‘সংখ্যালঘুরা সব সমাজেই শ্রেণী-বৈষম্যের শিকার, কিন্তু সংখ্যালঘুর মাঝেও আছে আরেক সংখ্যালঘুর বৃত্ত’ --- কবি শামস আল মমীন
আবেদীন কাদের
আমাদের আড্ডাটা এ সপ্তাহে একটু আগে শুরু করতে হয়েছিলো, অর্থাৎ সন্ধ্যার একটু আগে। প্রথমত ভ্যানু বদল হয়েছিলো, বিশিষ্ট অতিথি হিশেবে ছিলেন আমাদের সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ কথাশিল্পী সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
তাই আমরা একটু আগে আগে বসেছিলাম। গত কয়েকদিন ধরে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গন বেশ উত্তাল, বাংলাদেশের সকল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করেছে তাদের সরকারি চাকুরীতে কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে। তাই সারাদেশে এই আন্দোলনের কারণে রাজনৈতিক আবহাওয়া কিছুটা অস্থির হয়ে পড়েছে, জনজীবন অনেকটা বিপর্যস্ত। এমনকি সরকারকে সেনা মোতায়ন করে কারফিউ দিতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর গত তেপ্পান্ন বছরে ছাত্ররা এতোটা তীব্র আন্দোলন কোনদিন প্রায় করেনি কোন দাবি নিয়েই। এরশাদের শাসনামলে বড় ছাত্র আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু এমন কোন আন্দোলন তখন হয় নি। এতো সংখ্যক ছাত্র পুলিশ বা আইন রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে বা সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনের অত্যাচারে মৃত্যুবরন করেনি। তাই আমরা যদিও আড্ডায় কখনোই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে খুব বেশি একটা আলোচনা করি না, কিন্তু এসপ্তাহে শুরু থেকেই রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে ঢাকা থেকে আমরা সবাই প্রায় বিচ্ছিন্ন রয়েছি বেশ কয়েকদিন ধরে। কিন্তু ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম ও অন্যান্য বিদেশি সংবাদ মাধ্যমগুলোর সাহায্যে কিছু কিছু সংবাদ সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে থাকা বাঙালিরাই কোন না কোনভাবে পেয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু সব জাতীয় আন্দোলনের সময় যদি তথ্য প্রবাহ বন্ধ করে দেয়া হয় তাহলে যে অসংখ্য গুজব বাজারে ছড়িয়ে পড়ে, বাংলাদেশের প্রতি মুহূর্তের অবস্থা সম্পর্কেও সে-ধরণের বেশ কিছু গুজব অনেকের কাছে এসেছে।
আড্ডায় এসব গুজব নিয়ে কিছু আলোচনার পরই আমরা কথা বলছিলাম আমাদের সময়ের একজন ভীষণ পণ্ডিত মানুষ চিন্ময় গুহকে নিয়ে। দিনকয় আগে আমরা অধ্যাপক গুহর সঙ্গে একটি আড্ডায় বসেছিলাম, সেখানে হঠাৎ করেই তিনি অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখা কথাসাহিত্য বিষয়ে কথা বলছিলেন। তিনি এই লেখকের কথাশিল্পের ভূয়সী প্রশংসা করছিলেন। ডঃ গুহ জানিয়েছিলেন যে সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পের ভাষা ও নির্মিতি