ঢাকা ১৬ই অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৩১শে আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১২ই রবিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি


নিউ ইয়র্কে শনিবারের আড্ডা

redtimes.com,bd
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ৭, ২০২৪, ১১:৩৭ অপরাহ্ণ
নিউ ইয়র্কে শনিবারের আড্ডা

‘অমৃত মর্ত্যেরই দান, স্বল্পপ্রাণ প্রমোদের কণা’ !

আবেদীন কাদের

আমি আর আহমাদ মাযহার আড্ডা শুরু করলাম। সাধারণত কবি শামস আল মমীন শহরে থাকলে সবার আগে আগে তিনি সাধারণত আসেন, আমরা দুজনে কবিতা বা সাহিত্যের অন্য কোন শাখা নিয়ে কথা বলতে শুরু করি। কিন্তু এসপ্তাহে মমীন ভাই নিউ ইয়র্কের বাইরে স্বল্পকালীন ভ্রমণে গিয়েছেন, তিনি আড্ডায় যোগ দিয়েছেন, কিন্তু ভার্চুয়ালি। তাই প্রথমে মাযহার আর আমি কথা বলছিলাম বাংলাদেশের চলমান অবস্থা নিয়ে। আমরা দুজনেই এই বিষয় নিয়ে একটি উদ্বেগে থাকি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে একটু অস্থিরতার খবর পাই, কোথাও গ্রামে সঙ্গীত নিষিদ্ধ করেছে ছাত্রসমাজ, আবার দেখা যায় সামাজিক মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররা কাওয়ালির অনুষ্ঠান করেছে, তার ছবি এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাকে উপাচার্য নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তার সম্পর্কে লিখেছেন একজন প্রাক্তন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী, যাকে অপহরণে অংশ নিয়েছিলো এই ভদ্রলোক, তখন তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের ক্যাডার। এধরনের বিভিন্ন খবর আসছে। ফরহাদ মজহার অবিরাম লিখে যাচ্ছেন এই রাষ্ট্রপতিকে বিদায় দিয়ে বিপ্লবী সরকার গঠন করে নতুন করে শাসনতন্ত্র লিখতে পরামর্শ দিয়ে। আমেরিকা থেকে উড়ে গিয়ে এক সময়ের জাসদ কর্মী বর্তমানে মার্কিন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বক্তৃতা দিয়েছেন ঢাকায়, তিনি পরামর্শ দিয়েছেন শাসনতন্ত্র পুনর্লিখন করতে। ফরহাদ মজহার বা আলী রীয়াজ এরা কেউ আইনের মানুষ নন, শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞও নন, কিন্তু যেহেতু এরা সমাজবিজ্ঞান নিয়ে লেখেন বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক তাই এরা বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রে যে গণ-আন্দোলন হয়েছে, তার ভিত্তিতে নিজেদের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সাধারণ আদালত ছাড়াও Constitutional Court রয়েছে, যেখানে জনপ্রতিনিধিরা শাসনতন্ত্র তৈরি করার পর আইনি আলোচনা, বিতর্ক ও চুলচেরা বিশ্লেষণের পর বিভিন্ন ভেটিং করেন এবং জনপ্রতিনিধিদের কাছে পরামর্শসহ ফেরৎ পাঠান এবং তা পরে আইন পরিষদে তা জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা চূড়ান্ত অনুমোদনের পর রাষ্ট্র গ্রহণ করে। আমাদের সমাজে যেহেতু পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, তাই ধরে নেয়া যায় ফরহাদ মজহার বা অধ্যাপক রীয়াজের পরামর্শ অনুযায়ী নতুন শাসনতন্ত্র লিখে বা পুনর্লিখন করে পরবর্তী কোন সময়ে নতুন পার্লামেন্ট দ্বারা অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এই সমাজবিজ্ঞানী বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদ্বয় জনগণের প্রতিনিধি নন, তাঁদের শাসনতন্ত্র লেখার বা পুনর্লিখন করার পরামর্শ দেয়ার, বা লেখার অধিকারের আইনি বৈধতা আছে কিনা। এর উত্তরে হয়তো অনেকে বলবেন এই সরকার বিপ্লবের ফসল, তাই বিপ্লবী সরকার, কিন্তু সেই ক্ষেত্রেই আইনি জটিলতা দেখা দিতে পারে। একজন অর্থনীতিবিদ-ব্যাংকারের অধীনে কয়েকজন এনজিও কর্মী সরকারে বসলেন ছাত্রদের দ্বারা নিয়োগ পেয়ে, তারা দেশের শাসনতন্ত্র রচনার অধিকার পেয়ে গেলেন, এটা পরবর্তী সময় আইনে বা আদালতে টিকবে তো! আমাদের দেশে বন্দুকধারী দুই সেনাপতি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, দল গঠন করে, হ্যাঁ/না ভোট দিয়ে, নির্বাচন দিয়ে, আবার ক্ষমতাকে অনুমোদন আদায় করে এর আগেও শাসনতন্ত্র নিয়ে ইচ্ছামতো যা খুশি তাই করেছে। সুতরাং এই অন্তর্বর্তী সরকারও হয়তো তেমন কিছু করার চেষ্টা করবে। কারণ আমাদের শাসনতন্ত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কোন বিধান বা আইনি পদ্ধতি নেই, তাই এই সরকারের কাজকর্মকে পরবর্তী সময়ে অবশ্যই বৈধতা দিয়ে হবে কোন না কোন উপায়ে। আমার মনে হয় সেখানেই কোন রকম গোঁজামিলের প্রয়োজন হবে, ‘ডকট্রিন অফ নেসেসিটি’ বা অন্য কোন আইন-বহির্ভূত নামও তার দেয়া হতে পারে। কিন্তু তাতে সত্যিকার কোন আইনি ফয়সালা বিষয়টির হবে কিনা তাও বোঝা মুশকিল।

