ঢাকা ১০ই সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ই রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি


নিউ ইয়র্কে শনিবারের আড্ডা

redtimes.com,bd
প্রকাশিত আগস্ট ১৩, ২০২৪, ১১:৫৯ অপরাহ্ণ
নিউ ইয়র্কে শনিবারের আড্ডা

‘ফিরিবে বীভৎস নৃত্যে আজন্মের নিষ্ফলতা যত’ —-সুধীন্দ্রনাথ দত্ত

আবেদীন কাদের

গত কয়েকদিন ধরে বাংলাদেশের অস্থির রাজনীতি আমাদের সবাইকেই কিছুটা বিষণ্ণ করে রেখেছিলো। বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হলে বা টেলিফোনে কথা হলে একই বিষয় নিয়ে কথা হয়। কয়েকদিন ধরে টানা অস্থিরতা।  ঘরে সারাদিন পড়াশুনা বা বইপত্র সরিয়ে রেখে ঢাকার সংবাদ ব্রাউজ করাই ছিলো আমার একমাত্র কাজ, নিউ ইয়র্ক টাইমসের মতো বনেদী কাগজ প্রায় প্রতিদিন প্রথম পাতায় গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে সংবাদ ছাপতো। রাতে ঘুমুতে যেতাম সংবাদ দেখে, সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কাজ ছিলো নিউ ইয়র্ক টাইমস দেখা। বিষণ্ণতা আর উদ্বেগ মিলে মিশে খুব অবশ করে রাখতো মনটাকে। তাই কথা হলে দেখতাম কবি শামস আল মমীনের মতো অরাজনৈতিক মানুষও ঢাকার সংবাদ বিষয়ে হালনাগাদ থাকার চেষ্টা করেন।

 

