মোহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন
নদীর এপার ভাঙ্গে, ওপার গড়ে- এইতো নদীর খেলা। সকাল বেলার ধনীরে তুই- ফকির সন্ধ্যা বেল। কথায় আছে আগুনে পোড়া গেলে ভিটে মাটি টিকে যায়। কিন্তু নদী ভাঙ্গলে কিছুই অবশিষ্ট থাকে না।
উত্তাল পদ্মার স্রোত ও সর্বগ্রাসী ঘূর্ণি;এক এক করে গ্রাস করছে দালান-বাড়ি-সড়ক-হাট-বাজার-স্কুল-হাসপাতাল-ফসলি জমি-ফলের বাগান সবকিছু । ভাঙছে মানুষের স্বপ্ন,মনের গহিনে বাসা বাঁধছে অনিশ্চয়তা । চোখের সামনে সবকিছু বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীগর্ভে। ভাঙনের কবলে পড়ে সর্বস্ব হারিয়ে মানুষ ছুটছে অজানা গন্তব্যে। হাজার হাজার গৃহহীন মানুষের মাথা গোঁজার মতো ঠাঁই পর্যন্ত নেই। খোলা আকাশের নিচে কোনোমতে বেঁচে আছে তারা। খাদ্য নেই, পানি নেই,ওষুধ নেই। চলছে হাহাকার,বোবা কান্না আর আর্তনাদ।
নদীভাঙনে অনেকের জীবন দুর্বিষহ হয়েছে। কেউ হারিয়েছেন পরিবার, কেউ জীবিকা আর কেউ বা জীবনের সবকিছু। নদী ভাঙনে দিশেহারা হয়ে পড়ে নদীপাড়ের মানুষ। নিমিষেই বিলীন হয়ে যাচ্ছে ঘরবাড়ি,ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান,জমিজমাসহ সবকিছু। ভাঙনের শিকার মানুষের জীবন হয়ে উঠছে নরকসম।নদীর ভাঙাগড়ায় যে হারায়,তার হাহাকার ছাড়া কিছুই থাকে না। ভাঙনে নিঃস্ব মানুষের কান্না মিলিয়ে যায় গগনে। নদীভাঙনে ভিটেমাটি,সহায়-সম্বল হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ পথে বসছেন। অনেকে নদীভাঙনে উদ্বাস্তু হয়ে বস্তিতে আশ্রয় নিয়েছেন।
গোলা ভরা ধান, ঘোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, ছিল স্বচ্ছলতা। চোখের সামনেই সব বিলীন হয়ে আজ নি:স্ব সর্বহারা,নেই পরিবার নিয়ে মাথা গোজার ঠাই। পারছেনা কাউকে কিছু বলতে শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে পদ্মার বুকে। কয়েক বছর আগেও অর্থাৎ ২০১৮ সালেই শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া এলাকায় সাড়ে ছয় হাজার পরিবার নদীভাঙনের শিকার হয়। নদীগর্ভে বিলীন হয় পাকা ঘরবাড়ি,রাস্তাঘাট,ব্রিজ-কালভার্ট,হাট-বাজার,গাছপালা,ফসলি জমি,মসজিদ-মন্দির, হাসপাতাল,শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান,নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার মানুষের নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার দুঃখ হাহাকার দেখার যেন কেউই ছিল না। বিগত টানা ৩৫ বছরের ইতিহাসে নদী ভাঙন রোধ করতে কোনো প্রকার চেষ্টা করতে দেখা যায়নি। এমনটিই অভিযোগ নড়িয়ার হাজারো মানুষের। নদীতে নিজের ঘরবাড়ি জমিজমা হারানোর পর, নিম্নআয়ের বেশিরভাগ মানুষই ঢাকা ও বড় শহরগুলোতে পাড়ি জমায়। অনেকেই আবার অন্যের জমি বছর ভিত্তিতে ভাড়া নিয়ে, ঘর তুলে বসবাস করেন। কিন্তু এখন সেসব জমি ভাড়া পাওয়া যাচ্ছে, সেখানে বর্ষার পানি উঠে থাকায় তাদের পক্ষে বসতি করাও সম্ভব হচ্ছে না।
বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী প্রজন্ম নিয়ে ভাবেন,সেজন্য তিনি আগামীর বাসযোগ্য বিশ্বমানের সুবিধা সংবলিত বাংলাদেশ গড়তে চান। তার দূরদর্শী পদক্ষেপ ডেল্টাপ্লান-২১০০ বাস্তবায়নেরও ঘোষণা দিয়েছেন। আর এই মহাপরিকল্পনার সিংহভাগ কাজই পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বাস্তবায়ন করবে। এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে সারাদেশে নদী ভাঙন ও জলাবদ্ধতার কোনো সমস্যাই থাকবে না। দেশের নদী ভাঙন কবলিত এলাকা রক্ষায় ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে সরকার । নদী ভাঙনের ঘর-বাড়ি হারা মানুষের জন্য মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ঘরের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
