শরিফুল ইসলাম
কৃষি খাতের গলায় ফাঁস লাগিয়েছে একটি শক্তিশালী মধ্যস্বত্বভোগী সিন্ডিকেট ।
তারা রাজনৈতিক প্রভাব আর অর্থবিত্তের জোরে ধান-চাল ক্রয় অভিযান নিয়ন্ত্রণ করছে। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার পারস্পরিক যোগসাজশে গড়ে ওঠা এই সিন্ডিকেটের দাপটে সাধারণ কৃষক ও মিলাররা বঞ্চিত হচ্ছেন সরকারি ক্রয় কেন্দ্রগুলোতে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ধান-চাল সরবরাহ করার সুযোগ থেকে। সরকারি ক্রয়নীতির ফাঁকফোকর গলিয়ে সরকারি ধান-চাল সংগ্রহ অভিযানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সাধারণ কৃষকদের বঞ্চিত করছে এই সিন্ডিকেট।
কিশোরগঞ্জে এমন পরিস্থিতির শিকার হয়ে খাদ্য-শস্য উৎপাদনে অমনোযোগী হয়ে ভিন্ন লাভজনক ফসল উৎপাদনে মনোযোগী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। এমন পরিস্থিতিতে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়কে ঘুস-দুর্নীতির আখড়া হিসাবে বর্ণনা করে সুনির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ করে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগ করেন এক মিলার। বর্তমানে এ অভিযোগটির তদন্ত চলছে।
বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে চাল সংগ্রহে মিলারদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে মিলের সক্ষমতা এবং বরাদ্দ প্রদানে অনিয়ম-দুর্নীতি ও কারসাজির অভিযোগ এখন মুখে মুখে। এ ছাড়া অ্যাপের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করে ধান বিক্রির প্রক্রিয়াও দুষ্ট চক্রটির অদৃশ্য শেকলে বাঁধা পড়েছে। কিশোরগঞ্জ জেলায় চলতি বোরো মৌসুমে ১৪ হাজা ৩০৩ টন ও ২২ হাজার ৫২ টন চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। কিশোরগঞ্জের হাওড়ে বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। কিন্তু এরপরও বোরো চাষিদের মুখে হাসি নেই। খরচ ও ঋণ মেটাতে নতুন বোরো ফসল মাঠে ও খলা থেকেই অনেকে ৮২০ থেকে ৮৫০ টাকা মন দরে এক শ্রেণির ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এক মন বোরো ফসল উৎপাদনে সাড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে। সরকারি খাদ্য গুদামে চাল বিক্রিতে বিড়ম্বনার শিকার কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পানির দরে ধান তুলে দিচ্ছেন ফড়িয়া ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের হাতে।
কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার দানাপাটুলি ইউনিয়নের কালিয়াকান্দা গ্রামের কৃষক মো. ফরিদ উদ্দিন বলেন, তার ১০ একর জমিতে প্রায় ৬৫০ মন ধান উৎপাদন হয়েছে। তিনি অ্যাপের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হলেও খরচের টাকা মেটাতে পূর্ব অভিজ্ঞতার কারণে সরকারি ক্রয় কেন্দ্রের শরণাপন্ন হচ্ছেন না। তিনি জানান, গত বছর অনেক চেষ্টা করেও তিনি সরকারি ক্রয় কেন্দ্রে ধান বিক্রি করতে পারেননি। কিন্তু এর আগেরবার তিনিসহ চার কৃষক মিলে কিশোরগঞ্জ সরকারি খাদ্য গুদামে চার টন ধান নিয়ে গিয়েছিলেন। আর্দ্রতা ও চিটার অভিযোগ তুলে শেষ পর্যন্ত রাত সাড়ে ৮টায় ৪৫ কেজিতে মন ধরে গুদামে ধান বিক্রি করেন। তার অভিযোগ, ক্রয় অভিযানের সঙ্গে জড়িতদের যোগসাজশে প্রকৃত অর্থে রাজনৈতিক প্রভাব আর অর্থবিত্তের জোরে গড়ে ওঠা একটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট ক্রয় অভিযান নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।
সিন্ডিকেটের কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে মনে করছে কৃষি বিভাগ। আর এ কারণে ধান বাদ দিয়ে লাভজনক অন্য ফসল উৎপাদনের দিকেও ঝুঁকে পড়ছেন অনেক কৃষক। তারা বাজারে উপযুক্ত মূল্য থাকায় ভূট্টা চাষ করতেও শুরু করেছেন।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার ধনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান প্রদীপ কুমার দাস বলেন, সিন্ডিকেটের কারণে ধানের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ায় তিনি তার ৪০ একর জমি বর্গা চাষিদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এবার প্রতি একর জমিতে ৭০-৭৫ মন বোরো ফসল উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু তারাও খরচ এবং ঋণ মেটাতে ধান ফড়িয়া ব্যবসায়ীদের কাছে আগাম পানির দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এ ছাড়া প্রকৃত বোরো চাষিরা কখনো সরকারি খাদ্য গুদামে তাদের ধান বিক্রি করতে পারেন না সিন্ডিকেটের কারসাজিতে।
সিন্ডিকেটের কারসাজিতে সরকারি খাদ্য গুদামে চাষিরা ধান বিক্রির সুযোগ না পাওয়ার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (খামারবাড়ি) উপপরিচালক মো. আব্দুস সাত্তার।
চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য মিলের সক্ষমতা নির্বাচন, চুক্তিবদ্ধ হওয়া এবং তাদের বরাদ্দ প্রদানের ক্ষেত্রেও রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি ও ঘুস লেনদেনের অভিযোগ। ইতোমধ্যে কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মেসার্স হাজী রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী মো. সোহেল মিয়া জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বিশাল অঙ্কের ঘুস বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েছেন মর্মে খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর অভিযোগ করেছেন। আর এ অভিযোগের তদন্তে নেমেছে খাদ্য অধিদপ্তর। সোমবার রক্ষণ প্রকৌশলী মো. আমিনুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি তদন্ত দল কিশোরগঞ্জ এসে ঘটনা সরেজমিন তদন্ত করে গেছে।
সংবাদটি শেয়ার করুন