‘আবু জাফর শামসুদ্দীনের প্রবন্ধে যে দার্শনিকতার রূপ ভাস্বর, তাঁর কথাসাহিত্যিক সত্তাও একই রূপের প্রতিনিধি!’----আহমাদ মাযহার
আবেদীন কাদের
আমি বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম, প্রায় প্রতি শনিবারে আমি বিকেলের দিকে কিছুটা বিশ্রাম করি, শরীর ক্লান্ত থাকে। কিন্তু এই শনিবারে ভাবলাম না ঘুমিয়ে কিছুটা সময় বই পড়ে অপেক্ষা করে কাটাই! শৈবাল দুপুরের দিকে ফোন করে বলেছিলেন একজন নতুন অতিথি নিয়ে আসতে পারেন, তিনি আমাদের বন্ধু কথাশিল্পী ও সাংবাদিক মনিজা রহমান। মনিজা আগেও আমাকে বলেছেন দুয়েকবার যে সময় করে আসবেন। আমি ওঁর লেখা কবিতা শুনেছি এস্প্রেসো-৭৭ এর কাব্যানুসঠানে। কিছুদিন ধরে একটু একটু করে পড়ছি তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গল্পের বই ‘এক পশলা বৃষ্টি কেনার আগে’! অনেক লেখক আছেন আড্ডায় খুব একটা অভ্যস্ত নন, আবার ঢাকা ও কলকাতার লেখকদের মধ্যে দেখেছি কেউ কেউ ভীষণ আড্ডা-পাগল মানুষ। মনিজার আড্ডা নিয়ে ভাবনা আমি তেমন জানি না, কারণ ওঁকে আমি শুধু সাহিত্য অনুষ্ঠানগুলোতেই দেখেছি নিউ ইয়র্কে। আগে ওঁর বিভিন্ন ধরনের লেখা পড়েছি, এবারই প্রথম ওঁর পুরো গল্পের বই পড়ছি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ওঁর পড়ার বিষয় অর্থনীতি, পেশা হিশেবে বেছে নিয়েছিলেন সাংবাদিকতা। তার মাঝে আবার এমন একটি শাখা যা সাংবাদিকতায় ছেলেরাই বেশি থাকেন আমাদের সমাজে। সেটা ক্রীড়া সাংবাদিকতা। এই পেশাটা নেয়ার জন্যই হয়তো ওঁকে আমার একটু সাহসী সাংবাদিক মনে হয় সব সময়, যদিও আমি ওঁর করা কোন ক্রীড়া প্রতিবেদন আমি পড়িনি।
নিজের টেবিলে বসে কাজ করছিলাম, তখন সাতটার কিছুটা বাকি, কবি শামস আল মমীন এলেন। মমীন ভাইয়ের হাতে কফির মাগ ও শুকনো কিছু খাবারের প্যাকেট। আমরা দুজনে বসেই দিনের বাংলা পত্রিকার উল্লেখযোগ্য খবর ও সাহিত্য সাময়িকীগুলোতে কী বেরিয়েছে ঢাকায়, তা নিয়ে কথা বলছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আহমেদ মাযহার, শৈবাল ও ঢাকার দৈনিক ‘প্রথম আলো’র নিউ ইয়র্ক প্রতিনিধি তোফাজ্জল লিটন এসে পৌঁছলেন। আমার আর মমীন ভাইয়ের কবিতা বিষয়ক কথাবার্তা তড়িৎ ভিন্নখাতে মোড় নিলো। আজকাল বিভূঁইয়ে যত বাঙালি রয়েছেন প্রায় সবারই আলোচনার বিষয় বাংলাদেশের রাজনীতি। আমরা চাচ্ছিলাম রাজনৈতিক আলোচনা না করতে, কারণ আমরা এমনিতেই এসব ভেবে ভেবে সারাক্ষণ বিষণ্ণ থাকি! তাই আড্ডায় সাহিত্য বা শিল্প নিয়ে কথা বলাই আমাদের জন্য কিছুটা স্বস্তির! নিজের অন্যান্য পড়াশুনার বাইরে আমি বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে একটু একটু করে অধ্যাপক চিন্ময় গুহর লেখা টি এস এলিয়ট ও ফরাসী কবিতার প্রভাব বিষয়ে অসাধারণ বইখানি পড়ছিলাম। সেই যে আমাদের