ঢাকা ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি


ছোটগল্প ‘আলো-অন্ধকার’

abdul
প্রকাশিত জানুয়ারি ২৮, ২০১৬, ০৬:২৮ অপরাহ্ণ
ছোটগল্প ‘আলো-অন্ধকার’

ছোটগল্প ‘আলো-অন্ধকার’
মধ্যাহ্ন ভোজনের পর খানিক যান্ত্রিক বিশ্রাম! এর পরপর তল্পিতল্পা গুছিয়ে সোজা রাধানগর বাজারের এক অটোরিকসায় উঠে বসলাম। ড্রাইভার ক্ষীণস্বরে জিজ্ঞেস করলেন- বেশি জরুর নি? আমি মাথা নেড়ে না করলাম। ড্রাইভার বোধ করি একটু নিরাশই হল।

তপ্ত রোদ্দুর। কোথাও এতটুকু বাতাসের লেশও নেই। সমস্ত পৃথিবীই যেন অসহ্য উত্তাপে ক্রমশই হাঁপিয়ে উঠছে। আমার শরীরের জামা ঘামে ভিজে একাকার তবুও ড্রাইভারকে কিছু বললাম না। ড্রাইভার যাত্রী খোঁজতে থাকে। একটু সামনেই কয়েকজন সুন্দরী মহিলা গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে গাড়ির অপেক্ষা করছিল।

ড্রাইভার কী মনে করে যেন তার অটোরিকসাটি মহিলাদের সামনে এনে দাঁড় করাল। মহিলাদের জিজ্ঞেস করতেই তারা ভরাট গলায় উত্তর দিল- আমরা যাইতাম নায়; আমরার গাড়ি রাখা আছে। ড্রাইভারের মুখ ম্লান হয়ে আসে। অস্ফুট স্বরে বলে- কফালটাই খারাপ! এরপর বাঁকা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। আমার ঘর্মাক্ত অবস্থা দেখে ড্রাইভারের বুঝি মায়াই হল! অটোরিকসাটি রান করাল।

বাউর বাগ পয়েন্টে এসে গাড়ি থামা মাত্রই এক বৃদ্ধলোক তড়িৎগতিতে উঠে বসলো। এরপর আরেকজন মধ্যবয়সী যুবক। আমি মোবাইলে ইন্টারনেট ব্রাউজিং করা রেখে বৃদ্ধ লোকটির দিকে তাকাই। সালাম দিতেই বৃদ্ধ লোকটি ম্লান হেসে জিজ্ঞেস করলো- বাবা, আমারে চিনিলাইছোনি?- জ্বি অয়। তোমারে তো ঠিক… – আমি … পোয়া। আফনে বালা আছইননি? –আছি রে বাবা কোনরখম। তুমি … তান ফোয়ানি? তুমি নি ছাখরি খর কলেজো? – জ্বি অয়।

বৃদ্ধ লোকটি অবিরত কথা বলতেই থাকে। আমার বাবাকে ছোটবেলা থেকে কীভাবে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন, বড় হয়ে কোথায় কীভাবে গেলেন, কোথায় বাড়ি করলেন, যুদ্ধের সময় কীভাবে আশ্রয় দিয়েছেন তার সবই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করে যাচ্ছেন।

আমি লোকটির দিকে তাকাই। মুখভর্তি দাড়ি। কপালজুড়ে চিন্তার রেখা নিভৃতে অজানা ইতিহাসের ঘ্রাণ শুঁকে চলেছে। পরনে কয়েক বছরের পুরনো জামা। হাতে কাপড়ের ব্যাগভর্তি কীসের যেন পাতা! নিতান্ত দায়ে পড়েই হয়ত বাজারে নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তার পরিবারের সদস্যদের কথা জিজ্ঞেস করতেই তিনি শুরু করলেন করুন কাহিনি। এক বনেদী পরিবারের অবক্ষয়ের নির্মম কাহিনি।

এ কাহিনি জুড়ে কেবলি ভাগ্যদেবতার নির্মম প্রহসন! সারাংশ যা জানা গেল তাতে মনে হল- এখন তার পরিবারের অবস্থা খুবই খারাপ। অনেকটা দিন আনে দিন খায় গোছের। তাছাড়া পরিবারের তিনজন রোগীর পথ্য জোগার করা এবং তাদের সেবা শুশ্রূষা করতে করতে তিনি নিজেই এখন রোগী হওয়ার পথে!

আমি বৃদ্ধলোক ও তাঁর সাথের মানুষটির ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। খেয়া নৌকাতে উঠেও দুজনে খুব কাছাকাছি বসলাম। বৃদ্ধ লোকটির পারিবারিক গল্প চলতেই থাকে।

লোকটি অক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন। তাঁর চোখের ভাষাই বলে দেয় তাঁর পারিবারিক প্রহসনের কথা! বড় ভাইয়ের পড়াশোনা, তার ছেলে-সন্তানদের পড়াশোনা, জমি-জমা, গরু-বাছুর, হাট-বাজার থেকে শুরু করে সবকিছুই সে নিজ দায়িত্বে করতো। বড় ভাই ও তার সন্তানদের শিক্ষিত ও মানুষ করে গড়ে তুলতে তাঁর চেষ্টার ত্রুটি ছিল না।

এদের আলোতে আনলেও নিজে থেকে গেলেন অন্ধকারে। আর এই অন্ধকারটাই যেন তার জীবনের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াল। বড় ভাই ও তার সন্তানেরা জমির দলিল দস্তাবেজ নিজেদের নামে কৌশলে তুলে নিল।

আজ এই বৃদ্ধলোকটির স্ত্রী ও সন্তান কঠিন রোগে আক্রান্ত। বাজারে সবজির পাতাগুলো বিক্রি করেই হয়ত তার স্ত্রীর পথ্যের জোগাড় হবে! কথাগুলো বলতে বলতেই বৃদ্ধ লোকটির চোখ ঝাঁপসা হয়ে আসে। আমি তার চোখের দিকে আর তাকানোর সাহস পেলাম না। নৌকা ততক্ষণে পাড়ে এসে ভিড়েছে।

আমি আবারও তার ভাড়া মিটিয়ে দিলাম। জাফলংয়ের মেইন রোডে উঠার আগে তার হাতে পাঁচশ টাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বললাম- চাছা, … অটা রাখি দেউক্কা। চাছীরে কিচ্চু কিনিয়া দিবা।

টাকাটি হাতে দিতেই লোকটির চোখ দিয়ে নিভৃতে জল টপটপ করে গড়িয়ে পড়তে লাগলো। আমি আমার ডান হাত দিয়ে বৃদ্ধলোকটির চোখের জল মুছে দিয়ে বললাম- চাছা, … বালা থাকইন যে, চাছীরে আমার সালাম দিবা। নিজেকে সামলাতেও আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল।

কাজেই আর মুহূর্ত দেরি না করে কথাটি বলেই আমি মেইন রোডে উঠে এলাম। তপ্ত রোদ্দুরেও আমার চোখ ঝাঁপসা! চোখে তো কিছু পড়েনি, তবে ঝাঁপসা কেন?

লেখক: মুনশি আলিম

সংবাদটি শেয়ার করুন

September 2024
S M T W T F S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930