‘থাকগে সে সব বৃথা জিজ্ঞাসা’!
আবেদীন কাদের
আড্ডার শুরুতেই কথা ওঠে একটি বিষয়ে, সেটা আমাদের শিল্প মাধ্যমগুলোর মধ্যে গুণগত মানের দিক থেকে এতোটা পার্থক্য কী করে ঘটলো! আমাদের মতো একই ভাষাভাষী পশ্চিমবঙ্গের শিল্পমাধ্যমগুলোর মধ্যে এতোটা তফাৎ কোনদিনই দেখা যায়নি, সেটাই বা কেন! তিনটি শিল্প মাধ্যম, সাহিত্য, সঙ্গীত ও চিত্রকলা।
এই তিনটি মাধ্যমের মধ্যে কেন আমাদের সঙ্গীত এতোটা দুর্বল। যদিও চিত্রকলা শুরু হয় অনেক দেরিতে, অর্থাৎ চল্লিশের শেষ দিক থেকে কিছুটা অনানুষ্ঠানিকভাবে আমাদের শিল্পীরা কাজ শুরু করেন, কিন্তু প্রথম সারির কয়েকজন শিল্পী যারা কলকাতা আর্ট কলেজ থেকে স্নাতক হয়ে ভালো ছবি আঁকতে শুরু করেন, এবং ঢাকায় এসে তাঁরা আর্ট কলেজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এঁরাই আমাদের সমাজের শীর্ষ শিল্পীগণ। কিন্তু সঙ্গীত অনেক আগে থেকেই ছিলো, যদিও তা ফোক সঙ্গীত বা পল্লীগীতি ধরনের গান, কিন্তু এই মাধ্যমটির খুব বেশি একটা মানের পরিবর্তন ঘটেনি বহুদিন। কেন এমনটা হয়েছিলো, আমাদের মুসলিম ধর্ম সঙ্গীত বা চিত্রকলাকে পৃষ্টপোষকতা দেয় না বলে! এপ্রসঙ্গে আড্ডাটা প্রথমে শুরু করি আমি ও লেখক নসরত শাহ। নসরতই বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকেন কেন পূর্ববঙ্গের বাঙালি সমাজের সঙ্গীত ও চিত্রকলা একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়ে গেছে অনেকটা সময় ধরে। এ আলোচনা চলার সময়ই আহমাদ মাযহার এসে যোগ দেন।
আহমাদ মাযহার ভারতীয় সঙ্গীত, বিশেষ করে ধ্রুপদী সঙ্গীত যে কয়েক শতাব্দী ধরে খুব গভীরভাবে চর্চিত হয়ে আসছে বিভিন্ন ঘরানার মাধ্যমে, সেবিষয়ে আলোকপাত করেন। তখন এর গুণগত মান বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে বলেন ভারতীয় চিত্রকলা বিষয়ে। ভারতীয় চিত্রকলার আদি ভিত্তি হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর পটারি, অজন্তা ইলোরার পাহাড়ের গুহাতে যে চিত্রকলা পাওয়া গেছে, বা গবেষকরা যে ছবি বা ভাস্কর্য পেয়েছেন সরনাথ-গান্ধারায়, তাকেই ধরা হয়। এসব সূত্র থেকে বিভিন্ন সময়ে আধুনিক চিত্রকলার বিকাশ ঘটেছে, এমন একটি মন্তব্য করেন। মাযহার এ সময়ে আমাদের তরুণ বয়সে ভীষণ অভিনিবেশ নিয়ে পড়া অবন ঠাকুরের বাগেশ্বরী প্রবন্ধাবলী নিয়ে কথা বলেন। নন্দনতত্ত্ব বিষয়ে আমাদের প্রজন্মের পাঠকরা প্রথমে জানতে পারে অবন ঠাকুরের লেখা পড়েই। তিনি ভারতের শিল্পতাত্ত্বিকদের মধ্যে প্রথম সারির লেখক। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের জ্ঞান-নির্ভর ভিন্ন এক শিল্পতত্ত্ব সৃষ্টি করেন অবন ঠাকুর। তাঁর নন্দনচিন্তা ভারতীয় রেনেসাঁসের প্রেরণা যুগিয়েছিলো বলেও অনেকে মনে করেন। রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুর এক মাস আগে বলেছিলেন, আমার জীবনের প্রান্তভাগে যখন মনে করি সমস্ত দেশের হয়ে কাকে বিশেষ সম্মান দেয়া যেতে পারে, তখন সর্বাগ্রে মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের নাম। তিনি দেশকে উদ্ধার করেছেন আত্মনিন্দা থেকে, আত্মগ্লানি থেকে তাকে নিষ্কৃতি দান করে তার সম্মানের পদবি উদ্ধার করেছেন। তাকে বিশ্বজনের আত্ম-উপলব্ধিতে সমান অধিকার দিয়েছেন। আজ সমস্ত ভারতে যুগান্তরের অবতারণা হয়েছে চিত্রকলায় আত্ম-উপলব্ধিতে। সমস্ত ভারতবর্ষ আজ তার কাছ থেকে শিক্ষাদান গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের এই অহংকারের পদ তারই কল্যাণে দেশে সর্বচ্চ স্থান গ্রহণ করেছে। একে যদি আজ দেশলক্ষ্মী বরণ করে না নেয়, আজও যদি সে উদাসীন থাকে, বিদেশি খ্যাতিমানদের জয় ঘোষণায় আত্মাবমান স্বীকার করে নেয়, তবে এই যুগের চরম কর্তব্য থেকে বাঙালি ভ্রষ্ট হবে। তাই আজ আমি তাকে বাংলাদেশে সরস্বতীর বরপুত্রের আসনে সর্বাগ্রে আহ্বান করি।’
বাড়িতেই অবন ঠাকুরের ছবি আঁকা শুরু। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তার চিত্রকলার পাঠ খানিকটা দেরিতে। পঁচিশ বা ছাব্বিশ বছর বয়সের দিকে ইতালীয় শিল্পী ও আর্ট স্কুলের শিক্ষক গিলারডির কাছে তার শিক্ষা শুরু হয়। এসময়ে বিলেতের বিখ্যাত শিল্পী সি এল পামার কলকাতায় আসেন। তার কাছে অবনীন্দ্রনাথ লাইফ স্টাডি শিখেছেন, শিখেছেন তেলরঙয়ের ব্যবহার। এভাবেই ভারতীয় পদ্ধতি বা প্রাচ্য রীতি অনুযায়ী তিনি আঁকেন ‘কৃষ্ণলীলা সংক্রান্ত’ কিছু ছবি। ১৮৯৫ সালের দিকে অবন ঠাকুর নিরীক্ষাধর্মী ছবি আঁকা শুরু করেন। ১৮৯৭ সালের দিকে আঁকলেন শুক্লাভিসার-রাধার ছবি। এখানেই কবি গোবিন্দ দাসের বিভিন্ন পঙক্তিমালা ছবির মাঝে উৎকীর্ণ করেন। যা ছিলো পাশ্চাত্য ও ভারতীয় রীতির নতুন সংমিশ্রণ রীতি। ১৯০০ সালে কলকাতা আর্ট কলেজে তার কৃষ্ণলীলা সিরিজ প্রদর্শিত হয়। পরবর্তীকালে ই বি হেভেলের উদ্যোগে লর্ড কার্জনের দিল্লি দরবারে আরও দুটি প্রদর্শনী এবং লন্ডনের ‘স্টুডিও’ পত্রিকায় চিত্রসমালোচনা প্রকাশিত হলে অবন ঠাকুরের ছবি সাধারণ জনগণের সামনে আসে। তার আঁকা ‘শাজাহানের অন্তিমকাল’ ভীষণ খ্যাতনামা ছবি, আর তার পায়ের কাছে তার কন্যা। এছবি অবন ঠাকুর এঁকেছিলেন ১৯০২ সালে। এরপর তার আঁকা মুঘল সাম্রাজ্য ও তার অন্দরমহল নিয়ে অগণিত ছবি আঁকেন অবন ঠাকুর। কলকাতা আর্ট কলেজের শ্রেষ্ঠ দশক ধরা হয় ১৯০৫ থেকে ১৯১৫ সালের সময় পরিধিকে। এসময় জুড়ে কলকাতা আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন অবন ঠাকুর। অবন ঠাকুরের জাপানি রীতিতে আঁকা বিখ্যাত চিত্রকর্ম ‘ওমর