্যোতিষী বলে : ছুটি!
বাদশাহ : হুঁ।
জ্যোতিষী : এর মানে কী?
বাদশাহ : এর মানে, আগামীকাল থেকে আপনার আমার দরবারে আসা বন্ধ।
জ্যোতিষী : মাফ করবেন বাদশাহ নামদার । আপনি কি আমার সাথে রসিকতা করছেন? বিশ বছর ধরে আমি আপনার বাবার ভবিষ্যত গণনা করে আসছি...। গত একবছর আপনার...
বাদশাহ জ্যোতিষীর কথা শেষ হতে দেয় না।
বিস্ফারিত চোখে বলে: আমি তোমার সাথে রসিকতা করছি? তোমার তাই মনে হলো? আশ্চর্য! তোমার হিম্মত তো কম নয়! একথা বললে কী করে?
বাদশাহ সবাইকে লক্ষ করে বলেন : সবাই শুনুন। আমি ভাগ্যে বিশ্বাস করি না। কর্মে বিশ্বাস করি। এই, কে কোথায় আছো? এক্ষুণি এই জ্যোতিষীকে আমার দরবার থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও। আমি এই রাজ্যের বাদশাহ। আমি নিজহাতে কর্ম করে আমার ভাগ্য নির্মাণ করবো!
কিছু লোক এসে জ্যোতিষীকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে যায়।
শিল্পমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন : মন্ত্রী সাহেব, আপনার খবর বলুন।
শিল্পমন্ত্রী : বাদশাহ নামদার। আমার সালাম গ্রহণ করুন। রাজ্যের উত্তুরের যে উঁচু পাহাড়টা আছে, এর পেছনে এক বিশাল স্বর্ণের খনি পাওয়া গেছে।
বাদশাহ : আলহামদুলিল্লাহ। খুব খুব খুশির খবর দিলেন!
শিল্পমন্ত্রী : এই স্বর্ণ উত্তোলন করে যদি রাষ্ট্রীয় কোষাগারে সংরক্ষণ করা যায় বা বিদেশে রপ্তানি করে অনেক অর্থ উপার্জন করা যায় তবে ....
বাদশাহ : তবে কি আর বলতে? আমি এই রাজ্যের অধিপতি। আমি এই রাজ্যের নতুন নামকরণ করবো।
শিল্পমন্ত্রী : কী নাম? আমাদের দ্বীপের নাম তো আছেই, নিঝুমদ্বীপ!
বাদশাহ : নিঝুমদ্বীপ আর নয়। স্বর্ণদ্বীপ। এবার এর নাম হবে স্বর্ণদ্বীপ! একসময় এই দ্বীপ নিঝুম ছিল। এখন আর নেই। আর আমি হবো এই স্বর্ণদ্বীপের একমাত্র বাদশাহ,অধিশ্বর। দিকে দিকে এই স্বর্ণদ্বীপ ও আমার নাম ছড়িয়ে পড়বে।
দরবারের সবাই সমস্বরে বলে: 'জয়, বাদশাহ হিকমতের জয়।'
অর্থমন্ত্রীকে লক্ষ করে বাদশাহ বলেন : এবার আপনার বক্তব্য বলুন।
অর্থমন্ত্রী একটু নড়ে চড়ে বসে বলেন: বাদশাহ নামদার, গুস্তাকি মাফ করবেন। সেজন্য অনেক অর্থের প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় কোষাগার একেবারেই শূন্য। আপনার পূর্ব পুরুষেরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার একেবারেই শূন্য করে রেখে গেছেন। এই স্বর্ণ উত্তোলন করতে বিদেশ থেকে এক্সপার্ট, ইঞ্জিনিয়ার আনতে হবে। প্রচুর শ্রমিক প্রয়োজন। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। এরজন্যও প্রচুর অর্থের প্রয়োজন।
বাদশাহ : হুঁ। ঠিক বলেছেন। আমার পূর্ব পুরুষদের ছিল প্রজা অন্ত প্রাণ। দুস্থ প্রজাদের মাঝে সব অর্থ কড়ি বিলিয়ে দিয়েছেন। শোনেন মন্ত্রী! আমি আর সেরকম ভুল কিছুতেই করবো না! কাল থেকে যত খাত আছে সবখানে টেক্স বসিয়ে দিন। কেউ যেন টেক্স ফাঁকি দিতে না পারে সেদিকে সার্বক্ষণিক নজরদারি করবেন। দেখবেন, বছরান্তে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আবার অর্থের প্রাচুর্য খেলা করছে।
অর্থমন্ত্রী খুশিতে গদগদ কন্ঠে বলে : জি, বাদশাহ নামদার।
বাদশাহ এবার শিক্ষামন্ত্রীর দিকে লক্ষ করে বলে: তা মন্ত্রী সাহেব, আপনার কী অবস্থা?
শিক্ষামন্ত্রী : কী আর বলবো, বাদশাহ নামদার! আমার শিক্ষা খাতের তো তথৈবচ অবস্থা! এটা তো একটা লস প্রজেক্ট। আমাদের রাজ্যে তো শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ফ্রি। বিনামূল্যে বই বিতরণ হচ্ছে। সবাই ভালো ভালো পাস দিচ্ছে। কিন্তু চাকরি পাচ্ছে না। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, কলকারখানা, ছোটবড়ো কোম্পানি, কোথাও কর্ম খালি নাই। তাই বেকারের সংখ্যা দিন কি দিন বেড়েই যাচ্ছে। তাদের তেমন টাকাও নাই যে বিদেশে গিয়ে...কিছু একটা করবে। আর সেই বেকার যুবকেরা আপনার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠছে।
বাদশাহ : আদিখ্যেতা! দেশের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া শিখে বিদ্যায় দিগগজ হবে! সব আমার পূর্ব পুরুষের কাজ! ওরাই এই শিক্ষা খাতটাকে এক্কেবারে ধ্বংসের পথে ঠেলে দিছে। আর এক্ষুণি যদি এর লাগাম টেনে ধরা না যায় তবে আমার এই রাজ্যের অধিশ্বর হওয়াটাই বৃথা হবে, বুঝলে মন্ত্রী?
শিক্ষামন্ত্রী : জি বাদশাহ নামদার।
বাদশাহ: মাথায় শিক্ষার বস্তা নিয়ে যেকোনো সময় আমার প্রাসাদে হামলা করতে পারে। আমার রাজ্যে কোনো লস প্রজেক্ট বলতে কিচ্ছু থাকবে না। কাল থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। দেশের ছেলেমেয়েরা কাজ শিখবে, কাজ। যদি বিত্তশালী, জজব্যারিস্টার, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করতে চায়, তাদের জন্য বিদেশে লেখাপড়ার ব্যবস্থা করে দেব। সেদিকটা না হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীই দেখবে।
শিক্ষামন্ত্রী বিস্ময় প্রকাশ করে বলে: তাইলে আমার কী হবে, বাদশাহ নামদার?
বাদশাহ : তোমার পদও কাল থেকে ভেনিশ!
মন্ত্রী : ভেনিশ?
বাদশাহ : হুঁ। ভেনিশ।
বাদশাহ অর্থ আর শিল্প মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন : কী বলেন মন্ত্রী মহোদয়?
অর্থমন্ত্রী হেসে বলে : জি ভেনিশ। খুব খুব ভালো হবে।
শিল্পমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীর সাথে তাল মিলিয়ে বলে : জি, ভেনিশ! খুব ভালো হবে। শিক্ষা না থাকলে শিক্ষামন্ত্রী দিয়ে কী হবে?
বাদশাহ গম্ভীর কণ্ঠে টেলি ও যোগাযোগ মন্ত্রীকে লক্ষ করে বলেন : কাল থেকে শিক্ষামন্ত্রীর মুখ আমি দেখতে চাই না। আর রাজ্যের সর্বত্র সকল প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা, প্রচারের ব্যবস্থা করা হোক।
টেলি ও যোগাযোগমন্ত্রী আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বলে : তথাস্তু , বাদশাহ নামদার। আপনি যা হুকুম করেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করা হবে। আমি কালই দেশের সকল মিডিয়াতে তা প্রচারের ব্যবস্থা করছি।
একথা শুনে শিক্ষামন্ত্রীর হাসি মাখা মুখখানা বিবর্ণ হয়ে যায়। সে মনে মনে বলে: আমি কি নিজের কাটা গর্তে নিজেই পড়ে গেলাম?