ছাত্রজীবনে এলিয়টকে নিয়ে হেলেন গার্ডনারের The Art of T.S Eliot পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলাম, বার বার পড়েছিলাম। তারপর বিভিন্ন লেখকের এলিয়টকে নিয়ে লেখা পড়েছি। একাধিক জীবনীও পড়েছি এলিয়টের, তার মধ্যে পিটার অকরোয়েডের লেখা জীবনীটাই আমার সবচেয়ে ভাল লেগেছে। এলিয়টের কবিতা বিষয়ে সমালোচনামূলক অনেক লেখা পড়েছি, কিন্তু একজন ভারতীয় অধ্যাপকের লেখাও আমার ছাত্রজীবনে খুব ভালো লেগেছিলো, তিনি অধ্যাপক মঞ্জু জৈন। ছাত্রজীবন, অর্থাৎ ঢাকার জীবন পেরিয়ে আসার পর নব্বই দশকের শেষদিকে কবি মনজুরে মওলার অবিরাম চিঠি পেয়ে আমি এলিয়ট বিষয়ক অগণিত বই ও সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা নিউ ইয়র্ক থেকে পাঠাতে গিয়ে আবার নতুন করে এলিয়ট বিষয়ক অনেক লেখা পড়েছি। তখন জানতাম না কেন কবি মনজুরে মওলার এলিয়টকে নিয়ে এতো লেখার প্রয়োজন হচ্ছে। তিনি এলিয়ট ও ইয়েটসের কবিতার ভীষণ মুগ্ধ পাঠক, কিন্তু আন্দাজ করি এতো লেখা নিশ্চয় কোন লেখার প্রয়োজনে দরকার! এর কয়েক বছর পর জানতে পারলাম তিনি ছাত্রজীবন, এমনকি কর্মজীবন পেরিয়ে আসার পর এলিয়টের কবিতা নিয়ে পি এইচ ডি করছেন। অনেক পরিশ্রম করে ডিগ্রী শেষ করেছেন, কিন্তু কাউকে কোনদিন জানান নি। কারণ এটা করেছেন শুধুই নিজের আনন্দের জন্য। এলিয়টের ‘গির্জায় খুন’ অনুবাদ করেছেন, এলিয়টকে নিয়ে আরও বাংলায় বই লিখেছেন, কিন্তু একেবারে ডিগ্রী, তাও পরিণত বয়সে, এটা জেনে কিছুটা বিস্মিতই হয়েছিলাম!
অধ্যাপক চিন্ময় গুহর লেখা Where the Dreams Cross: T.S Eliot and French Poetry পড়তে পড়তে তরুণ বয়সে আমার এলিয়টের কবিতার প্রতি ভালোবাসা ও অন্যান্য অনুষঙ্গ মনে পড়ছিলো। ডঃ গুহর বইটি সত্যিই অসাধারণ, এই বইকে নিয়ে আলোচনা বাংলায় হয়েছে কিনা আমি জানি না, তবে হওয়া জরুরি। আমি জানতাম না এটি ডঃ গুহর পি এইচ ডির অভিসন্দর্ভ, তবে পড়তে গিয়ে বুঝতে পারলাম কী অসাধারণ গবেষণা কাজ! মমীন ভাই আসার পর আমাদের দুজনের এসব বিষয় নিয়েই কথা হচ্ছিলো। সম্প্রতি ডঃ গুহ সত্রীক নিউ ইয়র্কে এসেছিলেন, তখন আমাদের সামান্য কথাবার্তা হয়েছিলো, এছাড়া মমীন ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর টেলিফোনে কিছু কথা হয়েছে, এসব নিয়ে আমাদের আলোচনা হচ্ছিলো, আমার তখন মনে পড়ছিলো, অধ্যাপক ডঃ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম নিউ ইয়র্কের এক আড্ডায় অধ্যাপক গুহর এই অভিসন্দর্ভটি নিয়ে কথা বলছিলেন এবং এই লেখার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। আমার তরুণ বয়সে জগতের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন মনে হতো এলিয়টকে, সেই মুগ্ধতা আমার আজও কাটেনি! অবসর সময়ে বা মধ্যরাতে একাকী এখনও