দিলরুবা আহমেদ
এক.
মারুফ বেরিয়ে যাবার সময় নিধি দরজায় এসে দাড়ালো। চলে যাবার পরও বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে দাঁড়িয়ে-ই থাকলো। প্রায়ই এই সাত সকালে মারুফ যখন বেরিয়ে যায় নিধি তখন থাকে ঘুমে কাদা হয়ে। আঠা হয়ে লেগে থাকে বিছানায়। আদা জল খেয়েও তাকে উঠানো যায় না। আজ উঠেছে। কাল রাতে যখন থেকে খবরটা শুনেছে তখন থেকেই মন অস্থির, বিষণœ। আসলে বিষণœুুতার চেয়েও বেশি বিপন্ন বোধ করছে। বারে বারেই মনে হচ্ছে এমনও হতে পারে!! সত্যিই পারে! কিন্তু হচ্ছে তো । হয়েই তো যাচ্ছে !!এত কাছে ,এত পাশে, এরকম কিছু হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে ,ভাবতেই কেমন যেনো গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। কি ভয়ংকর একটা ব্যাপার। আরো কত রকম হতে পারতো কিন্তু এরকম কেন হতে যাচ্ছে। মারুফ যদি এমন করতো তাহলে সে কোন চুলোয় যেতো!! ভেবে এদিক এদিক অনেক দিকেই চাইলো। কোথায় যেতো সে, তা ভেবে নিজেই আকুল হলো।
কী দুর্গতি।কী দূর্গতি। কী দূর্দশা। ভয়াবহ দূরমতি। কী ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন । দুমরে মুচরে উঠছে যেন চারিধার। নিধি ভাবতে ভাবতে একা একাই দিশেহারা অনুভব করে। পরের ক্ষণেই মনে হলো ,নাহ্ যাক, এত ভোরে, এত কিছু ভাবতে তার ভালো লাগছে না। তারচেয়ে ভালো লাগছে দেখতে এই আলো আধারের প্রকৃতি, যেন লুকোচুরি খেলছে। আধার ছেড়ে আলো আসছে। কি পবিত্র একটা হালকা হালকা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া। মারুফ আগেও বলেছে এই সাত সকালে কাজে যেতে তার ভাল লাগে। কারণ খুব ফ্রেশ একটা হাওয়া থাকে তখন, চারদিকে, তাই। ডালাসের এত গরমের মাঝেও এই ভোরের বেলায় সে জানালা নামিয়ে দিয়ে এ.সি বন্ধ করে গাড়ি চালায়। বাতাসে নাক ভরে শ্বাস নেয়। তার কাজের জায়গাটা অনেক দূরে। কিছু করার নেই। যেখানে কাজ পাবে সেখানেই তো করতে হবে। কাগজপত্র থাকলে অনেক বাদ বিচারের সুযোগ থাকে। তাদের এত দরাদরির অবস্থা নেই। টেনে হিচড়ে দিন চলে যাচ্ছে, এই ঢের। মেনে নিতে হচ্ছে এভাবে চলে যাবার দিনগুলোও। যত স্বপ্ন আশা ছিল সব বাক্সবন্দী। লু হাওয়ায় উড়েও গেছে অনেক পত্র। স্বপ্ন লেখা পত্র, নীল খাম আর গোলাপী চিঠিতে ভরা মায়াময় কথক জীবন কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। কথা বলতেও আজকাল ভালো লাগে না। কোন কথায় কাকে কি বলে বসবে কে জানে। গল্পের আঙ্গিনায় সীমানা টেনে রেখেছে। কম মানুষ, কম মিশা, কম যোগাযোগ। যেন এক লুকিয়ে থাকার জীবন হয়েছে তার । চল্লিশ পেরুতেই যেন বুড়া-মুড়া হয়ে যাচ্ছে। বুড়িয়ে গেছে জীবন নদী, স্রোত, ফলন, বপন উল্লাস। শ্লথ মন্থর মিয়মান এক সময়ের পত্রিকা যেনো আজ সে। উৎসাহ হারাচ্ছে ক্রমে। উদ্যাম তো নাহ-ই। কেবলই মনে হয় কবে ধরা পড়ে যাবে। কবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বার করে দেবে এই দেশ থেকে। দুরু দুরু বুকে ভীরু পথ চলা। কেন যে মরতে এসেছিল এই দেশে। ভালো-ই-তো ছিল নিজ দেশে। মারুফের খালাত ভাই রাসেল ভাই থাকতেন ডালাসে। উনি মারুফের ভাই থেকে বন্ধু বেশি । প্রায় সমবয়সী। সেই উনিই তাল তুললেন। দেশে থেকে কি হবে। চলে আস এই দেশে। ব্যাস এরপর ভিজিট ভিসাতে সেই যে আট বছর আগে এসে ঢুকলো আর যাওয়া হয়নি। গেলে আর ফিরে আসাও যাবে না। ওয়ান ওয়ে জার্নি। এসেছো যখন থেকে যাও। চলে গেলে আর আসা-আসি নাই। থেকে যেতে হবে যতদিন পার। রাসেল ভাইয়ের তো কাগজপত্র আছে। কোন অসুবিধা নেই। দেশে যায় আবার ফিরে আসে। বেশ কয়েকটা গ্যাস স্টেশনের মালিক। দেশে বলতো পেট্রোল পাম্প। এখানে গ্যাস স্টেশন। ও-গুলোর একটাতেই বসে বা দাডায় মারুফ। রাসেল ভাইয়ের বিশ্বস্ত লোক দরকার ছিল। সেই স্থানটাই পূরণ করেছে মারুফ। রাসেল ভাইয়ের লাভ হয়েছে। ওরা এখন পুরাপুরি নির্ভরশীল রাসেল ভাইয়ের উপর। মেয়ে দুটো দেশে থাকতেই হয়েছিল, না হলে এদেশে এসে হেলথ ইনসুরেন্স আর ইনলিগাল অবস্থার কারণে বাচ্চা আর নিতে সাহস করতো না। কত শখ ছিল একটা ছেলের। আর হয়েছে তার ছেলে। রাসেল ভাইয়ের বৌ শরীফা ভাবী তো প্রায়ই বলতেন বাচ্চা নিতে। এদেশে জন্মানো মাত্রই সে এদেশের নাগরিক হয়ে যাবে। সেই বাচ্চা বড় হয়ে তাদের জন্য এপলাই করলে তারাও আমেরিকান হয়ে যাবে। যত্তসব। মূলা ঝুলানো নাকের উপর তার একেবারেই না পছন্দ। কবে কোন কালে কি হবে তাই ভেবে এখন গোফে তা দাও সবাই মিলে। এক্কেবারেই যত্তসব আইডিয়া। শরীফা ভাবীর কোন আইডিয়াই তার পছন্দ হয় না। মারুফের ইচ্ছা থাকলেও তার আর বাচ্চা নেওয়ার শখ নেই। জ্বর হলে একজন ডাক্তারের কাছে যাওয়া নিয়ে যত ঝামেলা হয় , সেখানে তার আর পেট বড় করার সাহস নেই। শরীফা ভাবী অবশ্য বলেন, প্যাগানন্ট মহিলারা লিগাল না ইললিগাল সেটা ধরা হবে না। প্রচুর সুবিধা পাবে। শরীফা ভাবীর কথায় নিধি নাচতে রাজি নয়। ওরা উসকে দিয়ে ফসকে পড়ে। তাদের এনে এদেশে এক বন্দী জীবন দিয়েছে। রাসেল ভাইয়ের উপর সব সময় তার এক ধরনের অসন্তোষ কাজ করে। যদিও মারুফ বারে বারেই বলে ওরাই তো সব করছে, করেছে, আমাদের জন্য। তারপরও ঐ দুজনকে তার পছন্দ হয় না। ভুল পথে তাদের এনেছে। ভুল ধারণা দিয়েছে। ভুলে অভ্যস্ত করেছে। মারুফ সব ভুলকেই সত্য বলে বিশ্বাস করেছে। নিধি পারছে না। পারছে কই !! তবে নিধির মন মরে গেছে। সে আর চায়ও না এত অনিশ্চিত জীবনের মাঝে নতুন আরেকজনকে টেনে আনতে। মেয়ে দুটোর কি ভবিষ্যৎ তাই ভেবে আনমনে প্রায়ই খাবি খায়। এদের কি হবে। এখন তো একজন নাইনথ গ্রেডে, আরেকজন ইলাভেনথ গ্রেড়ে যাচ্ছে। স্কুল বলে সাদাকালো লাল নীল সবুজ কাগজ নিয়ে ঝামেলা করে না। কিন্তু এরপর ভার্সিটিতে গেলে তখন কি হবে? কিভাবে ভর্ত্তি হবে তারা! কোন স্কলারশিপ কি পাবে তারা! মনে তো হয় না। মারুফ এত টাকা দেবে কোত্থেকে! শেষে কি মেয়ে দুটো গিয়ে দাড়াবে ম্যাক ডোনালস এ !! বারগার বানিয়ে জীবন কাটাতে শুরু করবে!! কে যেন বললো কাগজ ছাড়া ম্যাক ডোনালস এ-ও কাজ পাবে না। কি মুসিবৎ!!! ভাবতেই নিধির কান্না পায়। মাঝে মাঝেই তার কান্না পায়। প্রায়ই সে একা একা রীতিমত শব্দ করে কাঁদে। নিজের কষ্ট সে সইছে কিন্তু তাই বলে মেয়েদের এই দূর্দশার কথা ভাবলেই তাকে মহা আতংকগ্রস্থ হয়ে পড়তে হয়। ভয়াবহ আতংক তাকে গ্রাস করে। আতশবাজীর মতন উবে যায় আমেরিকার মোহ্। একটি সবুজ কাগজ, যেনো এখন মরিচিকা। জীয়ন কাঠি যেনো। কোথায় পাবে খুজে। কোথায় গেলে, কাকে বললে সে পাবে সবুজের দেখা। চারদিক যেন ধূসর। আরো ফ্যাকাশে হচ্ছে যেন ক্রমে। আরো পীত বর্ণ ধারণ করছে। যেনো এক ফোটা জলের তৃষ্ণা নিয়ে দাড়িয়ে রয়েছে, সাহারায়। চারজনই এখন যেনো ভাবছে কবে, কোথায়, কিভাবে ঐ কাগজটা আসবে। বড় মেয়েটি কথা বলে কম, অথচ সেই কিনা কয়দিন আগে বলেছিল বাপ-কে, :সবুজ কাগজটা হলুদ হয়ে গেছে বাপী। তুমি আর পাবে না। তোমাকে দেখ, পুলিশ এসে রেড কার্ড দেখাবে। কী ভয়ংকর কথা, অথচ মেয়েটা বললো কত সহজে। মারুফ মন খারাপ করে চলে গিয়েছিল। মেয়েকে ধমক দিয়ে নিধি জিজ্ঞেসও করেছিল, এমন কথা বলছিস