বাদশাহ শিক্ষামন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলেন : কী ব্যাপার? আপনি এখনও দাঁড়িয়ে আছেন?
শিক্ষামন্ত্রী বিনয়ের সাথে বলে: বাদশাহ নামদার, আমি একটা কথা বলতে চাই ।
বাদশাহ কঠিন কণ্ঠে বলে: আমি তোমার কোনো কথা শুনতে চাই না। এই, কে কোথায় আছিস? একে প্রাসাদের বাইরে নিয়ে যা।
সেই সাথে কয়েকজন সৈনিক এসে তাকে টেনে হিঁচড়ে দরবার থেকে নিয়ে যায়।
শিক্ষামন্ত্রী চিৎকার করে বলতে থাকে : বাদশাহ নামদার, আমার একটা কথা শুনুন, আমার একটা কথা রাখুন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেলে মেধাচর্চার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে। রাজ্যটা মেধাহীন হয়ে যাবে। রাজ্যটা একেবারে ....।
বাদশাহ বিকট শব্দ করে হাসতে থাকেন আর বলতে থাকেন : হা হা হা হা.....। মেধাহীন হয়ে যাবে! মেধা কোথায় যাবে? মেধার কি পা আছে যে হেঁটে হেঁটে অন্য রাজ্যে চলে যাবে? মেধা আমার রাজ্যেই বিচরণ করবে। আমি একে অন্যভাবে কাজে লাগাবো। আর মেধাবী কেউ যাতে এই দ্বীপ ছেড়ে কোথাও যেতে না পারে সে ব্যবস্থা করবো।
এমনসময় বাহির থেকে মিছিলের শব্দ ভেসে আসে।
''চাকরি চাই, চাকরি চাই। যোগ্যতার ভিত্তিতে চাকরি চাই। কর্তৃপক্ষের জবাব চাই। আমাদের কেন চাকরি নাই ?''
বাদশাহ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন : বাইরে শোরগোল কীসের?
অর্থমন্ত্রী তাচ্ছিল্যের সাথে বলেন : ঐ যে পার্থ বসু! ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি কইরা চাকরি না পাইয়া একটা স্কুল বানাইছে। স্কুলে মাস্টারি করে। এখন দল পাকাইয়া আপনার বিরুদ্ধে লাগছে। হুঁ, মিছিল বাইর করছে।
বাদশাহ : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তার আসন ছেড়ে বাদশাহের কাছে এসে দাঁড়ায়।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : জি, বাদশাহ নামদার, বলুন।
বাদশাহ : আমি হুকুম দিচ্ছি। এক্ষুণি যান। কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে ওদের ছত্র ভঙ্গ করার ব্যবস্থা করুন। সৈনিকদের বলুন, পারলে কয়েকজনকে গুলি করে হত্যা করতে। ওরা আমার রাজ্যের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে। যত্তোসব!
সৈনিকরা হুকুম মতো কাঁদুনে গ্যাস ছুঁড়ে মিছিল ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সুযোগ বুঝে কয়েকজনকে গুলি করে। এরমধ্যে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়।
কিছুদিন পর বিদেশ থেকে মোটা অংকের অর্থ খরচ করে এক্সপার্ট আনা হয়। বিজ্ঞানী আনা হয়। বাদশাহ তার দরবারের ঘনিষ্ঠ লোকেদের নিয়ে স্বর্ণের খনি উদ্বোধন করেন। নতুন করে দ্বীপের নামকরণ করেন, 'স্বর্ণদ্বীপ'। সেই অনুষ্ঠান একযোগে দেশের সকল মিডিয়ায় সম্প্রচার করা হয়।
বিজ্ঞানীর প্রশংসায় পঞ্চমুখ।
বাদশাহ দরবারে বসে বিজ্ঞানীকে লক্ষ করে জিজ্ঞেস করেন : কি হে বিজ্ঞানী? তোমার সেই ইম্পর্ট্যান্ট থিওরিটা যেন কী?
বিজ্ঞানী সগৌরবে উচ্চস্বরে বলে : 'Survival is the fittest.' বাদশাহ নামদার, যোগ্যতমরাই পৃথিবীতে টিকে থাকে। এর জন্য যুদ্ধের প্রয়োজন। যুদ্ধ করে যে জয়ী হয়, সেই টিকে থাকে। ক্ষুধা, তৃষ্ণার বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ করে টিকে থাকবে সেই প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে পারবে।
বাদশাহ : হুঁ। আর আমি হবো এর উৎকৃষ্ট মদদ দাতা। এর জন্য যত মদদ লাগে সব আমি দেবো। শ্রমিকদের কম মুজুরি দিয়ে দেশের কাজ করাবো। অল্প খরচে খেয়েপরে...বিনা চিকিৎসায় যারা বেঁচে থাকবে, তারাই আমার রাজ্যে টিকে থাকবে।
বাদশাহ দরবারের অন্যান্য মন্ত্রীদের লক্ষ করে বলেন : কী হে? বিজ্ঞানীর কথাটা কি ঠিক?
সবাই সমস্বরে বলে : ঠিক, ঠিক।
বাদশাহের দুই ঠোঁটের কোণায় হাসি।
বাদশাহ অর্থমন্ত্রীকে লক্ষ করে বলেন : আপনি এর সাথে একমত পোষণ করেন? মানে বিজ্ঞানী যা বলছে...।
অর্থমন্ত্রী আনন্দে গদগদ হয়ে বলে : বাদশাহ নামদার, অবশ্যই আমি একমত। আমিও অর্থনীতির একটা সূত্র আবিষ্কার করছি। এবং সেই নীতিতেই চলি।
বাদশাহ বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন : সেই নীতিটা আবার কী? বলো, তাড়াতাড়ি বলো, শুনি ।
মন্ত্রী : 'ব্যয় কমাও, আয় বাড়াও'। এটা অর্থনীতির মূল কথা।
বাদশাহ : এটা কী বলছো হে? এটা শুধু অর্থনীতির মূল কথা হতে যাবে কেন? এটা যে আমারও মনের কথা। এটা রাজ্যের মূল কথা! ব্যয় কমাতে হবে। আর আয় বাড়াতে হবে।
অর্থমন্ত্রী : বাদশাহ নামদার। আর একটা কথা।
বাদশাহ : আবার কী কথা? যেহেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে, সেহেতু সকল শিশু-কিশোর-যুবকদের আমাদের স্বর্ণ খনিতে খাওয়া-পরার বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে দেয়া যায়। তাহলে আর বিদেশ থেকে উচ্চ বেতনে শ্রমিক নিয়োগ করতে হবে না। জাস্ট কিছু ইন্সট্রাক্টর এনে আমাদের লোকদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করলেই চলবে।
বিজ্ঞানী অভিভূত হয়ে বলে : ইউরেকা! ইউরেকা! আমিও মনে মনে এই কথাই ভাবছিলাম। এরজন্য দৈনিক খাওয়া খরচ হিসেব কষে রেশন কার্ডের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
বাদশাহ : হুঁ। উত্তম প্রস্তাব!
অর্থমন্ত্রী : বাদশাহ নামদার! যদি অনুমতি প্রদান করেন তবে আর একটা কথা যোগ করতে পারি !
বাদশাহ কপাল কুঁচকে বলেন : আর একটা কথা?
অর্থমন্ত্রী : জি, বাদশাহ নামদার।
বাদশাহ : দেরি না করে ঝটপট বলে ফেলুন। যদি স্বর্ণদ্বীপের জন্য কল্যানমূলক হয় তবে অবশ্যই তা গ্রহণ যোগ্য হবে।
অর্থমন্ত্রী : দু-একটা উন্নতমানের প্রাইভেট হসপিটাল রেখে সব সরকারি হসপিটালগুলো বন্ধ ঘোষণা করলে খুব ভালো হয়! সরকারি হসপিটাল মানেই অর্থ অপচয় ....!
অর্থমন্ত্রীর কথাটা বিজ্ঞানী লুফে নিয়ে বলে : জি, বাদশাহ নামদার । আমিও সহমত পোষণ করছি।
বাদশাহ : হুম, এটাও একটা উত্তম প্রস্তাব।
সবাই সমস্বরে বলে: উত্তম প্রস্তাব, উত্তম প্রস্তাব।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী খুশিতে গদগদ হয়ে বলে: তাহলে তো আর কথাই নাই। আমার কাজ অনেক অনেক কমে যাবে। আমি কাজ না করেই বেতন পাবো। পায়ের উপর পা তুলে আরামে আয়েসে জীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।
বাদশাহ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে: কী বললেন? কাজ না করে বেতন নেবেন?