সত্যিই অসাধারণ! আমরা ষাট ও সত্তর দশকের পশ্চিমবঙ্গের গল্প উপন্যাসের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলছিলাম। সেখানে অধ্যাপক গুহ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের গল্পের কাহিনী ও ভাষার উদ্ধৃতি দিয়ে বিশ্লেষণ করছিলেন। তিনি জানান অনেক সময় আমাদের উপন্যাসের ভাষা বিষয়ে উপন্যাসিকদের ধারণাও অস্বচ্ছ। কিন্তু অধ্যাপক মনজুরুল ইসলামের লেখা পাঠ করলেই বোঝা যায় তিনি নিজের কথাশিল্পের ভাষা খুব সুচিন্তিতভাবেই ব্যবহার করেন। ডঃ গুহ বলেন আজকালকার অনেক লেখক যারা আধুনিক গল্প লেখেন তাঁরা সৈয়দ মনজুরের মতো অনেকেই ভাষা বিষয়ে সচেতন নন। এই লেখক ভাষাকে শুধু কাহিনীর বা উপন্যাসের ভার বহনকারী মাধ্যম হিশেবে বিবেচনা করেন না, বা ব্যবহার করেন না আবেগ প্রকাশের কাব্যিক সড়ক হিশেবে, বরং তিনি ব্যবহার করেন এর অধিক ভিন্ন আরেক ধরণের শিল্পের বাহন হিশেবেও বটে। আমি, শামস আল মমীন, আহমাদ মাযহার, ও নসরত শাহ যখন অধ্যাপক গুহর বলা বিভিন্ন বক্তব্য আড্ডায় হাজির করছিলাম, তখন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম কোন মন্তব্য না করে গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন।
হঠাৎ করে কথা ওঠে ইংরেজি সাহিত্যের কবিতার ভাষা ও কথাশিল্পের ভাষার মধ্যে বিশাল দূরত্ব নিয়ে। উনবিংশ শতাব্দীর ইংরেজি কাব্য সাহিত্যের ভাষার সঙ্গে কথাশিল্পের ভাষার যে অনেকটা দূরত্ব ছিলো, পরবর্তী সময়ে সেই দূরত্ব অনেকটাই কমে আসে। বাংলা সাহিত্যেও ষাটের দশকে দেখা যায় কথাশিল্পের ভাষা অনেকটা কবিতার ভাষার কাছাকাছি আসে। এর অন্যতম কারণ সম্ভবত কবিদের অনেকেই উপন্যাস বা কথাশিল্প রচনায় মনোনিবেশ করেন। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রথম জীবনে গল্পই লিখতেন, কিন্তু পরে কবিতায় মনোনিবেশ করেন। ঠিক এর উল্টোটা ঘটে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে। তিনি ছিলেন মূলত কবি, কিন্তু ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের আমন্ত্রণে শারদীয় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম উপন্যাস লেখেন ‘আত্মপ্রকাশ’ নামে। তবে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় কবিতা লেখেন নি, কিন্তু গল্প বা উপন্যাস যা লেখেন তার ভাষা একেবারে কবিতার উপাদানে ভরা। যদিও অনেক সমালোচক মনে করেন লিটল ম্যাগাজিন বা প্রতিষ্ঠানবিরোধী পত্রিকাগুলোতে যে তরুণ লেখকরা কথাসাহিত্য রচনায় ব্যাপৃত, তাঁদের লেখার ভাষায় বর্ণাঢ্যতায়, এর কাব্যময়তা ছিলো বা আজও রয়েছে, বা কেউ কেউ ভাবেন তাদের ভাষার বর্ণান্ধতায়ই শিল্পের বাস্তবতা। কথাশিল্পের বিচিত্র পরীক্ষা নিরীক্ষায় এই মাধ্যমকে শক্তিশালী রূপ দিতে চান অনেক লেখক। অন্যদিকে কবিতা যেদিন থেকে গদ্যকে নিজ মাধ্যম হিশেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে, গদ্যের অপরিসীম শক্তির প্রতি কবিতার তখন থেকেই এক ধরণের আনুগত্য দেখা দিয়েছে।
