মুহররাম মাস হিজরী সনের প্রথম মাস। চারটি সম্মানিত মাসের প্রথম মাস মুহররাম, জাহেলি যুগেও বিশেষ সম্মানও মর্যাদার চোখে দেখা হতো। এ মাসের ১০ই মুররাম শুধু উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য নয়, বরং এইদিনে পূর্ববর্তী অনেক উম্মত ও নবীদের অবিস্মরণীয় ঘটনার সূত্রপাত হয়েছিল। আশুরার দিবসের ঘটনা ও তাৎপর্যের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও অন্য একটি কারণে বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র, জান্নাতি যুবকদের সর্দার হযরত ইমাম হুসাইন (রা.) যালিম স্বৈরাচারী ইয়াযিদ বাহীনির হাতে নির্মমভাবে স্বপরিবারে শহীদ হন। ইতিহাসের জলন্ত সাক্ষী এই মহররম মাস।
ইতিহাস ঐতিহ্য ও রহস্যময় তাৎপর্য নিহিত রয়েছে এ মাস কে ঘিরে, সঙ্গে সঙ্গে এ মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ছিল,এসব কারণে এ মাসটি অত্যন্ত মর্যাদাপূর্ণ। মুহাররামের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। বিশুদ্ধ হাদিস এবং ঐতিহাসিক তথ্য মতে এদিনেই মহান আল্লাহ তায়ালা আসমান ও জমিন সৃষ্টি করেছেন, হযরত আদম হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি , বিভিন্ন নবীদের শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা, ফেরাউন কে নীলনদে ডুবিয়ে হত্যা, হযরত মুসা (আ.) এর উপর তাওরাত নাজিল, হযরত নূহ (আ.) এর জাহাজ ঝড়ের প্রবল থেকে রক্ষা, হযরত দাউদ (আ.) এর তাওবা কবুল, নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে ইব্রাহিম (আ.) উদ্ধার, হযরত আইয়ুব দূরারোগ্য ব্যধি থেকে সুস্থতা লাভ, দশজন নবীর মুক্তি লাভ এবং পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া সহ বিভিন্ন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
বিশেষত এদিনটি জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের মাথা তুলে দাঁড়াবার, ন্যায়ের পক্ষে অন্যায়ের বিপক্ষে জীবনকে বিলিয়ে দেবার। ইমাম হুসাইন (রা.) নির্মমভাবে ভাবে শহীদ হয়েছেন এবং রেখে গেছেন আমাদের জন্য অনুপম আদর্শ। হুসাইন (রা.) এর শাহাদাত শুধু শোকের নয়, বরং ত্যাগের অনুপম শিক্ষা।
কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা মুমিন হৃদয়ের রক্তক্ষরণ ঘটে। ইমাম মুয়াবিয়া (রা.) ইন্তেকালের পর তার তদ্বীয় পুত্র দুষ্ট প্রকৃতির স্বৈরাচারী যালিম ইয়াযিদ ক্ষমতা গ্রহণ করে, তখন ইমাম হুসাইন (রা.) মদিনায় ছিলেন। ইয়াজিদের শাসনবার গ্রহণের বিষয়ে তৎকালীন সময়ের অধিকাংশ সাহাবা একমত ছিলেন না। অনেকটা অস্ত্রের জুড়ে সে মুসলমানদের ক্ষমতা দখল করে। ইয়াযিদ মদিনার গভর্নরের মারফত ইমাম হুসাইন কে ইয়াযিদের অনুগত্য স্বীকার করতে বলে কিন্তু জান্নাতি যুবকদের সর্দার একজন সাচ্চা ঈমানদার হয়ে যালিম শাসকের অনুগত্য স্বীকার করতে রাজি হননি।