স্বাস্থ্যমন্ত্রীর খুশিমুখে মুহূর্তেই অন্ধকার নেমে আসে।
কাচুমাচু হয়ে আমতা আমতা করে বলে: বাদশাহ নামদার, না। মানে মানে, আমি বলছিলাম কি ঐ গরীব অথর্ব মানুষের চিকিৎসা নিয়ে আমার মাথা ঘামাইতে হবে না। তাইলে শুধু আপনার স্বাস্থ্যের দিকে বেশি করে নজর দিতে পারবো। আর যাদের বিত্ত বৈভব আছে তাদের স্বাস্থ্য ....।
বাইরে শোরগোল শুনা যায়।
বাদশাহ কান পেতে শোনার চেষ্টা করেন।
বাদশাহ : বাইরে কীসের শোরগোল হচ্ছে মনে হয়?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নির্লিপ্ত স্বরে বলে: ও কিছু না, বাদশাহ নামদার। একদল দুষ্কৃতকারী হায়েনা আপনার বিরুদ্ধে নামছে। আমি এক্ষুণি ওদের দমন করার ব্যবস্থা করছি।
সে দরজার কাছে গিয়ে চিৎকার করে বলে: ও রে, কে কোথায় আছিস, ওদের বাঘা বাঘা কয়েকজনকে ধরে বাদশাহর দরবারে নিয়ে আয় তো!
পর্ব : ৩
মিডিয়ায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা প্রচারিত হয়। ঘোষণা অনুযায়ী একদিনের মধ্যে সেই দ্বীপের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। সব স্কুল বন্ধ হলেও পার্থের স্কুল বন্ধ হয় না।
শিক্ষক পার্থ রোলকল করছেন। ইন্দ্র?
ইন্দ্র দাঁড়িয়ে বলে: প্রেজেন্ট স্যার।
পার্থ : গতকাল স্কুলে এ্যাবসেন্ট ছিলে?
ইন্দ্র মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
মালতি: জি স্যার। ও গতকাল ক্লাসে আসেনি।
পার্থ চোখ বড়ো করে মালতিকে বলে: স্টপ। আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি।
ইন্দ্র মাথা তুলে প্রথমে মালতির দিকে তাকায়। এরপর পার্থের দিকে তাকিয়ে বলে: জি, স্যার।
মালতি দাঁড়িয়ে বলে: আমি যখন স্কুলে আসছিলাম তখন ব্রিজের রেলিং উপর বসে ও আমাকে টিজ করছিল।
শিক্ষক পার্থ রেগে চোখ কপালে তুলে বলে: হোয়াট?
মালতি স্পষ্টভাবে বলে: ও বলছিল, 'ও সুন্দরী কই যাস্?পার্থ স্যারের বুলি খাস্!'
পার্থের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। হুংকার দিয়ে বলে : ইন্দ্র, এ কী শুনছি? আমি তোমাকে এই শিক্ষা দিছি ? মালতি আর তুমি একই ক্লাসে পড়ো। ও তোমার বোনের মতো। ওকে তুমি এই কথা বলতে পারলে? তাছাড়া আমি তোমার টিচার। টিচার বাপের সমতুল্য।চুপ করে আছো কেন? জবাব দাও।
ইন্দ্র দাঁড়িয়ে নিচু কণ্ঠে জবাব দেয় : বোনের মতো। বোন তো নয়? আমি স্কুলে আসি বা না আসি, ও বলার কে? ও আমার গার্জেন না কি? তাছাড়া রাজ্যের সব স্কুল বন্ধ। আপনি শুধু স্কুল খোলা রাখছেন।
পার্থ টেবিলে হাত দিয়ে জোর আঘাত করে স্টুডেন্টদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলে: রাজ্যের সব স্কুল বন্ধ হলেও আমার স্কুল বন্ধ হবে না। তোমার ভালো করে শুনে রাখো, কেউ স্কুলে এ্যাবসেন্ট থাকলে ফাইন হবে। একমাসের বেশি এ্যাবসেন্ট থাকলে স্কুল থেকে টিসি দিয়ে দেয়া হবে।
পার্থ মুহূর্ত কয়েক চুপ থেকে অতি কষ্টে রাগ সংবরণ করে ইন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বলে: থাক সে কথা। কোনো গার্জেন যদি মনে করে তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠাবে না, তো পাঠাবে না।
মিলা দাঁড়িয়ে বলে: স্যার, আমার আব্বু বলছে স্কুলে আসতে।
পার্থ মিলাকে বলে : তোমার আব্বুকে থ্যাঙ্কস।
পার্থ ইন্দ্রকে লক্ষ করে বলে: মানলাম, মালতি তোমার বোন না। মনে করো তোমার বোন রাস্তায় বের হলো। তোমার মতো অন্য একটি ছেলে ঠিক একই ভাবে তোমার বোনকে এই কথা বলে টিজ করলো। তখন তুমি কি করতে?
ইন্দ্র মাথা নিচু করেই বলে : স্যরি স্যার। আর এমনটা হবে না।
ক্লাসের সব ছেলেমেয়ে হাসিতে ফেটে পড়ে। ইন্দ্র মাথা নিচু করে থাকে।
পার্থ উচ্চস্বরে বলে : স্টপ। তোমরা হাসছো কেন? এখানে হাসির কী আছে? ইন্দ্র ওর ভুল বুঝতে পারছে। তোমরা সবাই ওকে স্যরি বলো।
ক্লাশের সবাই সমস্বরে বলে: স্যরি ইন্দ্র। স্যরি ইন্দ্র।
পার্থ: ওকে থ্যাঙ্কস জানাও।
সবাই সমস্বরে আবার বলে: থ্যাঙ্কস ইন্দ্র, থ্যাঙ্কস ইন্দ্র।
পর্ব : ৪
মিলা ঘুম থেকে উঠেই বিছানায় বসে মনে মনে বিড়বিড় করে বলে: 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি, সারা দিন আমি যেন ভালো হয়ে চলি।'
এরপর হাত মুখ ধুয়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে। কাজের মেয়েটি ওকে নাস্তা খেতে দেয়। খেতে বসে মিলা হঠাৎ দেখে গ্লাসে পানি দেয়া হয়নি। মিলার যেন পায়ের রক্ত মাথায় উঠে যায়। মিলা চিৎকার করে কাজের মেয়ে নূরীকে ডাকতে থাকে।
নূরী হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলে : আফা, আমারে ডাকছেন?
মিলা : জানিস না, কাউকে খাবার দিলে প্রথমে পানি দিতে হয়?
নূরী : দিতাছি। আমার ভুল হইয়া গেছে, আফা।
মিলা : ভুল হইয়া গেছে?
হাত উঁচিয়ে মিলা মায়ের বয়সী নূরীকে কষে থাপ্পড় দিতে যায়। কিন্তু পরক্ষণেই শিক্ষক পার্থের কথা মনে পড়ে। 'সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি.....
মিলা হাত গুটিয়ে নেয়।
মনে মনে বলে : না। এটা বোধহয় আমার ভালো কাজ হচ্ছে না। মায়ের বয়সী নূরীকে এভাবে....
পর্ব : ৫
ইন্দ্র সেদিন রাস্তা দিয়ে চলে যাচ্ছিল। দূরে ওরই সমবয়সী কয়েকটা ছেলে তাদের চেয়ে একটু কম বয়সী একটা মেয়েকে ঘিরে আছে, হঠাৎ ইন্দ্রের চোখে পড়ে।
ও দ্রুত এগিয়ে গিয়ে বলে : এই যে কী হয়েছে? আমার বোনটাকে একা পেয়ে ...
প্রথম ছেলেটা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে যেন।
: কে তোর বোন? হা হা হা...!