আড্ডায় সবার আগে এলেন মমীন ভাই, তিনি এলেই ঢাকার খবর নিয়ে কথা উঠলো। আমি সব খবর জানি না, কিন্তু আহমাদ মাযহার ও নসরত শাহ সারাক্ষণ সর্বশেষ খবর দেখার চেষ্টা করেন। মমীন ভাই আর আমি ঢাকার রাজনীতি নিয়ে কথা বলছিলাম, এর মাঝেই আহমাদ মাযহার ও শৈবাল এসে যোগ দিলেন। শৈবাল ও মাযহারের কাছে হাজারটা বিদেশী সংবাদ সংস্থা ও গুরুত্বপূর্ণ দেশগুলো বাংলাদেশ সম্পর্কে কী অবস্থান নিচ্ছে সে-সবের একেবারে শেষ সংবাদ জানালেন। এমনিতে আড্ডায় আমরা রাজনীতি নিয়ে একেবারেই কথা বলতে চাই না, কিন্তু গত প্রায় সপ্তাহ দুয়েক ধরে আমরা ভীষণ এনগ্রসড ছিলাম ঢাকার ছাত্র আন্দোলন নিয়ে। পনেরো তারিখ থেকে দিন পাঁচেক ছাত্রদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, মৃতের সংখ্যা যে হারে বাড়ছিলো, সরকারের এ বিষয়টি নিয়ে যে অমানবিক অবস্থান ছিলো তাতে কোনমতেই সাধারণ মানুষের সমর্থন সরকারের প্রতি থাকার কথা নয়। তার ওপর ছাত্রলীগের পাণ্ডাদের যেভাবে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে সাধারণ ছাত্রদের ওপর লেলিয়ে দেয়া হয়েছে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নির্দেশে তা কোনমতেই সমর্থনযোগ্য নয়। এসব বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলছিলাম। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা শহরগুলোতে ছাত্রীরা যেভাবে পুলিশের ও ছাত্রলীগের অত্যাচার সয়ে অকুতোভয়ে এগিয়ে যাচ্ছিলো তা বাংলাদেশের তরুণ সমাজের রাজনৈতিক ক্রিয়াকাণ্ডে একেবারে নতুন। ষাটের দশক থেকে আমরা ছাত্রদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড দেখে আসছি। আমি নিজে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র থাকার সময় থেকে প্রায় প্রতিদিন মিছিলে অংশ নিয়েছি, আশি এবং নব্বই দশকের স্বৈরাচার বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় আমি সরকারি কর্মকর্তা হিশেবে এর বিভিন্ন দিক দেখেছি, কিন্তু মেয়েদের অংশ গ্রহণ এবং এমন তীব্র সরকার বিরোধিতা এবং উজ্জীবিত অবস্থান আমি কোনদিন দেখিনি। একদিকে তাদের পোশাকে অনেকেই হিজাব ব্যবহার করছেন, কিন্তু দাবি আদায়ের কাঙ্ক্ষা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা প্রদর্শনের দিক থেকে একবারে ফায়ারব্র্যান্ড, এমনটা আমি ছাত্রজীবনে বা সরকারি চাকুরে হিশেবে কোনদিন দেখিনি। এছাড়া এই প্রথম বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছাত্রদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ এমন একটি পক্ষ হয়ে দাঁড়ালো যে ছাত্র সমাজ ও সাধারণ জনগণ তাদের বিরুদ্ধে। ষাট থেকে নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী সকল আন্দোলনগুলোতেই আওয়ামী লীগ ছিলো আন্দোলনকারী দল, সাধারণ জনগণ ছিলো তাদের পক্ষে। এবার চিত্রটা একেবারে উল্টো।  আরও একটি বিষয় লক্ষ করা গেছে, সেটি একেবারেরই অপ্রত্যাশিত ছিলো আওয়ামী লীগের জন্য। সেটি হলো দেশের তরুণ ও প্রবীণ শিল্পী, লেখক, গায়ক, অভিনয় শিল্পীগণ রাজপথে ছিলেন ছাত্রদের পক্ষে এবং সরকারের বিরুদ্ধে। পুরো ষাটের দশক থেকে নব্বইয়ের আন্দোলনের সময় পর্যন্ত চারুকলার ছাত্র থেকে শুরু করে বেলি রোডের অভিনয় শিল্পীরা ছিলেন আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগের পক্ষে, কিন্তু অনেকদিন ধরেই তাদের অনেককে রাষ্ট্রীয় উচ্ছিষ্ট বিলিয়ে শেখ হাসিনার সরকার নিজেদের দালাল বানিয়ে রেখেছিলো, কিন্তু ছাত্রদের আন্দোলনের সময় দেখা গেলো উচ্ছিষ্টভোগী রামেন্দু মজুমদার বা নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুরা নীরব, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুনরা একেবারে পাথরের মতো নীরব, কিন্তু সাধারণ জনগণ ও ছাত্রদের পক্ষে দেশের অধিকাংশ বিবেকী শিল্পীরা। নব্বই দশকের পর গত তিরিশ বছরে এই ট্রান্সফরমেশনটা ঘটেছে বা উচ্ছিষ্টভোগী শিল্পীরা একটা বড় মেটামরফোসিসের ভেতর দিয়ে গিয়ে শেখ হাসিনার মতোই তারাও যে নিজেদের মরাল শক্তি হারিয়ে সম্পূর্ণ দেউলিয়া হয়ে গেছে, তা তারা নিজেরাও টের পায়নি। তাই আজ যখন বিদ্রোহী ছাত্রদের ন্যায্য দাবি রাস্তায় উচ্চকিত স্বরে উচ্চারিত, তখন শেখ হাসিনার মাখন-খাওয়া শিল্পীরা রাজপথ থেকে অনেক দূরে। শিল্পী, লেখক, বুদ্ধিজীবীদের সত্যিকার শক্তির উৎস যে তাঁদের মরাল ও নৈতিক দৃঢ়তা থেকে উৎসারিত, তা তারাও যেমন ভুলে গেছেন, তেমনি শেখ হাসিনাও দুর্নীতির মোড়কে তা সম্পূর্ণ ঢেকে দিয়েছেন।

 