কথাশিল্পের ভাষা বিষয়ে আড্ডায় যখন বেশ জোরালো কথাবার্তা চলছিলো তখন সবাই আমরা শুনতে চাচ্ছিলাম এবিষয়ে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের বক্তব্য। তিনি শুধু ভীষণ দ্যুতিমান অধ্যাপকই নন ইংরেজি সাহিত্যের, সঙ্গে সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের একজন প্রতিভাবান কথাশিল্পীও বটে। কিন্তু অধ্যাপক চিন্ময় গুহের তাঁর লেখা নিয়ে মন্তব্য শুনে তিনি আসলে কিছু বলতে চাচ্ছিলেন না মনে হয়, তাঁর বন্ধুর প্রশংসা তাঁকে কিছুটা বিব্রত করলো মনে হয়, তাই একটু নীরব থাকলেন। কিন্তু অধ্যাপক গুহর পাণ্ডিত্য বিষয়ে অনেক প্রশংসাসূচক কথাবার্তা বললেন। কিন্তু বিষয়টার যখন পরিবর্তন হলো, অর্থাৎ সাহিত্যের অন্যান্য বিষয় নিয়ে যখন কথা উঠলো, তখন অধ্যাপক ইসলাম খুব গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখলেন। আহমাদ মাযহার এ সময়ে একটি কথা বলেন কথাশিল্পের ভাষা বিষয়ে, তাঁর মতে উপন্যাস বা কথাশিল্পের ভাষা সর্বগ্রাসী বলেই যথেচ্ছাচারী নয়। বরং বলা যায়, কবিতার মতোই কথাশিল্পের ভাষা স্রস্টার কল্পনার এক অদৃশ্য ও অলিখিত অনুশাসনের শৃঙ্খলে বাঁধা। আমরা সবাই খুব চাচ্ছিলাম এই আড্ডাটা চলুক শুধুই ডঃ ইসলামের কথা শুনে। কারণ ঢাকা ছাড়ার পর আমরা তাঁকে খুব বেশি একটা পাই না, তাঁর ফর্মাল বক্তৃতা বা আড্ডায় কথা শোনা হয় কম। আশির দশক ও নব্বইয়ের গোড়ার দিক পর্যন্ত আমরা নিউ মার্কেটে ‘প্রগতি’ প্রকাশনীর আড্ডায় প্রতি শুক্রবার তাঁর অনেক কথাই শুনেছি। সাহিত্য ছাড়াও নন্দনতত্ত্ব বা উত্তরাধুনিক ও পোস্টকলোনিয়াল থিওরি বিষয়ে সর্বশেষ বিতর্কগুলো পশ্চিমা একাডেমিক জগতে কী ঘটছে তা আমরা তাঁর কাছ থেকেই শুনতে পেতাম, বইপত্রও পেতাম তাঁর মাধ্যমে অনেক সময়। সে-সব থেকে বহুদিন আমরা বঞ্চিত। নব্বইয়ের দশকে ও শূন্য দশকে মাঝে মাঝে তিনি নিউ ইয়র্ক এলে নাট্যশিল্পী শাহীন খানের বাসায় দীর্ঘ আড্ডায় তাঁর বক্তব্য শুনেছি, ঋদ্ধ হয়েছি। তাই এই আড্ডায় আমাদের মাঝে সবাই প্রায় চাচ্ছিলাম তিনি সাম্প্রতিক সাহিত্য নিয়ে কথা বলুন, আমরা শুধু শুনি। কিন্তু মনজুর ভাই মানুষ হিশেবে এতো অমায়িক এবং হিউমারাস যে নিজের অগাধ পাণ্ডিত্য তিনি শুধু ঢেকে রাখেন তাই নয়, বরং আড্ডার একেবারে তরুণ লেখকদের কাছ থেকে তাদের লেখা শুনতে চান, মতামত জানতে চান।
এর মাঝেই মাযহার, নসরত শাহ ও আরও দুয়েকজনের অনুরোধে মনজুর ভাই আমাদের সাহিত্যের নানাদিক নিয়ে কথা বলেন। কেমন করে আমাদের স্বাধীনতার পর কথাশিল্প ও কবিতা ভিন্ন দিকে মোড় নিলো, কীভাবে বিভিন্ন বাকবদল ঘটলো শিল্পকলার বিভিন্ন মাধ্যমে, এর পেছনে সামাজিক বা শৈল্পিক কারণগুলোই বা কী ছিলো, এসব বিস্তারিতই আলোচনা করেন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন বহুধাখণ্ডিত জীবন-ব্যাখ্যার সূত্রে অন্তর্মুখীনতাই