সৌমিত্র দেব
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শুধু একজন মানুষ ছিলেন না । তিনি একটি চেতনার নাম । বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন তিনি । তাই পাকিস্তানীরা তাঁকে শুধু নির্মম ভাবে হত্যা করেনি তাঁর চোখ দুটোও উপড়ে নিয়েছিল ।
তিনি ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস দলের টিকিটে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।কিন্তু দেশভাগের পরে সব রকম সুযোগ সুবিধা থাকার পরেও তিনি ভারতে যান নি । নিজের দেশকেই ভালোবেসে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় রয়ে যান ।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ঐ বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ হতে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের পর একজন অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিক হিসেবে পাকিস্তানের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে তিনি অধিবেশনের সকল কার্যবিবরণী ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি বাংলাতেও রাখার দাবি উত্থাপন করেন। তিনি সেখানে বলেন, পাকিস্তানে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যাই বেশি এবং তারা বাঙালি, সেহেতু অবশ্যই বাংলাকে পূর্ব পাকিস্তানের সকল কার্যাবলির জন্য ব্যবহার করা উচিত এবং পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে । কেউ সেদিন তাঁর পক্ষে ছিলেন না।
লিয়াকত আলী খান সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের ভিত্তিতে এই দাবি নাকচ করে দেন।
তবু দমে যান নি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত । কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক , রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের বীজ রোপন করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে ছাত্ররা একে মাঠে নিয়ে যায় ।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত । ১৯৫৪ সালের জুন মাসে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে গভর্নরের শাসন প্রবর্তনের বিরুদ্ধে একটি ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হতে ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভায় তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক মন্ত্রী ছিলেন ।
ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত রাষ্ট্র পাকিস্তানে সংখ্যালঘুদের জন্য ৭২ টি আসন সংরক্ষিত ছিল । গণতন্ত্র ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি এবং অন্যান্য হিন্দু নেতারা সেই সুবিধা প্রত্যাখ্যান করলেন । তারা চাইলেন সমান মর্যাদা । চাইলেন যুক্ত নির্বাচন । এর ফলে বিকশিত হল বাঙালি জাতীয়তাবাদ । ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বাংলার হিন্দু , মুসলমান , বৌদ্ধ , খ্রিস্টান সবাই এক হয়ে গেল । এই উচ্চতার জন্য বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে দেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার “ভাষা ও স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করেছে ।
কুমিল্লা পৌরসভা কর্তৃপক্ষ মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক, বিশিষ্ট সংসদ সদস্য ও আইনজীবী হিসেবে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের নামে রাস্তার নামকরণ করে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে শহীদ খাজা নিজাম উদ্দিন সড়ক পর্যন্ত রাস্তাটি এখন থেকে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সড়ক নামে পরিচিত। ১৮ জুলাই ২০১৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর জগন্নাথ হলে তার নামে একটি ই-লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠা করা হয়।[১১] ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মরণে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যলয়-এ ঐ বছরই ছাত্রদের জন্য " ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হল" নামে একটি আবাসিক হল নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে কুমিল্লা স্টেডিয়াম এর নামকরণ করা হয় " ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্টেডিয়াম ।
কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত শহীদ হবার পর তাঁর হিন্দু সম্প্রদায় ক্রমাগত শুধু নীচের দিকে নামছে । সংখ্যায় নেমে এসেছে ৮ ভাগে । চিন্তায় চেতনায় হয়ে পড়েছে সংখ্যালঘু । ধীরেন্দ্রনাথ নিজেকে সংখ্যালঘু ভাবলে ভাষা আন্দোলনের বীজ বপন করতে পারতেন না। স্বাধীনতার স্বপ্ন ও দেখতে পারতেন না । সংরক্ষিত আসনের এমপি হয়ে সুযোগ সুবিধা নিতেন ।
কিন্তু তার উত্তরসূরি বাংলাদেশের
হিন্দুদের এখন আর বজ্রকণ্ঠ নেই। তারা নিজেদের মধ্যে ফিস ফিস করে কথা বলে। ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে তাকে পুলিশের সাহায্য নিতে হয় । একসময় ধীরেন্দ্রনাথেরা যে সংখ্যালঘুদের কোটা ঘৃণা ভরে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন , এখন তারা আবার সেই কোটা ফিরে পেতে চায় । সিড়ির শেষ ধাপে নেমে
এখন তারা নিজেদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক ঘোষণা করে তৃপ্তি পাচ্ছে ।
সংখ্যালঘু হিসেবে নিজেদের সুরক্ষা চায়। এরপরে হয় তো পাছায় একটা লাথি খেয়ে বলবে, মাইরেন না জনাব। আমরা আপনাদের পবিত্র আমানত । আমরা জিজিয়া কর দিতেও রাজি আছি ।
কিন্তু যদি তারা ঘুরে দাঁড়াতে পারে ।
তাদের মধ্যে ফিরে আসে ধীরেন্দ্রনাথের চেতনা । একটা একটা করে সব ধাপ পার হয়ে আবার উপরে উঠে যায় । স্পষ্ট করে বলে , আমি বাংলাদেশের হিন্দু, কিন্তু সংখ্যালঘু নই । এই দেশ আমরা সবাই মিলে স্বাধীন করেছি। এখানে আপনার যেটুকু অধিকার, আমার ও ঠিক ততটুকুই অধিকার। পুলিশের পাহারায় আমরা উৎসব পালন করতে চাই না । যদি আমার উৎসবে পুলিশ লাগে তাহলে আপনাকেও পুলিশ নিতে হবে। আমার মন্দিরে যেমন হামলা হয় , তেমনি আপনার ঈদের জামাতেও হামলা হয় । আমার আপনার বন্ধু এক। শত্রু ও এক । আসুন সবাই মিলে সেই শত্রুর মোকাবেলা করি । সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করি। আহা এ রকম ঘটনা যদি দেখতে পেতাম!
জানিনা বাংলাদেশের হিন্দুদের বড় অংশ কোন দিকে যাবে ।
তাদের জন্য নিবেদন করছি ফরিদ কবিরের কবিতা ।
তোমার সামনে খোলা আছে দুটি পথ
দুটি পথ আছে তোমার সামনে খোলা
একটি রাস্তা রাত্রির দিকে গেছে
অন্য পথের স্তম্ভে জ্বলছে আলো
তোমার সামনে খোলা আছে দুটি পথ
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com