এমন সব বিষয় নিয়ে আড্ডায় তীব্র রাজনৈতিক আলোচনাই হচ্ছিলো। আমি অনেকটা নীরব ছিলাম। আমার চিন্তার বিষয়টি ছিলো কিছুটা আলাদা। কেন বাংলাদেশের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এমন একটা দুশ্চিকিৎস্য অবস্থায় এসে পৌঁছলো। শেখ হাসিনা ‘৮১ সাল থেকে ২০০৯ সালের গোড়ার দিক পর্যন্ত খুব বেশি অগণতান্ত্রিক আচরণ করেন নি, সরকার প্রধান বা বিরোধী দলীয় নেতা হিশেবে। তাহলে তার রাজনৈতিক চরিত্রে এমন পরিবর্তন আসার কারণই বা কী কী! আমি আড্ডায় বিষয়টা তুলিনি, কিন্তু সবার কথাই শুনছিলাম আর ভাবছিলাম প্রশ্নটা। আমাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা আমাদের সমাজকে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে উপনিবেশিক সমাজ হিশেবে বাংলাদেশ সমাজ ‘৪৭ থেকে ‘৭১ সালের সময় পরিধি বা ‘৭২ থেকে আজ অবধি কী কী সামাজিক প্রতিবন্ধকতার জন্য একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক সমাজ হিশেবে গড়ে উঠতে পারেনি, তা আলোচনা করেন না। দ্বিতীয়ত, আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থায় শাসক হিশেবে ব্যক্তির ভূমিকা কী হবে আর শাসনতন্ত্রের ভূমিকা বা আইনের ভূমিকা কী হবে তা নিয়ে বিশদ আলোচনা হয় না। তৃতীয়ত, কেন আমাদের সমাজে ‘নির্বাচিত’ অথবা অনির্বাচিত সরকারের প্রধানদের মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্য রাষ্ট্রপরিচালনায় কতোটা ক্ষতিকারক বিষয় হয়ে উঠতে পারে তা নিয়ে কোন ভালো সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণও করা হয় না। ‘৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর ক্ষমতা গ্রহণের পর আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা কখনোই প্রায় গবেষণা করেন নি কেন বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত ও মনোজাগতিক ঝোঁকগুলো শাসনতান্ত্রিক আইনের ওপরে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছিলো, বা রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ায় তা কতোটা ক্ষতিকর ছিলো, বা আদৌ ক্ষতিকর ছিলো কিনা! এসব বিষয় নিয়ে কেন আমাদের সমাজবিজ্ঞানীরা বা লেখকরাও খুব একটা লিখতে বা গবেষণা করতে চান না! ‘৭৫ সালের পর থেকে সামরিক শক্তির জোরে যে-সকল অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণকারী স্বৈরশাসক দেশ শাসন করেছে, কেন তাদেরকে আইনের আওতায় এনে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি বা কাউকে কাউকে মরণোত্তর বিচার করা হয়নি, বা সিম্বলিক বিচারও করা হয়নি, এটা আমাকে অনেকদিন ভাবিয়েছে। তাহলে আমাদের দেশ-শাসকরা যে আইন বিষয়ে বা শাসনব্যবস্থা বিষয়ে কখনও পরিষ্কার কিছু ব্যবস্থা চান নি, সব সময়ই একটা জোড়াতালি দিয়ে চলার পথ বেছে নিয়েছেন সেটা নিয়েও সমাজবিজ্ঞানীরা কোন গবেষণা করেন নি, কেন আমাদের রাষ্ট্রগঠন প্রক্রিয়ার শুরুতেই ভীষণ বড় ত্রুটি ছিলো কিনা তা অন্বেষণ করে দেখা হয় নি! এসব বিষয় আমাকে অনেকদিন ধরে মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে, কিন্তু আমি নিজেও কোন গবেষণা প্রকল্প হাতে নেইনি। আমার ব্যক্তিগত ব্যর্থতার কারণ, যে-সময়ে আমি এই গবেষণা করার তীব্র ইচ্ছা বোধ করেছি, তখন আমার বয়স বা শারীরিক বৈকল্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু প্রশ্নগুলো আমাকে অনেকদিন ধরে কষ্ট দিয়ে চলছে। আমি আমার বন্ধুদের আড্ডায় অনেকবার এই প্রশ্ন তুলেছি, কিন্তু কংক্রিট কোন গবেষণা কাজ কেউ করার কথা চিন্তা করেন নি। কেন আমাদের রাজনৈতিক নেতারা অধিকাংশই যে জাতীয় দায়িত্ব নেয়ার জন্য মানসিকভাবে শিক্ষাগতভাবে প্রস্তুত নয়, তবুও তাদেরকে সে-প্রশ্ন আমাদের সুশীল সমাজ করেনি, তাদের মানসিক যোগ্যতার পরীক্ষার সামনে কোন বুদ্ধিজীবী তাদেরকে দাঁড় করান নি, সেটাও একটা ভাববার বিষয়। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের যে ন্যারেটিভ রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘৭২ সাল থেকে বাজারে চাউর করার চেষ্টা চলছে, তা শিক্ষাবিদ বা ইতিহাসবিদরা এসিড টেস্টের সামনে দাঁড় করান নি গবেষণার মাধ্যমে, এই প্রশ্নও আমাকে ভাবায়। অনেকেই বলেন আমাদের সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ বা বুদ্ধিজীবী সমাজ মানসিকভাবে রাষ্ট্রীয় প্রতাপ বা পুঁজির কাছে বিক্রি হয়ে যায় সহজেই, কথাটা হয়তো আংশিক সত্য, কিন্তু কেন বার বার জাতীয় আন্দোলনের পর সুযোগ আসার পরও আমাদের বুদ্ধিজীবী সমাজ দুরাচারী অবিশ্বাসযোগ্য রাজনীতিবিদদের পরীক্ষার সামনে দাঁড় করান নি, বা তাদের যোগ্যতা ও মানসিক ঝোঁক বা মনস্তত্ত্ব বিষয়ে জনগণকে হুশিয়ার করান নি। এই কাজ তো রাজনীতিবিদ বা আন্দোলনকারীদের করার কথা নয়, সমাজের পণ্ডিত সমাজ বা বুদ্ধিজীবীদের করার কথা। আজ যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে এত বড় ছাত্র ও সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ফেটে বের হচ্ছে, তা আমরা চাক্ষুষ করছি, কিন্তু শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের পর তার বিকল্প কাকে ও কীভাবে আমরা রাষ্ট্রক্ষমতায় আনবো, তার আইনি বৈধতা কেমন হবে, কী হবে তার শাসনতান্ত্রিক ভিত্তি তা কি আমরা বা আমাদের বুদ্ধিজীবী বা আইনের পণ্ডিতরা গভীরভাবে ভেবে দেখছেন? এর একটা দিক রাজনৈতিক, সেটা অনেকেই বোঝেন, কিন্তু জাতীয় স্বার্থের বা জাতির ভবিষ্যৎ কতোটা অনিশ্চয়তার মধ্যে যাচ্ছে, তা নিয়ে সম্ভবত কেউ ভাবছেন না। বা তা ভাবলেও আমরা তা জানতে পারছি না।