সম্প্রতি ফরহাদ মজহার এক বক্তৃতায় জানিয়েছেন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশকে ইউরোপের দেশগুলোর মতো উন্নত করা সম্ভব। এটা কীভাবে তা ঠিক জানি না। এই ফার্মাসিস্ট-কাম-সমাজবিজ্ঞানী-কাম-‘দার্শনিক’-কাম-লালন সাধকের হাতে নিশ্চয় কোন ‘চেরাগ’ রয়েছে যা দিয়ে তা সম্ভব। তবে আমাদের একজন কথাশিল্পী ফরহাদ মজহারের এই মন্তব্যের পর বলেছেন, ‘চাইলে পানি-পড়া ছিটিয়ে এই ‘মওলানা’ দেশটাকে এখনই ইউরোপ বানিয়ে ফেলতে পারেন’। যাহোক বার বার বাংলাদেশের সামনে এধরণের শাসনতান্ত্রিক বিপদ আগেও এসেছে, একাধিকবার সেনা অভ্যুত্থান হয়েছে, নব্বইয়ের আন্দোলন হয়েছে, ১/১১ হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশ সময়ই সেনাবাহিনী বা চতুর রাজনীতিবিদরা বিভিন্ন রকম ‘আজগুবি আইনি’ খেলাধুলা করেছে, এতে রাষ্ট্রের সত্যিকার কোন গণতান্ত্রিক কল্যাণ হয়নি। এখন এই ‘অন্তর্বর্তী সরকার’ যে ‘ঘোষণা’ নিয়ে এগোচ্ছে, তা হলো ‘রাষ্ট্র-সংস্কার’! কিন্তু কী সংস্কার, কেমন সংস্কার, কী অধিকারে এনজিও কর্মীরা সংস্কার করবে, আঠারো কোটী মানুষের দেশে কয়েক লক্ষ ছাত্র রাষ্ট্রের শাসনভার দখল করে এনজিও কর্মীদের হাতে দিয়ে বলবে ‘সংস্কার’ করুন, আর সংস্কার হয়ে যাবে, তার আইনি বৈধতা থাকবে, বিষয়টা কি সত্যিই এতো সরল? জগতের যারা শাসনতন্ত্র বিষয়ে পণ্ডিত, যারা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ক্রান্তিকালে বা অভ্যুত্থানের পর শাসনতন্ত্র রচনার আইনি বৈধতা পেয়েছেন বা শাসনতন্ত্র রচনা করেছেন বা পুনর্লিখন করেছেন, তাঁদের দেয়া বিধান বা তত্ত্ব আসলে কী রকম, সেটা মনে হয় আমাদের রাজনীতিবিদরা বা সমাজবিজ্ঞানীরা এই ‘অন্তর্বর্তী সরকারের’ হাতে এই গুরু দায়িত্ব দেয়ার পর ভালো করে ভেবে দেখতে পারেন। আমাদের সমাজে শাসনতন্ত্র বিশেষজ্ঞ বা এবিষয়ে আইনের পণ্ডিত নেই তা নয়, নিশ্চয় আছে। তাঁদের সঙ্গে বিষয়টি খোলামেলা আলোচনা করে রাষ্ট্রের জনগণকে সেই আলোচনার অংশভাক করা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সম্ভবত জরুরি।