ইন্দ্র মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
মেয়েটা ইন্দ্রকে দেখে মনে মনে সাহস পায়। সে বলে: দেখেন ভাইয়া, ওরা আমার পথ আটকেছে। স্কুলে যেতে দিচ্ছে না।
ইন্দ্র চিৎকার করে জোর গলায় বলতে থাকে:
হ্যাঁ। ও আমার সম্পর্কে বোন। আত্মীয়। তোমরা এক্ষুণি চলে যাও। নইলে ভালো হবে না বলছি। মেরে তোমাদের হাড়গোড় এক করে দেব।
ততক্ষণে শাহেদ কী হয়েছে, কী হয়েছে বলে এসে তাদের পাশে দাঁড়ায়। সেই সাথে আরও কয়েকজন এসে দাঁড়ায়। দুষ্টু ছেলেগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে চলে যায়।
ইন্দ্র মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে : বোন, এবার তোমার পথে তুমি চলে যাও।
পর্ব : ৬
একদিন বিকেলে পার্থ আপন মনে গান গাইতে গাইতে পথ চলছিলো।
'ভালো আছি, ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো......!'
হঠাৎ শ্লোগান শুনতে পেলো। তার মুখের গান থেমে যায়। সে থমকে দাঁড়ায়। পেছনে তাকিয়ে দেখে একটা মিছিল এগিয়ে আসছে। ভালো করে লক্ষ করে দেখে ।
মনে মনে বলে : ঐ যে, সামনের মেয়েটা, নিরুপমা না! হুঁ। নিরুপমাই তো! হোয়াটস দ্যা ম্যাটার? ওর মতো একটা শান্ত মেয়ে মিছিল বের করেছে? কেন? কী হয়েছে?
নিরুপমা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। এবার মাস্টার্স ফাইনাল দেবে। পার্থের তিন চার বছরের জুনিয়র। পার্থের সাথে পরিচয় হবার কিছুদিনের মধ্যেই দুজনার মাঝে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও গড়ে ওঠে। মনে মনে দুজন দুজনকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু পার্থের কোনো ভালো চাকরি হয়নি বিধায় এখনও পর্যন্ত সে তার ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারেনি। আর ভালোবাসাও বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি। তবে তারা দুজনেই মনে মনে সুদিনের প্রতীক্ষায় আছে। বিভিন্ন কারণে অনেক দিন ধরে ওদের দুজনের যোগাযোগও হচ্ছিল না।
মিছিলটা আরও কাছে এগিয়ে এলে শ্লোগানের কথাগুলো পার্থের কাছে স্পষ্ট হয়ে আসে।
শ্লোগান - জবাব চাই, জবাব চাই। কর্তৃপক্ষের জবাব চাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ কেন? জবাব চাই, জবাব চাই। বিচার চাই, বিচার চাই। ধর্ষণের বিচার চাই। বিচার চাই, বিচার চাই। প্রীতি হত্যার বিচার চাই।
পার্থের মনটা আবার বিষিয়ে ওঠে।
মনে মনে বলে : ছিঃ ! আমি শিক্ষক হয়ে এখনও পর্যন্ত বাদশাহর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে মিছিল বের করার সাহস পেলাম না? এটা তো আমার দায়িত্ব ছিলো! নিরুপমা মেয়ে হয়ে প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামছে! অথচ আমি শুধু মাত্র আমার স্কুলটা খোলা রেখেই দায়িত্ব শেষ করছি! গান গেয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছি! শেষের শ্লোগান কী যেন? ধর্ষণ! আবার ধর্ষণ? কে, কাকে ধর্ষণ করলো? কখন? আমি এখনও জানতে পারিনি?
পার্থ দৌড়ে মিছিলের সামনে যায়। নিরুপমাকে থামতে বলে। নিরুপমার কাছ থেকে জানতে চায়, কার এতবড়ো সর্বনাশ হলো, আর কে ই বা করেছে।
নিরুপমা থামে না। এগিয়ে যায়। তার চোখেমুখে অভিমান ফুটে ওঠে।
পার্থ দু'হাত প্রসারিত করে নিরুপমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।
ধমক দিয়ে বলে: থামো নিরুপমা, থামো। বলো, কে, কার এতবড়ো সর্বনাশ করলো?
নিরুপমা তার দলবল নিয়ে থামে। কান্না জড়িত কণ্ঠে বলতে থাকে। সব শুনে পার্থও নিরুপমার মিছিলে যোগ দেয়।
পর্ব : ৭
বাদশাহ তাঁর লোকজন নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। মিছিলের সম্মুখ ভাগে পার্থ আর নিরুপমাকে দেখে বিস্মিত হন।
মনে মনে বলে: আমার রাজ্যে এমন দুঃসাহস দেখায় কে?
ইশারায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলে সে বলে: না, না। তেমন কিছু না।
বাদশাহ : রাস্তায় বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে আর আপনি বলছেন, কিছু না?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বিষয়টি বাদশাহর কানে কানে বুঝিয়ে বললে বাদশাহ বলেন : হুঁ। বুঝতে পারছি।
যোগাযোগ মন্ত্রীকে লক্ষ করে বলেন : হুঁ। কিভাবে এর সমস্যার সমাধান করা যায়, কিছু অনুমান করতে পারছেন কি ্?
যোগাযোগমন্ত্রী : না, বাদশাহ নামদার। কিছুই ত আন্দাজ করতে পারছি না!
বাদশাহ : তোমাদের সবার মাথার খুলি গোবরে ভর্তি! নারীদের গৃহবন্দী করতে হবে! ওদের গৃহবন্দী করতে পারলেই আমার রাজ্য ধর্ষণ মুক্ত হবে।
শিল্পমন্ত্রী : সে কী! এই একবিংশ শতাব্দীতে তা কী করে সম্ভব?
বিজ্ঞানী : জি, বাদশাহ নামদার। আমার মনেও এ ধারণাই কাজ করছিলো।
বাদশাহ: ফুল খুব সুন্দর। তাই সুন্দরের পুজারি যারা, তারা বাগান থেকে ফুল ছিঁড়ে এনে গন্ধ শুঁকে নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে। নারীরাও ঠিক ফুলের মতো, বুঝলে? ওদের গৃহবন্দী না করলে এই ধর্ষণ প্রতিরোধ কিছুতেই সম্ভব না। আর নারীদের এভাবে মিছিল করাও বন্ধ হয়ে যাবে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী : বাদশাহ নামদার। তাহলে নারীদের ঘরের বাইরে আসতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিই?
বাদশাহ : হুঁ। ঠিক ! ঠিক বলেছেন!
সবাই সমস্বরে বলে : 'ঠিক। ঠিক। জয়, বাদশাহ হিকমতের জয়।'
পর্ব : ৮
একদিন সন্ধ্যায় পার্থ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল। হঠাৎ পাশের জঙ্গল থেকে গোঙানির শব্দ ভেসে আসে।
মনে মনে বলে : এভাবে গোঙিয়ে গোঙিয়ে আবার কে কাঁদছে?
এদিকে ওদিক তাকিয়ে সে কাউকেই দেখতে পেলো না। আরেকটু সামনে এগুতেই গোঙানির শব্দ স্পষ্ট হয়ে কানে লাগে। উৎকণ্ঠায় সে দ্রুত রাস্তা থেকে নেমে জঙ্গলের ভেতরে যেতে থাকে। শব্দ কোনদিক থেকে আসছে খুব ভালো করে লক্ষ করে সেদিকে এগিয়ে যায়।
পার্থ সগোক্তি করে : ঐ তো ! একটা মেয়ে দুহাত আর মুখ বাঁধা এবং অনেকটা বিবস্ত্র অবস্থায় মাটিতে উপুড় হয়ে ছটফট করছে!
পার্থ কোনো কিছু না ভেবেই মেয়েটার কাছে দৌড়ে গেল। মেয়েটাকে একটানে উল্টে এক ঝলক দেখে চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ছাড়তে থাকে।
মুহূর্ত কয়েক পর পার্থ বলে : নিরুপমা!
নিরুপমা ফ্যাল ফ্যাল করে পার্থের দিকে বোবার মতো তাকিয়ে থাকে।
পার্থ নিরুপমাকে তার বুকের সাথে যে কতোক্ষণ জাপটে ধরে রাখে সে নিজেই অনুমান করতে পারে না। রাস্তায় হর্ণ বাজিয়ে একটা গাড়ি অকস্মাৎ চলে যাওয়ায় পার্থের হুঁশ হয়।
পার্থ খুব দ্রুত নিরুপমার বাঁধন খুলে দিয়ে বলে : বলো, কে তোমার এমন সর্বনাশ করেছে? আমি তাকে খুন করে ফাঁসিতে ঝুলবো। বলো, কার এমন বুকের পাটা?