 

 

এসময় আড্ডায় আহমাদ মাযহার ও শৈবাল কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তোলেন, যা নিয়ে আমরা কম ভেবেছি। নসরত শাহ ও কবি এবিএম সালেহউদ্দীন ও কবি শামস আল মমীনও এই আলোচনায় যোগ দেন। প্রশ্নটি ছিলো এই ছাত্র আন্দোলন আমাদেরকে কোন অজানা ভবিতব্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে! আমরা কি শাসনতান্ত্রিক কোন অন্বিষ্টের চিত্র সামনে দেখতে পাচ্ছি যার একটি বৈধ কংক্রিট রূপ আমরা জানি, বা কেউ আমাদের সামনে হাজির করতে পারছেন! আমার দুশ্চিন্তার কারণ সেটি। আমি আমাদের কোন সমাজবিজ্ঞানী বা সুশীল সমাজের সদস্যকে জানি না যিনি আমাদেরকে জানাতে সক্ষম হয়েছেন কী আমাদের সামনে রয়েছে? এভাবে স্বৈরশাসক হয়ে ওঠার কারণগুলো কী হাসিনার, বা যদি তিনি পদত্যাগ করেন তাহলে পরবর্তী কী ব্যবস্থা রাষ্ট্রপ্রধান গ্রহণ করতে পারেন যা আইনসঙ্গত ও সমাজের জন্য কল্যাণকর! না, কেউ আমাদের তার কোন ইঙ্গিত জানান নি। সবাই একটা ধোঁয়াটে অস্বচ্ছ চিত্রই হাজির করছেন, যা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমরা জানি দেশের অর্থনীতি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে, শাসন সম্পর্কিত সকল প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা একেবারে নড়বড়ে, বিশেষত বিচারব্যবস্থা প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। পুলিশ, আমলাতন্ত্র বা শাসনযন্ত্রের অন্য অংশগুলোর অবস্থাও প্রায় একই রকম। ২০১৪ সালের পর থেকে সবগুলো নির্বাচনই প্রায় নামে মাত্র হয়েছে, মূলত সেগুলো ছিলো একেবারেই নির্বাচনের নামে পরাবাস্তব এক সামাজিক নাট্যকলা বিশেষ। এভাবে একটি রাষ্ট্র দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে না।