আমি আর আহমাদ মাযহার এই বিষয়টি নিয়েই কথা বলছিলাম। এর মধ্যেই লেখক নসরত শাহ, লেখক স্থপতি শামীম আমিনুর রহমান, কবি অভীক সোবহান, কথাশিল্পী বদরুন নাহার ও অধ্যাপক ডঃ ফারজানা সিদ্দিকা রনি এসে উপস্থিত হলেন। শামীম যেহেতু একজন সঙ্গীত, চলচ্চিত্র ইত্যাদি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেন ও পুরনো সঙ্গীতের রেকর্ড ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করেন, তাই আমরা সঙ্গীত নিয়েই কিছুক্ষণ আলোচনা করলাম। পুরনো দিনে রেকর্ড ইন্ডাস্ট্রি কেমন ছিলো, রেকর্ড প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলো কী ধরনের রেকর্ড বাজারজাত করতো এসব বিষয় নিয়ে শামীম আমিনুর রহমান আমাদেরকে অনেকক্ষণ এবিষয়ে বললেন।

এরপর আড্ডায় ডঃ ফারজানা সিদ্দিকা একটা তথ্য দিলেন যা আসলে সমাজবিজ্ঞানের বিষয়। বিষয়টা নিয়ে কতোটা গবেষণা হয়েছে জানি না, কিন্তু সমাজের তরুণ প্রজন্মকে বোঝার জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ফারাজানা জানালেন যে আমাদের তরুণদের মাঝে কম বয়সে বিয়ের প্রবণতা বেড়ে গেছে। এর কারণ সম্ভবত তরুণ তরুণীরা তাদের যৌন জীবনের একটা লাইসেন্সিয়েটেড অনুমোদন চায়। কারণ ছাত্রাবস্থায় বিবাহিত জীবনের ব্যয়ভার বহন করা একটু কঠিন, কিন্তু তবুও কেন এ প্রবণতা বেশি দেখা যাচ্ছে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েদের মাঝে! ফারজানার মতে এক ধরনের মধ্যবিত্ত বাবা মা, বিশেষ করে মায়েরা শহরে মেয়েদের ব্যাপারে খুব রক্ষণশীল। তারা কোচিং সেন্টারে-এ নিজেরা মেয়েদের নিয়ে যায় ও বাড়িতে নিয়ে আসে। মেয়েরা কী করে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী করে ইত্যাদির ব্যাপারে খুব চোখ রাখে। কিন্তু এসব মেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে প্রথম বর্ষেই প্রেমে পড়ে এবং অনেকে বিয়ে করে ফেলে। তাদের এই কম বয়সের বিয়ে সাধারণত ভিত্তি পায় যৌন জীবনের জন্য, কিন্তু তৃতীয় বা চতুর্থ বর্ষে উঠেই বিয়েগুলোতে ঝামেলা শুরু হয় বাস্তব জীবন বা ক্যারিয়ারের কথা চিন্তা করে। ততদিনে যৌন চাহিদায় কিছুটা একঘেয়েমি আসে। তাই খিটিমিটি শুরু হয়। ছেলে এবং মেয়ে দুপক্ষই বেশ সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। তাদের ফেসবুক বা ই মেইলের পাসওয়ার্ড নিয়ে ঝামেলা শুরু হয়। কে কে তাদেরকে ফেসবুকে ‘লাভ’ ইমোজী দিলো, কেন দিলো, তারা যদি কাজিন বা পরিবারের কেউ হয়, তাহলেও সন্দেহবাতিকগ্রস্ততা তাদেরকে ভর করে। ফারজানার অভিজ্ঞতা মতে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সিলিং বিভাগে এরকম দাম্পত্য জটিলতার হাজারটা অভিযোগ আসতে থাকে। প্রায় অনেকদিন আগে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের পর হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তরুণ তরুণীদের সম্পর্কের অভিযোগ বিষয়ে বাধ্যতামূলক কাউন্সিলিং বিভাগ খোলা হয়েছে। এই বিভাগগুলোতে যে অভিযোগ আসে, তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীরা গবেষণা করতে পারেন। ডঃ ফারজানার মতে বিষয়টা বিভিন্ন কারণে হতে পারে। তবে মূলত তরুণ তরুণীদের মধ্যে যৌন তাড়না বিষয়ে ধারণা আগের প্রজন্ম থেকে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। এটার পেছনে প্রযুক্তি, সংস্কৃতির পরিবর্তন ও সমাজে ইসলামিকিকরণের ফলে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের তরুণ তরুণীরা ভিন্ন জীবনে অভ্যস্ত হয়ে উঠছে, যৌনতা বিষয়ে তাদের ধারণাও বদলে গেছে!