খৈয়াম’ এক অনন্য শিল্পকর্ম । এ কলেজেই তিনি ছাত্র হিশেবে পেয়েছিলেন যামিনী রায়, শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু, মুকুল দে, সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলি ও ক্ষিতিন্দ্রনাথ মজুমদারের মতো মহৎ শিল্পীদের। অবন ঠাকুর কাগজ ছাড়াও বিভিন্ন মিডিয়ামে কাজ করেছেন, যেমন কাপড় ও কাঠ। একই সঙ্গে বানাতেন পুতুল। নিজে কাপড় কেটে পুতুল তৈরি করতেন। খুব সকালে যে ভ্রমণে বের হতেন তখন অভ্যাস মতো তিনি সুপারিগাছের খোল কুড়িয়ে আনতেন, আনতেন নারিকেলের মালা বা বিভিন্ন গাছের শেকড়। এসব কুড়িয়ে আনা জিনিসপত্র দিয়ে তিনি বিভিন্ন ধরনের ভাস্কর্য সৃষ্টি করতেন। ভারতীয় শিল্প বা প্রাচ্যের শিল্প যাতে সারা পৃথিবীতে পৌঁছয় সেজন্য তার চেষ্টার কোন ত্রুটি ছিলো না। সম্পূর্ণ ইউরোপীয় শিল্পরীতির সঙ্গে ভারতীয় রীতির মিশ্রণ ঘটিয়ে যে অসাধারণ নতুন শিল্পরীতির তিনি জন্ম দিয়েছেন তা আজও বিশ্বের শিল্প সমজদারদের কাছে এক শ্রদ্ধেয় বিষয়। ১৯০৭ সালে তিনি ও তার অগ্রজ গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করেন ‘ইনডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট’। এছাড়া শিল্পবিষয়ক অগণিত প্রবন্ধ রচনা করেছেন।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভারতীয় চিত্রকলায় অসাধারণ অবদান বিষয়ে আহমাদ মাযহার ও লেখক আদনান সৈয়দ দীর্ঘক্ষণ আলোচনা করেন। এরপর কথা ওঠে আরেকজন অপেক্ষাকৃত কম খ্যাতিমান শিল্পী সম্পর্কে, তিনি শিল্পী গোবর্ধন আশ। আমাদের চিত্রকলার জগতে আজকাল এই শিল্পীর কাজ নিয়ে খুব বেশি একটা আলোচনা হয় না। বিশেষ করে নীরদ মজুমদার, পরিতোষ সেন, গণেশ হালুই, গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, বা অন্যান্য সমকালীন চিত্রশিল্পীদের নিয়ে যতোটা আলোচনা হয়, সে তুলনায় গোবর্ধন আশ একেবারেই অনালোচিত বলা যায়। হুগলীর বেগমপুর গ্রামের পান চাষির ছেলে গোবর্ধন আশ বাবা মায়ের টানাটানির সংসারে জন্ম নিয়েও শিক্ষার প্রতি গভীর মনোযোগী ছিলেন। একেবারে ছেলেবেলায় চূড়ান্ত দারিদ্র্যের মাঝেই তার শিল্পশিক্ষা শুরু। তার শিক্ষকরা জানিয়েছেন তিনি স্কুলের নীচের ক্লাসগুলোতে উত্তরপত্রে প্রশ্নের জবাব না লিখে হামেশাই পাখি, নিসর্গ ও গাছাগাছালির ছবি এঁকে দিতেন। কিন্তু স্কুলের শিক্ষকরা এই অসাধারণ মেধাবী ছাত্রটিকে খুব স্নেহ করতেন বাংলা ও ইংরেজিতে এই ছেলেটির অতি উচ্চ মেধার জন্য। তার স্কুলের প্রধান শিক্ষকই তাকে কলকাতা আর্ট কলেজে পড়তে পাঠিয়ে দেন। তখন আর্ট কলেজে ছাত্র বিক্ষোভ চলছিলো ভারতীয় শিল্পী মুকুল দে’কে অধ্যক্ষ নিয়োগের কারণে। সেই বিক্ষোভে গোবর্ধনও ছিলেন। মুকুল দে তার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য বিক্ষোভকারী ছাত্রদের বৃত্তি বন্ধ করে দেন। গোবর্ধন ক্লাসে মনোযোগী ছিলেন না, কিন্তু বাইরে ঘুরে ঘুরে স্টাডি করতেন। মুকুল দে সেসব কাজকে ভীষণ পছন্দ করতেন। চিত্রশিল্পী গোবর্ধন আশের ছবির নির্মাণরীতি ও শিল্পসুষমা দুটোই সমকালীন অন্যান্য চিত্রকরদের থেকে একেবারে আলাদা ছিলো।