 

এসব নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েই আহমাদ মাযহার ও আড্ডার বাকী সদস্যরা প্রায় সবাই একমত হলেন যে আমাদের সমাজব্যবস্থায় সত্যিকার রাজনৈতিক দলীয় গণতন্ত্র না থাকার কারণে পরিবারতন্ত্র প্রায় স্থায়ী রূপ নিয়েছে। দেশের নির্বাচনে যারা অংশ নিয়ে রাষ্ট্র শাসন করবেন তারা নিজেদের দলে যদি অগণতান্ত্রিকভাবে বা পরিবারের শাসন চালিয়ে যান দশকের পর দশক, তাহলে তাদের দ্বারা রাষ্ট্রে কী করে গণতন্ত্রের চর্চা আশা করবে মানুষ। প্রথমত রাষ্ট্র জানে না এই রাজনৈতিক দলগুলোর অর্থ কোথা থেকে আসে, কারা এদেরকে চাদা দেয়, কী উদ্দেশ্য নিয়ে দেয়! এসব তহবিল কে কোন আইনের অধীনে নিয়ন্ত্রণ করে, কোথায় এই অর্থের সত্যিকার হিশেব পাওয়া যায়! নির্বাচনে কীভাবে দলীয় প্রার্থী নির্বাচন করা হয়, কে এই প্রার্থিতা নির্বাচনে সিদ্ধান্ত নেয়, কিসের বিনিময়ে দীর্ঘদিনের কর্মীকে বাদ দিয়ে হঠাৎ করে বড় অংকের অর্থের বিনিময়ে বা অন্য কারণে ব্যবসায়ীদেরকে প্রার্থী করা হয়। এরা নির্বাচিত হয়ে এলে দলের কাজে লিপ্ত হয়, নাকি যিনি প্রার্থী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন তার ব্যক্তিগত কাজে নিয়োজিত হয়! এসব বিষয় নিয়ে আড্ডায় বিস্তারিত আলোচনা হয়, কিন্তু আমাদের সবার প্রায় একই প্রশ্ন ছিলো এই পরিবারতন্ত্র বা একক দলীয় ‘মালিকের’ সিদ্ধান্তের অবসান কী করে সম্ভব! অথবা কী করে একনায়কী পরিচালনব্যবস্থা থেকে দলকে মুক্তি দেয়া সম্ভব? এসব বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আড্ডায় কথা হয়, কিন্তু আমাদের সমাজ আজ যে অবস্থায় নিয়ে গেছে দুটি পরিবার বা দলীয় প্রধানদ্বয়, তা থেকে রাজনীতিকে মুক্ত করা প্রায় অসম্ভব বিষয়। আজ দুতিন সপ্তাহ ধরে ছাত্রদের যে আন্দোলন চলছে তা সত্যিই যদি সফল হয়, তাহলে রাজনীতির একটা বড় রূপান্তর ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে তা অবশ্য বোঝা যাচ্ছে।  কিন্তু আমার দ্বিধাদীর্ণ মন কোন কিছু ঠিক নিশ্চিতভাবে ভাবতে পারে না। হয়তো আইনগত গোঁজামিল দিয়ে বা শাসনতন্ত্র অনুমোদন করে না, এমন একটা ‘আপদকালীন সরকার’ নাম দিয়ে একটা সরকার হবে, কিন্তু তা কি কোন সমাধান দেবে, নাকি দীর্ঘস্থায়ী কোন বড় সমস্যার জন্ম দেবে, সেটাই আমার মন ভাবছিলো!

