এস এম আব্দুল্লাহ সউদ জয়পুরহাট জেলা প্রতিনিধিঃ
অন্য বছরের চাহিদার তুলনায় আলুর উৎপাদন বেশি হওয়ায় সচরাচর বাজারে দাম স্থিতিশীল থাকতো। মৌসুমের শেষে হিমাগারগুলোতে আলু অবিক্রীত থেকে যেতো। বছর শেষে লোকসানের কথা বলতেন ব্যবসায়ীরা। এবছর হিমাগারে পর্যাপ্ত আলু থাকার পরও দাম বাড়েছে। কারণ হিসেবে কেউ বলছেন বাড়তি চাহিদার কথা কেউ বলছেন অন্যান্য পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব। তবে সিন্ডিকেটের আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
উত্তর বঙ্গের মধ্যে জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলা আলু উৎপাদনে শীর্ষে।হিমাগারগুলোতে চাহিদার তুলনায় অধিক পরিমাণে আলু মজুদ থাকার পরেও চড়া দামে আলু বিক্রি হচ্ছে।সাধারণ ভোক্তাদের দাবি,সিন্ডিকেটের মাধ্যমে আলুর দাম বৃদ্ধি করে মধ্যস্বত্বভোগীরা ফায়দা লুটছেন। ফলে ভোজন রসিক বাঙালির আলুর প্রেমে মন্দা। মাসখানেক ধরে সামগ্রিক বাজারদর ক্রমশ ঊর্ধ্বমুখী। এপ্রিল থেকে একের পর এক উৎসব পেরিয়ে ধাপে ধাপে বেড়েছে আলু,মাছ, মাংস থেকে সমস্ত সবজির দাম।
কৃষকদের আশা তারা গতবছরের ক্ষতিটা যেন কাটিয়ে উঠতে পারে। সেজন্য এবছর আলুর ফলন ভাল হওয়ায় অধিক লাভের আশায় কালাইয়ে দশটি হিমাগারে প্রকার ভেদে বিভিন্ন জাতের আলু তারা মজুদ রেখেছেন। তবে মে মাসে এসে যেভাবে আলুর দাম বেড়েছে তাতে কপালে চিন্তার ভাঁজ মধ্যবিত্তের। এমনকি আলুর দাম ক্রমশ মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।মধ্যবিত্তের আশঙ্কা,পরিস্থিতি এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে,বর্ষায় বা ডিসেম্বরে আরও দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে।
এ বছর মৌসুমের শুরুতে ১০টি হিমাগারে আলু সংরক্ষণ হয় (৬৫ কেজি ওজনে) ১৫ লাখ ৩৩ হাজার ২৮৩ বস্তা। সংরক্ষিত আলু উত্তোলনের মেয়াদ শেষ হবে আগামী নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। এসব হিমাগারে ১২ লাখ ৩৩ হাজার বস্তা আলু এখনও মজুত রয়েছে। গত বছরে এই সময়ে মজুতের প্রায় বেশিরভাগ আলু বিক্রি হয়ে গিয়েছিল।
উপজেলার বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে জানা যায়, বাজারে গত এক মাস আগে এক কেজি কার্ডিনাল ও স্টিক (লাল) আলু ১৪-১৫ টাকা, ডায়মন্ড (সাদা) ১৬-১৮, দেশি পাকরি (লাল) ২০-২২ এবং রুমানা (পাকরি) ১৮ টাকায় বিক্রি হয়।এখন উপজেলা সদরের নতুন ও পুরানো বাজার, কালাই পৌর বাজার ও পুনট হাটসহ ইউনিয়নের হাট-বাজার গুলোতে লাল আলু ৩০-৩২, ডায়মন্ড ৩৫, দেশি পাকরি ৩৬-৩৮ এবং রুমানা ৩৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। কেজিতে দাম বেড়েছে গড়ে ১৬ টাকা।
শনিবার কালাই হাটে আসা কৃষক আরমান হোসেন, মফিদুল ইসলাম ,আবুল হাসানসহ কয়েকজন জানান, গত এক মাস আগে এক কেজি আলু কিনেছেন ১৮ থেকে ২০ টাকায়। এখন কিনতে হচ্ছে ৩৮-৪০ টাকায়।
অথচ ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শুরুতে ১২ থেকে ১৪ টাকা কেজি আলু কিনেছেন। হিমাগারের ভাড়াসহ সব মিলে খরচ পড়েছে ১৭/১৮ টাকা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, মার্চ-এপ্রিলে কালাইয়ের হিমাগারগুলোতে( ৬৫ কেজি) ওজনের ১৫ লাখ বস্তা আলু সংরক্ষণ হয়েছে। উপজেলার ১০টি হিমাগারে উৎপাদনের ৯০ শতাংশ মজুত রয়েছে। উত্তোলনের শেষ সময় নভেম্বর মাস পর্যন্ত।
ব্যবসায়ী ও হিমাগার ব্যবস্থাপকরা জানিয়েছেন, গত বছর ১০টি হিমাগারে প্রায় ১৪ লাখ বস্তা আলু মজুত ছিল। গতবছরের মে মাসে প্রকারভেদে এক কেজি কার্ডিনাল ও স্টিক (লাল) আলু ৮-১০ টাকা, ডায়মন্ড (সাদা) ৮-৯ টাকা এবং দেশি পাকরি (লাল) ১২-১৪ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এবার চলতি বছরে একই পরিমাণ আলু মজুত থাকলেও দাম বেড়েছে চার গুণ।