এরপর আড্ডায় যে শিল্পীকে নিয়ে মাযহার ও নসরত শাহ কথা বলেন তিনি মকবুল ফিদা হুসেন। নসরত এই আলোচনায় যোগ দেয়ার আগে কলকাতার কয়েকজন শিল্পীর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও খুব কাছ থেকে তাঁদের ছবি আঁকার পদ্ধতি দেখার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য। আমি বেশ কয়েকজন চিত্রশিল্পীকে সত্তর দশকের শেষ দিক থেকে চিনতাম, কিন্তু নসরতের মতো আমার কারও কাজ ব্যক্তিগত পর্যায়ে দেখার সুযোগ হয়নি। বিকাশ ভট্টাচার্য অপেক্ষাকৃত কম বয়সে প্রয়াত হন। আমার মনে আছে ‘৯২ সালের ডিসেম্বরে আমি চিকিৎসার জন্য কিছুদিন কলকাতায় অবস্থান করছিলাম। সে-সময় তাঁর একটি চিত্র প্রদর্শনীর সংবাদ ও বিজ্ঞাপন দেখি। সেই প্রদর্শনীটি ছিলো বাঙালি বড় রাজনীতিবিদ, শিল্পী ও বড় মানুষদের পোরট্রেট নিয়ে। সেখানে জগদীশ চন্দ্র বসু থেকে সত্যজিৎ রায় পর্যন্ত প্রায় চল্লিশজন শীর্ষ বাঙালির পোরট্রেট প্রদর্শনীটিতে স্থান পায়। আমার মনে পড়ে প্রদর্শনীটি শুরুর দ্বিতীয় দিনেই সকল ছবি বিক্রি হয়ে যায়। কী ভীষণ জনপ্রিয় ছিলেন বিকাশ ভট্টাচার্য। এছাড়া নব্বইয়ের দশকে নিউ ইয়র্কে ভারতীয় ছবির একটি প্রদর্শনী হয় এবং সোহোতে সে-সব ছবি নিলাম হয়েছিলো। আমি একদিন সেই প্রদর্শনী দেখতে যাই কবি সৈয়দ শহীদের সঙ্গে। মনে আছে গণেশ পাইনের একটি ছবি আটলক্ষ ডলারের সামান্য বেশিতে বিক্রি হয়েছিলো।
যাহোক, মকবুল ফিদা হুসেন ভারতের চিত্র-প্রেমিকদের ছাড়াও বাংলাদেশের অনেক চিত্রসমালোচকদের কাছে খুব প্রিয়। চিত্রকর হিশেবে তাঁকে বলা হয় একজন চিরায়ত প্রেমিকের প্রতিভূ হিশেবে। ধর্মান্ধতা ও রাজনৈতিক অজ্ঞতার অন্ধভূমি হিশেবে তিনি ভারতকে এক সময় আখ্যায়িত করে স্বেচ্ছানির্বাসন নেন। জীবনের শেষদিনগুলি তিনি বিদেশেই কাটান। মৃত্যুর আগে এই শিল্পী নিজের দেশে ফেরা বিষয়ে মন্তব্য করেছিলেন এই বলে, ‘আমাকে কেউ বেঁধে রাখতে পারবে না, আমি কালই ফিরে যেতে পারবো, কিন্তু জানবেন আমি যেখানেই যাই না কেন, লন্ডন, প্যারিস, নিউ ইয়র্ক বা কাতার, আমি চিরকাল এক ভারতীয় শিল্পী হিশেবেই থাকবো।’