নিরুপমা এবার সত্যিই ডুকরে কেঁদে ফেলে।
পার্থ নিরুপমাকে শক্ত ভাবে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলে : বলো, বলো।
হঠাৎ নিরুপমা উঠে দৌড় দেয়।
আর বলতে থাকে : বিচার নাই, বিচার নাই। অত্যাচারী বাদশাহর রাজ্যে বিচার নাই। সুইসাইড ছাড়া গতি নাই।
পার্থও দৌড়ে গিয়ে নিরুপমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে : নিরুপমা! ধৈর্য ধরো।
নিরুপমা চিৎকার করে বলে : আমি এক্ষুণি সুইসাইড করবো। আমাকে ছেড়ে দিন।
পার্থ ওকে জোর পূর্বক কোলে করে নিরুপমার বাড়ির দিকে এগুতে থাকে।
আর বিড়বিড় করে বলতে থাকে : আত্মহত্যা মহাপাপ। তুমি কেন মরবে? তুমি তো অপরাধ করোনি।
নিরুপমার বাবা তার একমাত্র মেয়ের এই অবস্থা দেখে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি একেবারেই মূক ও স্থবির হয়ে পড়েন। মা বারবার জিজ্ঞাসা করতে করতে একসময় নিরুপমা বলে, যে তার এই সর্বনাশ করেছে সেই কুচক্রী বাদশাহর লোক। সে একজন সামান্য সৈনিক।
নিরুপমার মা বিলাপ করে করে বলেন : কত্তবার করে তোরে কইলাম বাড়ি থেকে বাইর হইছ না, বাইর হইছ না। তুই কথা শুনলি না। তোরে গত বছর বিয়া দিতে চাইলাম। বিয়া করলি না। এমএ পাস দিয়া চাকরি করবি! সাবলম্বী হবি! তারপর বিয়া করবি! এখন বাদশাহ ইউনিভার্সিটি বন্ধ কইরা দিছে। উপযুক্ত মেয়েদের ঘর থেইকা বাইর হইতে না করছে। আমরাও তরে না করছি। আমাদের কথা শুনলি ত নাইই...তুই বাদশাহর আদেশ অমান্য কইরা নিজেই নিজের সর্বনাশ ডাইকা আনলি? এখন কেউ তোরে বিয়া করব?
পার্থ : কী সব বলছেন মাসি মা! কেউ বিয়ে করবে না মানে? এসব কথা রাখেন। আমি নিরুপমাকে ভালোবাসি। আমি আপনাদের কথা দিলাম, আমি ওকে বিয়ে করবো। এখন আপনি ওকে একটু দেখে রাখেন। ও যেন কিছুতেই সুইসাইড করার মতো কোনো ঘটনা ঘটাতে না পারে।
পার্থ নিরুপমার মাথায় হাত রেখে বলে : নিরুপমা, তুমি কি বুঝতে পারো না যে আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি?
নিরুপমা মাথা নিচু করে থাকে। নিরুপমার মা শাড়ির আঁচলে চোখ মুছেন।
পার্থ নিরুপমার মাথায় হাত রেখে আবারও বলে : সত্যি বলছি, আমি তোমাকেই বিয়ে করবো, নিরুপমা।
নিরুপমার হৃদয়ে যেন আচমকা কাল বৈশাখী ঝড় বয়ে যায়।
দু'হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে কাঁদতে বলে : আপনি চলে যান। বাদশাহর লোক আমার শরীরের সর্বস্ব লুটে নিয়েছে। আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয়।
পার্থ দৃঢ় কণ্ঠে বলে : হুঁ। এটা সত্যি যে লুটেরা তোমার শরীর লুট করেছে। তোমার শরীর ক্ষতবিক্ষত করেছে। কিন্তু তোমার মন? সেটা তো এখনও অক্ষত আছে। সেটা তো লুট করতে পারেনি! আমি তোমার মনকে ভালোবাসি। তোমার শরীরকে নয়।
বলেই দ্রুত পার্থ নিরুপমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
পর্ব : ৯
সেদিন পার্থ ক্লাসে পড়াচ্ছিলো। বাদশাহর লোকজন বাইরে থেকে তাকে দেখছিলো। এক পর্যায়ে ঢুকে টেবিল চেয়ার বেঞ্চ ভাঙচুর করে। কয়েকজন এসে পার্থকে দুমাদুম কিল ঘুষি মারতে থাকে। পার্থও কম যায় না।
ওরা বলতে থাকে : তোর দিনকে দিন সাহস বাড়তাছে ?বাদশাহর কথার অমান্য? স্কুল খোলা রাখছস?
ছেলেমেয়েরা ভয়ে যে যেভাবে পারে দৌড়ে পালাতে থাকে। এর মধ্যে ইন্দ্র চিৎকার করে বলতে থাকে : স্যারকে আপনারা মাইরেন না।
মালতি ও মিলা কাঁদতে কাঁদতে বলে : স্যার, আপনি ওদের সাথে লড়তে পারবেন না। পালিয়ে যান স্যার, পালিয়ে যান।
কিন্তু পালিয়ে যেতে পারেনি পার্থ। পালিয়ে যেতে তার বিবেকে বাধে।
সে মনে মনে বলে : পালাবো কেন? আমি তো কোনো অন্যায় করিনি। অন্যায়ের সাথে আপোষ করা তো আমার ধর্মও নয়, কর্মও নয়।
বাদশাহর লোকজন তাকে কোমড়ে রশি বেঁধে বাদশাহর দরবারে নিয়ে যায়।
মালতি, ইন্দ্র, মিলা, শাহেদ ওদের স্যারের এই করুণ পরিণতি দেখে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে থাকে ।
পার্থকে বাদশাহর দরবারে উপস্থিত করা হলে বাদশাহর আদেশ অমান্য করায় তাকে প্রাসাদের এক অন্ধ কুঠুরিতে আটকে রাখা হয় । সেই কথা শুনে রাতের অন্ধকারে নিরুপমা বেরিয়ে যায়। নিরুদ্দেশ হয়।
পর্ব : ১০
স্বর্ণ খনিতে বেশির ভাগ শিশু-কিশোর শ্রমিক। খাওয়ার বিনিময়ে কাজ।
বাকিরা মোটামুটি যুবক বয়সী। বৃদ্ধদের সেখানে কোনো জায়গা নেই। এভাবে কাজ করার পর, দিন শেষে শ্রমিকদের মুজুরী বাবদ বাদশাহ যা বরাদ্দ করেছে সেটার সম্পূর্ণ অংশ দেয়া হয় না। একতৃতীয়াংশ দেয়া হয়। যদিও শ্রমিকদের প্রত্যেকের কাছ থেকে সম্পূর্ণ মুজুরী বুঝে পেয়েছে বলে তাদের কাছ থেকে কাগজে সাইন নেয়া হয়। একারণে শ্রমিকদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। কিন্তু যারাই প্রতিবাদ করে তাদের সবটুকু অংশই কেড়ে নেয়া হয়। অথবা তাদের গুম করা হয়।
শিশু-কিশোর শ্রমিকদের মজুরি বাবদ চাল দেয়া হয়।
যুবকদের টাকা দেয়া হয়।
কাজ শেষে মুজুরি নেয়ার সময় এক কিশোর প্রতিবাদ করে বলে: স্লিপে লেখা দুই কেজি চাল, আমার থেকে সাইন নিলেন দুই কেজি চালের। আর আমাকে দিলেন এক কেজি চাল?
বাদশাহর ক্যাশিয়ার : যা, যা। বেশি কথা বলিস না।
বিষন্ন মন নিয়ে কিশোর চলে যায়।
এরপর আরেকজন কিশোর আসে।
সে বলে: কম দিলেন কী রে? আরও এক কেজি দেন। কম দিলে আমি নিব না।
বাদশাহর ক্যাশিয়ার চাল কেড়ে নিয়ে বলে : না নিলে নাই। যা। এক কেজিও পাবি না। না খেয়ে মর গিয়ে।
যুবক শ্রমিকদেরও একই অবস্থা।
প্রথম শ্রমিক বাদশাহের ক্যাশিয়ারকে বলে: মুজুরীর টাকা দুইশ টাকার পরিবর্তে একশ টাকা দিলেন?