২০১১ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাত বছরেই ঐ এলাকার প্রায় সোয়া ১৩ বর্গ কি.মি. এলাকা নদীতে তলিয়ে গেছে। এর মধ্যে ২০১১-১২ থেকে ২০১৪-১৫ সময়কাল পর্যন্ত নড়িয়াতে প্রতিবছর গড়ে আধা বর্গ কি.মি. এর বেশি এলাকা ভাঙনের শিকার হয়েছে। চরজুজিরা, মুলফৎগঞ্জ ও নড়িয়ায় ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ভেঙেছে প্রায় ২ বর্গ কি.মি. ।
প্রমত্তা পদ্মার ভাঙ্গনে নি:স্বদের কান্নার আওয়াজ মিলিয়ে গেছে মানুষের পদচারনায়। পদ্মা পাড়ের সেই মানুষগুলোর চোখে মুখে নেই কোনো অনিশ্চিয়তার অমানিশি। নদীভাঙন কবলিত এলাকাকে রক্ষায় বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে সেই জায়গায় এখন ভাঙন রোধ হয়ে গড়ে উঠেছে মানুষের নিরাপদ আবাসস্থল। আর পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ যেন এখন পর্যটন নগরী। প্রতিদিনই শত শত লোক নদীর পাড়ে ঘুরতে আসছেন। ১ হাজার ৪১৭ কোটি টাকা ব্যয়ে শরীয়তপুরের জাজিরা ও নড়িয়া উপজেলার পদ্মা নদীর ডান তীর রক্ষা বাঁধ প্রকল্পের অধীনেই নির্মাণ করা হয়েছে ১০ কি:মি: পায়ে হাঁটার এই পাকা সড়ক যার নাম করণ করা হয়েছে ‘জয়বাংলা এভিনিউ’ নড়িয়া।
পদ্মা নদীর ডান তীররক্ষা বাঁধ প্রকল্পের অধীনে নির্মিত শরীয়তপুরের নড়িয়ার পদ্মা পাড়ের ১০ কিলোমিটার পায়ে হাঁটা (ওয়াকওয়ে) পাকা সড়ক । যার নাম রাখা হয়েছে ‘জয়বাংলা এভিনিউ’ এখন হাজারো মানুষের পদচারণায় মুখর। প্রতিদিনই শতাধিক মানুষ পরিবার নিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন নড়িয়ার পদ্মা পাড়ে। পদ্মার পলি মিশ্রিত পানিতে সৈকতের বিনোদন পাচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা। নদী ভাঙনের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত ছিল এলাকাটি। এখন পর্যটন এলাকায় রূপ নিয়েছে,স্বপ্নকে হার মানিয়ে।
‘জয়বাংলা এভিনিউ’ স্থানীয়দের কাছে ‘মিনি কক্সবাজার’। ভ্রমণ পিপাসুদের উপচেপড়া ভিড়ে হাজারো মানুষের পদচারনায় মুখরিত। প্রতিদিনই হাজারো মানুষ পরিবার নিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন পদ্মা পাড়ে। পদ্মার পলি মিশ্রিত পানিতে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের বিনোদন পাচ্ছেন ভ্রমণপিপাসুরা ।
শত বছরের পদ্মার ভয়াল ভাঙন রোধ করে পদ্মার ডান তীরের স্থায়ী বাঁধের ‘জয় বাংলা এভিনিউ নড়িয়া’ প্রতিনিয়ত মানুষকে আকর্ষিত করে। প্রতিদিন শরীয়তপুর ও আশপাশের জেলার মানুষ এখানে সপরিবারে এসে ঘুরে ফিরে আনন্দে সময় কাটাচ্ছেন। পদ্মা পাড়ে নতুন এই পর্যটন কেন্দ্রে বিভিন্ন ফাস্টফুটের দোকান গড়ে উঠেছে। সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থানের,বেড়েছে কর্মচাঞ্চল্য।
পর্যটকদের সুবিধার্থে সড়কের পাশে তৈরি হবে বিশ্রামাগার। রয়েছে প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থাও। রাতে ‘জয়বাংলা এভিনিউ’ সোডিয়াম লাইটে আলোকিত। ঝাউ গাছ, ওয়াকওয়েতে টাইলস, নদী পাড়ের সিড়ি ভ্রমণ পিপাসুদের নতুন মাত্রা যোগ করেছে । সব মিলে কয়েক বছর আগের ভয়াল পদ্মা পাড় এখন আনন্দমুখর নতুন পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এখন আর পদ্মা পাড়ে কান্নার শব্দ শোনা যায় না,শোনা যায় আনন্দ ধ্বনি। পদ্মায় সূর্য উদয় ও সূর্যাস্ত দেখে মুগ্ধ । পর্যটক ও দর্শনার্থীরা বাঁধের পাশে বেঞ্চে বসে এবং নদীর তীরে ফেলে রাখা ব্লকের ওপর বসে পদ্মার পানিতে পা ভিজিয়ে আনন্দ উপভোগ করছে।
#
লেখক: পিআরও, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়
সংবাদটি শেয়ার করুন