আমাদের সমাজে বিয়ে, যৌনতা, প্রেম ও তরুণ তরুণীদের মেলামেশা নিয়ে অনেক ধরনের ট্যাবু রয়েছে। কিন্তু শিক্ষিত মধ্যবিত্ত নাগরিক সমাজের এই ট্যাবুগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলেও এসব বিষয়ের বিরোধিতা করে কোন ভিন্ন যৌন-সংস্কৃতি আমাদের সমাজে গড়ে ওঠেনি আগে, কিন্তু এখন একদিকে ধর্মীয় রাজনীতি যেমন বেড়েছে, সমাজের অন্তঃসলিলে একটা নীরব ধর্মীয় স্রোত অনেকদিন ধরেই বহমান, কিন্তু সেদিক থেকে দেখলে বরং যৌনাচারে তরুণ সমাজে আজকের প্রবণতার বিরুদ্ধেই যাওয়ার কথা, কারণ ধর্ম হিশেবে ইসলাম যৌন ‘অনাচার’, বিবাহবহির্ভূত প্রেম বা ভালোবাসার সম্পর্কে অনুমোদন করে না। তাহলে এটা বেড়ে যাওয়ার কারণ কী! তবে প্রতিষ্ঠান হিশেবে বিবাহ কম বয়সে ইসলাম অনুমোদন করে না, তা আমাদের সমাজে তেমন দেখা যায়নি। এই সমাজেই এক শতাব্দী আগেও শিশু বা বালিকাবিবাহ মুসলমানদের মধ্যে অহরহ ঘটেছে। পশ্চিমা দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের অনেকেই আঠারো বছর বয়সে বিবাহকে মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অনুকূল বলেছেন। কিন্তু আধুনিক পশ্চিমা সমাজে এই বয়সে খুব একটা বিবাহে ইচ্ছুক নয় তরুণ তরুণীরা, সেটার কারণ আর্থিক ও পেশাগত। মার্কিন সমাজে গত চার বা পাঁচ দশকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক তরুণ তরুণীরা পেশা বা ক্যারিয়ারকে বিয়ের আগে স্থান ও গুরুত্ব দিয়ে আসছে, সেকারণে মার্কিন যুবক যুবতীরা ২৮-৩১ বছর বয়সের আগে বিয়েতে আগ্রহী হচ্ছে না আজকাল। এটার অন্যতম কারণ শুধু আর্থিক বা পেশা তাই নয়, বরং বিয়ে না করেও বিবাহিত দম্পতিদের সকল সুবিধা তারা আইনগতভাবে ভোগ করতে পারে এবং সন্তানাদি নিতে পারে, প্রতিপালন করতে পারে, তাই বিবাহে ইচ্ছুক তরুণ তরুণীর সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে দিনে দিনে। কিন্তু বাংলাদেশের শিক্ষিত নাগরিক সমাজের মাঝে অর্থনীতির বা পুঁজির বিশ্বায়ণের ফলে মার্কিন সংস্কৃতি অনেকটাই অনুকরণের ঝোঁক বেড়ে গেছে, কিন্তু বিবাহের ক্ষেত্রে কেন এটা বিপরীতমুখী তা কিছুটা বিস্ময়ের। ডঃ ফারজানা সিদ্দিকার আলোচনায় এই বিষয়টিও এসেছে। ইন্টারনেট ও সামাজিক মাধ্যম তরুণ দম্পতিদের মাঝে যেমন বিশ্বাস বা আস্থা ভেঙ্গে যাওয়ার কারণ অনেকটা, তেমনি একাধিক বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ও প্রেমের সম্পর্কের আধিক্য দেখা দিচ্ছে। এই বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বিবাহবিচ্ছদের অন্যতম কারণও হয়ে দাঁড়াচ্ছে বাংলাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ তরুণীদের মাঝে। তবে যৌনতা ও দৈহিক সম্পর্কের ট্যাবু অনেকটা ভেঙ্গে যাচ্ছে দিনে দিনে, এটাও সত্যি। ডঃ ফারজানার আলোচনা থেকে আমার মনে একটি প্রশ্ন বার বার জেগেছে, যদিও সেটি নিয়ে আমি আড্ডায় কথা বলিনি, বিষয়টি হলো বাংলাদেশের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিয়ের বয়স যে অনেকটাই কম দেখা যাচ্ছে, এর প্রাথমিক কারণ কি প্রেম, নাকি অবদমিত যৌনতা! তরুণ তরুণীরা পশ্চিমাদের মতো সহজেই যৌনকর্মে লিপ্ত হতে পারে না, তাই বিয়ে করে ফেলে, নাকি বিয়েটা করে কারণ তারা প্রেমকে অধিকতর মূল্য দেয় এবং প্রেমের জন্যই বিয়ে করে! অর্থাৎ আমাদের সমাজে রোমান্টিক প্রেমের সম্পর্ক আগের থেকে দ্রুত বদলে যাচ্ছে! আগেও গোপনে তরুণ তরুণীরা প্রেম করতো, কিন্তু বিয়ে বিষয়টাকে গুরুত্ব দিতো তরুণ যখন পেশাজীবনে প্রবেশ করতো। তবে এর ব্যতিক্রমও দেখা যেত।
সাম্প্রতিক গবেষণাগুলোতে দেখা যায় ‘প্রেম’ প্রায় প্রত্যেক সমাজেই একটি বিশ্বজনীন ঘটনা বা মানবিক আচরণ, তবুও এটাকে সব সমাজে বিয়ের জন্য আবশ্যিক বিষয় বিবেচনা করা হয় না। ১৯৯২ সালে Jankowiak & Fischer একটি গবেষণা চালান, এতে দেখা যায় প্রেম বা ভালোবাসা বিয়ের ক্ষেত্রে কী ধরণের ভূমিকা রাখে, এর ফোলে দেখা যায়, কোন কোন সমাজে ‘প্রেম’ বিয়ের স্থায়িত্বের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। তবে অনেক সমাজে বিয়ের ক্ষেত্রে প্রেম বা ভালোবাসা বড় কোন ভূমিকা রাখে না, বরং নিজেদের বোঝাপড়া বা মানবিক বিশ্বাস সেখানে কার্যকর ভূমিকা রাখে। একই প্রতিষ্ঠান পরবর্তী কয়েক বছরে একই বিষয় নিয়ে আবার যখন গবেষণা করে তাতে দেখা যায় ৮৯% শতাংশ সমাজে কনসেপ্ট অফ লাভ বা ভালোবাসার ধারণা দাম্পত্যের ফাংশনালিটি বা কার্যকারিতা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে শিক্ষিত বা কম শিক্ষিত, নাগরিক মধ্যবিত্ত বা অন্যান্য সব শ্রেণীর দম্পতিদের মাঝেই। অর্থাৎ প্রেম বা ভালোবাসার সত্যিই গুরুত্ব রয়েছে বিয়ের স্থায়িত্বের ক্ষেত্রে। কিন্তু একই গবেষণায় এও দেখা গেছে, এমনকি প্রেমোত্তর বিয়েতেও ভায়লেন্স বা সহিংসতার পরিমাণ খুব একটা কম নয়।