ভারতের স্বাধীনতার পর পর সাহিত্য ও শিল্পকলার বিভিন্ন শাখায় এক ভিন্ন নির্মাণরীতি ও শিল্পাদর্শ লক্ষ করা যায়। সাহিত্যের প্রতিটি ভারতীয় ভাষায় ও চিত্রশিল্পে এটা বেশি প্রকাশিত। জাতীয়তাবাদের সংকীর্ণ মতাদর্শ ভেঙ্গে আন্তর্জাতিকতার বিশালতা খুঁজতে চল্লিশের দশকের শুরুতে যে সব শিল্পী তাঁদের নতুন পথের সন্ধানে লিপ্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে ‘দি বোম্বে প্রগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপ’ অন্যতম। এই গ্রুপে তখন যারা ছিলেন তাঁদের মধ্যে মকবুল ফিদা হুসেন, ফ্রান্সিস নিউটন সুজাও ও এস এইচ রাজা ছিল্রন। আমার তরুণ বয়সে যখন ভারতীয় চিত্রকলা বিষয়ে সামান্য কিছু পড়তে শুরু করি তখন গোয়ানিজ বংশোদ্ভূত শিল্পী ফ্রান্সিস সুজা আমার ভীষণ প্রিয় ছিলো। ভারতীয় শিল্পরীতির সঙ্গে পশ্চিমা আধুনিক চিত্ররীতিকে শিল্পিতভাবে মিশ্রণের এক অসাধারণ শিল্পী ফ্রান্সিস সুজা। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিল্পী আকবর পদমাসের কিছু কাজ দেখেও আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম সে-সময়ে। আহমাদ মাযহার হুসেনের সঙ্গে সঙ্গে ওয়াসিম কাপুরের চিত্ররীতি নিয়েও বেশ কিছু মূল্যবান মন্তব্য করেন। হুসেনকে ভারত সরকার পদ্মশ্রী খেতাব দেয় ১৯৫৫ সালে, ১৯৭৩ সালে পদ্মভূষণ পুরস্কার, ১৯৯১ সালে পদ্মবিভূষণ পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি। তবে জগতের বড় সম্মানগুলোর মধ্যে ১৯৭১ সালে সাও পাওলো বিয়েনালে শিল্পী পাবলো পিকাসোর সঙ্গে শিল্পী হুসেনকেও বিশেষ আমন্ত্রণ জানানো হয়।
এত জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানের পরও শিল্পী হুসেন ছিলেন ভারতীয় কট্টর গোঁড়া হিন্দুদের চক্ষুশূল। যারা শিল্পের বিচার করতে অক্ষম তারাই দেখা যায় হুসেনের ছবিতে, বিশেষ করে ‘মাদার ইনডিয়া’ ও অন্যান্য হিন্দু ধর্ম ও দেব দেবীর বর্ণনামূলক কাহিনীচিত্র, মহাভারতের বা হিন্দু উপাখ্যানের কাহিনীচিত্রের সাবলীল প্রকাশ না বুঝেই এক শ্রেণীর ভারতীয়রা প্রতিবাদ শুরু করে। মৌলবাদী হিন্দুরা রাজনৈতিক হাতিয়ার হিশেবে এসবকে ব্যবহার করে।
নসরত ও মাযহারের মন্তব্যের সঙ্গে আদনান সৈয়দও হুসেনের কাজের ধারাকে নিজের মতো করে বিশ্লেষণ করেন। তাঁদের বক্তব্য অনুযায়ী হুসেনের কাজকে কোন নির্দিষ্ট ধারার মাঝে বাঁধা কঠিন। অনেকটা কোলাজের মত দ্বিমাত্রিক ফর্মগুলো ভাসমান ক্যানভাসের মত খোলা আকাশে উড্ডীন যেন। উজ্জ্বল ও লাউড বা চড়া রঙয়ের ব্যবহার তাঁর কাজকে দিয়েছে তারুণ্যের ছোঁয়া। ভারতীয় সংস্কৃতি ও রামায়ণ বা মহাভারতের আখ্যানগুলো ছিলো তাঁর ছবির বিখ্যাত কন্টেন্ট। এছাড়া মায়ের মুখ খুঁজতে গিয়ে তিনি একটা সময়ে সারাক্ষণ মাদার টেরিজার মুখ এঁকেছেন। প্রেমিকার মুখ খুঁজেছেন তিনি এক সময় এঁকেছেন চিত্রনায়িকা মাধুরী দীক্ষিতের মুখ। ভারত ভূমির অবিচ্ছেদ্য আদর্শ মোহনদাশ গান্ধির মুখ এঁকেছেন গভীর জীবন দর্শন উপস্থাপনায়। হুসেনের এপিক আকারের ক্যানভাসগুলো ভারতমাতার বিশালত্বই প্রমাণ করে বার বার।