আমি বুদ্ধদেব বসু, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশসহ যে দুচারজন জগতের মহৎ কবির কবিতা পড়তে ভালোবাসি, তাঁদের একজন এলিয়ট। মমীন ভাইয়েরও প্রিয় কবিদের একজন এলিয়ট। তিনি দীর্ঘদিন ইংরেজি সাহিত্য পড়েছেন ও পড়িয়েছেন নিউ ইয়র্কে, তাই তাঁর এলিয়ট চর্চা অব্যাহত ছিলো অনেকদিন, কিন্তু আমি ঢাকার ছাত্রজীবনের পর আজ কয়েক দশক ধরে শুধুই আনন্দের জন্য এলিয়ট পড়ি! মাযহার, শৈবাল আসার পর আমাদের আলোচনার বিষয় পরিবর্তিত হলো, হয়তো মমীন ভাইকে নিয়ে একা কোনদিন বসলে আবার কথা হবে এলিয়টের কবিতা বিষয়ে!
এর মাঝেই এক সঙ্গে বেশ কয়েকজন বন্ধু এলেন, ডঃ ফারজানা সিদ্দিকা রনি, কথাশিল্পী বদরুন নাহার, কবি অভীক সোবহান, তাঁদের বন্ধু আহমেদ সায়েম ও জান্নাত সৈকত। জান্নাত ইনফরমেশন টেকনোলজির মানুষ, তিনি কম্পিউটার সম্পর্কিত পেশায় যুক্ত রয়েছেন। একেবারে নীরব ও কোমল ধরণের বন্ধু। একে একে আড্ডার সদস্য অনেক হয়ে গেলো। আড্ডা শুরু হলো আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে কলকাতা বা ভিন্ন ভাষার সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা। আমি দেখলাম বেশ আড্ডার মাঝখানেই টুকটাক সাইড টক শুরু হয়েছে। এটা আমাদের প্রায় জাতীয় চরিত্রের মধ্যে পড়ে, তিন চারজনের আড্ডাতেই অনেক সময় একাধিক বিষয়ে দুটো দলে কথা বা বাদানুবাদ শুরু হয়ে যায়। যাহোক আমরা দুয়েকজন বন্ধুকে বলে আড্ডাটা একটি বিষয়ে নিয়ে এলাম। আমি ফারজানাকে জিজ্ঞেস করলাম তাঁর পি এইচ ডি’র অভিসন্দর্ভটি বাংলা একাডেমী ছেপেছে কিনা। আমার জানার ইচ্ছে ছিলো, কারণ আমি বাংলাদেশের নারী উপন্যাসিকদের লেখা সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে আগ্রহী। ইদানীং কয়েকজন নারী কথাশিল্পী অসাধারণ লেখেন, তাঁদের লেখা নিয়ে এখনও কেউ হয়তো গবেষণা করেন নি, তবে করবেন আমি নিশ্চিত। ফারজানা যে-সাতজন নারী উপন্যাসিকের লেখা নিয়ে গবেষণা করেছেন, তাদের মধ্যে রিজিয়া রহমান ও দিলারা হাশেম আমার খুব ভাল লাগে। কিন্তু আমার একেবারে তরুণ বয়সে সেলিনা হোসেনকে নিয়ে আমি লিখেছি, তবে নব্বই দশকের শুরুর দিকে তাঁর ‘গায়ত্রী সন্ধ্যা’ পড়ে আমার মনে হয়েছে তিনি হয়তো মোটেই খুব গুরুত্বপূর্ণ লেখক নন। এরপর তাঁর আরও দুয়েকটি লেখা পড়ার চেষ্টা করে আর এগোতে পারি নি। কয়েক বছর আগে আমার ভাল লাগা লেখাগুলো নিয়ে লিখেছি দিলারা হাশেম সম্পর্কে, তবে বেশ ছোট লেখা সেটি। আমি খুব আগ্রহী ছিলাম ফারজানার আজকের লেখকদের নিয়ে কী মন্তব্য তা জানার, কিন্তু ফারজানা এমন একটি মন্তব্য করলেন যা আমাকে কিছুটা বিস্মিত যেমন করেছে, তেমনি খুব ভালোও লেগেছে। ফারজানা বললেন, আমাদের কথাশিল্প বেশ দুর্বল, এঁদের অনেকের লেখা পড়াই যায় না, কিন্তু আমি এ বিষয়ে কিছুই লিখতে