 

আড্ডায় শৈবাল বার বার আমাদের রাজনীতির ও রাজনৈতিক দলগুলোর ব্যক্তিকেন্দ্রিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে কী করে গণতান্ত্রিক নতুন কিছু করা যায় তা নিয়ে বলতে চাচ্ছিলেন, কিন্তু সমাজবিজ্ঞানীদের তাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক সমাজ-বিশ্লেষণগুলো মাথায় রাখলে তেমন কোন সিদ্ধান্তে আসা দুরূহ। আমাদের সমাজে গত পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে বলতে গেলে কোন গণতান্ত্রিক সরকার আসেনি। নির্বাচনের মাধ্যমে যারা শাসন ক্ষমতার দায়িত্ব নিয়েছেন, তারা সবাই শেষ পর্যন্ত অগণতান্ত্রিক শাসক হয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমাদের রাজনীতিকরা বার বার নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনের সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু বার বারই তারা তা হেলায় হারিয়েছেন, নিজেদের লোভ, দুরাচারী চরিত্রের পরিচয় দিয়ে লুঠনকারী হিশেবে নিজেদের প্রমাণ করেছেন। তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রায় নেই বললেই চলে। আমি আমাদের রাজনীতিবিদদের ওপর আস্থা রাখতে সত্যিই ভয় পাই। আমি মনে করি না এর বিপরীতে আমাদের সুশীল সমাজ বা ২০০৭ সালের সেনা সমর্থিত সরকারের মতো কাউকে দায়িত্ব দিয়ে তেমন কোন লাভ হবে। মনে হয় না তারা কোন সুফল বা সুশাসন বয়ে আনতে পারবে। আহমাদ মাযহার, শৈবাল, এবিএম সালেহউদ্দীন, নসরত শাহ ও আড্ডার অন্য বন্ধুরা আমার সঙ্গে অনেকেই দ্বিমত করেন ভবিষ্যৎ নিয়ে। কিন্তু কোন ধরনের রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা জাতি হিশেবে আমাদের জন্য উত্তম তাও বন্ধুদের মধ্যে কেউ দিলেন না। কিন্তু মাযহার, নসরত ও আরও দুয়েক বন্ধু রাজনৈতিক দলের নেতাদের ওপরই ভরসা রাখেন, কিন্তু আইন ও বিচারব্যবস্থা এবং আমলাতন্ত্র ইত্যাদির পরিবর্তনের ওপর খুব জোর দেন। মাযহারের মতে আমাদের বর্তমান আমলাতন্ত্র, সামরিক ও বেসামরিক, দুটি আমলাতন্ত্রই ভীষণ ক্ষতিকর দেশের জন্য। এরা বিভাজিত সমাজকে দীর্ঘদিন নিজেদের দুর্নীতি দিয়ে ঢেকে রেখেছেন। এর পরিবর্তন ছাড়া সুশাসন প্রায় অসম্ভব।

 

আড্ডার মাঝখানে আমাদের বন্ধু কবি শহীদুল টুকু এসে যোগ দিলেন টরোনটো থেকে। সঙ্গে ছিলেন আমাদের আরেক বন্ধু রফিক। টুকু ভাবী ও সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া তরুণ ছেলে অশেষকে নিয়ে এসেছেন। স্কুল থেকে গ্রাজুয়েশনের পর অশেষের নিউ ইয়র্কসহ আমেরিকার কয়েকটি বড় শহরে ভ্রমণ করার সুযোগ দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন টুকু, সেই প্রতিশ্রুতিই পালন করতে এসেছেন আমেরিকায়। অশেষ ভীষণ কৌতূহলী তরুণ, সবকিছু জানতে চান, প্রচুর প্রশ্ন করে। ভাবী স্বভাবতই নীরব ও কোমল মানুষ। শুধু আড্ডায় বসে তীব্র তক্কাতক্কি শুনলেন। টুকু বাংলাদেশে ও নিউ ইয়র্কে ছিলেন অর্থনীতির ছাত্র। টরোনটোতেও একই বিষয় পড়াশুনা করেছেন। এছাড়া ফরিদপুরের মানুষ হিশেবে দেখেছি রাজনীতি বিষয়ে আচ্ছন্ন থাকেন মানসিকভাবে। কিছুটা বাঙালি জাতীয়তাবাদী, কিন্তু মনের রাজনৈতিক ঝোঁক অনেকটা কেন্দ্র থেকে বাম দিকে, ঝুঁকে থাকেন আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের বা তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের কথিত স্বপ্নের দিকে। বঙ্গবন্ধু বিষয়ে খুব আবেগাক্রান্ত। তাই আমাদের রাজনৈতিক তক্কাতক্কিতে টুকু যোগ দিলেন, কিন্তু আমার বা মাযহারের মতোই বর্তমানে চলমান ছাত্র আন্দোলন দেশকে কোথায় নিয়ে যাবে তা নিশ্চিত নয় তার মনও। তিনিও অনেকটাই দ্বিধান্বিত।