এরপর আমাদের আলোচনায় আসে কবি লেখক বা শিল্পীদের জীবনে প্রেম বা ভালোবাসার বিষয়টি এতো বেশি গুরুত্ব বহন করে কেন! এর কারণ সম্ভবত লেখক শিল্পীরা মানসিকভাবে আবেগ বা সংবেদনশীলতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে জীবনে। বিবাহ, প্রেম ও যৌনতা বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনার পর আমাদের আড্ডায় লেখকদের জীবনে প্রেম নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। আমাদের লেখক ও কবিদের আত্মজৈবনিক লেখাগুলোতে যৌনতা বা প্রেম নিয়ে খোলামেলা কথাবার্তা কেউ লেখেন নি, তা নয়, তবে অধিকাংশ লেখকরাই তাঁদের প্রেম বা যৌন জীবন নিয়ে খুব একটা সত্যভাষণ করেন নি। এক ধরনের বানানো কথাবার্তাই অধিকাংশ কবি লেখকরা লিখেছেন। ষাটের কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে দেখা গেছে তাদের শিক্ষাজীবনে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যথেচ্ছ যৌনজীবন যাপন করা বা নারীসঙ্গ করা সম্ভব ছিলো না, বিশেষত সামাজিক অনুমোদন নিয়ে করা সম্ভব হয়নি, তাই তারা গোপনীয়তার আশ্রয় নিয়েছেন, মিথ্যাচার করেছেন লেখায়, বেশ্যাগামী ছিলেন অনেক লেখক কবি, কিন্তু আত্মজৈবনিক লেখাগুলোতে তা খোলাখুলি লেখেন নি। তরুণ বা কিশোর বয়সে অনেকেই সমকামিতার শিকার হয়েছেন, ‘পেসিভ’ বা ‘একটিভ পার্টনার’ হিশেবে, কিন্তু তা নিয়ে খোলাখুলি লেখেন নি। যাও দুয়েকজন আকারে ইঙ্গিতে লিখেছেন, তার অধিকাংশই বানানো বা কষ্টকল্পিত। কিন্তু এদের মধ্যেও কেউ কেউ তাঁদের যৌন জীবন নিয়ে লিখেছেন, কিছুটা সততার পরিচয়ও দিয়েছেন। তবে একটি ব্যাপার লক্ষণীয়, আমাদের সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের বা বোর্ডের সেরা ছাত্ররা কখনই খুব একটা লেখালেখির জগতে আসেন নি, এসেছেন মাঝারি বা নিচু ধরণের ছাত্ররা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন সাহিত্য বিভাগে যারা ভাল ফলাফল করে লেখালেখিতে এসেছেন, তারাও অধিকাংশই বোর্ডের মেধা তালিকায় খুব সাধারণ বা নীচের দিকের ছাত্র। তাই তাদেরকে সমাজের উচ্চশিক্ষিত বা ধনী ঘরের সুন্দরী মেয়েরা প্রেমের ব্যাপারে খুব একটা কাছে ঘেষতে দেয়নি, বা বিয়েতেও রাজী হয়নি। তাই আমাদের সমাজের কবি সাহিত্যিকরা নারীদের কাছে খুব একটা আকর্ষণীয় পুরুষ ছিলো না। এদিক থেকে একমাত্র ব্যতিক্রম শামসুর রাহমান। শামসুর রাহমানই আমাদের সমাজে প্রথম কবি, যিনি শিক্ষা বা রুচির দিক থেকে একেবারে ভিন্ন মানুষ ছিলেন। নারী পুরুষ বা ধনী দরিদ্র সবার কাছে তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় এবং সম্মানিত মানুষ। তাই অগণিত সুন্দরী নারীদের কাছ থেকে তিনি প্রেমের আর্তি পেয়েছেন। আমাদের কবি সাহিত্যিকরা অধিকাংশই শিক্ষার দিক থেকেও খুব একটা দ্যুতিমান ছিলেন না। শামসুর রাহমান সেদিক থেকেও দেশি বিদেশি সাহিত্য বিষয়ে শুধু ওয়াকেবহালই ছিলেন তা নয়, তিনি সাহিত্যকে বুঝতেও পারতেন তাঁর সমকালীন অনেক কবি সাহিত্যিকের চেয়ে ভাল।