পারি না, কারণ পাঠকরা ভুল বুঝতে পারেন। যেহেতু প্রশান্ত কথাশিল্পী তাই মানুষ কীভাবে নেবে আমার সমালোচনা সে ব্যাপারে আমার কিছুটা ভয় থেকেই যায়। আমার কাছে এই মন্তব্য খুব রুচিবান মনে হয়েছে। আসলে কোন সমালোচকের বা প্রাবন্ধিকের পরিবারের কেউ সাহিত্যিক হলে তাঁকে খুব সচেতন থাকতে হয় এবিষয়ে লেখার ক্ষেত্রে। পাঠক ভাবতে পারেন যে নিজের পরিবারের সদস্য লেখক বলে তিনি তাঁর বাইরে কাউকে মূল্য দিচ্ছেন না। ফারজানা বিষয়টা নিয়ে যেভাবে ভেবেছেন, এভাবে আজকাল কেউ ভাবতেই চান না। আমাদের সাহিত্যিকদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আকাল রুচির। এছাড়া ফারজানার আলোচনায় বেশ কয়েকজন তরুণ নারী লেখকের লেখা বিষয় এলো, দেখলাম ওঁর মন্তব্য খুব মৌলিক, আমার পড়া কিছু লেখকের লেখা বিষয়ে ওঁর ধারণার কাছাকাছি আমার ধারণা, কিন্তু সত্যিই ওঁর নির্মোহ আলোচনা আমার ভীষণ ভালো লাগলো। কথাশিল্প নিয়ে এই আলোচনায় ফারজানার কথা বলার পর আহমাদ মাযহার ও বদরুন নাহার অংশ নিয়ে অনেক কথা বললেন আমাদের গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্য সম্পর্কে, যা আমাদের আড্ডাকে সত্যিই ঋদ্ধ করেছে। এসময় কথাশিল্পের ভাষা নিয়ে কথা ওঠে। কিন্তু হঠাৎ কবি অভীক সোবহান আমাদের সাহিত্য পত্রিকার মান ও সাহিত্যের গুণগত মান উন্নয়নের ক্ষেত্রে এর ভূমিকা নিয়ে খুব জরুরি একটি বিষয় উত্থাপন করেন। লিটল ম্যাগাজিন থেকে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্য পত্রিকাগুলো সাহিত্যের উন্নয়নে যে ভূমিকা পালন করে তা আমরা জানি, কিন্তু কেন যেন রাষ্ট্র বা সাহিত্যের জগৎ আমাদের লিটল ম্যাগাজিনগুলোকে সত্যিকার পৃষ্ঠপোষকতা দেয় না। এটা দুঃখজনক। প্রায় দেড় দশক আগে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্যবিদ্যায় অধ্যাপনার সময় অনেক কষ্টে এক ফর্মার একটি কবিতার পত্রিকা বের করার চেষ্টা করতেন অভীক। নিজের বেতনের পয়সা ব্যয় করে তিনি তা করতেন। নতুন দম্পতি বদরুন ও অভীক জিলিপি ও মুড়ি খেয়ে দিন কাটাতেন, অভীকের বেতন থেকে সিগারেট ও মুড়ি-জিলিপির পয়সাটা রেখে সবই ব্যয় করতেন পত্রিকা ছাপানো ও বই কেনার পেছনে। এক ফর্মা পত্রিকা বের করতেই অর্থের চিন্তায় থাকতেন অভীক, সেখানে সেই সিলেটেই এক তরুণ লেখক আহমেদ সায়েম ষোল ফর্মার লিটল ম্যাগাজিন বের করতেন কোন বিজ্ঞাপন ছাড়া। বিষয়টা আশ্চর্যের, বিশেষ করে এর সম্পাদকের কমিটম্যানট ও একাগ্রতা দেখে তাই মনে হয়েছে অভীকের। পরে অভীক সায়েমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন এটা কী করে তিনি সম্ভব করেছেন! আসলে সায়েম ও কয়েক বন্ধু মিলে তাদের হাত খরচের সকল টাকা বাঁচিয়ে পত্রিকাটি প্রকাশ করতেন।