এরপর আমাদের আড্ডায় কিছুটা রাজনীতি নিয়ে কথা শুরু হয়। গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশে ছাত্রদের কোটা আন্দোলনের জের দেশকে এমন অচলাবস্থায় নিয়ে যায় যে আমরা চাইলেও এই বিষণ্ণতা থেকে নিজেদেরকে মুক্ত করতে পারিনি। শৈবাল তাই বার বার ঘুরে ফিরে সাহিত্য ও শিল্পকলার আলোচনার মধ্যে নিজের রাজনৈতিক হতাশা নিয়ে কথা বলছিলেন। পাকিস্তানসহ আফ্রিকার কয়েকটি দেশে জাতিসংঘের পেশার সূত্রে তাঁকে থাকতে হয়েছে কিছুদিন। সে-সব দেশের মুসলমানদের সঙ্গে রাজনীতি নিয়ে কথা বলে এবং নিজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে তিনি আড্ডায় কিছু মন্তব্য করেন। তিনি বলেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিষয়ে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর ফন্দি ফিকির কোন পর্যায়ে নিয়ে গেছে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসকে, সেটা খুব জটিল আকার ধারণ করেছে তরুণদের স্বচ্ছভাবে বোঝার ক্ষেত্রে। এছাড়া আজকের প্রজন্মের তরুণ ছাত্ররা আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস বুঝতে কেন ভিন্ন পথের অনুসরণ করছে, এটা কেনই বা আমাদের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা শাসক শ্রেণী বুঝতে অক্ষম তা শৈবাল বিশ্লেষণ করেন একেবারে নির্মোহ ও নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টিকোণ থেকে।
হঠাৎ আমাদের দৃষ্টি যায় ঘড়ির দিকে, মধ্যরাত প্রায় ছুঁই ছুঁই, নসরত শাহকে যেতে হবে কানেকটিকাট, তাঁর শেষ ট্রেন ধরতে ছুটতে হবে। তাই শৈবাল তাঁকে তুলে বেরিয়ে পড়লেন ট্রেন স্টেশনের দিকে। আমি, মাযহার ও আদনান সৈয়দ নতুন কিছুটা পানীয় নিয়ে ফিরে গেলাম কবিতায়। কবি শামস আল মমীন কোভিদে আক্রান্ত হয়ে গত কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম সশরীরে আড্ডায় উপস্থিত থাকতে পারেন নি, কিন্তু ফোনে ভারচুয়ালি আড্ডায় যোগ দিয়ে আমাদের সঙ্গেই ছিলেন দীর্ঘক্ষণ। আমরা বাংলাদেশ ও কলকাতার সমকালীন কবিতা ও প্রবন্ধ সাহিত্যের মান নিয়ে কথা বলতে শুরু করলাম। আমাদের একটি বিষয়ই ভাবার ছিলো, কেন বাংলাদেশের প্রবন্ধ সাহিত্য পশ্চিমবঙ্গের প্রবন্ধসাহিত্য থেকে মানের দিক থেকে এতোটা দূরের। মাযহার এ বিষয়ে দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ জানালেন। আদনান ও আমার ধারনা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পাকিস্তানের সময় থেকেই সমাজকে স্বাধীন ও বিশ্লেষণাত্মকভাবে বুঝতে শেখায় না, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রশক্তি