ক্যাশিয়ার তার দিকে চোখ লাল করে তাকায়। সে কথা না বাড়িয়ে ভয়ে চলে যায়।
দ্বিতীয় শ্রমিক প্রতিবাদ করে।
: না। নিব না। আমাকে দুইশ টাকার জায়গায় একশ টাকা দিলেন? বাদশাহর কাছে আমি নালিশ করব।
বাদশাহর চেলা তার লোক ডেকে বলে : এই, কে আছিস? একে নিয়ে যা ত। এক্কেবারে গুম করে দে।
দুজন লোক এসে তাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যায়।
এভাবেই চলতে থাকে।
পর্ব : ১১
নিরুপমা রাতের অন্ধকারে গভীর বনের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকে। কোনো ভয়ডর যেন তাকে স্পর্শ করছে না। পূর্ণিমার চাঁদ তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলছে।
নিরুপমা মনে মনে বলে : হুঁ। আমার এ রাজ্যে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। আমি আত্মহত্যা করবো ।
পরক্ষণেই ভাবতে থাকে : উঃ আমি যদি ঐশ্বরিক শক্তি পেতাম! ও আমার পরম সৃষ্টিকর্তা! তুমি যদি আমাকে এমন একটা শক্তি দিতে যা দিয়ে এই অত্যাচারী বাদশাহকে চিরতরে এই রাজ্য থেকে দূর করে দিতাম!
তখন ভোর হয়ে আসছে। পুবের আকাশ লাল হয়ে ওঠেছে। বন পেরিয়ে আসতেই একটা নদী চোখে পড়লো নিরুপমার।
সে মনে মনে ভাবে : হুম! এই তো পেয়েছি! এই নদীতেই আমি ঝাঁপ দেবো। নিজেকে এক্কেবারে শেষ করে দেবো। হে নদী, তুমি আমাকে গ্রহণ করো।
ধীরে ধীরে নিরুপমা নদীতে নামে। হিম শীতল পানি।পানিতে নামতেই বনের ভেতর সারারাত হাঁটার ক্লান্তি যেন ক্রমশ দূর হতে থাকে। গলা পর্যন্ত নেমে ডুব দিলো।
নিরুপমা মনে মনে বলে : ইস্! কী যে প্রশান্তি!
এভাবে তিনবার ডুব দিতেই মনে হলো তার শরীরে পেঁচানো বারো হাত শাড়িটা কে যেন খুলে নিয়ে যাচ্ছে! এর পরিবর্তে রাজকীয় পোশাক পরিয়ে দিচ্ছে। যতই নদীর তীরের দিকে যাচ্ছে তার শরীর থেকে ধীরে ধীরে শাড়িটা খসে পড়ে পানিতে। ভাসতে থাকে। সমস্ত শরীর রাজকীয় পোশাকে আবৃত করে ফেলে। তার হাত-পা, শরীরের রঙও যেন পাল্টে গেছে!
তীরে উঠে নিরুপমা বেশ ভয় পেয়ে যায়।
নিরুপমা নিজের শরীরে হাত বুলিয়ে দেখতে থাকে। মন্ত্রমুগ্ধ সে ! হঠাৎ সে বিদঘুটে হাসির শব্দ শুনতে পায়।
: হা হা হা হা.....!
নিরুপমা ভীত সন্ত্রস্ত কণ্ঠে বলে : কে? কে ওখানে? এভাবে কে হাসছে?
লাল শালু কাপড় পরিহিত এক বৃদ্ধ নিরুপমার সামনে এসে দাঁড়ায়।
নিরুপমা মনে মনে বলে : সে কী? দরবেশ? এখানে দরবেশ এলো কোত্থেকে?
বৃদ্ধ : ভয় পাসনে মা। ভয় পাসনে। আমি তোর সবটা জানি। তোর পরনে যে পোশাকটা দেখছিস, এটা আমি তোকে দান করলাম। তুই সতী সাবিত্রী। যা। যে পথে এসেছিলি সে পথে যা। আর স্বর্ণদ্বীপকে শান্তির রাজ্যে পরিণত করতে হলে এই পোশাকটা তোর খুব কাজে লাগবে।
নিরুপমা ভয় মিশ্রিত কন্ঠে বলে: কিন্তু আমি তো ফিরে যেতে আসিনি। আমি মরতে আসছি।
দরবেশ আবারও হা হা হা করে হেসে ওঠে। ওর হাসির শব্দে সারা বনও কেঁপে ওঠে।
দরবেশ: বাহ্! চমৎকার সিদ্ধান্ত নিছিস! কী হবে তুই মরে গেলে? কার কী আসে যায়? তুই মরে গেলে কারো কিচ্ছু আসে যাবে না। কিন্তু আরেক জন মরে গেলে...
নিরুপমা আঁতকে উঠে বলে : কে? কে মরে গেলে? পার্থ দা?
দরবেশ: না।
দরবেশ হেসে বলে: দুর পাগলি। পার্থ মরবে কেন? নিরুপমা করুণ চোখে তাকিয়ে বলে: শুনেছি, বাদশাহের লোকেরা ওকে ধরে নিয়ে গেছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণে...মে ...।
দরবেশ নিরুপমার মুখের কাছে হাতের তর্জনী ধরে বলে : চুপ। পার্থ মরবে না। বাদশাহ। বাদশাহ মরবে।বাদশাহর মন্ত্রীরা মরবে। ওদের চেলারা মরবে। ওরা মরে গেলে দেশটা বাঁচবে। দেশের মানুষ বাঁচবে।
ততোক্ষণে নিরুপমার ভয় কেটে যায়।
নিরুপমা নিচু হয়ে দরবেশকে প্রণাম করে।
দরবেশ নিরুপমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলে : এই পোশাকে কেবল মাত্র তুই স্পর্শ করতে পারবি। তুই ছাড়া আর কেউ স্পর্শ করলেই সে মরণ ঘরে চলে যাবে। আর এভাবেই তুই সবাইকে মারবি। তোর স্বর্ণদ্বীপে সুশাসন ফিরে এলেই তুই এই পোশাক এখানে এসে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে দিলেই তুই আবার আগের পোশাক ফিরে পাবি।
দরবেশের কথা শুনে নিরুপমার আনন্দ যেন আর ধরে না। মুহূর্তেই সুইসাইড করার কথা ভুলে যায়।
পর্ব : ১২
বাদশাহ তাঁর দরবারে আজ খুশ মেজাজে আছেন।
বাদশাহ নিজেই বক্তা। আর সবাই শ্রোতা।
বাদশাহ : হা হা হা .....! আমার বিরোধিতা করার আর কেউ নেই। আমি এখন এই স্বর্ণ দ্বীপের একমাত্র বাদশাহ। অধীশ্বর.....!
বাদশাহর দরবার উৎসব মুখর হয়ে ওঠেছে।
সবাই মিলে বাদশাহ হিকমতের জয়গান গাইছে।
শিল্পমন্ত্রী : আমাদের হিকমত বাদশাহর জয় হোক ।
বিজ্ঞানী : জয় আমাদের হিকমত বাদশাহর জয় ।
আর সবাই সমস্বরে বলে ওঠে : জয় আমাদের বাদশাহর জয় ।
পর্ব : ১৩
নিরুপমা নতুন রূপে ফিরে আসে আবার স্বর্ণদ্বীপে। প্রথমেই যায় স্বর্ণ খনিতে শিশু-কিশোরদের উদ্ধার করে আনতে। খনি এলাকায় এসে প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়াতেই দারোয়ান অস্ত্র হাতে দৌড়ে আসে। অপরূপা সুন্দরী রাজকুমারীর মতো দেখতে নিরুপমাকে দেখে চোখ ঘষতে থাকে।
দারোয়ান : কে? কে তুমি?
নিরুপমা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
দারোয়ান : উহু! হুরপরী! আমি স্বপ্ন দেখছি না তো!
নিরুপমা উচ্ছল ভঙ্গিতে এবার কথা বলে ওঠে : না। তুমি স্বপ্ন দেখছো না। হা হা হা হা....! আমি কোনো হুরপরী না। আমি মানুষ। নারী।
নিরুপমার হাসি প্রতিধ্বনি তুলে দূরে মিলিয়ে যায়।
দারোয়ান ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে বলে : ক্বে, ক্বে, ক্বে তুমি?
নিরুপমা : আমি শান্তির দূত। তোমাদের স্বর্ণ দ্বীপের বিশৃঙ্খল অবস্থা দূর করে শান্তি ফিরিয়ে দিতে এসেছি ।
দাড়োয়ান বিস্ময় প্রকাশ করে বলে : শান্তির দূত! আমরা স্বর্ণ দ্বীপবাসী, এইতো, বেশ আছি। শান্তিতেই আছি। এখানে কোনো বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে না। তুমি চলে যাও। নয়তো তোমাকে মারতে আমার একটা গুলির চেয়ে বেশি খরচ করতে হবে না !