কেন বাপটাকে? :না বলে কি করবো। আমাদের ক্লাশের সবাইতো ড্রাইভিং লাইসেন্সের জন্য রেডি হচ্ছে। পেয়েও গেছে লারনার লাইসেন্স কয়েকজন। আমরা ইললিগাল বলে আমি তো এ্যাপলাই -ই করতে পারছি না। নিধি চুপ করে যায়। কিছু বলে না। আজ এত সুন্দর সকালে দরজায় দাড়িয়ে হঠাৎ তার ভয়ে কষ্টে অসহায়ত্বে বড় কান্না পেতে থাকে। আপন মনেই বলতে থাকে হে খোদা, পথ দেখাও তুমি। তুমি পথ দেখাও। হে পারওয়ারদিগার, তুমি রক্ষা কর। হঠাৎ দুটো কাঠ বিড়ালী ছুটে গেল সামনে দিয়ে। সিড়ির মুখেই একটা বিশাল বট গাছ আছে। বহুদিনের পুরাতন গাছ। কাঠ বিড়ালী ছুটে ঐ গাছে উঠলো । পাশেই কাঠের সিড়ি । সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে এলেই তাদের এ্যাপাটমেন্ট। মোট চারটা এ্যাপাটমেন্ট। নীচেও চারটা। তার আশেপাশের সবাইকে সে চিনে গেছে। প্রায় বছর তিনেক তো হবেই এইখানে উঠে এসেছে। আগের এ্যাপাটমেন্টে এক ইললি গাল সুদানীকে ধরতে এসে পুলিশ সবার ঘরে ঢুকে ঢুকে সার্চ করছিল। এত ভয় পেয়ে গিয়েছিল যে পরের দুদিনের মধ্যেই বাসা বদল। তারাও যে ইললিগাল জানতে পারলে পুলিশ যে কি করতো কে জানে। না আসলে জানে সে। পুলিশ কি করতো তা সে ভালই জানে। তবে এতটা সে আর ভাবতে চায় না। মাঝে মাঝে এটা ভাবে যে, ভাবতেই পারে না ,অথচ ঘটে গেলে সে কি করবে! ভয়াবহ ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন যেন সেটা। লুকোচুরি, লুকোচুরি, লুকোচুরির জীবন। হঠাৎ যদি এই এ্যাপটমেন্টে এসে হানা দেয় পুলিশ কোথায় লুকাবে তারা তখন। ছোটবেলায় কত খেলেছে লুকোচুরি, এখন আবার শুরু হয়েছে। এখন বললেই এখন না। গত আট বছর ধরেই চলছে এই লুকোচুরির জীবন। পিক আ-বু। পিক-আ-বু। এদেশের বাচ্চারা তাই বলে। দেশে বলতো, কু-লু-ক। কু-লুক বললেই খুজতে বের হতো পুলিশ হিসাবে যাকে রাখা হতো সেই বন্ধুটি। কু-লুক মানেই তো খারাপ লুক। তাই কি!! মানে কি এই কু-লুক-এর। এলো কোত্থেকে এই আজব শব্দ !! জানা হয়নি কখনোই। এক জীবনে কত কিছুই অজানা রয়ে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিধি এক মনে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। কী বিশালতা ওখানে। আকাশবাসী হলেই শুধু তার মুক্তি আসবে। পাখী হতে মন চায়। ঘুরবে জগৎময়। কোন সীমানা থাকবে না। পরাধীনতা থাকবে না। ভয়ডরহীন জীবন চায় নিধি। শুধু জান না কেমন করে পাবে। বুক ফুলিয়ে গলা উচিয়ে কালেম ভাইতো প্রায়ই বলতেন যে সাধারণ ক্ষমা আসছে। সবাই ক্ষমা পেয়ে নাগরিক হয়ে যাবে। কোথায় কি!! আজও তো হলো না। কালেম ভাই অবশ্যই হাল ছেড়ে দিয়েছেন বোঝা যাচ্ছে। না হলে এমন কাজ করতে যাচ্ছেন কি করে। হুরমুড় করে সামনের বাসা থেকে বের হলো ভারতী। কাজে যাচ্ছে কি সাত সকালে। ভীষণ মোটা সে। কিন্তু পড়ে আছে ঢোলা শার্ট, চিপা জিনস প্যান্ট আর কেড়স। :কোথায় যাও! কাজে। : না ,মর্নিং ওয়াকে। দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে ভারতী সিড়ির দিকে। ভারতী তো প্রায়ই বলে পাটেলকে সে বিয়েই করেছিল আমেরিকা আসবার জন্য। এসেছেও। মনজিল এ পৌছেছে। তবে সুখে নেই। হাড়ে বজ্জাত লোকটা। প্রায়ই মারপিট শুরু হয় ওদের বাসায়। পুলিশ আসে। ভারতীয় বলে তাকে পিটায়। পাটেল বলে ভারতী তাকে কিলায়। কি যে সত্যি কে জানে। সেভাবে ভাবলে সে নিজে অনেক সুখী। কত ভাল মানুষ মারুফ। কত যতেœ আদরে রেখেছে তাকে। মেয়ে দুটাকেও নয়নের মনি করে রেখেছে। এত পরিশ্রম করে দিনভর। রাতভর। তারপরও কোন রাগ, শোক, কষ্টের তাপ মেয়েদেরকে বা বৌ-কে বুঝতে দেয় না। হাসি মুখে ঘুরে বেড়ায়। আহা এত ভাল মানুষ মারুফ, আল্লাহ কেন যে তার দিকে রহমতের বৃষ্টি বর্ষায় না!! ভারতীয় পাশের এ্যাপাটমেন্টেই থাকে এক ইরাকী। মাতেও না। তাকায়ও না। কথা তো বলেই না। একা একা থাকে। রহস্যময় চরিত্র। সবশেষ ৪নং এ্যাপাটমেন্টে থাকে চীনা একটা পরিবার। স্বামী স্ত্রী আর একটি মেয়ে। মেয়েটি অবশ্য ঐ লোকের আগের ঘরের। মেয়েটি পুরোপুরি আফ্রিকানদের মতন দেখতে। কালো আমেরিকান মেয়ে। প্রথম দিন তো না বুঝেই মারুফকে বলেও ছিল, : দেখেছো ওরা কাজের লোকও রেখেছে এ্যাপার্টমেন্টে। মারুফ তাই শুনে জবাব দিয়েছিল, :জানো এ দেশে কারা কাজের লোক রাখে? এ্যাপাটমেন্টে থাকবে আবার কাজের লোক রাখবে ! এটা বাংলাদেশ পেয়েছো? :হয়তোবা চীন থেকে নিয়ে এসেছে। :চীন থেকে আফ্রিকান মেয়ে ধরে নিয়ে এসেছে। :তা হলে কি করছে ওদের বাসায়? :সাবলেট নিয়েছে কিনা দেখ। কিন্তু এখানে এই এ্যাপাটমেন্টে সাবলেট তো এলাউড না। : ১৫/১৬ বছরের মেয়ে কি সাবলেড নেবে। :চীনাদের বয়স বোঝা যায় না। :ওতো চীনাদের মতন না দেখতে।এককথা কতবার বলতে হয়। মন থাকে কোথায়? ব্যাস ঐ ইস্যু নিয়ে তারপরে দুজনার ঝগড়া হয়ে গিয়েছিল। তবে সেও বসে থাকেনি। গবেষণা আর গোয়েন্দাগিরি চালিয়ে গেছে। ছি: ছি: আজ মনে পড়লে লজ্জাই লাগে। ঐ লোকের নিজের মেয়ে এটি। আর সে কিনা কত কি ভেবেছে ঐ মেয়েকে নিয়ে। বিয়ে করেছিল আমেরিকান আফ্রিকান মহিলাকে, কাগজের জন্য। কাগজ হয়েছে। ভালোও বেসে ফেলেছিল তাকে। বাচ্চাও হলো। তারপর একসময় বৌ-টি চলে গেল। রয়ে গেল মেয়েটি। ভদ্রলোক আরেকজন চীনা মহিলাকে বিয়ে করে সুখী হয়েছেন তবে ঐ মেয়েটি রয়ে গেছে সবার মাঝে আরেকজনের অস্বিত্ব ঘোষণা দিতে। এতো সব খবর দাতা হচ্ছে ভারতী। ভারতী প্রায়ই মেয়েটিকে ‘কাগজ সুন্দরী’ বলে ডাকে। ভারতী-র বাংলা ভাগ্যিস ঐ চাইনিজ পরিবার বুঝে না। তাই জানে না তাদের মেয়েটিকে কী ডাকা হচ্ছে। ‘কাগজ সুন্দরী’র আসল নামটা সেও জানে না। মেয়েটি কথা বলে না কারও সাথেই। খুবই খাপ ছাড়া বেখাপ্পা ধরনের বলে সে যেন নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে। হঠাৎ নিধির মনে হলো মেয়েটি যেন তার মতনটা বাইরের জগত সংসার থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছে। এমন মনে হওয়াতেই যেন হঠাৎ বড় পরান পুড়ে উঠলো। আহা মেয়েটি কি অপাংতেয়। সবাই অন্যরকম তার চারধারে। সে যেন কারো নয়। কেও-যেন তার নয়। ‘কালো আর ধলো বাহিরে কেবল ভেতরে সমান রাঙা’কে যেন বলেছিল !! ভুলে গেছে নিধি। একসময় কত কবিতা মুখস্ত ছিল এখন সব ভুলে গেছে। সে যেন ক্রমে আদ্যিকালের পদ্যি বুড়ী হতে চলেছে। নাহ্ দরজার খোলা হাওয়ায় চুল উড়িয়ে আর কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে। ১০০টা পরটা বানানোর অর্ডার আছে। আজ বিকেলেই পরটা-র ডেলিভারী দিতে হবে। এখনই তাড়াতাড়ি এটা ওটা তৈরি করে বাচ্চাদের খেতে দিয়ে পরটা বানাতে বসতে হবে। কিছুদিন হয় সমুচার অর্ডার কমে গেছে। সবাই পরটা চাইছে বেশি করে। পিরোজপুর থেকে যে কাজের মেয়েটা কুমিল্লায় এসেছিল তাদের বাড়িতে কাজ করতে তাকে খুব মনে পড়ে পরটা বানাতে বসলে। সে এদেশে এলে এত্ত এত্ত পরটা দু-মিনিটেই বানিয়ে দিতে পারতো। মাঝে মাঝে মনে হয় ঐ মেয়েটার মনে হয় অভিশাপ ছিল তার উপর, না হলে এমন হয়! সে আর ঐ কাজের বুয়া এখন যেন এক কাতারে, মাঝে মাঝে তাই তার মনে হয়। দরজা বন্ধ করতে করতে নিধি ভাবে আজ একবার ফোন করে দেখবে দোকানে দোকানে যে পরটাগুলো দিয়ে