কথাশিল্পের প্রধান লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিলো একটা সময়, ফ্রয়েড এবং ইয়ুঙ্গের প্রভাব অবশ্যই সক্রিয় ছিলো। কিন্তু সমাজ মানসের গভীর মর্মশায়ী অসুস্থতার চেতনা মানুষের অন্তর্গত সত্তার অন্বেষণী হয়ে উঠেছিলো। কথাশিল্প হয়ে ওঠে এমন এক বাহন যার মাধ্যমে বর্ণাঢ্যতা, বীর্যবত্তা চিত্রিত হয়, বা কথাশিল্প হয়ে ওঠে মানব জীবনের অন্বিষ্টসন্ধানী এক রূপক বিশেষ। ফলে এর চারিত্র একদিকে যেমন কবিতার কাছাকাছি হয়ে ওঠে নির্মিতির বিমূর্ততা নিয়ে, অন্যদিকে সময় ও সমাজবাস্তবতার ছবিকেও সে সততার সঙ্গে রূপায়িত করতে প্রয়াস নেয়।
স্বাধীনতার ঠিক পর পর আমাদের কথাশিল্পীদের অনেকেই পশ্চিমবঙ্গের অনেক শক্তিশালী লেখকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হন খুব সহজেই, যা ষাটের দশকের মাঝামাঝি থেকে প্রায় বন্ধ ছিলো। এই তরুণ লেখকরা কেউ কেউ যদিও পশ্চিমা কিছু আধুনিক লেখকদের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, তাঁরা নতুন করে বাংলা ভাষার কিছুটা অপরিচিত পশ্চিমবঙ্গের তরুণ ও কিছুটা জ্যেষ্ঠ লেখকদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হন। ফলে আমাদের কথাশিল্পে ভাষা ও নির্মিতির দিক থেকে কিছু পরিবর্তন এলো। কেউ কেউ নিজেদের লেখাকে দেখেন পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখার শিল্পপ্রাণতার নৈকট্যপ্রাপ্ত, কেউ কেউ এই ধারা থেকে দূরে। তাই যত দিন যেতে লাগলো ততই আপাত ফর্মাল রিয়ালিজমের গদ্যমাধ্যম বিষয়গত বাস্তবতার ছবি পরিহার করে বিষয়ের অতীত ভিন্ন এক স্বরূপে দেখা দেয়। সেটা কিছুটা কাব্যের বিমূর্ততার সীমানা-ছোঁয়া। এটার বিবিধ সাহিত্যিক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু স্বাধীনতা-উত্তর সমাজজীবনে যে-অস্থিরচিত্ততার ছবি লক্ষ করা যায় বা যে-সোশ্যাল ডিসইনটিগ্রেসন ঘটে, তা থেকেই কথাশিল্পের বা সামগ্রিকভাবে সাহিত্যের ফর্মে বা ভাষার বস্তু-লক্ষে ঋজু অনুশাসন অপেক্ষা কাব্যের ছায়া লক্ষ করা যায়। কেন এমনটা ঘটে তার বিচার হয়তো পরবর্তী কালের সমালোচকরা ভালো করতে পারবেন, কিন্তু আমাদের সাহিত্যে এটা পরিলক্ষিত হয়। সমাজবিজ্ঞানীরা এটার কারণ ভালো বিশ্লেষণ করতে পারবেন, কিন্তু সমাজের টালমাটাল অবস্থা সাহিত্যের ভাষা ও ফর্মকেও যে ভীষণ প্রভাবিত করেছে, সেটাই সত্য।
এসময় লেখক আদনান সৈয়দ একটু দেরিতে এসে আড্ডায় যোগ দেন। আড্ডায় তখন কথাশিল্প নিয়ে কথা হচ্ছিলো, আদনান সেটাতে যোগ দিয়ে কথাশিল্পীর অভিজ্ঞতা বিষয়ে মন্তব্য করেন। কেন কথাশিল্পীর জন্য জীবনাভিজ্ঞতা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ সে-প্রসঙ্গ তোলেন এবং অধ্যাপক মনজুরুল ইসলামের কাছে বিষয়টা সম্পর্কে জানতে চান। নসরত শাহ, কবি অভীক সোবহান ও কথাশিল্পী বদরুন নাহারও এ বিষয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে অভিনিবেশ নিয়ে ও