বা ক্ষমতাকে প্রশ্ন করতে শেখায় না, তাই চিন্তাশীল কোন লেখাই বলতে গেলে আমাদের সাহিত্য এনকারেজ করে না। সমাজ, বা শিক্ষাব্যবস্থা যে বিষয়কে পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না, সেটা সমাজে আদৃত হয় না কখনই। আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ক্ষমতাকে পূজা করতে শেখায়, প্রশ্ন করতে শেখায় না। বরং প্রশ্নকারীকে শাস্তি দেয়। এধরনের সমাজে চিন্তাশীল লেখকের জন্ম হতে পারে না সম্ভবত।
আমরা আমাদের স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি কবিতায় যে কয়েকটি বাঁক লক্ষ করি তা নিয়ে কথা বলছিলাম। আমাদের কথার মাঝে ‘৭২ সাল থেকে কয়েক বছর কলকাতার জনপ্রিয় কয়েকজন কবি যেমন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শঙ্খ ঘোষ কেন ঢাকার পাঠকদের কাছে জনপ্রিয় ছিলেন তা নিয়ে আলোচনা করি। যদিও এই তিনজন কবি একেবারে তিন ধরনের। তাহলে তাঁদের কবিতা কেন আমাদের কাব্যরসিকদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ পর্যায়ের কবিতাগুচ্ছ অন্ধকারের হাত ধরেই নিয়ে এসেছে শ্মশানের প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ। ‘অন্তিম কৌতুক’, ‘কে পশ্চাতে, ‘শবযাত্রী সন্দিগ্ধ’ ‘সম্মেলিত প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি কবিতায় শ্মশানের ভাবনা বার বার এসেছে। কিন্তু একেবারে শেষদিকের কবিতা ‘যেতে পারি, কিন্তু কেন যাব’ বা অন্যান্য কয়েকটি কাব্যগ্রন্থে এই কবিই ছিলেন লক্ষ্যভেদী গবেষক শব্দের প্রকৃতি নিয়ে। অন্যদিকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন একেবারে ভিন্ন আত্মিক অভিজ্ঞান সন্ধানী, কিন্তু তাঁর কবিতার সুর পাঠককে নিয়ে যায় গীতিময় এক গদ্যের বিস্তারে। অধিকাংশ কবিতাতেই ষাটের দশকে এই কবি অন্বেষণ করেন প্রেমের বিবিধ অর্থানুসন্ধান। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ আবার এই দুই কবির থেকে একেবারে ভিন্ন ভাবনার কবি। তাঁর কবিতা যে সচেতনতায় বিশিষ্ট, তা কোন আরোপিত সচেতনতা নয়, বরং এক গভীর অর্থময় চলিষ্ণু সত্তার আধার সন্ধানী কাব্যরূপ।
রাত গভীর হচ্ছিলো, আমরা কিছুটা ঘোরের মাঝে কবিতা নিয়ে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিয়েছিলাম তিনজনে। ঘড়ির কাঁটা প্রায় দেড়টা ছাড়িয়ে গেছে অনেকক্ষণ আগে, তাই উঠতে হলো সবাইকে। আমি আড্ডার টেবিলে খাবার বাসন গেলাস না ধুয়ে একই রকম রেখে বাতি নিবিয়ে রেকর্ডারে গান চালিয়ে শুয়ে পড়লাম। হাজারটা বিষণ্ণ ভাবনায় ঘুম আসছিলো না আমার। এক ধরনের অবসন্নতা আমাকে গ্রাস করছিলো!
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com