এসেছিল সেগুলোর কি হাল হয়েছে। বিক্রি হয়েছে কিনা জানা দরকার। হোম মেইড জিনিষের খুব কাটতি এই দেশে। হয়ে যাবে দ্রুতই। এই বিজনেসে খুব নতুন সে। এক আপা আছেন ঐ পেছনের দিককার এক এ্যাপাটমেন্টে থাকেন ওনার পরটা খুবই চালু। ওনার থেকেই শেখা। মারুফ প্রথমে শুনে বললো, :ডালাসে ঘরে তৈরি পরটা পাওয়া যাচ্ছে বিক্রির জন্য এটাই অসাধারণ ঘটনা। সেও সাথে সাথে বলেছিল, :বৌও পাওয়া যায়, বরও। সবুজ বৌ, সবুজ বর। সেক্ষেত্রে আমারটা কোন অসাধারণ ঘটনা নয়। :ঐ বৌ- বর তো ছেড়ে দেবে বা যাবে। তোমার পরটা তো তা করবে না। :বাথরুমে- টয়লেটে গেলে এটাও ছেড়ে যাবে। মারুফ হা হা করে হেসে উঠেছিল। আর কিছু থাক বা না থাক ঐ লোক হেসে উঠে অনেক আনন্দ যেন ধরে রাখে এই চার দেওয়ালের ভেতর। ঐ হাসির তরঙ্গ-ই যেনো তাকে চমকে উঠিয়ে মনে করালো এবার কাজে নামতে হবে। দরজা বন্ধ করবে কি করবে না তখনই কানে এলো কান্নার শব্দ। এত সকালে কে কাদে। কোথায়? চেয়ে দেখে কাঠের সিড়িতে বসে বসে কাদছে আফ্রিকান চাইনীজ মেয়েটি। যাবে কি কাছে। নাহ , কি দরকার। কাদুক। কেদে কেটে ঠাণ্ডা হোক। এদেশে এতটা অযাচিতভাবে কারো পার্সোনাল লাইফে ঢু-মারা ঠিক না। হয়তো বা প্রচণ্ড শব্দে ফেটে উঠবে। তারপরও ঐ যে বাঙালী মনন, মা-গিরি, ঐ টুকু মেয়ে একা বসে কাদছে, চেয়ে চেয়ে দেখে চলে যাওয়া গেলো না ,এগিয়ে গেলো কাছে, একা কাঁদতে দিতে মন চাইলো না।। :ওয়াটস রঙ? আর ইউ ওকে? হোয়াই ক্রাইং। মেয়েটি খুব দ্রুত চোখ মুছে বললো, :আমি ওকে, গুড মরনিং। :মর্নিং। বসতে পারি তোমার পাশে? :সিউর। নিধি সিড়িতে বসলো, ওর পাশে। বললো, :ওয়েদার ইজ নাইস। যেন খেজুরে আলাপ জুড়ালো। :ইয়েস। :দেখিনি তোমাকে ক’দিন। :ইয়াহ, মায়ের কাছে দিলাম। :তুমি তাকে ভিজিট কর? থাকেন কই? :মিজোরী -তে। যাই মাঝে মাঝে, খুব কম যাই। আমরা দু’জন এখন দুরকমের। আমি বৌদ্ধ সে খৃস্টান। ও বলে আমার কোনকিছু সে পছন্দ করে না। এখানে আমি যা শিখছি তা সে পছন্দ করে না। আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে চায়, ধর্ম বদলাতে বলে। :যাবে? :নোপ। আই লাভ ড্যাড। ও তো সেই ছোটবেলায় আমার দুই বছর বয়সে আমাকে ফেলে রেখে চলে গিয়েছিল। এলো এত বছর পরে। গেল ১৩ বছর সে ছিল না আমার জীবনে। :তাই তুমি কাদছিলে? :এত ঝামেলা ভালো লাগে না। কি হতো আমার বাবা মা যদি একসাথে থাকতো। কিংবা দুজনাই আফ্রিকান বা চাইনীজ হতো। আমি যখন আমার বাবার কাছেই থাকছি তাহলে আমি বাবার মতন চাইনীজদের মতন দেখতে হলেও তো পারতো। : তা ঠিক। ব্রোকেন ফেমেলির দেখেমেয়েরা যুগে যুগে বিবিধ সমস্যার মধ্য দিয়ে- ই যায়। :বাবা-কে বলেও ছিলাম শুধু কাগজের জন্য আমেরিকান সিটিজেন শিপ আছে বলে আমার মা-কে বিয়ে করা তার ঠিক হয়নি। কি ভালো হতো যদি আমি তোমাদের দেশের কারো ঘরে জন্মাতাম, তুমি কত ভালোবাস তোমার মেয়েদের। বলেই মেয়েটি হু হু করে কেঁদে উঠলো। নিধি হাত বাড়িয়ে মেয়েটিকে বুকে টেনে নিতে গিয়েও নিল না। দরকার কি মায়া বাড়ানোর। কি দরকার যা ওই মেয়ের নেই অযথাই ক্ষণিকের জন্য তার স্বাদ দেওয়ার। অন্যের বাচ্চা ছুয়েছে বলে না আবার তার বিরুদ্ধে মামলা করতে ছুটে ওই চীনা পরিবার। তারপরও উঠে যেতে গিয়ে ওর মাথায় একটা হাত রাখলো শুধু। নিজেই বুঝলো ভয়ে থাকতে থাকতে সাধারন কিছু মানবিক কাজও সে নি:সংকোচে করতে পারছে না। জানতে চাইলো, :তোমার নামটা যেনো কি? :আমার নামটা অনেক কঠিন। তোমার মনে থাকবে না। চাইনিজ নাম। ভারতী যা ডাকে তাই ডেকো। কাগজের ফুল। :তুমি জান তা! মানে জান ? : হ্যা, ও-ইতো বলেছে। এর মানে ফ্লাওয়ার। পেপার ফ্লাওয়ার। আসলে আমি ওয়েস্ট পেপার। নিধি চুপচাপ চেয়ে দাড়িয়ে থাকে। কামেল ভাই কি জানেন উনি নতুন কোন ধরনের ফুলের বা ভুলের জন্ম দিতে যাচ্ছেন না!! আজ ওনার বিয়ে করতে যাবার কথা। কাগজের জন্য কোন এক বিদেশীকে বিয়ে করার কথা। শুনেছে সে-ও আফ্রিকান আমেরিকান কালো মেয়ে। কালেম ভাইয়ের বউ বাচ্চা আছে, তারপরও একি ঘটাতে যাচ্ছেন উনি। এতটাই কি জরুরি। মারুফও কি কোনদিন বাধ্য হবে ঐ পথে যেতে, একটি সবুজ কাগজের মোহে। ভারতীর জগিং শেষ। ধুপধাপ করে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসছে। তাদের পাশ দিয়ে যেতে যেতে বললো, বসে থাকলে চলবে, জীবন মানেই তো দৌড়ানো। জীবন ভর দৌড়ানো। নিধি বলল, :ঠিক তাই, যার যা নেই তার জন্য দৌড়ানো, আমার আকাশ নেই আমি আকাশের জন্য দৌড়াচ্ছি। ভারতী না থেমে যেতে যেতেই হেসে বলল, :কিছু জিনিস কেও কখনোই পায় না। কিন্তু তারপরও বেস্ট অফ লাক। বাই দা ওয়ে, জানতো সিডকা পোকা একটানা ১৭ বছর মাটির নিচে ঘুমায়। তারপর মাটি থেকে বেরিয়ে এসে চিৎকার করতে করতে তিন দিনের মাথায় মারা যায়। আকাশ পেলে তোমারও না তাই হয় আবার! বলে হাসলো। নিধির মনে হলো, যে উপায়ে কালেম ভাই সবুজ হচ্ছেন তেমন কিছু মারুফ করলে সেও আকাশ পাবে কিন্তু চিৎকার করতে করতে তিনদিনের মাথায় মারা যাবে। জবাব না দিয়ে নিধি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে সিড়ি কোনে। একি এক আজব মায়ার সিড়িতে সে বাধা পড়েছে, না পারছে নামতে না উঠতে। না ফিরে যেতে না থাকতে। হে খোদা তুমি রক্ষা কর। রক্ষা কর। আপন মনেই ডেকে উঠলো নিধি স্রষ্টার উদ্দেশ্যে।
দুই
নন্দনাভাবীর কথা ভেবে কাদবে না হাসবে তা বিন্তী বুঝে উঠতে পারছে না।
লোকে বলে আজব মহাদেশ এই আমেরিকা।তাই বলে এতোটা আজব!
রাতুল বহুক্ষণ বাসা ছাড়া। সেই কাকডাকা ভোরে কাজে গেছে। অবশ্য খবরটা শুনেছে। বেশ উৎসাহও দেখালো। ভাবখানা, একজন পথ খুলে দিচ্ছে, এবার সেও বিয়ে করে ফেলবে। একজন যখন করছে, তার পথ ধরে বাকিরাও করবে। যতোজন ইললিগাল আছে সবাই লাইন ধরে আমেরিকান মেয়েদের বিয়ে করবে। দরকার হলে ওই একই মেয়েকে বাকিরাও বিয়ে করবে দলবদ্ধভাবে। যুথবদ্ধ জীবন যাপন। রাতুল এ রকম একটা আভাস দিয়ে হাসতে হাসতে চলে গেছে। নন্দনা ভাবী সুপারহিট। দারুণ বা নিদারুণ কাজটা স্বামীকে করতে দিচ্ছেন। চারদিকে বেশ সাড়া পড়ে গেছে। সকালে সিরাকিউস থেকে শিরীর ফোন। সে জানতে চাইলো খবরটা সত্যি কি না। কতো দূর সিরাকিউস, সেখানেও খবর চলে গেছে! নিঃসন্দেহে এটা বড় ধরনের দুঃসংবাদ। তাই বাতাসের আগেই ধেয়ে বেড়াচ্ছে। অবশ্য এখানকার পুরুষ মহলের ভাব দেখে মনে হচ্ছে খুবই সুসংবাদ। যেন খুবই আমোদের কিছু ঘটতে যাচ্ছে। তারা আহাল্লাদে ডগমগ একেবারে। আবার টেলিফোন ক্রীং ক্রীং। বিন্তী ফোন ধরলো না। জানে চারটা রিংয়ের পর অ্যানসারিং মেশিন বেজে উঠবে। মেসেজ রেকর্ড হোক। দরকার মনে করলে সে-ই পরে ফোন করবে। ওপাশের পাবলিক আরো এক ডিগ্রী বাড়া, সে কোনো মেসেজ না রেখেই ফোন রেখে দিল। অনেকের ফোনেই এখানে কলার আইডি রয়েছে। যেই ফোন করুক তার নাম, ফোন নাম্বার টেলিফোনের মেমোরিতে থাকে। তাদের নেই। রাতুল তা রাখেনি। খুবই কৃপণ সে, এক পয়সা করে টাকা জমায়। এতো টাকা জমিয়ে কি করবে? আরেকটা বিয়ে করবে? লিগাল হবে। কাউকে আর বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। নন্দনাভাবীর বরকে খুবই শাদাসিধা মানুষ মনে হতো, এ লোকের পেটে পেটে এতো! বাপরে!
