ড. এম সুয়াইব
তথ্যপ্রযুক্তিসহ সকল প্রযুক্তি নানা মাধ্যমে আমাদের পৃথিবীর আর্থসামাজিক মানচিত্রকে গত তিন-চার দশকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞানের নানা অভূতপূর্ব আবিষ্কার ও উন্নয়নের কারণে মানুষ দিন দিন বেশি সক্ষমতা অর্জন করছে।
বর্তমান প্রযুক্তির অভাবিত উদ্ভাবন সমাজের ব্যাপক আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্হা থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। আমাদের দেশেও আর্থসামাজিক অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। আমাদের দেশে এখন আর আগের মতো সপ্তাহের একটি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট সময়ে হাট বসে না। এখন সপ্তাহের প্রতিদিনই বাজার বসে। মহাসড়কের দুই পাশে দোকান বেড়েই চলছে। ব্যবসাবাণিজ্যের প্রসার ঘটছে। গ্রামের রাস্তায় এখন আর গরুর গাড়ি দেখা যায় না, এমন কী প্যাডেল রিকশা ভ্যানের জায়গা দখল করে নিয়েছে ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক। গ্রামে খুব কম পরিবার আছে যাদের ফ্রিজ,টিভি নেই। মোবাইল ছাড়া পরিবার এখন খুঁজে পাওয়া দায়। আর এ সবই হয়েছে আমাদের চোখের সামনে গত দুই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে। নতুন নতুন প্রযুক্তি আমাদের জীবন ব্যাবস্হাকে পাল্টে দিচ্ছে। আমরা, আমাদের অজান্তেই পুরাতন ব্যবস্হার পরিবর্তে নতুন ব্যবস্হায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি। এ সব প্রযুক্তি আমাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে এক নতুন সমাজ ব্যবস্হায় যা আমরা কখনো কল্পনাও করিনি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব আমাদের দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। বলা হচ্ছে এ শিল্পবিপ্লবের প্রভাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্হার আমূল পরিবর্তন হবে। যার প্রভাব ইতোমধ্যেই সীমিত আকারে হলেও পড়তে শুরু করেছে। সময়ের পরিক্রমায় এটি আরও বেশি দৃশ্যমান হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লব আমরা মিস করেছি। ১৭৮৪ সালে প্রথম শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে বাষ্পীয় ইঞ্জিন মানুষের হাতে তুলে দিয়েছিলো গতিকে। মূলত পানি আর বাষ্পের ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি হয় এ শিল্পের মাধ্যমে। এর পর ১৮৭০ সালে দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের মাধ্যমে বৈদ্যুতিক বাতি মানুষকে দেয় এক আলোকিত বিশ্ব। আর এ বিদুৎ শক্তি ব্যবহার করে গণ-উৎপাদন শুরু হয়। দ্বিতীয় শিল্পবিপ্লবের আর্শীবাদ বিদ্যুৎ-কে আমরা মানুষের ঘরে পৌঁছে দিলাম ২০২১ সালে। বিদুৎ নির্ভর শিল্পবিপ্লবকে আমরা ধরতে ব্যর্থ হলাম। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের শুরু হয় ১৯৬৯ সালে। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছে আমেরিকা। ইন্টারনেট বিশ্বকে গ্লোবাল ভিলেজে রূপান্তরিত করলো। কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয়ে গেলো। ১৯৬৪ সালে আমাদের এ ভূখণ্ডে প্রথম কম্পিউটার এলো। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবকেও আমরা যথা সময়ে ধরতে পারিনি। দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া শিক্ষাব্যবস্হাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে কুদরত-ই-খোদা কমিশন গঠন করেন। কুদরত-ই-খোদা কমিশন রিপোর্টের ভিত্তিতে শিক্ষাব্যবস্হাকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে টি এন্ড টি বোর্ড গঠন করা হয়। বেতবুনিয়ায় ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্হাপন করা হয়। বঙ্গবন্ধু সরকার কিছু কনসেপ্ট নিয়ে কাজ করেছিলেন। ৩য় শিল্পবিপ্লবকে মোকাবিলার জন্য সদ্য স্বাধীন দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং স্বল্প, মধ্যে ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করার জন্য বিভিন্ন কমিটি গঠন করে, এ-সব কমিটিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু সরকারের পর এ-সব বিষয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো কাজ হয়নি।
এমন কি আমাদের অজ্ঞতার কারণে বিনামূল্যে সাবমেরিন ক্যাবল কানেক্টিভিটি সুযোগও হাত ছাড়া হয়েছে। যা পরে আমাদের অর্থের বিনিময়ে নিতে হয়েছে। ১৯৯৬ সালে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর গুরুত্বপূর্ণ চারটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন,যার সুদূরপ্রসারি প্রভাব তখন সবাই বুঝতে পারেনি। সেই চারটি সিদ্ধান্ত হলো কম্পিউটারের উপর থেকে সকল প্রকার ভ্যাট,ট্যাক্স প্রত্যাহার, মোবাইল ফোনের লাইসেন্স একটি আপরেটরের পরিবর্তে সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া। এর ফলে গ্রামীণসহ অনেকগুলো কোম্পানী মোবাইল সেবায় চলে আসে এবং লাখ টাকার মোবাইল কয়েক হাজার টাকায় মানুষের হাতে পৌঁছে যায় । তৃতীয় সিদ্ধান্ত হলো ইন্টারনেট সংযোগ জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়া। চতুর্থ সিদ্ধান্ত ছিলো কারিগরী শিক্ষার প্রসার। এসবই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সহায়ক হিসেবে কাজ করছে। পৃথিবীর কোনো দেশই সময় নির্ধারণ করে ঘোষণা দিয়ে ডিজিটাল দেশ হয়নি,এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম বাংলাদেশ। আগামী এক দশকে ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে আমরা এমনসব পরিবর্তনের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি, যা এর আগে পাঁচ দশকেও সম্ভব হয়নি।