ঢাকার বাইরে অনেক নাম না জানা তরুণ লেখকরা এভাবেই কষ্ট করে সাহিত্য পত্রিকা বা লিটল ম্যাগাজিন বের করেন, যার খবর আমাদের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকরা কম রাখেন।
এরপর আমরা আবার ফিরে আসি সাহিত্যের ভাষা বিষয়ে আলোচনায়। আমার অনেক কিছু জানার ছিলো অধ্যাপক ফারজানা সিদ্দিকার কাছে। ফারজানা পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের সাহিত্য বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা বললেন। তাঁর মতে ষাটের কবিতা আমাদের সাহিত্যে সবচেয়ে শক্তিশালী কবিতা। এরপর সত্তর ও আশির দশক সেদিক থেকে ভাবলে বেশ দুর্বল, আবার শূন্যদশক থেকে কবিতার কিছুটা বাঁক বদল ঘটতে দেখা যায়। পঞ্চাশ ও ষাটের কবিতা ও কথাশিল্প নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ফারজানা একটি মন্তব্য করেন, যা আসলে আমরা খুব বেশি একটা কোনদিন ভেবে দেখিনি, যদিও মাযহার আমাদের আড্ডায় উর্দু কবিতা বিষয়ে বলতে গিয়ে কিছু মন্তব্য করেছেন, কিন্তু আমাদের সমালোচনা সাহিত্যে এটা কম উল্লিখিত হয়েছে। ফারজানা বলেন ‘৫২ ভাষা আন্দোলনের পর উর্দু ভাষা বিষয়ে আমাদের সাহিত্যিকদের বা পাঠকদের মনোজগতে এক ধরণের অপছন্দ বা ডিসডেইন গড়ে উঠেছিলো, কিন্তু এতে আমাদের কবিতার কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। ইংরেজি, ফরাসী বা অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষার কবিতা থেকে বাংলা ভাষার কবিরা অনেক গ্রহণ করেছেন, তাতে কবিতার সৌন্দর্য বাড়ে, তেমনি উর্দু ভাষা থেকে যদি আমাদের ষাটের কবিরা এই ভাষার লিরিসিজম বা অন্যান্য উপাদান বাংলা কবিতার সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে গ্রহণ করতেন তাতে আমাদের কবিতারই ভালো হতো। এখানে ভাষা আন্দোলনের রাজনৈতিক দিকটা আমাদের কবিতাকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে।
এসময় মাযহার ঢাকার উর্দু ভাষার কবিদের বাংলা ভাষার কবিদের সঙ্গে সাহিত্যিক ও ভাবনার আদান প্রদানের দিকটির উল্লেখ করেন। মাযহার জানান, কবি আসাদ চৌধুরী আশির দশকের শুরু থেকে ঢাকার উর্দু ভাষার কবি নওশাদ নূরি, ও আরও কয়েকজন কবির কবিতার অনুষ্ঠান করে তাঁদের কবিতার ভাষা ও ভাবনাকে বাঙালি তরুণ কবিদের মাঝে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন, কারও কারও কবিতা অনুবাদও করেছেন। সত্তরের শুরুতেই আমরা দেখেছি আবু সয়ীদ আইয়ুবের অনুবাদে গালিবের ও মীর তকি মীরের কবিতার অনুবাদ ও দীর্ঘ ভূমিকা। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও আয়ান রশীদও গালিবের কবিতার অনুবাদ করেছেন। সম্প্রতি আমাদের বন্ধু কবি সাবেরা তাবাসসুম অনুবাদ করেছেন গুলজারের কবিতা। আমি সাবেরার কবিতা ও গদ্যের অনুরাগী পাঠক। ওঁর অনুবাদও বেশ সুন্দর তা গুলজারের কবিতার অনুবাদ পড়ে বুঝেছি। তবে আমাদের উর্দু কবিতা নিয়ে আলোচনায় ফারজানা ও মাযহারের আলোচনার সময় আমার বার বার সাবেরার অনুবাদের কথা মনে পড়ছিলো। এসময় উর্দু কবিতা কেমন করে বাংলা কবিতার সৌন্দর্য বাড়াতে পারে এবিষয়ে কবি এবিএম সালেহউদ্দীন কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেন, তাঁর আলোচনায় শৈবাল, মাযহার ও অন্যান্য বন্ধুরা যোগ দেন, কিন্তু সালেহউদ্দীনকে একটা জরুরি কাজে চলে যেতে হয়, তাই তিনি জানান, এবিষয়ে তিনি আগামী সপ্তাহে দীর্ঘ আলোচনা করবেন।
উর্দু কবিতা নিয়ে কথা চলতে থাকে, তখন বাংলার মহৎ সুরকারদের মধ্যে শচীন দেববর্মণ, সলিল চৌধুরী ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কলকাতা ছেড়ে বোম্বে গিয়ে কালজয়ী সঙ্গীতে সুর করেছেন তার সামাজিক ও অন্যান্য কারণ নিয়েও কথা হয় আড্ডায়। উর্দু কবিতা বা বাংলার বাইরের উপমহাদেশের অন্যান্য ভাষার সাহিত্য বা কবিতা নিয়ে কথা বলার সময় মনে পড়ে, কিছুদিন আগে একটি ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বাংলায় উর্দু সাহিত্যের অনুবাদ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা শুনেছি জাভেদ হুসেনের কাছে। তিনি শুধু উর্দু সাহিত্য অনুবাদই করেন নি, বলা যায় আমাদের দেশে উর্দু সাহিত্যের সবচেয়ে মেধাবী গবেষকদের একজন। এই ভাষায় কবিতার সৌন্দর্য কেমন, বাংলা কবিতাকে তা ষাটের দশক থেকে এনরিচ করেছে তা আমি কবি আসাদ চৌধুরী ছাড়া জাভেদ হুসেনের কাছেই প্রথম ভাল করে জেনেছিলাম। কিন্তু ফারজানা যে বিষয়টি জোর দিয়ে জানালেন তা হলো ভাষার রাজনীতি কখনো কখনো সাহিত্যের সৌন্দর্যকে ক্ষতি করে, যা বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে ‘৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পরে ঘটেছে। সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক, শুধু সাহিত্যের নান্দনিক দিকের বিবেচনা থেকে ফারজানার বক্তব্য গুরুত্বপূর্ণ। ফারজানা নিজে কবি, তাই কবিতা নির্মাণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম যে ভাষা তার সঙ্কট বা শক্তি বিষয়ে তিনি খুবই সচেতন। গত শতাব্দীতে ইউরোপে ও বাংলা কবিতায়ও ভাষার নানা ধরণের ব্যবহারের সঙ্কট দেখা দেয়। কিন্তু তার পেছনের ইতিহাস সৃষ্টি হয়েছে ইউরোপে এরও পূর্বে শতাব্দীকাল আগে। ইউরোপে তাত্ত্বিকভাবে রুশোর সভ্যতাকে দায়ী করার সময় থেকে এর শুরু। তাহিতি দ্বীপের আবিষ্কার ও দ্বীপবাসীদের জীবনের বিচিত্র বিষয় নিয়েও ইউরোপীয় দার্শনিকেরা ভাবতে শুরু করেন বহুদিন আগে থেকেই, আর সেই ভাবনার সঙ্গী ছিলো ভাষা দিয়ে নির্মিত মানুষের শিল্প। কিন্তু ব্যতিক্রম যে নেই তা নয়, মনোবিজ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বিস্তীর্ণ সীমানা যখন গত শতাব্দীর মাঝামাঝির দিকে ফ্রয়েড ও অন্যান্যদের চেষ্টায় নির্ধারিত হতে থাকে তখন নন-ভারবাল বা অনুচ্চারিত ভাষার পরিধিও বেড়ে গিয়েছিলো। তখন কবিদের ব্যবহৃত শব্দের সীমানা কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ‘অসীমের পানে গাহিছে হৃদয়’ এই পঙক্তির ‘অসীম’ নিশ্চয় বিজ্ঞানী বা গাণিতিকের ‘ইনফিনিটি’ শব্দের সঙ্গে তুলনীয় নয়। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও স্বীকার্য যে শেক্সপিয়ার মিলটন বা জন ডান প্রায় সর্বদাই শিল্প, বিজ্ঞান, দর্শন, সঙ্গীত সকল বিষয়ের ভাষাতেই নিজেদেরকে প্রকাশ করতে সক্ষম ছিলেন। তাহলে এই মহৎ শিল্পীদের ‘ভাষা’র অসাধারণত্বের উৎস কোথায়, তাও অন্বেষণের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে।
কোথাও কোথাও ডঃ ফারজানা ও মাযহারের আলোচনার সূত্র ধরে বেশ কিছু ভারী বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছিলো। আমার ইচ্ছা ছিলো যেহেতু বদরুন নিজে কথাশিল্পী ও ডঃ ফারজানা গবেষণা করেছেন নারী কথাশিল্পীদের শিল্প-চারিত্র নিয়ে, তাই তাঁদের কাছ থেকে জানার আমাদের কথাশিল্পের ভাষার বিষয়ে। আমি নিজে কবিতা ও কথাশিল্পের ভাষার বিবর্তন বিষয়ে খুব উৎসাহী, কিন্তু সমস্যা হয় যদি আড্ডায় অনেক সদস্য থাকে তাহলে একটি বিষয়ে, বিশেষ করে এধরণের ভারি বিষয়ে সবাই মনোযোগ দিতে পারেন না, তখন পাশে ছোট ছোট বিষয় নিয়ে দুয়েকজন সদস্য নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন। তাই আমার ইচ্ছাটা তেমন পূরণ হলো না। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বদরুন ও ফারজানার কাছ থেকে এ বিষয়ে তেমন জানা গেলো না, অনেক কথার মাঝে ওঁদের দুজনের মূল্যবান মন্তব্য প্রায় হারিয়ে যাচ্ছিলো। আমি তখন ফারজানার কাছ থেকে তাঁর নিজের লেখা পাঠ শুনতে চাইলাম। ফারজানা শোনালেন তাঁর নিজের লেখা একটি কবিতা। খুব ভাল লাগলো কবিতাটি। আমি আগে কোনদিন ফারজানার কবিতা পড়িনি। আমার জাহাঙ্গীরনগরের তরুণ বন্ধু-কবিদের কবিতার আঙ্গিক, বিষয় ও নির্মিতি সবই কিছুটা আলাদা, নতুন ও ভিন্ন স্বরের ভিন্ন সুরের মনে হয়। আহমেদ শামীমের কবিতা অনেক বছর আগে যখন প্রথম নিউ ইয়র্কের আড্ডায়, শাহীন খানের বাসায় শুনি, তখনও আমার এ ধারণাই হয়েছিলো। এর আগে সম্প্রতি লেখা অসাধারণ একটি কবিতা পাঠ করে শোনালেন কবি শামস আল মমীন।
আড্ডায় কবিতা পাঠের পর আহমেদ মাযহারকে অনুরোধ করি তাঁর লেখা কথাশিল্পী, অনুবাদক ও রাজনৈতিক ভাষ্যকার আবু জাফর শামসুদ্দীঙ্কে নিয়ে লেখা একটি প্রবন্ধ পাঠ করতে। আড্ডায় পাঠের জন্য একটু দীর্ঘ হলেও আমরা সবাই নীরবে মাযহারের পাঠ করা প্রবন্ধটি শুনলাম। আমাদের সাহিত্যে বলতে গেলে একেবারে অবহেলিত এই কথাশিল্পীকে নিয়ে গবেষণা প্রায় হয়নি বললেই চলে। অধ্যাপক সৈয়দ আজিজুল হক কিছুটা লিখেছেন। আমি এক সময় একটু চেষ্টা