রান্নাঘর থেকে বড় মাছ কাটার ছুরি এনে টেবিলের ওপর রাখলো। খুবই ধারালো ছুরি। রাতুলকে এটা দিয়ে আজ একটু ভয় দেখাবে। ফান হবে। নিজের মনেই বিন্তী হাসলো। জলল্লাদের মতো মুখভঙ্গি করে কিভাবে কি বলবে তারও রিহার্সাল দিয়ে নিল। এদিক-সেদিক চেয়ে দেখলো ছেলেরা আবার দেখছে না তো, না তারা কমপিউটার গেমস-এ বুদ হয়ে গেছে। জলল্লাদকে নকলের কাজটা ভয় থেকে করছে কি? না, তা নয়, আনন্দের জন্যই করছে। নিজেই নিজেকে বললো। রাতুল খুবই ভালো একজন মানুষ। তাকে নিয়ে কেনই বা অযথা এতো দুর্ভাবনা সে ভাববে। ইয়েস, রাতুল খুবই ভালো মানুষ। তাই সে শংকামুক্ত, ইয়েস, অফকোস, বিন্তী গরবিনী ভঙ্গিতে ঘাড় নাচালো। তারপর আপন মনেই যা বললো আর মানে হচ্ছে, একঘেয়ে বন্দী প্রবাস জীবন থেকে মুক্তির জন্য, ক্ষণিক আনন্দের জন্যই সে এসব ভাবছে, করছে। দেটস ওল। তাকে পাগল ভাববার কোন কারন নেই। অবশ্যই না। জানালা দিয়ে খোলা প্রান্তরের দিকে চেয়ে থাকলো কিছুক্ষণ ,চুপচাপ। খুবই খোলামেলা পরিবেশ চারদিকে। চোখ মেললেই দিগন্ত ছুয়ে যায়। দিগন্ত কি সব সময়ই এমন উদাস করা হয়! যেন বাউলের একতারা! কি আছে এ মহাদেশে? কাজ, অর্থ? যেসব বৌ কাজ করে তারা ক্লান্ত-বিধ্বস্ত হয়ে বাসায় ফেরে, রান্না করে, বাচ্চা সামলায়, টিভি দেখে বা হিন্দি মুভি দেখে। ঘুমায় আবার উঠে একই জীবনযাত্রা। দেশে বিশাল এক জগৎ আছে। ব্যবহৃত হোক বা না হোক। আছে তো সবই, সবাই। এখানে কেউ নেই। একা, একলা চলরে। সঙ্গী আছে কিছু। গল্পগুজব চলে হয়তো কিছুক্ষণ। একই মুখের একই কথা কতো আর শোনা যায়! আশপাশে বহু বিদেশীর বাস। তাদের দেশে থেকেও মনে হচ্ছে তারা বিদেশী। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আসতে-যেতে হাই আর বাই আছে। হাই বলেই বাই। মনে হয় খাজকাটা, দাগ দেয়া পথ, ওই দিয়েই চলতে হবে। একটু এদিক-সেদিক হলেই অচেনা জগৎ, অদেখা ভুবন। যেন বসবাস দ্বীপে। যেন দ্বীপান্তর হয়েছে। এ রকমই মনে হয়। আচ্ছা, যারা বহু বছর আছে তারাও কি এ রকম ভাবেই ভাবে !!! কিংবা বাংলাদেশি যারা এ দেশে খুবই শিক্ষিত, অনেক বড়লোক বা খুব বড় চাকরি করে তারাও কি ওই রকম ভাবে, নাকি শুধু সে ভাবছে? তার একান্ত নিজস্ব ভাবনা!
রাতুল এখানে একটা দোকানে কাজ করে, সেলসম্যান। দেশে কলেজ টিচার ছিল, এখানে মুদি দোকানের কর্মচারী। বিন্তীর বুকটা ফেটে যায়। কি মরাতে যে এ দেশে এসেছিল? রাতুল প্রায়ই বলে যতদিন ইললিগাল থাকবে ততদিন ভাল কাজ সে পাবে না। আবার ফোন বাজছে, ক্রীং ক্রীং ক্রীং। এবার উঠে ফোন ধরলো। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নিধীভাবীর গলা। শুনেছেন ভাবী, ঘটনাটা কি ঘটতে যাচ্ছে? নন্দনাভাবীর বরের কথা বলছেন? হ্যা তাই, নাউজুবিল্লাহ। ভাই নাকি আজকেই বিয়ে করবেন! এতোক্ষণে মনে হয় কাম খতম। আল্লাহর নামে জবাই হয়ে গেছেন। তবে সবাই এসব জানে ঘটনা ঘটার পরে, তাঁর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আগেই জানাজানি হয়ে গেছে। তাইতো দেখছি, একি অরাজকতা, এও কি সম্ভব! তওবা তওবা। বিন্তী এবার হি হি করে হাসতে লাগলো। বললো, এটা হচ্ছে গ্রীন কার্ড-এর ক্যারিশমা। আপনি নতুন এসেছেন। তাই বেশি খারাপ বোধ করছেন ভাবী। আপনারা কি ভালো বোধ করছেন? তা না। তবে এ দেশে নাকি গোপনে হরহামেশাই হচ্ছে এসব। কালেম ভাই সবার কাছ থেকে বুদ্ধি নিতে গিয়ে ব্যাপারটা রাষ্ট্র করে ফেলেছেন। ওই মেয়ের কি বাপ-মা নেই। যে বিয়ে করছে তার বৌ আছে, বাচ্চাও তিনটে। ওই মেয়ের বাপ-মা দিয়ে কি হবে। এ হচ্ছে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ। খেল খতম, বেলা খতম। বৌগিরি শেষ। নিধী চুপ করে আছে। কিছু বলছে না। বিন্তীর এবার হাসি পাচ্ছে। জানে নিধীর পক্ষে অনেক কিছুই কঠিন মেনে নেয়া, বড় লোকের মেয়ে। এসে পরেছে এই দেশে। সে অনেক বছর বিভিন্ন দেশে থেকেছে। সে জানে, বোঝে, জীবন কতো রকমের, কতো কঠিন এই জীবনটা যাপন করা। সহস্র ঝুটঝামেলা, শ শ প্রকল্প। বিশুদ্ধ ব্যাপারটা প্রথম যৌবনেরই স্বপ্ন গাথা, ক্রমে এতে মিশ্রণ ঘটে, ভাঙন ধরে। বললো, খোজ নিলে দেখা যাবে ওই মেয়ের মা-ই হয়তো সাতটা, বাবা চারটা বিয়ে করে ইতিমধ্যেই বসে আছে। হয়তোবা এগুলো তাদের কাছে খুবই দুধভাত। শিক কাবাব পরোটা তাহলে কোনটা। আমাদের অংশটা। নিধী হুম করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিধীকে একটু হালকা করার জন্য বিন্তী বললো, তবে কালেম ভাই নতুন বৌয়ের সঙ্গে শোবে না। মেয়েটার একটা বয়ফ্রেন্ড আছে। তার সঙ্গেই থাকবে। আমার অবশ্য ধারণা, মেয়েটা কালো না হয়ে শাদা হলে কালেম ভাই ঠিকই বাসরঘর সাজিয়ে বসে থাকতেন। কথাটা বলে বিন্তী নিজেই হাসতে থাকলো। : হুম ,আফ্রিকান-আমেরিকান কেনো ? :হোয়াইট আমেরিকান-দের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট ম্যারেজ করতে গেলে নাকি তিন ডাবল খরচ হতো। এখনই প্রচুর টাকার শ্রাদ্ধ হবে। :হু! কিন্তু একটা বৌ থাকতে আরেকটা বিয়ে! :আরে ভাবী, আপনিও যেমন, তারা ইললিগাল, কোনো কাগজপত্র আছে নাকি। আইনের কতো ফাক আছে, অতো কিছু কি আমরা জানি নাকি? :হু, তাও ঠিক। :হয়তো কাগজপত্রে নন্দনাভাবীকে ডিভোর্স দেখিয়েছে। :হু। :ভবিষ্যতে দেখবেন, নন্দনাভাবীই অফিশিয়াল হয়ে গেছেন দ্বিতীয় স্ত্রী ,দি বেলেক কুইন হবে দি ফাস্ট লেডী। হু। বিন্তী হাসতে হাসতে বললো, আপনি শুধু হু হু করছেন কেন? আমার সঙ্গে একটু হাসেন। হাসলে মন ভালো হবে। নিধী তারপরও চুপ করে আছে। একজন বলবে আর অমনি সে হাসতে শুরু করবে এতো পাগল সে না। বিন্তীও চুপ রইলো কয়েক মিনিট। এক সময় বললো, আমরাও ইললিগাল এ দেশে। তাই হেসে একটু হালকা হতে চাচ্ছি। মাঝে মধ্যে মনে হয় নিঃশ্বাস নিতেও পারছি না, এতো ছোট হয়ে আসছে চারদিকের পৃথিবী। রাখি আজকে। এরপর ফোন রেখে খালি ঘরে কয়েকবার চক্কর দিল, ছেলেদের রুমে গিয়ে বসলো, জানালায় উকি মেরে অযথাই কিছু দেখার চেষ্টা করলো, কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো অজান্তেই, তারপর টিভি চালিয়ে আনমনে টিভির দিকে চেয়ে বসে পড়লো বিন্তী। চেয়ে আছে টিভির দিকে, ভাবছে অন্য কিছু। বিন্তী ,বিন্তী,বিন্তী, মা যাকে আদর করে ডাকতেন বিন্তু বলে। বহুকাল ডাক শোনা হয় না। মা চুল আচড়ে দিতেই ওই নামে ডাকতেন। এখন মা কোথায়, চুল কোথায়। দূর, বহুদূর। ববছাট চুলে হাত বুলিয়ে হু হু করে পরাণ কেদে উঠতে চাইলো।
ছেলে দুটো সম্ভবত কমপিউটারের সামনে থেকে উঠেছে। তাদের গুজুর গুজুর, ফুচুর ফুচুর শোনা যাচ্ছে। যমজ দুই ভাই রাজু, সাজু। দুজন দুজনার বন্ধু। গ্রেড ফাইভের ছাত্র। নন্দনাভাবীর সবচেয়ে ছোট ছেলেটা লোহিত তাদের সঙ্গেই পড়ে, একই ক্লাসে। স্কুলেও কি এ নিয়ে আলাপ আলোচনা চলছে নাকি? ছেলেদের কথাটা জিজ্ঞাসা করতে লাজুর খুবই লজ্জা লাগছে। অবশ্য ঘটনা বাংলাদেশিদের বাইরে প্রকাশ পাওয়ার কথা নয়। নিজেদের সম্মান রক্ষার্থে অন্য জাতপাতের কাছ থেকে লুকিয়েই রাখার কথা ব্যাপারটা। আবার ফোন, ক্রীং ক্রীং। তার উঠতে ইচ্ছা করছে না। কে এতো ফোন করে। সে টিভিতে ইড়ষফ্ ইবধঁঃরভঁষ দেখছে। এ দেশে টিভি সিরিয়ালগুলো একেকটা পনেরো বিশ বছর ধরে চলে। পাত্রপাত্রীরা যেন এই ড্রামা সিরিয়ালের জন্যই জন্মায় আবার এটা করতে করতেই মরে। জীবনব্যাপী সাধনা। দর্শকেরাও তাই। একেকজনের একেকটা সিরিয়াল প্রিয়। যে যারটাতে ডুবে বসে আছে। বাংলাদেশেও আজকাল নাকি এ রকম শুরু হয়েছে। রাজু ফোন ধরে কার সঙ্গে যেন গল্প করছে। ১০ বছরের ছেলে হলে কি হবে, নজর রাখতে হবে। এ দেশের বাতাস খুবই খারাপ। :কার সঙ্গে কথা বলছিস। :লোহিত। :কি বলছে সাগর। :মাম, তার নাম লোহিত। :লোহিত একটা সাগরের নাম। লাল সাগর। প্রথম দুই ভাই সাগর কি, লোহিত কি, কেন বলছে, ভুল নাম বলা যাবে না ইত্যাদি তর্ক করতো। এখন ওই চ্যাপ্টার বাদ দিয়েছে। বললো, তোমার লাল সাগর এখন আকাশে আছে, আমাদের যেতে বলছে, যাবো। :আকাশে মানে? :আকাশদের বাসায়। যাবো? না করতে গিয়েও আবার বললো, :আচ্ছা যা। বুঝতে পারছে, লোহিতের মন ভালো নেই। তার এখন বন্ধুদের সঙ্গ দরকার।