ব্যক্তিগত পর্যায়ে ষাটের শেষদিক থেকে নব্বইয়ের গোড়ার দিক পর্যন্ত আমি নিজে ঢাকার অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ কবি লেখকদের সঙ্গে মিশে ও আড্ডা দিয়ে বুঝেছি, শামসুর রাহমান শুধু যে উন্নত রুচির মানুষ ছিলেন তাই নয়, তিনি সততার দিক থেকেও ছিলেন প্রায় সবার থেকে আলাদা। আমার নিজের মনে অনেক সময় প্রশ্ন জেগেছে, আমাদের সমাজের কবি সাহিত্যিকদের যে শুধু বিশ্বাস করা যায় না তাই নয়, তারা কেন এতোটা মানবিক দিক থেকেও ক্ষুদ্র মানুষ! এর কারণ হিশেবে অনেক বন্ধু আমাকে বলেছেন, দারিদ্র লেখকদের মানসিকভাবে ক্ষুদ্র করে রেখেছে। আমার একথাটাকে আংশিক সত্য মনে হয়েছে। আমার ধারণা, আমাদের লেখকদের অধিকাংশই সাহিত্যের বা শিল্পের মৌলিক উদ্দিষ্ট বিষয়ে অজ্ঞ, সাহিত্য বা শিল্পের মৌলিক উদ্দিষ্ট ও অন্বিষ্ট মানুষকে রুচিবান ও মহত্তর মানুষে রূপান্তরিত করা, সেটা আমাদের সমাজে কম হয়েছে, এর কারণ আমাদের কবি লেখকদের অধিকাংশই নামমাত্র পড়াশুনা করেছেন, বিশ্বসাহিত্যের ধ্রুপদী লেখা বা সাহিত্যের এসেন্সকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, এঁরা অন্য পেশায় থাকলেও একই ধরণের ক্ষুদ্রতা বা অমানবিকতার পরিচয় দিতেন হয়তো। এটা সবচেয়ে বেশি প্রমাণিত হয়েছে, স্বাধীনতার পর, বিশেষত আমাদের দেশের সামরিক স্বৈরশাসনের সময় যেভাবে কবি লেখকরা শাসকদের পদলেহন করে নিজেদের আত্মা বিক্রি করেছেন সামান্য জাগতিক সুবিধার জন্য।
এঁদের মধ্যে যে দুয়েকজন ব্যতিক্রম দেখা যায়, তাঁদের মধ্যে সবার আগে মনে মনে পড়ে শামসুর রাহমানের নাম। তিনি যে অসংখ্য সুন্দরীদের প্রেমের ও সান্নিধ্যের সৌন্দর্যে নিজেকে সিক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন, তার কারণ সম্ভবত তাঁর উন্নত রুচি, সাহিত্য বিষয়ে সত্যিকার শিক্ষা এবং গভীর মানবিকতাসম্পন্ন গুণাবলি!
আড্ডায় এসময় আহমাদ মাযহার একটি স্মৃতিচিত্র পাঠ করলেন একজন সিএনজি চালককে নিয়ে। এই সিএনজি চালক পুরনো ঢাকার বাসিন্দা, শামসুর রাহমানের ছেলেবেলার বন্ধু। তাঁর স্মৃতিতে কবি ও তাঁর জীবনের বিভিন্ন বিষয় তাঁর বয়ানে সত্যিই আমাদেরকে মুগ্ধ করে। মাযহার একদিন হঠাৎই এই মানুষটির দেখা পেয়েছিলেন এবং শামসুর রাহমান বিষয়ে এই বন্ধুর বয়ান স্মৃতিবদ্ধ করে রেখেছিলেন।