মনোযোগ দিয়ে শোনেন। অনেক সমালোচক মনে করেন লেখকের অভিজ্ঞতা যা কথাশিল্পীর জন্য বড় সম্পদ, সেটা মোটেই সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতা নয়। কথাশিল্পীর প্রধান শক্তি কী, এই প্রশ্নের উত্তর হতে পারে অভিজ্ঞতাসঞ্জাত ও মননসমৃদ্ধ কল্পনাই তার মূল শক্তি। যেহেতু শিল্পমাত্রই নিপুণ ও অভিনিবিষ্ট কল্পনার নির্বাচন, তাই কল্পনা কথাশিল্পীকে ও তাঁর অন্তর্দৃষ্টির জন্য সহায়ক তুলি। তাই কোন কোন সমালোচক বলেন যে-মন কৃতিমতায় পূর্ণ, যেমন নির্দিষ্ট কিছুতে আসক্ত বা আবেগাশ্রয়ী, বা বলা যায় পল্লবগ্রাহী, সে-মন ভালো কথাশিল্প রচয়িতা হতে পারে না। কথাশিল্পীর মন কবির মতো শুধু কবিত্বেই আসক্ত নয়, বা নাট্যকারের মতো শুধু নাট্যরসেই তাঁর মন পক্ষপাতি নয়, তাঁর মন জীবনের স্বাভাবিক স্বাস্থ্যের প্রতি দৃষ্টিনিবদ্ধ, জীবনের তুচ্ছ ও নিচ এবং মহৎ ও সুন্দর বা কদর্যের নিমগ্ন রূপতাপস হতে পারে, এই বিচিত্র রূপতপস্যা কথাশিল্পীকে এমন এক শক্তি দেয় যা তাঁর নিজস্ব রসসাধনা। এর অন্বিষ্ট জীবনের রূপ-অন্বেষণ। রূপ সাধনার এই দুরূহ ও বন্ধুর পথে কথাশিল্পীকে প্রতিপদেই পরীক্ষা দিতে হয়।
আড্ডায় কথাশিল্প বিষয়ে আমরা অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, আহমাদ মাযহার, নসরত শাহ, আদনান সৈয়দ ও বদরুন নাহারের এধরনের বিভিন্ন মন্তব্য শুনছিলাম। কথাবার্তাগুলো বেশ ভারি হয়ে উঠছিলো, এসময় মনজুর ভাই নিজেই কিছু হিউমার-মিশ্রিত হালকা বিষয়ের অবতারণা করেন। বাঙালিদের বিভিন্ন হাস্যরস বিষয়ক কথাবার্তার সূচনা করে। এর মাঝে তাঁর মাতুল বিখ্যাত লেখক সৈয়দ মুজতবা আলীর বিভিন্ন প্রসঙ্গ ওঠে। মনজুর ভাই সিলেটের মানুষদের সৈয়দ মুজতবা আলীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধার বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন হয়তো তিনি তাঁর কিছুটা প্রাপ্যমূল্য পেয়েছেন কলকাতার মননশীল লেখক পাঠকদের কাছে, কিন্তু বাংলাদেশে তিনি খুব বেশি একটা সম্মান পান নি।
আমাদের আড্ডাটায় কিছুটা হাসি আনন্দের উপাদান দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইসলাম, বাকীরা ছিলেন বাংলাদেশের গত কয়েকদিনের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে খুব বিষণ্ণ। অধ্যাপক ইসলাম যে বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত বা বিষণ্ণ ছিলেন না তা নয়, তিনিও ভীষণ চিন্তিত ছিলেন, কিন্তু নিজের অন্তর্গত দুশ্চিন্তাকে তিনি কিছুতেই প্রকাশ করতে চান নি। তবুও হঠাৎ ঢাকার তরুণ ছাত্রদের কথা উঠতেই আমাদের ভেতরে নীরব থাকা কষ্টটা কিছুটা প্রকাশিত হতে থাকলো বিভিন্ন কথাবার্তায়। কেউ কেউ ডঃ ইসলামের কাছে জানতে চাইলেন আমাদের তরুণ সমাজের মাঝে এতোটা গভীর ও পুঞ্জিভূত ক্ষোভের কারণ তিনি কী মনে করেন! বিশেষ করে আহমাদ মাযহার নসরত শাহ ও আদনান সৈয়দই জানতে চান। আমি পুরো আড্ডাটাতেই চেষ্টা করেছি সকলের কথা শুনতে। বাংলাদেশের অস্থির ছাত্রান্দোলনের সামাজিক রাজনৈতিক কারণগুলো আমি মোটামুটি আন্দাজ করতে পারি, তাই খুব বেশি একটা কিছু জিজ্ঞেস করিনি বা আলোচনাও করতে চাইনি। কবি শামস আল মমীন সারাটা আড্ডার সময়ই ছিলেন প্রায়-নীরব।