ইয়াজিদ মদিনার গভর্নর কে নির্দেশ দেন ইমাম হুসাইন (রা.) বাইয়াত গ্রহণ না করলে কারাগারে নিক্ষেপ করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে। মদিনার গভর্নর বিপদে পড়ে যান। তিনি কিভাবে প্রিয় নবীজির নাতিকে কারাগারে পাঠাবেন? তিনি হযরত ইমাম হুসাইনকে অনুরোধ করেন মদিনা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে, বাধ্য হয়ে তখন তিনি মক্কায় হিজরত করেন। এমতাবস্থায় কুফার কিছু লোক তাকে কুফায় আগমনের আমন্ত্রণ জানান এবং তার হাতে বাইয়াত গ্রহণের অঙ্গীকার করেন। পরপর কয়েকটি আমন্ত্রণ পত্র পেয়ে তার স্বীয় চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিল (রা.) কে কুফায় প্রেরণ করেন। মুসলিম ইবনে আকিল পরিস্থিতি ইতিবাচক অনুধাবন করে ইমাম হোসাইন (রা.) কে কুফায় আগমনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়ে চিঠি পাঠান। কেননা শুধু কুফায় ইমাম হোসাইন এর প্রতিনিধি হিসেবে তার নিকট আঠারো হাজার লোক হাতে বায়াত গ্রহণ করেছিল।
মুসলিম বিন আকিলের পত্র পেয়ে হযরত ইমাম হোসাইন কুফার পথে রওনা দিলেন। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, ওমর ইবনে আব্দুর রহমান সহ হিতাকাঙ্খীদের উপদেশ, অনুরোধ এক্ষেত্রে রক্ষা না করে ইসলামী খেলাফত দূরাচারীদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য তার সফর কর্মসূচি শুরু করেন। কিন্তু ভাগ্যের বিপাকে অবস্থা পরিবর্তন হতে লাগলো। ধূর্ত ইয়াযিদ কুফার গভর্নর পরিবর্তন করে উবাইদুল্লাহ ইবনে যিয়াদকে নতুন গভর্নর করে। সে ছিল হিংস্র ও নির্মম। মুহাম্মদ বিন আশাআছের নেতৃত্বে সত্তর জন সৈন্যর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আহত হয়ে পড়েন অবশেষে ইবনে যিয়াদের নির্দেশে মুসলিম বিন আকিল (রা.) কে হত্যা করা হয়। মুহাম্মদ বিন আশাআছ ইমাম হোসাইন কে কুফাতে আগমন না করা এবং শাহাদাতের সংবাদ পৌঁছান। এ সংবাদের প্রেক্ষিতে মুসলিম গোত্রের প্রতিশোধ গ্রহণের প্রেক্ষিতে শপথ নিলেন ইমাম হুসাইনের কুফা গমণ ছাড়া আর কোন পথ রইল না। অবশেষে গিয়ে কারবালার প্রান্তরে উপনীত হলে একহাজার ইয়াযিদের বাহিনী প্রতিরোধ করলে যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়।
আগে থেকেই আহলে বাইতের জন্য ফোরাত নদীর পানি বন্ধ করে দিল এবং নবী পরিবারদের বিরুদ্ধে ২০-২২ হাজার সশস্ত্র বাহিনীর সাজে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধের আহ্বান করলো। ৬১ হিজরী দশ মুহররাম ইমাম হোসাইন (রা.) ইয়াজিদি বাহিনীদের সাথে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হন। তিনি তাদের উদ্দেশ্যে এক হৃদয়গ্রাহী ভাষণ দেন- জুহায়র ইবনে কায়েসও অগ্রসর হয়ে শত্রুদের আহলে বাইতের হত্যা করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানান। কিন্তু পাপিষ্ট সীমার তীর নিক্ষেপ এর মাধ্যমে