করেছিলাম লিখতে, কিন্তু মাযহারের লেখাটা সত্যিই ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আবু জাফর শামসুদ্দীনের লেখা বিষয়ে লিখতে গিয়ে মাযহার লিখেছেন, ‘তাঁর সাহিত্য অধিকার করে আছে রাজনীতিভাবনা ও জীবনযাত্রার বৈচিত্র্যানুসন্ধান। আরও বিশেষ করে হয়তো বলা যায় বাঙালি মুসলমানের আত্মানুসন্ধান তাঁর লেখার কেন্দ্র উপজীব্য। তাঁর মনে জিজ্ঞাসা জেগেছিল, বাংলা অঞ্চলে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রীতিলতা-সূর্যসেন এঁর মঙ্গল পাণ্ডেদের কথা যেভাবে উল্লিখিত হয়, তিতুমীর কিংবা হাজী শরীয়তুল্লার প্রসঙ্গ তেমনভাবে উল্লিখিত হয় না কেন? সভ্যতা এঁর সংস্কৃতির উৎকর্ষের নামে বাংলা সাহিত্যে ব্রিটিশ শাসকদের অনুগত উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরকে যতটা না ভয়ঙ্কর রূপে দেখানো হয় তার চেয়ে খারাপভাবে চিত্রিত করা হয় পাকিস্তান শাসনামলকে। বাংলাদেশের মুসলমানদেরকে পশ্চাৎপদ আর অনগ্রসর চিহ্নিত করে যে মনোভঙ্গি প্রধান হয়ে উঠেছিল তারই পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে ভাওয়াল পরগনাকে উপজীব্য করে লেখা ‘ভাওয়ালগড়ের উপাখ্যান’ -এ। …’পদ্মা মেঘনা যমুনা’ পরিকল্পিত ত্রয়ী উপন্যাসের দ্বিতীয় রচনা হলেও এটিকে দ্বিতীয় খণ্ড বলা হয়তো যথার্থ হবে না। নয় শতাধিক পৃষ্ঠার অখণ্ড সংস্করণের এই উপন্যাসটিরও রয়েছে ‘উন্মেষ’, ‘উদ্ঘুরনা’, ‘মহানগরী’, ‘ঝড়’, ‘উলঙ্গ আদম’ নামের পাঁচটি পর্ব।…সাহিত্য সমাজে আবু জাফর শামসুদ্দীনের প্রধান পরিচয় তিনি প্রাবন্ধিক। প্রবন্ধ-সংকলনগুলোতে তাঁর যে জীবনবোধের পরিচয় পাওয়া যায়, যে দার্শনিকতার রূপ তাঁর চিন্তায় ভাস্বর তাঁর কথাসাহিত্যিক সত্তাও একই রূপের প্রতিনিধি। তাঁর গল্প উপন্যাস নিয়ে উপর্যুক্ত আলোচনায় তাঁর মননসত্তার যে পরিচয় দেয়া হয়েছে তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলোও তারই উজ্জ্বলতর প্রতিনিধি।’
আহমাদ মাযহারের প্রবন্ধটি শুনলাম আমরা সবাই মনোযোগ দিয়ে। সত্যিই একটি উৎকৃষ্ট লেখা কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক আবু জাফর শামসুদ্দীনকে নিয়ে।
রাত অনেক হয়ে গেছে। আড্ডার সবাই ধীরে ধীরে বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন। আমি ডঃ ফারজানা সিদ্দিকা রনিকে আবার আড্ডায় আসতে নিমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলাম, কারণ ওঁর কাছ থেকে কথাশিল্প সম্পর্কে আমার অনেক কিছু জানার উৎসাহ রয়েছে, যা এই আড্ডায় জানা হলো না।
সবাই চলে যাওয়ার পর আমি টেবিলে নিজের কাজে মন দিলাম!
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium, Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: [email protected]
Web Design by: SuperSoftIT.com