ডঃ ইসলাম ছাত্রদের এই কোটা সংস্কার আন্দোলন ও এর কারণে সৃষ্ট ভয়াবহ অবস্থার কথা উঠতেই নিজের ছাত্রদের এই রাজপথে প্রতিবাদ ও জীবন দেয়ার বিষয় বলতে গিয়ে নির্দিষ্ট করে কারও দিকে তর্জনী না তুলে জানালেন তাঁর নিজের গত প্রায় পঞ্চাশ বছরের অধ্যাপনার অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু কথা, যা আমরা সবাই মনোযোগ দিয়ে শুনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ডঃ ইসলামের সম্পর্ক, অর্থাৎ ছাত্রজীবন ও অধ্যাপনার জীবন মিলে প্রায় ছাপ্পান্ন বছরের। তিনি নিজের চোখে দেখেছেন প্রায় গত ছয় দশকের ছাত্র রাজনীতির চেহারা। তিনি তাঁর মন্তব্যে আমাদের সমাজ বিভিন্ন আন্দোলনগুলোকে কীভাবে দেখেছে, রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক দল ও সরকারগুলো বিভিন্ন সময়ে ছাত্র আন্দোলনকে কীভাবে পর্যবেক্ষণ, পর্যালোচনা ও নিয়ন্ত্রণ করেছে সে সম্পর্কে একটু নির্মোহ দৃষ্টিতে তাঁর মতামত দেন। তাঁর মন্তব্যের সার কথা ছিলো আমাদের সমাজে শিক্ষাসহ বিভিন্ন সামাজিক ও রাষ্ট্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেভাবে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছে জনগণের কাছে, নৈতিক অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে সমাজ, তাতে করে দিনে দিনে আমরা আমাদেরকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছি, আমাদের সামনের ভবিষ্যৎ সত্যিই অন্ধকারাচ্ছন্ন। ডঃ ইসলাম একটি কথা খুব জোর দিয়ে বলেন, সেটি হলো কাউকে একা দায়ী করে লাভ নেই, আমরা সামগ্রিকভাবে সমাজটাকে, এর শিক্ষাব্যবস্থা ও আমাদের নৈতিক সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছি। এখন এর ফল হিশেবে দেখা যাচ্ছে বিভিন্ন অরাজকতা। রাষ্ট্র আজ এমন একটা অবস্থায় এসে পৌঁছেছে যে আমাদের সামনে আশা করার মতো তেমন কিছু আর দেখা যাচ্ছে না। নিজের ছাত্রজীবনে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ও তাঁদের নৈতিক অবস্থান, শিক্ষা ও রুচি তিনি যা দেখেছেন তার উল্লেখ করে বর্তমান সময়ে শিক্ষকতার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের কথা তুলনা করে বলেন যে এই অবস্থায় আমরা একদিনে আসিনি, দীর্ঘদিনের অপরাজনীতির ফলে এটা ঘটেছে। নিরীহ ছাত্রসমাজ এর প্রতিবাদ করেনি তা নয়, কিন্তু রাষ্ট্র ও আমাদের সামাজিক অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে আমরা এই অবস্থাকে রুখতে পারি নি। আমরা আমাদের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক অবক্ষয়কে রুখতে পারিনি। একটা সময়ে আমরা দেখলাম প্রায় সবকিছুই ভেঙ্গে পড়ার অবস্থায় পৌঁছে গেছে। তাই এখন এই অবস্থা থেকে আমাদের শিক্ষাজগৎকে বাঁচানো সত্যিই ভীষণ কঠিন।