বিকট শব্দ করে হাসতে হাসতে এগিয়ে যায়। নিরুপমাকে ধরতে চেষ্টা করে। আবার থেমে যায়।
দারোয়ান : হুম! এক্ষুণি তোমাকে মরণ ঘরে পাঠাচ্ছি। তবে মারার আগে তোমাকে ....হা হা হা হা.... একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই। নারী! ছলনাময়ী! কাছে এসো। তোমার ছলনায় আমি ডুবে যেতে চাই।
নিরুপমা পিছিয়ে যেতে যেতে বলে: সাবধান! আমাকে স্পর্শ করো না। আমাকে স্পর্শ করলে নির্ঘাত তোমার মরণ হবে। অযথা পাপ করে মরণ ডেকে এনো না।
দারোয়ান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ।
দারোয়ান : পাপ! নারী, তুমি জানো না, বাদশাহর আদেশ কোনো নারী ঘরের বাইরে আসতে পারবে না? নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে? তারপর তোমার মতো এত সুন্দরী নারী বের হলে তো কথাই নেই! সেই নিরুপমার মতো অবস্থায় পড়তে হবে! হা হা হা হা ....এটাই বাদশাহর আদেশ! আমার হাত থেকে রক্ষা নাই, নারী তোমার আর রক্ষা নাই।
নিরুপমাকে স্পর্শ করা মাত্রই দাড়োয়ান ভারী রাইফেল সহ মাটিতে পড়ে যায়। মুখগহ্বর থেকে জিহ্বা বেরিয়ে আসে। চোখের মণি অর্ধেক কোটরের ভেতর ঢুকে যায়। নিরুপমা দারোয়ানের এই বিদঘুটে চেহারা দেখে ভয়ে চিৎকার করে দুহাতে চোখমুখ চেপে ধরে।
নিরুপমা : উফ্ মাই গড! কী বিভৎস! উফ্ গড ব্লেস মি।
মূহুর্ত কয়েক পর নিরুপমা স্বগোক্তি করে: নিরুপমা! এভাবে ভয় পেলে চলবে কেন? স্বর্ণদ্বীপে শান্তি ফিরিয়ে আনা, এটা যে তোমার দায়িত্ব ও কর্তব্য! স্বর্ণদ্বীপে শান্তি ফিরিয়ে আনতে যদি কিছু মন্দ লোকের প্রাণ যায় তো যাবে। অন্যায়কে কখনো প্রশ্রয় দেয়া উচিত নয়। একটা অন্যায় প্রশ্রয় দিলে হাজারটা অন্যায় মাথা চাড়া দিয়ে ওঠবে!
নিরুপমা এবার অনেকটাই সহজ হয়। একে একে দশ বারো জন দারোয়ান, ম্যানেজার,ক্যাশিয়ারকে মোকাবেলা করে ও সামনের দিকে এগিয়ে যায়। পেছনে পড়ে থাকে তাদের লাশ!
নিরুপমার স্বগোক্তি : ঐ তো! শিশু-কিশোররা কাজ করছে! ইস্! ওদের শরীরের কি যে অবস্থা! এক একটা কঙ্কাল যেন! কীভাবে ঘাম ঝরছে ওদের শরীর থেকে ! আহা! যাদুমণিরা! তোমাদের এক কষ্ট? এই ঘাম ঝরানোর বিনিময়ে উৎপাদিত স্বর্ণ বিক্রি করে বাদশাহ আর বাদশাহর লোকেরা মজা লুটছে!
শিশু-কিশোর শ্রমিকরা নিরুপমাকে দেখে ভয়ে চমকে ওঠে। ওদের হাত থেকে তরল স্বর্ণের কনটেইনার পড়ে যায়।
নিরুপমা তাদের লক্ষ করে বলে : তোমরা একদম ভয় পাবে না।
ওরা সমস্বরে বলে : কে তুমি?
নিরুপমার হাসি হাসি জবাব : আমি এই স্বর্ণদ্বীপের শান্তির দূত। তোমাদের উদ্ধার করে নিতে এসেছি।
কয়েকজন যুবক এগিয়ে এসে বলে : শান্তির দূত না ডাইনী? নিশ্চয়ই বাদশাহের লোকেরা তোমাকে এখানে পাঠাইছে। আমাদের বিভ্রান্ত করার জন্য।
নিরুপমা তাদের অভয় দিয়ে বলে : না। আমি ডাইনী নই। তোমরা আমার সাথে ফিরে চলো। তোমরা তোমাদের মা-বাবার কাছে ফিরে যাবে। স্কুল-কলেজ ইউনিভার্সিটি সব খুলে দেয়া হবে। তোমরা আবার পড়ালেখা শুরু করবে। হাসপাতালগুলো খুলে দেয়া হবে। তোমাদের অসুস্থ মা-বাবার ফ্রিতে চিকিৎসা হবে।
কে একজন বলে : তুমি কি আমাদের সাথে তামাশা করতে আসছো?
নিরুপমা : না। মোটেও না। তোমরা এক্ষুণি আমার পেছনে পেছনে এসো। কিন্তু সাবধান! আমার কাছাকাছি কেউ আসবে না। আমাকে ভুলেও কেউ স্পর্শ করবে না। স্পর্শ করলেই নির্ঘাত মৃত্যু!
এক যুবক বলে : আমরা তোমার সাথে বের হই আর দারোয়ানরা এসে আমাদের মেরে ফেলুক।
নিরুপমা: না। কোনো দারোয়ান আর বেঁচে নাই। ওরা সবাই ...মরে ভূত হয়ে গেছে।
ওরা সারিবদ্ধভাবে এক অন্ধ বিশ্বাসের উপর ভর করে নিরুপমার পেছনে পেছনে স্বর্ণ খনির এরিয়া থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসে।
'জয় জয় জয় জয়,
স্বর্ণদ্বীপের জয় হবে নিশ্চয়।'
'পতন হোক, পতন হোক, দুঃশাসনের পতন হোক,
বাদশাহ হিকমতের দৌরাত্ম্যের অবসান হোক।'
তাদের শ্লোগানে মুখরিত হয় স্বর্ণদ্বীপের রাজপথ।
পর্ব : ১৩
বাদশাহর জলসা ঘর সেদিন নাচে গানে উল্লাসে ভরপুর। বাদশাহ তখন সেখানে অবসর সময় কাটাচ্ছিলেন। প্রাসাদের বাইরে মিছিলের শব্দ শুনে বাদশাহ তাঁর আসন ছেড়ে জলসা ঘর থেকে বেরিয়ে প্রাসাদের মূল ফটকের সামনে গিয়ে এক সৈনিককে কারণ জিজ্ঞেস করেন।
বাদশাহ : এই, কে কোথায় আছো?
বাইরে আবার কিসের গণ্ডগোল চলছে?
সৈনিক বলে: বাদশাহ নামদার, এক নারী রাজকীয় পোশাক পরে কিছু লোকের সাথে মিছিল কইরা প্রাসাদের দিকেই আসতাছে।
বাদশাহ: কে এই নারী?
সৈনিক: চিনতে পারতাছি না। মুখ ত ঢাইকা রাখছে।
নিরুপমার দল ততক্ষণে প্রাসাদের কাছাকাছি চলে আসে। যারাই ওকে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে স্পর্শ করছে তারাই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। বাদশাহ প্রাসাদের ফটক পেরিয়ে বাইরে আসে। নিরুপমাকে থেকে দেখে আশ্চর্য হয়ে এগিয়ে যায়। পেছনে সৈনিকও যায়।
বাদশাহ চিৎকার করে বলে: কে এই নারী? এত দুঃসাহস! আমার আদেশ অমান্য করে ঘর থেকে বেরিয়ে আসছে?
সৈনিক বলে: বাদশাহ নামদার, আমাদের স্বর্ণদ্বীপে এমন সুন্দর নারী কখনোই চোখে পড়ে নাই। আমার মনে হইতাছে, অন্য কোনো দেশ থেইকা আসছে।
বাদশাহ: কী? অন্য দেশ থেকে? অন্য দেশের নারী আমার স্বর্ণদ্বীপে প্রবেশ করলো কিভাবে? কোথায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী? কোথায় বিজ্ঞানী? তাদের সবাইকে ডাকো। ওরা কি সীমান্ত... ।
একে একে সবাই আসে। নিরুপমা তার দলবল সহ বাদশাহর সামনে এসে দাঁড়ায়। মন্ত্রীরা নিরুপমার দলবল দেখে ভীষম খায়।
বাদশাহ : কে তুমি?
