‘ঘনিষ্ঠ চাঁদের নিচে চোখ আর চুলের সংকেতে
মেধাবিনী’ !
আবেদীন কাদের
সেপ্টেম্বরের শুরুতেই বাতাসে তাপমাত্রা কিছুটা কমে গেছে নিউ ইয়র্কে, তাই সন্ধ্যাটা নামার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা আড্ডাটায় বসতে চাচ্ছিলাম, বিশেষ করে আমি আর কবি শামস আল মমীন। মমীন ভাই তাই সাতটার দিকেই চলে এলেন। আমরা বসে দুজনে কথা বলছিলাম, ঢাকার সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়েই কথা চলছিলো। এসময়ই আহমাদ মাযহার এলেন। আমরা তিনজনে রাজনীতি ও সাহিত্যের দুয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে কথা বলছিলাম। কিন্তু গত মাস খানেক যাবৎ আমাদের অনেকেরই সময় কাটে ঢাকার প্রতিদিনের খবরে চোখ রেখে, তাই ঘুরে ফিরে সেই বিষয়েই আমাদের আলোচনা এগোতে থাকে। বছর দুয়েক ধরে কেউ কেউ আড্ডায় ভেবেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেহেতু সারাক্ষণ সমালোচনায় মুখর ছিলেন, তাই যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টাকে খুব সহজে এড়িয়ে যাবে না। তারা আসলে তলে তলে আবার ১/১১ এর মতো কোন কারণে ফখরুদ্দীন-মইনউদ্দিনের সরকারের আদলে কোন সরকার গঠন করবে যেখানে মোহাম্মাদ ইউনুসকে সরকার প্রধান করা হতে পারেন। প্রবাসে যারা রাজনৈতিক বিষয়ে লেখালেখি করেন, তারাও এরকম ভেবেছেন। কিন্তু খুব একটা আশ্চর্যের কিছু ঘটেনি যখন ইউনুস সাহেব অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিশেবে শপথ নিলেন। কিন্তু এঘটনা যখন সত্যে পরিণত হলো, তখন অনেকেই এটাকে স্বাভাবিক হিশেবে নিয়েছেন। কিন্তু সমস্যাটা হলো, কেমন আচরণ করছেন ডঃ ইউনুসগত এক মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিশেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থেকে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যে পুরনো কর্মকর্তাদের যেভাবে বদল করা হচ্ছে, তাতে বোঝা যায় এই সরকার ব্যাংকিং থেকে অন্যান্য আমলাতান্ত্রিক পদে সম্পূর্ণ নতুন লোক নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে আগের সরকারের পছন্দের লোকদের বিদায় করে এই সরকারের পছন্দের লোক নিয়োগ করা। কিন্তু এই সরকারের পছন্দের লোক কারা? তাদের রাজনৈতিক পরিচয় কী বা তাদের রাজনৈতিক ঝোঁকগুলোই বা কী কী! এটা এখনও পর্যন্ত যা সংবাদপত্রে এসেছে, তাতে দেখা যায় এসব পদে যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তারা অধিকাংশই আওয়ামী বিরোধী লোক। হয়তো তারা অনেকে আওয়ামী বিরোধী রক্ষণশীল দলের সদস্য, কিন্তু এসব নতুন নিয়োগপ্রাপ্তরা কাজে যোগ দিয়েছেন এবং তাদের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সরকারের ক্ষমতাসীন লোকদের মাঝে হয় কিনা আমি জানি না। কিন্তু সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় যা ঘটছে তা হলো জেল থেকে কিছু সংখ্যক সন্ত্রাসবাদী আসামীদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এরা অনেকেই কট্টর মৌলবাদী ইসলামী সন্ত্রাসবাদী, বিএনপির নামকরা সন্ত্রাসী, খুনি। কেন হঠৎ করে এদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে, কীভাবেই বা তারা ছাড়া পাচ্ছে, সে বিষয়ে সরকারের তরফ থেকে কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয় নি। হেফাজতে ইসলাম, বা আরও দুয়েকটি মৌলবাদী ইসলামিক দলের সদস্য সন্ত্রাসীদেরও ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।
জামাতে ইসলাম বা ইসলামী দলগুলোর জনগণের মাঝে সমর্থন কত শতাংশ সেটা দেশের লোকজন জানে। কিন্তু সরকার পরিচালনায়, রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে তাদের হঠাৎ করে এতোটা গুরুত্ব কী কারণে পাওয়া, তাও অনেকের মনে প্রশ্ন জাগায়।
এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানের বিভিন্ন বক্তব্য সাধারণ মানুষের কাছে প্রশ্ন জাগাতে পারে। যেমন ডঃ ইউনুস ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই-কে একটা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেখানে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছেন। এই মন্তব্যগুলো জনমনে প্রশ্ন জাগাবে। অন্তর্বর্তী সরকার কোন জনগণের প্রতিনিধি সরকার নয়। একটি গণঅভ্যুত্থানের পর তাকে ক্ষমতায় বসানো হয়েছে, সামনের নির্বাচনের পর পরবর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি বিদায় নিতে বাধ্য হবেন, কিন্তু তিনি নাকি কিছু রাষ্ট্রসংস্কার করবেন, কিন্তু জনগণ স্পষ্ট করে জানে না সেই সংস্কারগুলো কী কী, বা তা করার আইনি অধিকার এই সরকারের রয়েছে কিনা। যেহেতু তাঁরা নির্বাচিত প্রতিনিধি নন, তাই রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত তাদের নেয়ার আইনি বৈধতা নেই, এটাই আইনের কথা, কিন্তু ছাত্রদের দেয়া ‘সংস্কার’ কাজ পরিচালনার জন্য তারা এমন কিছু সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন যার জন্য রাষ্ট্রকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। বাংলাদেশের জনগণের জানার রয়েছে এই সরকার সংস্কার যে করবে, তা আসলে কী? কেউ কেউ বলেছেন এই সরকার শাসনতন্ত্র রচনা করবে বা পুনর্লিখন করবে, এই অধিকার তাদেরকে কে দিয়েছে তা জনগণের কাছে পরিষ্কার নয়। তাছাড়া তাদের অধিকার ও আইনের সীমানা কতোটা সে-বিষয়েও রাজনীতিবিদ, শাসনতান্ত্রিক পণ্ডিত বা সমাজের সিভিল সোসাইটির সদস্যদের মাঝে তেমন কোন আলোচনা হয়েছে বলেও জানা যায় নি।
দ্বিতীয়ত, এই অন্তর্বর্তী সরকার আরেকটি রাজনৈতিক এবং আইনি সিদ্ধান্ত দিয়েছে, সেটা হলো, বিচার শেষ হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিশেবে কোন কার্যকলাপ চালাতে পারবে না। এটা আইনের ও শাসনতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত। এই সরকার তা পারে কিনা, তাও ভেবে দেখার বিষয়। যেহেতু আওয়ামী লীগ দল হিশেবে ক্ষমতা থেকে মাত্র বিতাড়িত, তাই এধরণের সিদ্ধান্ত চট করে এরা দিতেই পারে, কিন্তু আইন ব্যবস্থা বা আদালত যদি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, এই সিদ্ধান্ত টিকবে কিনা তাও ভেবে দেখা যেতে পারে। আমাদের স্মৃতিতে আছে জেনারেল আইয়ুব সামরিক অভ্যুত্থান করে ১৯৫৮ সালে ক্ষমতায় এসে পাকিস্তানের অনেক রাজনৈতিক নেতাকে ‘এবডো’ নামক এক নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করেছিলেন, যারা অধিকাংশই আদালতে আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে তাদের অধিকার ফেরৎ পেয়েছিলেন। সামরিক সরকারের পক্ষে যা সম্ভব হয়নি, ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে এই আদেশ দিয়ে রাজনীতিকদের রাজনীতি করার অধিকার কেড়ে নিতে পারবে বা বন্ধ রাখতে পারবে তা বিশ্বাস করা কঠিন। অবশ্যই আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে দেশে বেআইনি দুঃশাসন চালিয়েছে, কিন্তু তার বিচার করার অধিকার সম্ভবত রয়েছে দেশের আদালতের বা পরবর্তী সংসদের। নিশ্চয় এই সরকারের আদালতের বাইরে গিয়ে এধরনের সিদ্ধান্ত আইনে টিকবে কিনা ভেবে দেখার বিষয়।
আমাদের আড্ডার মূল তক্কাতক্কি ছিলো রাজনৈতিক এসব বিষয় নিয়েই। আমি আড্ডায় একটি প্রশ্ন তুলেছিলাম যে এই সরকারের রাষ্ট্রপরিচালনার বা কিছু আইনি সিদ্ধান্তে ইসলামী দলগুলোর প্রতি তাদের নৈকট্যের ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছে কিনা! ডঃ ইউনুস তার গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা ও নির্দিষ্ট বয়স পেরিয়ে যাওয়ার পরও ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ আঁকড়ে থাকার বিরুদ্ধে শেখ হাসিনা সরকার ব্যবস্থা নিয়েছে। ডঃ ইউনুসের হাজারটা হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ করে কোন জাদুবলে তার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা খারিজ হয়ে যেতে পারে, সেটা ভাবনার কথা। অবশ্যই আদালত বিবেচনা করে, শুনানি করে মামলা খারিজ করতে পারে, কিন্তু তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আদালতে সব সিদ্ধান্ত উল্টো হয়ে যায় কী করে এটাও খতিয়ে দেখা জরুরি।