 

আড্ডার এক পর্যায়ে আমাদের সুশীল সমাজ বা শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের যে দ্বিচারিতা রাজনীতি বিষয়ে, তা নিয়ে কথা উঠলো। আমি কেন জানি না আমাদের শহুরে নাগরিক সমাজ ও মধ্যবিত্ত সুশীল সমাজের সদ্যসদ্যের বিষয়ে খুব একটা আশাবাদী ধারনা পোষণ করি না, শ্রদ্ধাশীলও নই, নব্বইয়ের আন্দোলনের পর তাদের অধিকাংশের ‘বাণিজ্যপ্রীতি’ বা আখের গোছানোর তৎপরতা আমি কাছ থেকে দেখেছি। আমাদের রাজনীতিতে গত তিন চার দশকে দেখা গেছে এই শ্রেণীর মাঝে লোভ ও অনৈতিক এবং ব্যক্তিস্বার্থ-তাড়িত প্রকৃতিই বেশি দেখা গেছে। রাষ্ট্রের সুশাসন বা নৈতিক কোন বড় দায়িত্ব এই শ্রেণীর হাতে যাক আমি তা কখনোই চাই না। সে-কারণে ‘৯১ সাল থেকে পরবর্তী যে কয়েকটি কেয়ারটেকার সরকার আমি দেখেছি, তাদের বিষয়েও আমি খুব একটা শ্রদ্ধাশীল নই। অবশ্যই রাজনৈতিক সরকারগুলোর চেয়ে তাদের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বেশি থাকে বলে তারা বড় ধরনের দুর্নীতি করতে পারে না, কিন্তু একটি জাতি বা রাষ্ট্রকে বড় জায়গায় নিয়ে যাওয়ার যে Vision দেশপ্রেমিক রাজনীতিকদের মাঝে থাকে তাও তাদের মাঝে দেখা যায় নি। তারা কেউই রাষ্ট্রের স্থায়ী কল্যাণে আইনগত একটি ব্যবস্থা দিতে সাহায্য করেনি, বা তারা পারেনি। তাই বর্তমান ছাত্র আন্দোলনের পর যদি একটা কেয়ারটেকার সরকার আসেও আমি সে-বিষয়ে খুব আশাবাদী নই, তাদের ক্ষমতা বা মরাল ও ভিসনারী ক্ষমতা বিষয়ে সন্দিহান। অন্তত আগের কয়েকটি এমন সরকারের অভিজ্ঞতা থেকে আমার মনে সেরকম চিন্তারই জন্ম হয়েছে। একটা অস্থায়ী ব্যবস্থায় জোড়াতালি দেওয়া ব্যবস্থা হয়, কিন্তু রাষ্ট্রের পরিচালকরা আবার দুর্নীতি ও বেআইনি কাজে লিপ্ত হয়, দেশে সুশাসন আসা কঠিন হয়ে পড়ে!