নিরুপমা : আমি? হা হা হা হা...! আমাকে জিজ্ঞেস করছেন?
বাদশাহ : হুম! তোমাকেই জিজ্ঞেস করছি। মনে ত হয় তুমি আমার এই রাজ্যের নও। কোন দেশ থেকে আসছো? কেন আসছো?তোমার সাহস হলো কেমনে আমার এই স্বর্ণ রাজ্যে প্রবেশ করার?
নিরুপমা : আমি এই স্বর্ণদ্বীপের শান্তির দূত! এই রাজ্যে এখন সাধারণ জনগণের চরম দুর্দিন চলছে। আমি তাদের সুদিন ফিরিয়ে দিতে এসেছি। আপনি এই রাজ্যের শান্তি কেড়ে নিয়েছেন । আমি এই রাজ্যের শান্তি ফিরিয়ে দিতে এসেছি। একঘন্টার মধ্যে প্রতিটি স্কুলে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হসপিটাল সব খুলে দেয়ার ব্যবস্থা করা হোক। পার্থ বসুকে মুক্তি দেয়া হোক।
বাদশাহ : কে তুমি? আমার মুখের উপর কথা বলছো?এ সাহস তোমাকে কে দিয়েছে?আমি এই রাজ্যের শান্তি কেড়ে নিয়েছি? সত্যিই! তুমি আমাকে হাসালে! আর পার্থ বসুকে মুক্তি দেব?
নিরুপমা: হ্যাঁ।
বাদশাহ: পার্থ বসুর সঙ্গে তোমার কী সম্পর্ক? তুমি ওর মুক্তি চাওয়ার কে?
নিরুপমা: ও একজন ভালো মানুষ। ও এই রাজ্যের সাধারণ মানুষের ভালো চায়।
বাদশাহ: এই, কে কোথায় আছিস? এই নারীকে বন্দি করে আমার জলসা ঘরে নিয়ে আয়।
নিরুপমা : সাবধান! সে চেষ্টা করবেন না।
বাদশাহ : আমাকে ভয় দেখাচ্ছো? তাও আবার সামান্য নারী হয়ে? জানো? তোমাকে মারতে আমার সৈনিকের একটা গুলির চেয়ে বেশি খরচ হবে না?
নিরুপমা : জানি।
কয়েকজন সৈনিক এসে বলে : বাদশাহ নামদার, হুকুম করুন। আমরা এই নারীকে শেষ করে দিই।
বাদশাহ ইশারা করলে নিরুপমাকে লক্ষ করে গুলি ছুঁড়ে। কিন্তু গুলি নিরুপমার শরীরে লাগা মাত্রই নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে যায়।
বাদশাহ এবার রাগে গজগজ করতে করতে নিরুপমাকে ধরতে চেষ্টা করে। নিরুপমা একপা একপা করে পেছনে যেতে থাকে।
বাদশাহ : হা হা হা হা ... ভয় পাচ্ছো?
নিরুপমা : না। মোটেও না।
বাদশাহ : সত্যি করে বলো, তুমি কে?
নিরুপমা : সত্যিই আপনি জানতে চান, আমি কে?
বাদশাহ : হ্যাঁ।
নিরুপমা : আমি নিরুপমা।
বাদশাহ : নিরুপমা!
নিরুপমা : হ্যাঁ, নিরুপমা। যাকে আপনার এক সৈনিক ধর্ষণ করছে। এবার বলেন, পার্থ বসুকে কোথায় লুকিয়ে রাখছেন? যদি বাঁচতে চান, এক্ষুণি তাকে আমার সামনে নিয়ে আসুন।
বাদশাহ : তুমি যে নিরুপমা, এর প্রমাণ কী?
নিরুপমা : আগে পার্থ বসুকে আমার সামনে এনে উপস্থিত করুন। এরপর আমি প্রমাণ দেব।
বাদশাহ : হা হা হা হা ....!
বাদশাহ থমকে দাঁড়িয়ে একজন সৈনিককে ইশারা করলে পার্থ বসুকে কিছুক্ষণ পর নিয়ে আসা হয়।
নিরুপমা পার্থ বসুকে দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। সে পার্থ বসুর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে।
কিন্তু পরমুহূর্তেই তার প্রতিবিম্ব তার সাথে কথা বলে ওঠে। সে কথা আর কেউ শুনতে পায় না।
প্রতিবিম্ব : সাবধান নিরুপমা! সংযত হও।
নিরুপমা কয়েক কদম এগিয়ে পার্থ বসুর মুখোমুখি দাঁড়ায়।
নিরুপমা মুখের কাপড় সরিয়ে দেখালে বাদশাহ ও তাঁর লোকজন বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায়। পার্থ বসুও ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
পার্থ বসু চমকে উঠে বলে : নিরুপমা!
বাদশাহ মন্ত্রীদের লক্ষ করে বলেন : আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ওর এই রাজকীয় পোশাক টেনে খুলে ফেলুন। আর পার্থকে ওর সামনেই গুলি করে হত্যা করুন।
বাদশাহ অট্টহাসিতে ফেটে পড়েন : হা হা হা.....। কয়েকজন পার্থ বসুকে মারতে এগিয়ে যায়। আর কয়েকজন নিরুপমার পোশাক খুলতে এগিয়ে যায়।
নিরুপমা দ্রুত পার্থের সামনে গিয়ে দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে বলে : সাবধান! কেউ একপা এগোবে না।
কিন্তু কেউই নিরুপমার কথা শুনেনি। একে একে বাদশাহসহ সবাই নিরুপমাকে ধরতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
পার্থ বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়।
মনে মনে বলে : কে এই নারী? ও কি সত্যি সত্যিই নিরুপমা? সে এই রাজকীয় পোশাক কোথায় পেলো?
পার্থ নিরুপমাকে লক্ষ করে বলে : কে তুমি? তুমি কি স্বর্গ থেকে নেমে আসছো ? তুমি কি দেবী?
নিরুপমা : না। আমি কোনো দেবী নই। আমি আপনার নিরুপমা! আসুন। প্রাসাদের বাইরে আসুন। ইন্দ্র, শাহেদ, মিলা মালতিরা আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।
কিন্তু সাবধান! ভুলেও আপনি আমাকে স্পর্শ করবেন না।
দুজনেই দুরত্ব বজায় রেখে প্রাসাদের বাইরে আসে। সবাইকে দেখে পার্থ আনন্দে আবেগ ধরে রাখতে পারে না। কেঁদে ফেলে।
সবাই শ্লোগান দিতে থাকে : জয়, পার্থ স্যারের জয়। জয়, নিরপমা ম্যাডামের জয়।
শ্লোগানের আওয়াজ আকাশে বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ভাসতে থাকে।
পার্থ অভিভূত হয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। এক বৃদ্ধের ডাকে পার্থ চমকে ওঠে।
বৃদ্ধ : পার্থ?
পার্থ : কে?
বৃদ্ধ : হে প্রিয় বৎস, পার্থ! আজ থেকে তুমি এই স্বর্ণদ্বীপের রাজা। আর নিরুপমা? ও রাণী।
পার্থ অবাক হয়ে বলে : কে আপনি?
নিরুপমা : ওনি আমাদের শুভাকাঙ্খী। স্বর্গ হতে আসছেন।
বৃদ্ধ : নিরুপমা, তুমি তোমার কথা রক্ষা কর।
নিরুপমা : তথাস্তু ।
বৃদ্ধ মুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে যায়।
নিরুপমা পার্থকে লক্ষ করে বলে : চলুন আমার সাথে।
পার্থ : কোথায়?
নিরুপমা : চলুন না। কিন্তু সাবধান! আমাকে কিছুতেই স্পর্শ করবেন না।
নিরুপমা পার্থকে নদীর ধারে নিয়ে যায়। ওর পোশাক খুলে নদীতে ছুঁড়ে ফেলে।
পার্থ নিরুপমাকে আগের বেশে দেখে চিৎকার করে ওঠে : নিরুপমা! আমার নিরুপমা!
নিরুপমা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
পার্থ নিরুপমাকে জড়িয়ে ধরে।
( সমাপ্ত)
রচনা কাল ও স্থান : ৬/১১/২০২০, ধানমন্ডি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com