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের বিষয়ে কেউ ধারণাও করতে পারছে না ভবিষ্যতে কী হবে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে জনসংখ্যা কম। এসব দেশে কাজ করার মতো জনবলের ঘাটতি রয়েছে। তাদের অন্যের শ্রমের উপর নির্ভর করতে হয়। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূল উদ্দেশ্য হলো জনশক্তির অভাবকে রোবট ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি দিয়ে পূরণ করা। পৃথিবীর সব দেশে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব একই মাত্রায় হবে না। জাপান ইতিমধ্যেই বলেছে আমরা যান্ত্রিক সভ্যতা চাইনা,মানবিক সভ্যতা চাই। এই যান্ত্রিক সভ্যতা দিয়ে মানবজাতি এগুতে পারেনা। সেই কারণে তারা বলছে সোসাইটি ৫০ গড়ে তুলতে হবে। জাপান মনে করে প্রযুক্তি হতে হবে মানবিক। বাংলাদেশে চতুর্থশিল্প বিপ্লবের প্রয়োগ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর মতো ঐ পর্যায়ে এ মূহুর্তে হবে না। এর প্রয়োগ ভিন্ন পর্যায়ে হবে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের প্রভাব ইতিমধ্যে বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে। আগামী কম-বেশি এক দশকের মধ্যে শিল্প খাতের ৫৩ লাখ পেশাজীবীর পেশা পরিবর্তন করতে হবে। ২০৪১ সালের মধ্যে পোশাক ও বস্ত্র শিল্পের ৬০ ভাগ,আসবাবপত্র শিল্পের ৫৫ ভাগ,প্রক্রিয়াজাত খাদ্য ও কৃষিতে ৪০ ভাগ, চামড়া শিল্পের ৩৫ ভাগ এবং পর্যটন শিল্পের ২০ ভাগ জনবলের চাকরি পরিবর্তন করতে হবে অর্থাৎ চাকরি হারাবে। আমরা পৃথিবীতে এক অসাধারণ ভালো সময়ে বসবাস করছি। পৃথিবীতে ১২ বিলিয়ন ড্রাইভার লাগে। এখন ড্রাইভার লেস গাড়ি চলবে। এই টেকনোলজি উন্নত বিশ্বের ড্রাইভারের চাহিদা পূরণ করবে। যারা ড্রাইভারের কাজ করতো তারা দ্রুত প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ জনশক্তি হয়ে অন্য সেক্টরে কাজ করবে। প্রশ্ন হলো সবাই কী প্রশিক্ষণ নিয়ে দক্ষ হয়ে কাজ যোগাড় করতে পারবে,যারা পারবে না তাদের কি হবে। তবে আশার কথা হলো এই কাজ হারানো চাপ একসাথে আসবে না। পর্যায়ক্রমে আসবে। আর এজন্য বর্তমান শিক্ষাব্যবস্হার পরিবর্তে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সহায়ক শিক্ষাব্যবস্হা গড়ে তুলতে হবে। ইন্ডাস্ট্রি এবং একাডেমির মধ্যে সমন্বয় গড়ে তুলতে হবে। যাতে শ্রম বাজারের চাহিদা মোতাবেক দক্ষ জনবল তৈরি করা যায়।
বিশ্বের দুই শত কোটি মানুষের অপূরণকৃত প্রয়োজন বিশ্ব অর্থনীতির সাথে সম্পৃক্ত করার সুযোগ এনে দেবে এটাই হলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ইতিবাচক দিক। এর মাধ্যমে অতিরিক্ত চাহিদা ও যোগান সৃষ্টি হবে। ডিজিটাল সক্ষমতা অর্জনে সবার আগ্রহ থাকবে। বাংলাদেশের মতো অতিরিক্ত জনশক্তির দেশগুলো তাদের শ্রমশক্তিকে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা নিতে পারবে। তবে এ জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়ন। আমাদের দেশে ইতিমধ্যেই অদক্ষতাকে কেন্দ্র করে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে যারা চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় দক্ষ জনশক্তি তৈরি করবে। এরা ভূঁইফোড়, এরা অদক্ষ জনবল তৈরি করছে,মানুষকে ঠকাচ্ছে, দেশের ক্ষতি করে লাভবান হচ্ছে। দ্রুতই পরিকল্পনা মাফিক সঠিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে, তাহলে এসব ভূয়া প্রতিষ্ঠান এমনিতেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব মোকাবিলায় সরকারি, বেসরকারিসহ সংশ্লিষ্ট সকল অংশীজনদের সাথে ইতিমধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছে, যা খুবই ইতিবাচক দিক। দেশের জনসাধারণকে এ বিষয়ে সচেতন করতে হবে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সম্ভাব্য চ্যলেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে হবে এবং এগুলো মোকাবিলার উপায় খুঁজে বের করতে হবে। বিষয়টি খুব সহজ নয়, এজন্য বিশ্বের উন্নত দেশের অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে। জ্ঞান যদি কাজেই না লাগে, সে জ্ঞানের কোনো মূল্য নেই। তাই উন্নত দেশের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান উন্নয়নশীল দেশসহ সকল দেশে সহজে এবং বাধাহীনভাবে বিনিময় করতে হবে। এভাবেই চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুফল সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়বে। জাতির আশা আমাদের ডিজিটাল প্রজন্ম হাত ধরে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ দক্ষতার সাথে মোকাবিলা করে স্বপ্ন পূরণের নতুন যুগে প্রবেশ করবে বাংলাদেশ।
সংবাদটি শেয়ার করুন