 

রাত গভীর হলে নসরত বিদায় নেন শৈবালের সঙ্গে, তাকে কানেকটিকাট যেতে হবে। টুকু ভাবী, অশেষ ও রফিককে নিয়ে বিদায় নিলেন। এরপর আমি, মমীন ভাই ও মাযহার বসলাম আমাদের সাহিত্য ও কবিতা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা করতে। প্রায় ঘণ্টা আড়াই এই আড্ডা চলে আমাদের প্রবন্ধ ও কবিতা বিষয়ে কথা বলে। প্রথমেই কথা শুরু হলো বাংলা সাহিত্যে প্রবন্ধের বিভিন্ন ধরনের লেখা নিয়ে। মূলত মাযহার প্রবন্ধ, নিবন্ধ, শশীভূষণ দাশগুপ্তের দেয়া অভিধা ‘রচনাসাহিত্য’ বিষয়ে আলোচনা করেন, এগুলোর সংজ্ঞা, ট্রিটিজ, অভিসন্দর্ভ বা ডিসারটেশন, মনোগ্রাফ ও রচনাসাহিত্যের মাঝে কী পার্থক্য, বা সেসব পার্থক্যের ধরণ কেমন, তা নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করেন। প্রবন্ধের বিভিন্ন ধরন সম্পর্কে মাযহারের এই দীর্ঘ বক্তব্য ছিলো সত্যিই অসাধারণ এবং আমাদের জন্য খুব মূল্যবান। আমাদের তরুণ লেখকরা রচনাসাহিত্যের বা প্রবন্ধের বিভিন্ন ধরণের এই সংজ্ঞা বিষয়ে খুব সচেতন নন, এবিষয়ে মাযহারের বক্তব্যটা পুরো লিখে পাঠ করলে আমাদের জন্য আরও উপকারী হবে।

 

এছাড়া আড্ডার এই পর্যায়ে আমরা তিরিশের কবিতার সঙ্গে পরবর্তী দশকগুলোর বাংলা কবিতার পার্থক্য কোথায় তা নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা করেছি। অনেকদিন পর রাজনীতি এবং সাহিত্য নিয়ে আমাদের আড্ডায় সত্যিই খুব মূল্যবান কিছু কথা আমরা শুনতে পেলাম।

 

রাত গভীর হলে সবাই বাড়ির দিকে চলে গেলেন। আমি এরপর টেবিলে বসে আরও ঘণ্টা দুয়েক নিজের পড়ার কিছু কাজ করলাম, কিন্তু পড়া এগোচ্ছিলো না। বার বার মনের ভেতর আমাদের ছাত্র আন্দোলন ও রাজনৈতিক অস্থিরতা কেন জানি মনটাকে বিষণ্ণ করে রাখলো। আমি শুধু ভাবছিলাম ‘৯০ এর আন্দোলনের পর আমাদের দেশ তো সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্থায়ী রূপ দেয়ার সুযোগ পেয়েছিলো। কিন্তু কেন তা এমনভাবে ব্যর্থ হলো। মনে পড়লো আমার ছাত্রজীবনে নিউ স্কুলে আমি দিনের পর দিন জার্মান দার্শনিক ও আইনের তাত্ত্বিক-পণ্ডিত কার্ল স্মিটের তত্ত্ব বিষয়ে তক্ক করেছি, সেমিনার দিয়েছি তাঁর কন্সটিটিউশনাল থিওরি নিয়ে। আমি এই তাত্ত্বিকের সব লেখার বক্তব্য সমর্থন করি তা নয়, কিন্তু তাঁর ক্ষুরধার পাণ্ডিত্যকে আমি শ্রদ্ধা করি। তাঁর অন্যতম তাত্ত্বিক বই The Crisis in Parliamentary Democracy নিয়ে যে আমার হাজারটা প্রশ্ন রয়েছে, যা ছিলো আমার অধ্যাপকদের সঙ্গে আমার তর্কের বিষয়, তা বাংলাদেশের আজকের রাজনৈতিক সমস্যা বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আমার খুব মনে পড়ছিলো। এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতে অনেকটা সময় কেটে গেলো, ঘুমুতে গেলাম প্রায় সকালের দিকে! বাতি নিবিয়ে রেকর্ডারে রাজেশ্বরী দত্ত ছেড়ে দিলাম, আমার প্রিয় গান ‘কিছুই তো হলো না’ বাজছিলো খুব করুণ সুরে!

 

 

 

 

 

 

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

September 2024
S M T W T F S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930