ডঃ ইসলাম বলেন তাত্ত্বিকভাবে এই অবস্থার বিশ্লেষণ হয়তো করা সম্ভব, কিন্তু এতে সমস্যার সমাধান খুব বেশি একটা হবে বলে মনে হয় না। রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের যে সম্পর্ক, নাগরিকের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র যেভাবে নির্ধারণ করে দিচ্ছে তাতে তরুণ সমাজ নিজেদের ভবিষ্যৎ বিষয়ে গভীরভাবে শঙ্কিত। সেই শঙ্কা তাদের জীবন ও ভবিষ্যতকে অনিশ্চিত করে দিচ্ছে বলেই তারা প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছে। কিন্তু এছাড়াও বিভিন্ন কারণ রয়েছে এই ছাত্রসমাজের বিদ্রোহের। সম্ভবত মানুষের কথা বলা বা মত প্রকাশের স্পেস সংকীর্ণ হতে হতে এমন একটা অবস্থায় এসেছে যে সাধারণ ছাত্রদের নিজেদের চাকুরী বিষয়ে কোটা সংস্কারের দাবির সঙ্গে নীরবে প্রায় অধিকাংশ তরুণ সমাজ সমর্থন জানাচ্ছে। এটি একটি সাধারণ দাবি নিয়ে আন্দোলন, কিন্তু এর আড়ালে হয়তো মানুষের ভিন্ন রাজনৈতিক ক্ষোভেরও ছবি কিছুটা দেখা যাচ্ছে। তবে আড্ডায় কোন রাজনৈতিক দল বা একক কাউকে দায়ী না করে অধিকাংশ সদস্যই মন্তব্য করেন যে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা চাকুরিকে লক্ষ্য করে বিবেচনা করা হয় আজকের সমাজে। শিক্ষার অন্যান্য মূল্যকে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। এর জন্য ছাত্ররা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। সারাদেশে এতো বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত তরুণ বেকার, এতো বৈষম্য বিরাজ করছে সরকারি ও বেসরকারি কর্মক্ষেত্রে, যার জন্য প্রতি বছর সরকারি সামান্য তিন চার হাজার চাকুরীর জন্য কয়েক লক্ষ কলেজ গ্রাজুয়েট তরুণ রুদ্ধশ্বাসে ছুটছে। অর্থাৎ আমাদের অর্থনীতি প্রতিবছর যে বিপুল সংখ্যক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েট বের হচ্ছে তাদের কর্মসংস্থান করতে অক্ষম। এর অতিরিক্ত রয়েছে বিপুল দুর্নীতি। অর্থাৎ সাধারণ দরিদ্র তরুণ সমাজ অর্থের বিনিময়ে চাকুরী ক্রয় করতে অপারগ ও হতাশাগ্রস্ত । এই অবস্থা সৃষ্টি করেছে এই দুর্নীতিপরায়ণ রাষ্ট্রব্যবস্থা। এটাই ছাত্রসমাজের আন্দোলনের মূল কারণ। এছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো আমাদের সমাজের নেতৃত্বের মরাল বা নৈতিক ধ্বস! স্বাধীনতার পর থেকে আজ প্রায় পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে আমাদের সমাজকে যারা পরিচালনা করেছেন তারা কেউই প্রায় কোন নৈতিক বা মরাল দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারেন নি, এমন কোন নেতৃত্ব প্রায় নেই বললেই চলে যার বা যাদের বিশ্বাসযোগ্যতা সমাজের কাছে প্রশ্নাতীত। তাই দুর্নীতি ও অপশাসন সমাজকে আজ এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে!