এসময় ডঃ ফারজানা সিদ্দিকা ও আহমাদ মাযহার শামসুর রাহমানের জীবনের কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করেন, যা সত্যিই সবাইকে মুগ্ধ করে। ফারজানা জানালেন, শামসুর রাহমান লিখিত কিছু অগ্রন্থিত কিছু প্রেমের কবিতার তিনি সন্ধান পেয়েছেন। পেয়েছেন কিছু ব্যক্তিগত প্রেমপত্রের সন্ধান। ফারজানা বলেন, সিলেটে একজন লেখকের সন্ধান তিনি পেয়েছেন যিনি তরুণ বয়স থেকে গভীরভাবে অনুরাগী শামসুর রাহমানের কবিতার। সেই সূত্রেই তিনি কবির সঙ্গে তাঁর ঢাকার বাসায় দেখা করেন, অনেকদিন গভীর রাতে তিনি তিনি কবিকে লেখার টেবিলে লিখতে দেখেছেন, যখন কবি একাকী লিখতেন। তিনি যখন যেতেন, কবির সঙ্গে আড্ডা হতো, তাকে থেকে যেতে বলতেন কবি রাতে তাঁর বাসায়। তিনি ঘুমুতে পারতেন না, মুগ্ধ চোখে কবির দিকে তাকিয়ে দেখতেন গভীর রাতে, তিনি লিখছেন, কবির মুখমণ্ডলে আলোকচ্ছটা বা এক ধরণের Aura বা Halo তিনি লক্ষ করতেন। এতোটাই ছিলো এই তরুণের মুগ্ধতা কবির প্রতি। একদিন এই তরুণই হয়ে ওঠেন কবির এক প্রেমিকার কাছ থেকে পাওয়া চিঠির বাহক। কবি তার মাধ্যমে ওই প্রেমিকার উদ্দেশ্যে লিখিত অনেকগুলো কবিতা একটি ফোল্ডারে করে প্রেমিকাকে উপহার হিশেবে পাঠান। কবির উদ্দেশ্যে লেখা এই প্রেমিকার চিঠি, বা কবি লিখিত চিঠিও তিনি বহন করে নিয়ে যেতেন। এক সময় এই প্রেমিকার জীবনে কিছুটা দাম্পত্য জটিলতা দেখা দেয়, তখন নিজের নতুন জীবন, কবির সঙ্গে দেখা করতে না পারা, ইত্যাদি হাহাকার মিশ্রিত বয়ান দিয়ে সেই প্রেমিকা এই তরুণকে চিঠি লিখতেন। তিনি গভীর বিশ্বাসের সঙ্গে সেসব চিঠি এবং কবির লেখা অপ্রকাশিত কবিতাবলি নিজের সংগ্রহে রেখে দিয়েছেন, কবির প্রতি ও তাঁর প্রেমিকার প্রতি সম্মান দেখিয়ে। আজও সেসব তাঁর কাছে তোরঙ্গে গচ্ছিত রয়েছে যত্নের সঙ্গে।