দুই ছেলেও ঘটাঘট রওনা হয়ে গেল। পাশের এক অ্যাপার্টমেন্টেই আকাশদের আবাস। স্কুলেও আজ ছুটি চলছে। ভাল-ই হবে , বন্ধুরা এক সাথে হোক। :পৌছেই কল দিবি। এ দেশের লোকাল কল ফ্রি। যতো খুশি কল করো। এসব সুবিধা দেশে যদি থাকতো, আহ, দিনভর কতো কথা বলা যেতো! এবার বিন্তী টিভিতে মনোযোগ দেয়ার চেষ্টা করলো। এ মুভির পাত্রপাত্রীদের সঙ্গে প্রতিদিনই তার দেখা হয়, হচ্ছে। তারা অবশ্য তাকে দেখতে পাচ্ছে না, আফসোস! সে গভীর মনোযোগ দিয়ে তাদের জীবনযাত্রা পর্যবেক্ষণ করে। তারা যখন একে অপরকে ভালোবাসে, মনে হয় জান দিয়ে দেবে, ভালোবাসায় বুক ফেটে টস টস করে রস পড়ছে। আবার হঠাৎই যেন চিরতরে বিদায়। একেকটা চরিত্র, ড্রামার ভেতরই হাজারটা করে বিয়ে করছে, ছাড়ছে। ঘর ভাঙা যেন মুখের কথা। সবারই স্টেপ সম্পর্ক রয়েছে। সৎ পিতা, সৎ মাতা, সৎ কন্যা, কতো কিছু তাদের এবং সবাইকে নিয়েই তাদের ফ্যামিলি। আমেরিকানদের সত্যিকারের জীবন এতোটা এরকম না নিশ্চয়ই? এতো ড্রামাতে পূর্ণ কি জীবন হতে পারে। তবে মাঝে মধ্যেই এসব ড্রামা দেখতে দেখতে মনে হয় সময় বুঝি পেছনের দিকে হাটছে। সেই আদিম যুগের মানুষের মতন যখন অনেক বিয়ে অনেক বৌ থাকতো সে ধরনের বিষয় ও ঘটনাবলী চলছে ড্রামাতে। তবে এখন এট এ টাইম একটাই বৌ এটুকুই পার্থক্য। বহু বিবাহ কিন্তু বৌ থাকছে বাসায় একটাই। মেয়েরাও এখন অনেক বিয়ে করছে, ছাড়ছে। এদিকে আবার এগিয়েছে। ছেলেদের মনোপলি মার্কেট খতম। বাংলাদেশের বাচ্চারা রূপকথার বইতে যেমন পড়তো প্রচুর সৎ বাবা বা সৎ মায়ের গল্প, এখানে অহরহ আশপাশে তাদের দেখতে পাচ্ছে। পার্থক্য হলো প্রথমে বুঝতেই পারা যায় না সৎ না আপন। সৎ সে রকম খারাপ না। আবার অসৎ সে রকম সৎ না। তাই যোগ-বিয়োগ করে মোটামুটি একই ঘরে ফেলে দেয়া যাচ্ছে। বিন্তী ভ্রƒ কুচকে আনমনেই সেই সদাসর্বদার ভাবনাতেই ফিরে যায়। কি এমন মধু আছে এই দেশে? অহর্নিশিই এ ভাবনা তাকে পেয়ে বসে। ভাগ্যিস পড়াশোনার দৌড় বেশি না। না হলে এ বিষয়ের ওপরই পিএইচডি করতে শুরু করে দিতো। রাতুলকে জিজ্ঞাসা করেছিল, বলতো এ দেশের মধুটা কোথায়? ঝটপট উত্তর,হানি ইজ মানি ,মাই ডিয়ার হানি ।হানি থাকলে হানাহানি থাকে না। আজকাল আবার সে আমেরিকান আদবকায়দা শিখছে, ডাকবে হানি। ধুত্তোর। কে বলবে তাকে দেখলে ভূগোলের গোলগাল একজন শিক্ষক ছিল। গড়াতে গড়াতে এসে ঠেকেছে হানি-তে। এখন কোনো গণ্ডগোল না পাকালেই হয়। কালেমভাই আবার তার খুব খয়ের খা। খয়ের খাকেও একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল, এ দেশের থাকার এতো সাধ কেন ভাই। ভাইও সঙ্গে সঙ্গে বললেন বাচ্চাদের জন্য, বাচ্চাদের পড়াশোনার জন্য, নিরাপত্তার জন্য। ঢাকায় প্রতিদিনই দুই তিনটা করে বাচ্চা তুলে নিয়ে যাচ্ছে। বিন্তীর অবশ্য জিজ্ঞাসা করতে ইচ্ছা করেনি, কোথায়, কেন, কি জন্য নিয়ে যাচ্ছে। তার মতে, এটা একেবারেই বোগাস কথা, গালগল্প। আমেরিকাতে তিল এসে তাল হয়েছে। তারপরও খেয়াল করেছে আজকাল সেও কথা প্রসঙ্গে প্রায়ই বলছে বাচ্চাদের জন্য থাকা, না হলে এ থাকার কি মানে, এ রকম বলাতেই অভ্যাস গড়ে উঠছে। এরপরও অভ্যস্ত হচ্ছে না, আশ্বস্ত তো নয়ই। সদাসর্বদা বিচলিত। কি যেন নেই, কি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। কি যাচ্ছে হারিয়ে তাও যেন ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। প্রায়ই নামাজে বসে খোদার কাছে প্রার্থনা করে, এতো সুন্দর তোমার এ দুনিয়াতে এতো কেন অশান্তি। কোথায় গেলে কেমন করে একটু শান্তিতে থাকতে পারবো খোদা সে পথ আমাদের তুমি দেখাও। তার প্রার্থনার কথা শুনে রাতুল বলে, সুদূর পরাহত স্বপ্ন, সেই দুনিয়া এখন আর খুজে পাবে নাকো, খড়ংঃ ড়িৎষফ, এড়হব পধংব. আবার বেল। এবার কলিংবেল। দরজার বাইরে দাড়িয়ে কেউ ডাকাডাকি করছে। যে ডাকছে তার তর সইছে না আবারও কলিংবেলে টিপ দিয়েছে। উফ আল্লাহ! এ বাসায় হয় টেলিফোন, নয় কলিংবেল বাজতেই থাকবে। যেন বাজনা বাদকের বাসা। এ অসময়ে কেউ আসে। দুপুর তিনটে। রীতিমতো অসময়। যে ঢুকলো, ভাবেনি সে আসবে। নন্দনাভাবী। হাসছেন। হাসছেন-ই তো। না, ভুল না, ভদ্রমহিলা হাসছেন। ভদ্রমহিলার বুকের পাটা আছে তা অলরেডি প্রমাণিত। তাই সে চোখে ভুল দেখছে না। মহিলা হাসছেনই। শুধু হি হি শব্দটা হচ্ছে না। কি ব্যাপার ভাবী, হঠাৎ! প্রশ্ন করে বিন্তীর নিজেই লজ্জা পেয়ে গেল। আসা মাত্রই একজনকে এ কেমন কথা। তাকেও কিছুটা সৌজন্যতার অভিনয় করতে হবে। হয়নি কিছুই এমন ভাব করতে হবে। বললো, কয়দিন দেখা নেই যে ভাবী, ভুলেই গেছেন নাকি? মনে মনে বললো বরের বিয়ে নিয়ে কি খুব ব্যস্ত বুঝি? দেখাই পাওয়া যায় না। আপনিই ভুলে গেছেন। যান না তো কই? বিন্তী মনে মনে বলে, সারা দিন তোমাদের মালা জপছি, এতো কাণ্ড করছো, ভুলতে দিচ্ছো কই। বিন্তী বুঝতে পারছে সে সৌজন্যতার বেড়াজালে আটকা পড়েছে। ভাবছে এক, বলছে আরেক। পেটে এক, মুখে অন্য কিছু। মহিলাকে আজ খুবই সুন্দর লাগছে। বরের বিয়ের দিন মেয়েদের কেমন দেখায়, বিন্তী আগে কখনো দেখেনি। আজই প্রথম। দোয়া করে এ দেখাই যেন শেষ দেখা হয়। এ দেখা দেখতে তার মন চায় না। নন্দনাভাবীকে দেখে অবশ্য বোঝা যাচ্ছে না তার মন ভালো, না খারাপ? হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলো, মন ভালো? মাগো, কি জিজ্ঞাসা করলো। তাড়াতাড়ি বললো। শরীর ভালো আছে ভাবী? না হলে এলাম কেমন করে? তাই তো। আচমকা যেন সে প্রশ্ন করছে আর বেকুব বনছে। তার থেকে থেকে কেন যেন মনে হচ্ছে হিমাগারে তারা দুজন বসে আছে। হিমশীতল চারদিক। বেশি দূরের কিছু দেখতে পারছে না। চারদিক সাদা। বেদনার রঙ কি সাদা? কাফনের কাপড় হয় সাদা রঙের। কি বলবে বুঝতে পারছে না। কেউ মারা গেলে কি বলতে হয় জানে, পরীক্ষায় ফেল করার সান্ত্বনাও তার জানা আছে। রাস্তায় উল্টে পড়ে হাত ভাঙলে না হেসে সমবেদনা জানাতে হবে তাও সে বোঝে। কিন্তু এখন? বরের বিয়ের দিন কি বলতে হয়? আহ মরণ! এখন সে কি বলবে? এতো বছরের জীবনে এ রকম কোনো অভিজ্ঞতার কথাও কার থেকে শোনেওনি। জুদাই মুভিতে এ রকম কিছু একটা দেখেছিল বোধহয়। ভাগ্য ভালো, নন্দনাভাবীই কথা শুরু করলেন। এমনিতেও মহিলা বরাবরই মিশুক। বাসায় খুব একা লাগাছিল, তাই এলাম। সে তো কোর্টে গেল। বাচ্চারা কে কোনদিকে গেল বুঝতে পারলাম না। আশপাশের কোনো অ্যাপার্টমেন্টেই গেছে বোধহয়। আবার চুপচাপ। কথা খুজে পাচ্ছে না। কথার হরতাল চলছে, বোবাদের রাজত্ব কায়েম হচ্ছে। হঠাৎ নন্দনাভাবী বললেন, আসলে কোনো উপায় ছিল না। ১৬ বছর এ দেশে আছি। কতোকাল আর ইললিগাল হয়ে থাকবো। দেশেও চলে যাওয়া সম্ভব না। বিন্তীর মনে হতে লাগলো নন্দনাভাবী কথাগুলো তাকে বলছেন না, নিজেকেই বলছেন। নিজেকেই নিজেদের কথা শোনাচ্ছেন, শোনানোর যেন চেষ্টা চলছে। কিন্তু শোনাতে পারছেন না। নিজেই নিজের ব্যাখ্যা নিচ্ছে না, অন্যদিকে ফিরে আছেন। নিজেই একই কথা বার বার বলে চলেছেন। হঠাৎ বললেন, দেখুন ভাবী, মিতাভাবী কেমন মানুষ, তার বাসায় গেলাম, আমাকে দেখেই বললেন, বরের বিয়ের নিমন্ত্রণ দিতে, না বরযাত্রী করে নিতে এসেছেন। বিন্তী বুঝতে পারলো না মিতাভাবী কে। টেক্সাসের বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠি কেউ হবে হয়তোবা। মাকীভাবী আমাকে দেখার পর থেকেই শুধু মুখ টিপে হাসতে লাগলেন। আর শোভা…। আপনি কি তাদের সবার বাসা হয়ে এসেছেন? নন্দনাভাবী মাথা নাড়লেন, হ্যা। তবেই হয়েছে, হাজার জন হাজার কথা বলে ইতিমধ্যেই মাথা খারাপ করে দিয়েছে। কিন্তু বিন্তীর মনে হতে লাগলো, বাকি যে কয়জনার বাসা রয়েছে সবখানেই মহিলা যাবেন ।