চাহিদা বাড়ার কারণে ব্যবসায়ীরা বেশি লাভের আশায় আলু উত্তোলন করছেন না। এতে দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ছে বলে অভিযোগ হিমাগার মালিক,খুচরা বিক্রেতা ও ক্রেতাদের। তাঁদের দাবি, ব্যবসায়ীরা কারসাজি করে সংকট সৃষ্টি করেছেন। কম আলু বের করে ঘণ্টায় ঘণ্টায় দাম বাড়াচ্ছেন। হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা।
কালাই পৌর বাজারের খুচরা বিক্রেতা শফিকুল ইসলাম বলেন, আলু হিমাগারে থাকলেও বিক্রি করছেন না। অন্যভাবে বস্তা প্রতি ২০০ থেকে ২৫০ টাকা বেশি দিলে ঠিকই পাওয়া যাচ্ছে।
কালাই হাটের বিক্রেতা সাজেদুল বলেন, শনিবার পুনট হিমাগারে গিয়ে দেখেন,শুক্রবারের চেয়ে দাম বস্তাপ্রতি ২৭০-৩২০ টাকা বেশি। জীবিকার তাগিদে বেশি দামে তাকে আলু পাইকারি কিনে খুচরাতে বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
যদিও ব্যবসায়ীদের দাবি,দাম বৃদ্ধির সঙ্গে মজুতের কোনো সম্পর্ক নেই।তবে আলুর মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।কারণ অনেক কৃষকের বাড়িতে এখনও আলু মজুত রয়েছে। হিমাগার মালিকরা বলছেন, কী কারণে ব্যবসায়ীরা আলু উত্তোলন করছেন না, তা জানা নেই তাঁদের। সরকার উদ্যোগ নিয়ে ব্যবসায়ীদের তালিকা নিয়ে নজরদারিতে রাখলে বাজার থেকে মূল্য বৃদ্ধি হবে না।
আলু ব্যবসায়ী আবুল হাসনাত বলেন,অর্থের অভাবে তিনি আলু মজুত করতে পারেননি। তারপরও কেনাবেচা করছেন। যে দামে কেনেন, দু’এক টাকা লাভ করে মহাজনদের আড়তে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। যাঁরা মজুত করেছেন, এক মাসের ব্যবধানে তাঁদের তিনগুণ লাভ থাকছে। তারপরও বিক্রি করছেন না। তাঁদের উদ্দেশ্য ভালো না।
কেন দাম বাড়ল আলুর? এমন প্রশ্নের জবাবে আলু ব্যবসায়ী মাহবুব হোসেন বলেন, যে আলু মার্চ মাসের শুরুতে বস্তা প্রতি বিক্রি হতো ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায়,এখন তার দাম বেড়ে হয়েছে ১৬০০ টাকা। দেশী পাকরী আলুর বস্তা প্রতি বিক্রি হতো ৮০০/৮৫০ টাকার মধ্যে তার দাম বেড়ে হয়েছে ২১০০ টাকার কাছাকাছি। এতে অত্যাধিক মূল্য বৃদ্ধির জন্য বিক্রেতা থেকে ক্রেতা সবাই সমস্যায় পড়েছেন বলে তিনি মত ব্যক্ত করেন।
পৌর এলাকার সরাইলে এম ইসরাত হিমাগারের ব্যবস্থাপক রায়হান উদ্দিন বলেন, আরও বেশি লাভের আশায় ব্যবসায়ীরা আলু বিক্রি করছেন না। উত্তোলনের সময় রয়েছে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত। এটিও কারণ হতে পারে। সরকারকেই বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে,গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে আলুর দাম বেশি পাওয়ার আশায় চাষিরা আলু চাষে ঝুঁকে পড়েন। শুধু চাষিরাই নয় ব্যবসায়ীরাও এবার বাণিজ্যিকভাবে আলুর চাষ করেন।ব্যবসায়ীরা মৌসুমের শুরুতে হিমাগার মালিকদের কাছ থেকে গত বছরের মতো এবারও লাভের আশায় ঋণ নিয়ে উপজেলার ১০টি হিমাগারে আলু রাখেন।
জেলা কৃষি বিপণন কর্মকর্তা রতন কুমার রায় বলেন, আলুর দাম বৃদ্ধির কথা শুনলেও এক মাসে চারগুণ হওয়ার বিষয়টি তাদের জানা নেই। যে সব ব্যবসায়ী কারসাজি করছেন, তাঁদের তালিকা করে আইনগত পদক্ষেপ নেবেন বলে তিনি জানান।
জেলা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ইফতেখারুল আলম রিজভি বলেন, জেলায় অভিযান অব্যাহত রয়েছে। ভবিষ্যতে আরও জোরদার করা হবে। যারা সিন্ডিকেটে জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংবাদটি শেয়ার করুন