৩১শে জানুয়ারি ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৭ই মাঘ ১৪২৯ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ১:২৭ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২১, ২০২৩
ডা. মামুন আল মাহতাব (স্বপ্নীল)
ক্যাডাভেরিক অর্গানিক ডোনেশন : অমরত্বের পথে যাত্রা
গত ১৯ জানুয়ারি বৃহস্পতিবার দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এক অনন্যসাধারণ দিন। নতুন এক ইতিহাস রচিত হয়েছে। প্রথমবারের মতো এ দেশে সম্পন্ন হয়েছে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন। ২০ বছর বয়সী একজন তরুণীর ব্রেন ডেথ হলে তাঁর কিডনি দুটি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুজন রোগীর দেহে। তরুণীর কর্নিয়া দুটি প্রতিস্থাপন করে দুজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী পৃথিবীটাকে আবারও স্বাভাবিকভাবে দেখার সুযোগ পেয়েছেন। বাংলাদেশে এক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়েই গত বছর পাঁচ শর ওপর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। কর্নিয়া প্রতিস্থাপনও এ দেশে নতুন কিছু নয়। তার পরও ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন নিয়ে হয়তো আলোচনা, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের জরুরি প্রেস কনফারেন্স ইত্যাদির কারণটা যে কি তা যে কারো মনে প্রশ্ন জাগাতেই পারে। ঘটনাটি নানা কারণেই তাৎপর্যবহ।
প্রথমত, এটি দেশের ইতিহাসে প্রথম ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন। যখন কোনো রোগীর ব্রেন ডেথ হয়ে যায়, তখন তাঁর পরিবারের সম্মতিক্রমে তাঁর অঙ্গগুলো খুলে নিয়ে প্রতিস্থাপন করা যায় অসুস্থ মানুষের শরীরে। শুধু কিডনি আর কর্নিয়াই নয়, প্রতিস্থাপন করা যায় হার্ট, ফুসফুস, লিভার আর পরিপাকতন্ত্রও। এত দিন বাংলাদেশে ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টেশন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ বাংলাদেশে এসংক্রান্ত কোনো আইনই ছিল না। রোগীর ব্রেন ডেথ নিশ্চিত করা, আর রোগীর স্বজনদের কোনোভাবে প্রভাবিত না করে অর্গান ডোনেশনে উদ্বুদ্ধ করায় ইথিক্যাল ও ম্যুরাল অনেক বিষয় জড়িত। এ কারণেই পুরো প্রক্রিয়াটিকে একটি আইনের আওতায় আনাটা জরুরি। আবারও ধন্যবাদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে, কারণ আরো অনেক ভালো কাজের ভিড়ে তিনি এই ভালো কাজটিও করে দিয়েছেন। ধন্যবাদের পাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। কারণ দেশের চিকিৎসাবিজ্ঞানের সেরা এই পাদপীঠটি আরো একবার দেশে চিকিৎসাবিজ্ঞানের অগ্রগতিতে অগ্রণী ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো।
সারা পৃথিবীতেই যেকোনো অর্গান ট্রান্সপ্লান্টের ক্ষেত্রেই অর্গান প্রাপ্তি একটা বড় চ্যালেঞ্জ। আর কোনো কোনো অর্গানের ক্ষেত্রে তো ক্যাডাভেরিক ডোনার ছাড়া কোনো গত্যন্তরই নেই। যেমন—হার্ট, লাঙ কিংবা ইন্টেসটাইন। ক্যাডাভেরিক ডোনার পাওয়া গেলে অর্গান ট্রান্সপ্লান্ট রেসিপিয়েন্টদের জন্য এর চেয়ে ভালো খবর আর কিছুই হতে পারে না। বিশেষ করে যখন একজন ক্যাডাভেরিক ডোনার নতুন একটা জীবন উপহার দিতে পারে দুজন কর্নিয়া, দুজন কিডনি, একজন হার্ট, একজন ইন্টেসটাইন, দুজন লাঙ আর এক থেকে দুজন লিভার ট্রান্সপ্লান্ট রেসিপিয়েন্টসহ ৯ থেকে ১০ জন মুমূর্ষু মানুষকে।
তবে আমার কাছে যা আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে হয় তা হলো, এই প্রথম যেকোনো কারো জন্যই আক্ষরিক অর্থেই অমরত্ব অর্জনের দুয়ারটা খুলে গেল। মৃত্যুর পর বেঁচে থাকার আশায় আমরা অনেকে অনেক কাজ করি। তারপর আশায় থাকি যে মৃত্যুর পর পৃথিবীতে যেসব মানুষকে আমরা ছেড়ে রেখে যাব তারা আমাদের কথা স্মরণ করবে কথায়, বলায় আর ইদানীংকালের ফেসবুক স্ট্যাটাসে। অমন অমরত্ব অর্জন করেছেন অনেকেই, তবে তা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্থায়ী হয় না। ফেসবুক স্ট্যাটাস বড়জোর কয়েকটি সপ্তাহ। দেশের প্রথম ক্যাডাভেরিক অর্গান ডোনার সারাহ ওসবের কোনো ধারই ধারেননি। তাঁর অমরত্বের জন্য তাঁকে কারো ফেসবুক স্ট্যাটাসের ওপর নির্ভর করতে হবে না। সারাহর কিডনি আর চোখ ধারণ করে যেসব মানুষ পৃথিবীতে বহুদিন বেঁচে থাকবেন, তাঁদের প্রতিটি সুস্থ, কৃতজ্ঞ নিঃশ্বাস সারাহর অমরত্ব নিশ্চিত করবে। পৃথিবীতে যখন মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছি, যেতে তো একদিন হবেই। কিন্তু সারাহর মতো বেঁচে থাকতে পারে কজন?
লেখক : অধ্যাপক ও ডিভিশন প্রধান ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় এবং সদস্যসচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com