আড্ডার আলোচনা যখন দেশের বিভিন্ন দুঃসংবাদ নিয়ে বেশ বিষাদাক্রান্ত অবস্থায় চলে যাচ্ছিলো তখন অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আমাদেরকে কিছুটা হালকা মেজাজে ফিরিয়ে আনার জন্য কবি শামস আল মমীন ও বদরুন নাহারের কাছে তাঁদের কবিতা শুনতে চাইলেন। মমীন ভাই তাঁর সাম্প্রতিক সময়ে লেখা কয়েকটি কবিতা পড়ে শোনালেন। বদরুন নাহার শোনালেন তাঁর লেখা ‘এখানে গরম পড়েছে’ কবিতাটি। কবিতাটির বিষয় নিউ ইয়র্কের গ্রীষ্মকালীন আবহাওয়া, কিন্তু এর অন্তরালে রয়েছে ঢাকার স্মৃতি, গ্রীষ্মের তাপে সামান্য শীতলতার খোঁজে ফরাসী দূতাবাসের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গ উপভোগ করার স্মৃতি! কবিতাটির মাঝে যে ছবি আঁকা তা আড্ডার প্রায় সকলের পরিচিত, কিন্তু তা সবাইকে কিছুটা বিষণ্ণতা-ছোঁয়া স্মৃতিও মনে করিয়ে দেয়! মমীন ভাইয়ের কবিতার বিষয় মার্কিন সমাজের বৈষম্য। চার দশকের বেশি সময় আগে এদেশে এসে তিনি তরুণ ছাত্র হিশেবে এদেশের সংখ্যালঘু ছাত্রদের মাঝে যে বৈষম্যবোধহেতু হতাশা লক্ষ করেছেন তার চিত্র তিনি কবিতায় এঁকেছেন। কবিতার বিষয় সবার চেনা, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টি দেখেন খুব জটিল বিষয় হিশেবে। এটা শুধু অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য নয়, এর মাঝে রয়েছে মানুষের আদিম এক শ্রেণী বৈষম্যের ছায়া। সংখ্যালঘুরও নানা বৃত্ত রয়েছে, সংখ্যালঘুর মাঝেও রয়েছে নানা সংখ্যালঘু সমাজের বৃত্ত, সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা ও বিষয়টির বিশ্লেষণ খুব জটিল ছবি হাজির করে, মমীন ভাইয়ের কবিতা দুটি তার কিছুটা ইঙ্গিত দেয়!
রাত গভীর হয়, সবাই প্রায় দূরে যাবেন। তাই লোপা ভাবির রান্না করা অসাধারণ কিছু খাবার উদরস্ত করে আমরা সবাই দ্বিতীয় দফা আড্ডায় মগ্ন হই। কিন্তু বাড়ি ফেরার তাড়ায় তা দীর্ঘায়িত করা সম্ভব হয় না। তাই দারুণ লোভনীয় এক আড্ডা থামিয়ে দিয়ে সবাইকে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিতে হয়।
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com