এবং সাফাই গাইবেন। নিজেকে হালকা করবেন, সান্ত্বনা খুজবেন। বললেন বাচ্চা তিনটার ভবিষ্যৎ আছে। টাকা পয়সা অনেক হয়েছে। কিন্তু বৈধ কাগজপত্র নেই বলে সেগুলো নিয়েও টেনশন। বাড়ি কিনে তাতেও শান্তি মতো ঘুমানোর উপায় নেই। কখন চলে যেতে হয়, কখন যে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে এ শংকা। চা দেই ভাবী? দিন। উঠে পড়ে নিজেই যেন সে বাচলো। বিন্তী চা নিয়ে ফিরে এসে দেখে নন্দনাভাবী নিঃশব্দে কাদছেন। বিন্তীর একবার ইচ্ছা করে জিজ্ঞাসা করতে, সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে, তাহলে কাদছেন কেন? জিজ্ঞাসা করা হয় না। টেবিলের ওপর ছুরিটার দিকে চোখ পড়ে। যেভাবে রেখেছিল সেভাবেই পড়ে আছে, সরানো হয়নি। একবার ভাবে জিজ্ঞাসা করবে, কি এতো মোহ এ কার্ডের, সবুজ কাগজের। গ্রীণ কার্ড কি এতোই জরুরি। কেন এতো সইতে হবে। কেনই বা এতো প্রবঞ্চনা নিজের সঙ্গে। মুখে শুধু বললো চা ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে ভাবী। নন্দনাভাবী কোনো উত্তর দেন না। কোনো কথাও বলছেন না, শুধুই কেদে চলেছেন। চা ঠাণ্ডা হচ্ছে। হায়রে জীবন, কাদার জন্য একজন আপন মানুষও নন্দনাভাবীর পাশে নেই। বগুড়ায় তিনি রেখে এসেছেন সাত ভাই, তিন বোন, মা-বাবা, কতো স্বজন। আজ কেউ নেই পাশে। এক প্রতিবেশীর বাসায় বড় বেদনার কান্নাটুকু কেদে নিচ্ছেন নীরবে, খুব গোপনে। বের হয়েই দেখাতে হবে হু কেয়ারস ভাবসাব। যে সন্তানের দোহাই দিয়ে এ দেশে থাকা তারাও একাই কাদবে। এখানে সবাই একা, এখন থেকেই শুরু হোক প্রস্তুতি। হঠাৎ নন্দনাভাবী বললেন, বলুন তো, কার বিয়ে হয় না। বাচ্চাদের। বাচ্চারা বড় হলে হবে। তাই তো! তাহলে গাছের। গাছেরও হয়। আমি একটা মুভিতে দেখেছি শাবানা আজমীর গাছের সঙ্গে বিয়ে হচ্ছে। তাহলে মাছের। মাছের ভাষা আমরা বুঝি না। তাদের কর্মকাণ্ডও পানির নিচে। তারা বাদ। তাহলে। তাহলে আর কি, স্বামীদের। বিবাহিত বলেই তারা স্বামী। তাহলে আবার বিয়ে কিভাবে? তাই তো, এটা তো মাথায় আসেনি! কিন্তু বিন্তীর মনে হতে থাকে নন্দনাভাবী বুঝি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। তার চোখ মুখ অস্বাভাবিক। তাড়াতাড়ি এ মহিলাকে সে এখন বিদায় করতে পারলেই বাচে। মহিলা খুব ঘন ঘন টেবিলের উপর রাখা মাছ কাটার সেই ছুরিটার দিকে তাকাচ্ছেন। সর্বনাশ কি হয়! কি হয়! কি করে বসে। ত্রাহি ত্রাহি একটা ভাব যেন অনুভব করছে বিন্তী। কিন্তু নন্দনাভাবী কিছুই করলেন না। হঠাৎ যেমন এসেছিলেন তেমনিই উঠে দাড়ালেন। খুবই শান্ত হাভ-ভাব। তবে একবারও পেছন ফিরলেন না, খোদা হাফেজও বললেন না। সোজা বের হয়ে হাটা ধরলেন। বিন্তী জানে না কোথায় কোন অজানার পথে চলা শুরু নন্দনার, কতো দূর যাবে আরো এভাবে। সে শুধু চুপচাপ পেছন থেকে চেয়ে থাকে।
তিন : নাও, আই নো হোয়াই দিস কর্নার ইজ সো ব্রাইট। নিহা চোখ তুলে চেয়ে দেখলো তার দিকে চেয়ে হাসছে আইভান। সে এখন নতুন ট্রেনার। নতুন প্রজেক্টটা সম্পর্কে নতুনভাবে তাদের কিছু সফটওয়ার তারা শেখাবে। আইটি ফিল্ডে এই এক জটিলতা, নিত্য নতুন কিছু শিখতে হয়। আবিষ্কারের শেষ নেই। নতুন নতুন সংযোজনের কমতি নেই। ঘাটতিও নেই। মাঝে মাঝে মাথা যে বিগড়ে যায় না সেই ঢের। এত কিছু এত রকমের। কত কিছু এই মাথায় ধরে রাখতে হয়। মাথা ভরা জ্ঞান তার। কার যেন ছিল মাথা ভরা টাক তার। ছোটবেলায় কোন কবিতায় যেনো পড়েছিল, মাথা ভরা টাক তার। যাই হোক মনে নেই তার এখন আর। তবে ট্রেনার আইভান-কে দেখলে লাইনটা মনে পড়ে। এর পুরা মাথা সেইভ করা। সাদা ফর্মা মাথা সুটেও বুটেড। খুবই হ্যান্ডসাম। ভদ্রলোক হাসেনও খুব সুন্দর করে। বেশ জ্ঞানগুণী চোখ করে মুচকী হাসেন। যেন ভাবখানা তোমরা তো কেওই কিছু জানো না ।এতে অবশ্য তাচ্ছিল্য থাকে না। বরং থাকে এক ধরনের প্রশয়। সে জানাতে এসেছে মমতা নিয়ে যেন। গত তিনদিন ধরেই টানা ক্লাশ নিচ্ছে। ক্লাশের ফাকে ফাকে সে ফান করার জন্য বিভিন্ন ওয়েব সাইড এ ঘুরছে। এর ওর পিসিতেও ঢুকছে তাদের মনিটর শেয়ার করার জন্য। ট্রেনিং এ আছে ওরা ১০ জন। সবার সামনে পিসি আছে। কানে হেডফোন। মাইক্রোফোন মুখে। গুগলে ‘জয়েন মি’ লিখে ঐ ট্রেনার আইভানের সাথে কনফারেন্স কলের মতন একসাথে কানেক্টেড হয়ে দশজনই সম্মিলিতভাবে অংশ গ্রহণ করছে ট্রেনিং সাইডে। যে যার সিটে কিউবে বসে দেখছে শুনছে পড়ছে একসাথে। কিছু বলতে চাইলে মাউথ পিস আছে। চেট এর মাধ্যমেও চোটপাট করা যায়, মতামত জানানোর অপশন আছে। একজনের মনিটর অন্যজন দেখতে চাইলে ট্রেনার রিয়োয়েন্ট পাঠায়। একপেস্ট করলে বাকি নয়জন তা দেখতে পায়। বেশ হাইফাই মজার এ শিক্ষা পদ্ধতি । কালো বোর্ড নেই। চক নেই। প্রশিক্ষকের দাড়িয়ে দাড়িয়ে চিৎকার করে পড়া বোঝানোর দায় নেই। হেটে হেটে সবার কাছে যাবারও দরকার নেই। নিজের জায়গায় বসে ট্রেনার যা বলার বলে যাচ্ছে। বাকিরাও একই বিল্ডিংয়েও থাকতে পারে বা ওকলাহোমা অথবা হাওয়াই থাকলেও অসুবিধা নেই। নিহা আপন মনেই বলে, লাইফ ইজ ওয়াও। অওসাম।
পৃথিবী আগামীতে আরো কত এগিয়ে যাবে প্রযুক্তিতে। যতটুকু দেখছে ততটুকুতেই সে মুগ্ধ। অবাক হয়ে ভাবে আহা আরো কত কিছু না দেখেই চলে যেতে হবে। কতইবা বয়স তার, এই ৩৫/৩৬ হবে। তবে ৭০ আসতে আসতে আরো অনেক কিছুই দেখা হয়ে যাবে। ভাবতেই তার মনটা খুশি হয়ে উঠলো। ঠিক জানে না কেন তবে তার প্রায়ই মনে হয় ৭০ বছর পর্যন্ত সে বেচে থাকবে। আজকাল এও মনে হয়, ভাগ্যিস একদিন সব পিছুটান ছেড়ে,সব ভুল বাতিল করে, সেই সাথে যৌতুক লোভী বিয়ের পাতকে ভাগিয়ে দিয়ে, স্কলারশীপটা হাতে নিয়ে ছুটে দেশ থেকে বের হয়ে এসেছিল। আজ নিজেই সে নিজের জয় ধ্বনি দেয়। ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটা সে নিতে পেরেছিল। সঠিক সিদ্ধান্তটা যথার্থভাবে যথা সময়ে নেওয়া খুবই জরুরি। আজও সে সবার আগেই অফিসে হাজির। বাকিদের এখনও দেখা নেই। সময়ের আগেই সে সবখানে পৌছাতে ভালোবাসে। আসবার সময় সে সবার জন্য ডিম ভাজি আর পরটা নিয়ে এসেছে। দেশী ব্রেক ফাস্ট করাবে সবাইকে আজকে। আলুভাজিও দিতে চেয়েছিলেন কাদরী ভাবী। কাল রাতে, বলতে গেলে মাঝ রাতে ঐ মাইলা তার বাসায় এসে উঠেছেন এক মেয়েসহ। চেনেতো নাই। জীবনেও এক নজর দেখেছে বলেও মনে হয় না। বাংলাদেশী অসহায় মহিলা, কিছু অতি পরিচিত আপনজন কয়টা দিনের জন্য ওনাকে বাসায় রাখতে অনুরোধ করেছেন। বলা যায় বাসায় লুকিয়ে রাখতে বলেছেন। ওনার বর ইললিগাল বলে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে । মহিলারও এখন বিপদ আছে। ধরেও নিয়ে যেতে পারে। অনেকে বলছে মহিলাদের কেউ ধরবে না তার উপর বাচ্চা আছে। কিন্তু সত্যিই যদি ধরে নিয়ে যায় তাহলে ঐ বাচ্চারই-বা কি হবে। মহিলা আছেন এখন বাসায়। রাতে ঘুমাননি। নিহা এদিক ওদিক কিছু গল্প করেছে। অপ্রাসঙ্গিক কথাই বেশি বলতে চেয়েছে। তেমনি একটা ছিল তার অফিসে প্রায়ই সবাই জানতে চায় বাংলাদেশী খাবারের কথা। তারও ইচ্ছে একদিন সবাইকে নাস্তা করাবে। ব্যাস কাদেরী ভাবী লেগে গেলেন নাস্তা তৈরি করে দিতে। ২২টা পরটা ২২টা ডিম ভেজে দিলেন। নিহা বুঝতে পারছে মহিলাটি এসব করছে কৃতজ্ঞতা বশে। আশ্রয় দাত্রীকে খুশি রাখতে। আহা ভদ্রঘরের একটি মেয়ে সময়ের কত অসহায় অবস্থায় পড়েছে। নিহার মনটা কষ্টে ভরে ওঠে। যদিও বলে দিয়েছে তিনদিনের বেশি ঐ মহিলাকে সে রাখবে না। তিনদিন পর রাস্তা মাপ। থাক কেন এইদেশে যখন কাগজ নেই। এত কি সোনার খনি এদেশে! এত কষ্ট এত লাঞ্চনা বঞ্চনা সয়ে থাকতে কেন হবে। ঢাকায় তো বললো খিলগায়ে তিনতলা বাড়ি করেছে। সোনারগায়ে জমিদারী ছিল কোন এককালে। সোনারগাও বললো নাকি মাধবপুর বললো! যাই হোক, যা হোক, তার এত ভেবে কাজ নেই। যেখানে খুশী সেখানে হোক। এখন যেখানকার রাজা রানী সেখানে চলে গেলেই হয়, শেষে না তাকেই আবার আশ্রয়দাত্রী হিসাবে সমস্যায় পড়তে হয়। সে একটা দায়িত্বশীল কাজে রত এদেশে। এইচ ওয়ান ভিসাতে আছে। সে- না আবার টানা হেচড়ায় পড়ে যায়। ইট ¯েমলস গুড়। ইয়াম ইয়াম। কেননট ওয়েট ফর অল টু কাম টু ইট। তুমি শুরু করে দাও। তবে দু’মিনিটের মধ্যেই বাকিরা এসে যাবে। আইভান খাবারের চারদিকে এমন ভাব করে ঘুরতে লাগলো যেন এখনই হুমড়ী খেয়ে খেতে বসবে। কিন্তু বসছে না। নিহা জানে সে বসবেও না। অন্যদের জন্য অপেক্ষা করবে। অতি ক্ষুধার্থের ভাব করে একই সাথে নিহাকে বুঝাচ্ছে সে একটি অসাধারণ কাজ করেছে খাবার এনে, একই সাথে অন্যদের জন্য অপেক্ষা করে দেখাচ্ছে এত ক্ষুধাও সে সংবরণ করছে তাদের ভালোবাসায় একসাথে খাবে বলে। অতি ভদ্র, অতি অমায়িক। এবং অবশ্যই অতি কেলকুলেটিভ। এদেশে না আসলে সে জানতেই পারতো না কোন দিন মানুষের ভদ্রতা কোন পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। কার মনে কি আছে তা তো জানার উপায় নেই তবে উপরে উপরে চরম ভদ্র এরা। নিহা অবশ্যই এই ভদ্রতার প্রশংসা করে। এসেই যেমন কি সুন্দরভাবে তাকে রুম আলোকময় করে দেয়ার কৃতিত্ব দিয়ে দিল। অথচ এমন কথা এতটা আভিজাত্যের মাঝে রেখে কবে কি কখনো কোন দেশী শিক্ষক-প্রশিক্ষকের মুখে শুনেছে কোন শিক্ষানবীশ। এতটা সৌন্দর্য্য ঔদার্য্য এতটা পরিচ্ছন্ন ট্রান্সপারেন্সি, বড়ই বিরল বহুদেশেই, বহু সমাজ কাঠামোতেই। প্রথম দিনেই নিহার কলিগ কেলী যখন আইভানকে বলে বসলো, : তুমি কি যাবে আজ আমার সাথে ডিনারে। আইভান সাথে সাথে খুব আনন্দের একটি হাসি দিয়ে বললো, :থ্যাক ইউ। থ্যাক ইউ। বাট আই ডু নট ওয়ান্ট টু মিস দি ওপরচুনিটি টু এসপে›ড কোম্পানী মানী। লেট মি এনজয় ইট দিস টাইম। কেলীকে না করলো ,কিন্তু কি সুন্দরভাবে। মুহূর্তেই আইভানকে সে সম্মানের জায়গায় রাখলো ।শিক্ষক হতে হবে এমনই। যে জানে কাছে থেকেও তার দূরত্ব আর মর্যাদা বজায় রাখতে। পাশ থেকে আলবাট যদিও বলেছিল কেলীকে ফিসফিসিয়ে, :সবাই জানে তোমার থেকে দূরে থাকা উচিত। আলবাটের ফিসফিসানী বেশ জোরেই ছিল কারণ মাউথ পিস মুখে রেখেই সে বলেছিল। সবাই হেসে উঠতেই বলেছিল, :জানি না আমি কেন শুধু তোমার পেছনে ঘুরি। আইভান বলল, :তোমার ওর সামনে চলে আসা উচিত। সামনের কিউবে। তাহলেই সে তোমার পিছু পিছু ঘুরবে। দেখছো না আমি ওর সামনে বসি। :লেডিস ফাস্ট ম্যান। লেডিস ফাস্ট।লেট দেম সিট ইন ফাস্ট রো। আলবার্টের গার্লফেন্ড যে কেলি আইভান তখনও জানতো না। যেদিন জানলো সাথে সাথেই বললো, :ঠিকই আছে, তুমি ওর পিছু পিছুই ঘুর। এটাই নিয়ম। সবাই হেসেছিল। কিন্তু নিহা হাসেনি। কারণ সে জানে কেলীর আরেকজন বয়ফ্রেন্ড আছে। একসাথে দুইজনকে সে নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে। অন্যজন সেই মহিম, সে এই অফিসে কাজ করে না বলে অন্যরা জানে না। কাল বহুরাত পর্যন্ত ঐ মহিমের সাথে কেলী ঝগড়া করেছে। মহিম শুধু মাত্র কাগজের জন্য তাকে বিয়ে করতে চায় বলে সে খুব মর্মাহতও। ভালোই হয়েছে। এককুলে ভিড়েছে। মাঝ দরিয়াতে নেই আর। একদিন মহিম আরেকদিন আলবার্ট এই দুই ধারা বজায় না রেখে একটা বাদ দিলেই ভালো। যদিও বলেছে দিয়েছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়। বাহ্ ঐ যে দৌড়ে আসছে কেনী। বাচবে বহুদিন। ভাবতে না ভাবতেই সে এসে হাজির। কাল বহুরাত পর্যন্ত তার সাথে ছিল। গাড়ি একসিডেন্ট করেছে,গাড়ি নষ্ট হয়েছে। একটা প্রেমিক বাতিল হয়েছে। এক জীবনে এক সকালে আর কি কি করবে ঐ রমনী কে জানে। ছুটতে ছুটতেই সে এসে একটা বাটিতে রুটি আর ডিম ভাজা তুলে নিয়ে হাপুস হাপুস করে গিলতে গিলতে নিজের সিটে গিয়ে বসলো। মনে হচ্ছে এই জন্মে খায় নি। অভুক্ত। আইভান জিজ্ঞেস করলো, :গুড় মনিং, সব ঠিক আছে? গাড়ির দুর্ঘটনার ভয়াবহ খবরটা গতকালকেই পেয়েছি। হেরী সরি ফর ইট, ওরিড টু। কেলী চোখ বন্ধ করে মাথা হেলিয়ে দিয়ে এমন একটা ভঙ্গী করলো যার একটাই মানে, আর বল না, আমি তো মরতে বসেছি। :তোমার গাড়ি তো নেই, কিভাবে এলে। আইভানও জানে। কিন্তু জানলো কিভাবে? কেলী যেন বুঝতেই পারছে তার মনোভাব। সে নিজেই খুজে পেতে দেখে ঠেকে বের করে নেওয়ার আগেই কেলী বলল, :ফেইসবুকে স্টাটাস দিয়েছিলাম। ডিটেইলস। সবাই জানে এখন, তুমি কত ভালো। সবাই বলছেও তুমি কত হৃদয়বতী। ব্রাউন গার্লসদের সবাই হিপ হিপ হুররে বলছে। কাল আমার গাড়ির একসিডেন্ট হওয়া থেকে পুরা কেচাল তুমি সামলেছো। থ্যাক ইউ। বলেই এসে জড়িয়ে ধরলো। কাছে আসতেই নিহা বলল, :আইভান তো মাত্র এসেছে। আসা মাত্রই ওকে ফেইসবুক ফ্রেন্ড করে ফেলেছো! কেলী সাথে সাথে চোখ টিপলো। মুখ বাকিয়ে আজিব একটা হাসি দিল। মানেটা খুব সম্ভবত তুমি বুঝবা না। নিহা তাকিয়েই রয়েছে দেখে এবার বলল, :আমি প্রথম দিনেই ওকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। এত্ত হ্যান্ডসাম ছেলে। ও বলেছে ট্রেনিং শেষ হলে আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করবে। এখন ‘ফলো’তে টিপে রেখেছে। আমি ‘পাবলিক’ স্টাটাস দিলেই সে পেয়ে যাবে। ও ভাবেই পেয়ে যাচ্ছে। এখন আমি সব স্টেটাসই পাবলিক দিচ্ছি। বলেই আবার চোখ টিপলো। : ও তোমার চেয়ে কত ছোট সে খবর রাখ!! : হু কেয়ারস নিহা। মন আর বয়স সহযাত্রী না । তুমি-ই তো বলেছিলে একদিন। : মহিম তোমাকে হেইট করবে। : অলরেডী করে। : আলবার্টও। : আমিও সবাইকে আরো বেশি করে হেইট করি। করবো। বলেই সে হাসতে লাগলো। বললো, লাইফ ইজ ফুল অফ ফান। টেক ইট ইজি গার্ল ।ইজি গোয়িং হওয়াটাই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয়। নিহা আর কথা না বলে নিজের জায়গায় এসে বসলো।