এছাড়াও একাধিক নারী শামসুর রাহমানের প্রেমে আচ্ছন্ন ছিলেন আমরা জানি। একজন নারী রাজশাহী থেকে সারাজীবন কবিকে ভালোবেসে গেছেন নীরবে। কবি মাঝে মাঝে রাজশাহী গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখাও করেছেন।

আড্ডা এতোটা আবেগাচ্ছন্ন ঘনবদ্ধরূপ নিয়েছিলো যে কখন মধ্যরাত পেরিয়ে গেলো, টেরই পাইনি আমরা। সবাই বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলেন। ফারজানা দেশে ফিরে যাবেন, তাই একটু বিষণ্ণ ছিলো তাঁর ফিরে যাবার কথাটি ভেবে। আমি ঘরের বাইরে বেরিয়ে ফারজানা ও অন্যান্য বন্ধুদের বিদায় দিলাম!

সবাই চলে যাওয়ার পর নিজের টেবিলে বসে আমি ভাবছিলাম সেই সত্তর দশকের শুরু থেকে আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর মাধ্যমে শামসুর রাহমানের সঙ্গে আমার পরিচয়। অধ্যাপক সিদ্দিকীর বাসার আড্ডায় অনেকদিন তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, দেখেছি তাঁর বন্ধু আবদুল বারিক চৌধুরীর বাড়ির সান্ধ্যকালীন পানের আড্ডায়। আমার প্রিয় ছাত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ও লেখক, বর্তমানে ঊর্ধ্বতন সরকারী কর্মকর্তা সুবর্ণা চৌধুরীকে পড়ানোর পর অনেক সন্ধ্যায় আমি শুধু এই অসাধারণ দুই মনীষীর সান্নিধ্যের আশায় তাঁদের আড্ডায় বসেছি, অনেকদিন সেই আড্ডায় পেয়েছি কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহকে। এছাড়া দৈনিক বাংলা অফিসে সম্পাদকের কক্ষের আড্ডায়, ‘পদাবলি’র সান্ধ্যকালীন সভাগুলোতে কবি শামসুর রাহমানের স্নেহ আমি বহু বছর পেয়েছি, যেখানে থাকতেন কবি বেলাল চৌধুরী, কবি রফিক আজাদ, কবি রবিউল হুসেন ও এক ঝাঁক তরুণ কবি। সাড়ে চার পাঁচ দশক আগের অগণিত সেই সব স্মৃতি এই গভীর রাতে আমাকে অনেকটাই বিষণ্ণ করে দিলো, নিঃসঙ্গ একাকী ঘরে!

সংবাদটি শেয়ার করুন

October 2024
S M T W T F S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031