যুদ্ধের সূচনা করে। বাহিনীর একাংশের সেনাদক্ষ হুর ইবনে ইয়াযিদ হুসাইনের দলে চলে আসলে তার উপরেও তীর নিক্ষেপ শুরু হল। তুমুল যুদ্ধে ইমাম হোসাইন এর অধিকাংশ আহলে বাইতের সদস্যরা শহীদি সুরাহা পান করেন। শহীদ হলেন হযরত আলি আকবর, পাপীষ্টরা তার লাশকে টুকরো টুকরো করে ফেলে। এদিকে উমার ইবনে হাসানের তরবারির আঘাতে কাসিম বিন হাসান আহত হয়ে পড়ে। তার মুখ থেকে বের হল চাচা! হযরত হুসাইন এসে তাকে ধরলেন এবং উমার কে তরবারির আঘাতে কনুই পর্যন্ত হাত কেটে দিলেন। ভাতিজার লাশ কাঁধে তুলে নিয়ে আহলে বাইতের অন্যান্য শহীদদের পাশে শুয়ে দিলেন। হযরত হুসাইন (রা.) সঙ্গী সাথীহীন একাই দাঁড়িয়ে রইলেন। ময়দানে একা হলেও শত্রুদের কারো সামনে আসার সাহস হচ্ছিল না। হযরত হোসাইন কে হত্যার পাপ কেউই তার কাঁধে বহন করতে চাইলো না। অবশেষে কুন্দা গোত্রের পাপীষ্ঠ মালিক ইবনে নাছির অগ্রসর হলো এবং ইমাম হুসাইনের উপর তরবারির আঘাত চালালো। তিনি মারাত্মক আহত হলেন, তার ছেলে আব্দুল্লাহকে আহবান করলেন এবং নিজের কোলে বসালেন। ইবনে আসদি নামক এক দুর্ভাগা তাকেও তীর মেরে শহীদ করে দিল। ইমাম হোসাইন এই নিষ্পাপ শিশু বাচ্চার রক্ত কালবালার মাটিতে ছিটিয়ে দিলেন এবং বললেন হে আল্লাহ! তুমি এই জালিম লোকদের থেকে আমাদের প্রতিশোধ নিও।
ইমাম হুসাইন (রা.) পিপাসা অত্যন্ত বৃদ্ধি পেলে ফুরাত নদীর দিকে অগ্রসর হলে তখন হাসিন বিন নমীর তার মুখ লক্ষ্য করে তীর নিক্ষেপ করল। তীর হোসাইন এর মুখে আঘাত করল এবং অনেক রক্তক্ষরণ হল। সীমার দশজন সৈন্যসহ হুসাইনের দিকে অগ্রসর হল। ইমাম হুসাইন (রা) পিপাসার্ত ও মারাত্মক আহত অবস্থায় তাদের সাথে মোকাবেলা করছিলেন। যেদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন ভাগ ভাগ বলে পালাচ্ছিল। সীমার যখন বুঝতে পারলো সবাই হোসাইনকে হত্যা করা থেকে বাঁচতে চাচ্ছে তখন এক যুগে আক্রমণের নির্দেশ দিল। আদেশ পেয়ে পাপিষ্টরা একযোগে অগ্রসর হয়ে আঘাত করল। ইমাম হুসাইন মোকাবেলা করতে শাহাদাতের সুরাহা পান করেন।
সীমারের নির্দেশে সুনান ইবনে আনাসই ইমাম হুসাইন (রা) এর মাথা থেকে শরীর বিচ্ছিন্ন করে দিল। ইমাম হোসাইন এর শরীরে ৩৪ টি বর্শার ছিদ্র, ৪০ টি তরবারির ও ১২১ টি তীরের জখম ছিল। তবে এই সংখ্যা নিয়ে মতভেদ আছে। শত্রুরা হযরত জয়নাব, শিশু,পুত্রহীনা ও বিধবা সহ সর্বমোট ১২ জনকে এক শেকলে বেঁধে শেকলের এক মাথা হযরত জয়নুল আবেদীনের বাহুতে বেঁধে এবং অন্য মাথা জয়নাবের বাহুতে বেঁধে দেয়। উত্তপ্ত মরুতে এখানে সেখানে হাটে বাজারে ঘুরিয়েছে যাতে দুনিয়াবাসী জানতে পারে ইয়াযিদ বিজয় অর্জন করেছে। নবী পরিবারকে বন্দী অবস্থায় কুফা থেকে শত শত মাইল দূরে সিরিয়ায় মোয়াবিয়ার সবুজ রাজপ্রাসাদে আনা হলো। দুঃখ কষ্ট সহ্য করার পরেও ইয়াজিদের দরবারে সাহসী ভূমিকা রাখলেন হযরত জয়নাব। সিরিয়ায় বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখে চতুর ইয়াযিদ তার কৌশল বদলাতে বাধ্য হল। বন্দীদের সসম্মানে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করল কিন্তু সেসব ছিল বনিতাপূর্ণ , মুখে একরকম বললেও কাজ করেছিল ভিন্ন।