এর সাথে কথা বলা মানে সময়ের অপচয়। বাকিরাও আসতে শুরু করেছে। নিহা গত দুদিনের করা সোলিউশনগুলো দেখতে শুরু করলো। কেলী বলল, :বেশি ভালো করার চেষ্টা কর না, তুমি বেশি ভালো হলে আমরা নিজেদের গর্দভ ভাববো বা আমাদের গর্দভ দেখাবে । কী আজব জ্বালা। আইভাস বলল, :একজন উঠলে সে প্রয়োজনে কুয়া থেকে বাকিদেরও টেনে তুলতে পারবে। কেও-ই না পারলে আমাকেই তো বেড দেখাবে। আইভালো কথাটা বলে নিহার দিকে চেয়ে হাসলো। যেনো নিহা ভালো করলে সে জিতে যাবে। বয়স কত এই ছেলের। ৩০ হবে কি হবে না। পারলে তার থেকে ছোট। নিহার বয়স বোঝা যায় না আর অবশ্য এদেশের মানুষের বয়স নিয়ে বেশি কোন ভাবনাও থাকে না। নিহা দেখেছে বাংলাদেশে থাকতে এক বছর কি ছয় মাসের বড় হলেও কেমন করে যেনো বড়বোনের চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া যেত অনায়াসে। ব্যাপারটা এদেশে অচল। কেমন করে যেন কে বড় কে ছোট সম্পর্কের ক্ষেত্রে এগুলো যেন ম্যাটারই করে না। আপা, ভাইতো নয়ই। বস, স্যার, ম্যাডামও না। আচ্ছা বিপদ তো , সবাই সবার বন্ধু যেনো। ধুর সেই বা কেন এতকিছু ভাবছে ঐ আইভানকে নিয়ে। সেও খেতে বসেছে পরোটা ডিম। বেশ মজা করেই খাচ্ছে। আর তার দিকে চেয়ে আইভান দুটো আঙ্গুল তুলে বুঝালো অসাধারণ সুস্বাদু হয়েছে। নিহার হঠাৎ মনে হলো সবাই এত মজা করে যে পরটা খাচ্ছে তাতে কি লেগে রয়েছে কাদরী ভাবীর দু এক ছোটা অশ্র“জল। নিহার হাতটা থেমে গেল। মনটাও গেল খারাপ হয়ে । ভাবলো ফোন করে জেনে নেওয়া দরকার অচেনা কাদরী ভাই কোথায় আছেন, কেমন আছেন এখন। অফিস রুম থেকে বের হতে হতে শুনলো, আইভান জানতে চাইছে কেলী কাছে, :তো তুমি এলে কিভাবে আজ? :ওয়াকিং বলেই কেলী খুব মজা করে হেসে উঠলো। তারপরে বললো, :আমার সামনের বাসায় এক বৃদ্ধা থাকেন, তাকে বলেছি রোজ ১০ ডলার করে দেব ,তুমি আমাকে আনবে নেবে অফিসে। রাজি হয়েছে। তো সে নামিয়ে দিল। নামিয়ে দিয়েই বলেছে ২৫ ডলারের কমে সে এ কাজ করবে না। বলে চলে গেছে। নিতে আসবে না। :তাহলে যাবে কিভাবে। :তুমি লিফট দিও। নিহা আনমনেই হাসলো। আইভান তো জানে না কি গ্লু-র সাথে দেখা হয়েছে তার। কানখাড়া করে রাখলো যেতে যেতেই। আইভানের জবাবের জন্য। তবে আইভানও কম না। সে বলছে, :আমি তো নতুন ডালাসে। ওয়াশিংটন ডিসি হলে অবশ্যই পারতাম। এখানে তো আমিই যাই কোম্পানীর গাড়িতে, ওটাই আবার সকালে গিয়ে নিয়ে আসে। তুমি চাইলে আমি ওদের জিজ্ঞেস করে দেখতে পারি। ওরা নিলে আমার তো কোন অসুবিধা নেই। :চিন্তা করো না, প্রটোকল এলাউ করবে না। আমি-ই পৌছে দেব। আর কেও না হলে তো ওর ব্রাউন গার্ল আছেই। আলবার্ট নিহাকে দেখিয়ে দিয়ে হাসলো। আলবার্ট সবে মাত্র ঢুকছে। কিন্তু ঢুকতে ঢুকতেই কেলীকে সামলাতে ব্যস্ত হয়েছে। নিহা বের হয়ে এলো অফিস থেকে, বিশাল কাচের বিল্ডিং। একদিন একটা ঢিল যদি কেও মারে তবে কি হবে।নিশ্চয়ই গুরগুরিয়ে পড়বে না। ঐভাবেই তৈরি নিশ্চয়ই। হা একটা ঢিলে কিছুই হবে না। নীল বিল্ডিংটা খাড়া হয়ে দাড়িয়ে থাকবে। দাড়িযে আছে। সে ফোন করার আগেই ফোন এলো। নিধির ফোন। নামের মিলের কারণে দু’জনার বেশ বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে হঠাৎ করেই। থাকেও একই এপার্টমেন্টে কমপ্লেক্সে। আসার আগে একবার ভেবেছিল নিধি-কে জানিয়ে আসবে সারাদিন কাদরী ভাবী একা একা তার বাসায় থাকবেন। নিধিতো ঘরেই থাকে। সে হয়তো একটু খোজ রাখতে পারবে। বলার আর সময় পায়নি। কিন্তু সে আবার এসময়ে কেন ফোন করলো। সব ঠিক আছে তো ঔদিকে। নাকি তার বাসায় হানা দিয়ে পুলিশ কাদরী ভাবীকে ধরে নিয়ে গেছে। তারও তাহলে বারোটা বাজবে। একেবারে বারোটা ।এইচ ওয়ান ভিসা তো কেনসেল হবেই । জীবনও আর সিটিজেনশিপ হবে না। কেন যে মরতে এদের কথায় শুনতে রাজি হয়েছিল। ভয়ে ভয়ে বলল, হ্যালো, নিহা, শোন একটা দুঃসংবাদ আছে? নিহার বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো, বলল, কি, কি হয়েছে নিধি? পুলিশ এসেছে! কি কি কি বলছো। পুলিশ কেন? আ-আ করে প্রচণ্ড একটা চিৎকার দিলো নিধি। নিহার হঠাৎ খেয়াল হলো আরে, এ সে কি করছে। নিধির তো এমনিতেই পুলিশ ভীতি আছে। কারণ তারাও ইলনিগাল। নিধি বলে মিস্টার ই ও মিসেস ই। পুরাটা বলতেও নাকি তার সাহস হয় না। কি হয়েছে নিধি। চিৎকার কেন করছো? কোথায় পুলিশ। কে পুলিশ পাঠিয়েছে। আরে না। আমি জানি না। জানতে চাইছি তুমি কেন ফোন করেছো! আর বলো না। ভয়াবহ একটা সকাল শুরু হয়েছে। তুমি কি জান কালেম ভাই আজ বিয়ে করতে যাচ্ছেন! ওনার বৌ-কে এই মাত্র দেখলাম চুনী ভাবীর বাসা থেকে বের হয়ে গড় গড় করে হেটে চলে যেতে। চুনী ভাবীকেও দেখলাম বিশাল এক ছুরি নিয়ে দরজায় দাড়িয়ে থাকতে। কি ভয়াবহ। থাকতে না পেরে তোমাকে ফোন দিলাম। বল কি! কি সর্বনাশ। হচ্ছে-টা কি? ঠিক তাই। উনি কি ছুরি দিয়ে বিন্তী ভাবীকেই তাড়া করেছিলেন না ছুরিটা দিয়ে কালেম ভাইকে জবাই করে দেওয়ার জন্য উৎসাহিত করছিলেন বুঝতে পারলাম না। নিধি শান্ত হও। কিন্তু কে এই কালেম ভাই। উনি কেন বিয়ে করতে চাইছেন? বৌ-আছে বলছো আবার। নাহ তোমার সাথে কথা বলে লাভ নেই। তুমি তো চেন-ই না আবার কাওকে। রাখি। অফিস কর। পরে কথা বলবো। নিধি ফোন রেখে দিল। নিহা চুপচাপ অফিসের সামনে দাড়িয়ে রইলো। হচ্ছে কি চারদিকে এসব!! ধূরতর। কি সুন্দর বাতাস বইছে। সামনে একটা বুথে বসে কয়েকজন সিগারেট টানছে। অফিসের ভেতর সিগারেট খাওয়ার কোন নিয়ম নেই। টানতে চাইলে বাহিরে এসে ছাই কর সিগারেট। দেশের কথা মনে পড়লো, যত্রতত্র সিগারেট পড়ে থাকতো তাদের পাড়াতে। সেই ছেলেও সিগারেট টানতো। ঐ যে, যে বলেছিল ভালোবাসে তারপর যৌতুকের সামনে বলদ হয়ে বলি হয়ে গেল। বাজে বাজে একদম বাজে ছেলে। আর এরা এই মারুফ ভাই রাতুল ভাই কত যতেœ আগলাচ্ছে পরিবার -কে। কত ভয়াবহ চাপের মাঝে থেকেও বাচ্চাদের সুন্দর একটি দিন দেবার অপেক্ষায় আছে। একটা টেক্সী এসে থামলো অফিসের ভেতর। হলুদ রংয়ে টেক্সী ক্যাপ। কেলী কি টেক্সী কল করেছে। নিহা চেয়ে রইলো । এখনও তো চলে যাবার সময় হয় নি। নাকি ও ছুটি নিয়ে চলে যাচ্ছে। একি! এতো, রাতুল ভাই। উনি কেন? রাতুল ভাই যে ক্যাপ চালায় তাতো সে জানতো না। বলল, :সালাম ভাই, এখানে কেন? :অফিস থেকে টেক্সীর কল দিয়েছে। মনে হচ্ছে উনি একটু বিব্রতবোধ করছেন। একটু কাচুমাচু করেই বললেন, :ভাবছি পার্ট টাইম টেক্সী চালাব। কি বলেন। কাগজ না হওয়া পর্যন্ত আর কি! কাগজ হলে ‘রাজু বানজায় গা জেন্টেলম্যান’। নিহা হেসে বলল, : সব কাজই সমান। :তা তো বটেই। :আপনাদের কোন এক বন্ধু শুনলাম আজ বিয়ে করছেন। :জি জি। :উনি কি আপনাদের সবার জন্য মডেল। বলে নিহা হাসলো। মি. জেন্টেলম্যান আরো লজ্জার একটা হাসি দিয়ে বললেন, :আরে নানা কি যে বলেন। :প্রয়োজন বাপকেও ছাড়ে না। জানেনই তো ‘নেসিসিটি নোওস নো ল।’
:সেটাই। অনেক কিছুই আমরা করি শুধুই প্রয়োজনে। এর সাথে আর কিছু নেই আগে বা পরে। একটাই রুল প্রয়োজন। জীবনের তাগিদ।
দেখলো আলবার্ট নেমে এসেছে, সাথে আইভান ও কেলী। কেলীর মাথা ঘুরছে,শরীর খারাপ লাগছে, গেল কালকের ধকলের ফসল । ওকে বাসায় পৌঁছানোর জন্য টেক্সী কল করা হয়েছে। অফিস ছেড়ে আলবার্টও যেতে পারছে না। আটবার্ট খুবই অসহায় মুখ করে নিহার দিকে চাইলো। নিহা বললো, :ভালোবাসাকে সরিয়ে দেয় প্রয়োজন। যার প্রয়োজন যেখানে তাকে সেখানে থাকতে হয়। তোমাকে অফিস করতে হবে আজ। চাইলেও কেলীর সাথী হতে পারছো না এখন। বলতে বলতে ফিরে চললো নিহা অফিসে। আইভানও আসছে তার পিছু পিছু। লিফটে উঠতে উঠতে আইভান জানতে চাইলো, ভবিষ্যত প্লেন কি? নিহা হেসে বলল, লাল সবুজের পতাকার দেশের মানুষ। হয় সবুজ হব না হয় লাল কার্ড খেয়ে দেশে ফিরে যাব। হয় লাল নয়তো সবুজ। আইভান হা করে চেয়ে আছে দেখে খেয়াল হলো , হায়, শীট, এসব সে কেন বলছে আইভানকে! মানুষের চারদিকে যা ঘটে চলে,মানুষের ভাবনাগুলোও সে দিকেই ধায়। তারও তাই হয়েছে। হেসে বলল, নেভার মাইনড। জাসট কিডিং।
তবে সে সবুজ হবে চাকুরির মাধ্যমে, সবুজ পাত্রী হবার সুযোগই তার নেই। নিহা বীর দর্পে অফিসের ভেতরে ঢুকে পড়লো। তাকে খুবই ভালো কাজ দেখাতে হবে। মিস ই সে হতে পারবে না কিছুতেই, কখনোই না।
সংবাদটি শেয়ার করুন