আহলুল বাইতের সদস্য হুসাইন (রা.) এর প্রতি নবীজি (সা.) এর ভালোবাসা ও হুসাইন (রা.) এর ভালোবাসা আমাদের জন্য আল্লাহর ভালোবাসা পাওয়ার মাধ্যম- এই সুসংবাদ উম্মতকে জানিয়ে বলেন, হোসাইন আমার থেকে আর আমি হুসাইন থেকে যে হুসাইনকে ভালোবাসে আল্লাহ তাকে ভালবাসেন,নাতিদের মত হোসাইন একজন। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) কে এক ব্যক্তি ইহরাম অবস্থায় মশা মারার হুকুম জিজ্ঞেস করল। তিনি ব্যক্তির পরিচয় জানতে চাইলেন। জানলেন, এ ব্যক্তি ইরাক থেকে এসেছেন। ইবনে ওমর বেশ দুঃখ পেয়ে বললেন, যারা নবীর বংশধরকে শহীদ করল তারা মশা মারার বিধান জানতে চায়! আমি নিজ কানে শুনেছি রাসুল (সা) কে হাসান ও হুসাইন (রা.) কে বলছেন, হাসান হোসাইন দুনিয়াতে আমার দুটো সুগন্ধি ফুল। আহলে বাইতের সদস্যদের প্রতি ইতিহাসের নৃশংসতম নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে সারা জীবন সে মানুষের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে রয়ে গেল। এমনকি ইতিহাস তালাশ করলে দেখা যায় তার সন্তান মুয়াবিয়া ইবনে ইয়াযিদ যে কিনা শাসনভার গ্রহণ করেনি,সে বলেছিল আহলে বাইতের সাথে শাসনবার ক্ষমতা দখলের জন্য যে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল আমার বাবা সেই ক্ষমতা আমি দখল করতে চাই না। নবীজী (সা.) জান্নাতি যুবকদের দুই সরদার কে ভালবাসেন এবং আল্লাহর যেন তাদের ভালোবাসেন সে মর্মে বলেন- হে আল্লাহ আমি তাদের উভয়কে ভালোবাসি আপনি তাদেরকে ভালবাসুন।
ইমাওমে আশুরা শুধু আমাদের প্রতিবাদি হতে শিখায়নি কুরআন সুন্নাহ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা হওয়ার শিক্ষা দেয়। শুহাদায়ে কারবালার আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে সবকিছু বিলীন করে দেওয়া যাবে কিন্তু অন্যায় অসত্যের কাছে আপস করা চলবে না, মাথা নত করা যাবে না। কবি বলেন,ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়, কারবালা কে বাদ অর্থাৎ ইসলামের পুনরায় পুনর্জাগরণ হয় কারবালার পর পরই। তিনি ইয়াজিদের হাতে বাইয়াত গ্রহণ করলে কারবালার ঘটনা ঘটতো না এবং ধর্মীয় উচ্চাসনে বসানো হতো। কিন্তু নীতি, আদর্শ, সত্য, মানবতা ও মুক্তির জন্য নিঃসংকোচচিত্তে এ রকম প্রাণ দানের ঘটনা বিরল। অসত্য-অন্যায়ের কাছে মাথা নত নয় বরং আমাদের হতে হবে আত্মত্যাগের বলে বলিয়ান, দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং হকের পথে পাহাড়ের ন্যায় অটল-অবিচল।
মাওলানা আজিজুল ইসলাম রিয়াদ
সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইসলামিক চিন্তাবিদ