সরকার কয়েকটি সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানের নাম ঘোষণা করেছে, এরা অধিকাংশই তাদের স্ব স্ব অবস্থান থেকে পেশার রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ বিরোধী হিশেবে পরিচিত। রাষ্ট্রের আমলাতন্ত্রে যে ব্যাপক রদবদল হয়েছে ও হচ্ছে, সেখানে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের পদায়ন করতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে একটি বা দুটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের বা গোষ্ঠীর প্রতি আনুগত্য রয়েছে এমন কর্মকর্তাদেরই পদায়নে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে। সেখানে দক্ষতা বা সততা ও জ্যেষ্ঠতা বিচারের বিষয় হচ্ছে না। যারা আওয়ামী লীগ সরকার দ্বারা নিগৃহীত হয়েছেন দক্ষতা মেধা ও জ্যেষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে চাকুরীতে পুনর্বহাল যৌক্তিক, কিন্তু যারা আওয়ামী লীগ বিরোধিতার যোগ্যতায় পদায়িত হচ্ছে, তারা এই সরকারের বা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে কিনা বলা মুশকিল। কোন সরকার যদি আমলাতন্ত্র নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে আইন ও নৈতিক বিষয় বিবেচনায় না রাখে তার ফল রাষ্ট্রের জন্য সুফল বয়ে আনে না। আমলাতন্ত্রের চলমান নিয়মানুযায়ী এই পেশাটা কিছু দুর্নীতিবাজ লম্পট সৃষ্টিতেই সাহায্য করে, এর পরিবর্তন করতে পুরো সিস্টেমটাকেই পরিবর্তন জরুরি। তা যতদিন না করা যায়, ততদিন চলমান আইনকে বা নিয়মাবলীকে সুষ্ঠুভাবে মেনে চলাই শ্রেয়।
রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে এসব কথা চলতে থাকলো, মমীন ভাই যথারীতি প্রায়-নীরব। হঠাৎ বেশ কয়েক সপ্তাহ পর এসে যোগ দিলেন আমাদের বন্ধু কথাশিল্পী স্বপন বিশ্বাস। স্বপন আমাদের রাজনৈতিক আলোচনায় যোগ দিলেন। এর আগেও দেখেছি স্বপনের রাজনৈতিক বিশ্বাস একেবারে অসাম্প্রদায়িক, নির্জলা গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতি। স্বপনের গল্প যারা পড়েছেন, তারা জানেন তাঁর কথাশিল্পের অন্তঃসলিলে এক ধরণের গভীর রাজনৈতিক বিশ্বাস ও প্রতিশ্রুতি থাকে। চরিত্রায়নে কখনও কখনও কিছুটা স্যাটায়ারিক ঝোঁক লক্ষ করা গেলেও সমাজ-পর্যবেক্ষণে ভীষণ তির্যক চোখ তাঁর রয়েছে, তা আমি তাঁর একটি গল্প সংকলন বিষয়ে সংক্ষিপ্তভাবে লিখতে গিয়ে বলেছি। আমি মাস খানেক ধরেই লক্ষ করেছি স্বপন ছাত্র আন্দোলনের সময় থেকেই আমাদের রাজনীতির দ্বিচারিতা বিষয়ে কিছুটা সাবধানী উচ্চারণ করেছেন ফেসবুকের স্ট্যাটাসগুলোতে। সম্ভবত একটু সংযত বাক্যাবলি দিয়ে তিনি চলমান রাজনীতির বাহ্যত চেহারার আড়ালে ভয়ঙ্কর বিষ-মিশ্রিত ছোবল থাকার সম্ভাবনা বিষয়ে আমাদেরকে কিছুটা সচেতন করেছেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনেক স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করার ফাঁকে ফাঁকে আমাদের যে দুচারজন বন্ধু কট্টর মৌলবাদী রাজনৈতিক ছাত্র ও রাজনীতিকদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা যে থাকার সম্ভাবনাই বেশি, তা তাঁর লেখায় থাকতো। কিছু সেটা আমাদের উদারনীতিবাদী রাজনীতিকদের অনেকেই আন্দাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন, বিশেষ করে লেখক শিল্পীদের মাঝে। কিন্তু গত একমাসের ডঃ ইউনুসের শাসনকাল বিশ্লেষণ করলে সহজেই অনুমান করা সম্ভব কারা জেল থেকে অকাতরে জামিন পাছে, কাদের বিচারের মামলা খারিজ হয়ে যাচ্ছে, কাদের সাজা মকুব হয়ে যাচ্ছে সাধারণ ইশারায়! মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যে যাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্ণধার হিশেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, তা ভালো করে পর্যালোচনা করলে কোন কোন ক্ষেত্রে স্বপন বিশ্বাসের স্যাটায়ারগুলোর মর্মবাণী কিছুটা আন্দাজ করা সম্ভব! রাজনীতি আসলেই এক ধরণের ‘তামাশা’!
আমরা এই আলোচনা করার সময়ই মুখর আনন্দধ্বনির মাঝে আড্ডায় এসে যোগ দিলেন এক দল বন্ধু, কবি অভীক সোবহান, কথাশিল্পী বদরুন নাহার ও অধ্যাপক ডঃ ফারজানা সিদ্দিকা রনী। আমি রনীকে দেখে ভীষণ আনন্দিত হলাম, কারণ গত সপ্তাহে রনী জানিয়েছিলেন তিনি দেশে ফেরার আগে আর আসতে হয়তো পারবেন না। আমি ভাবছিলাম ওঁকে অনুরোধ করবো এই শনিবারে আসতে, কারণ যাবেন তিনি আগামী সপ্তাহে। আড্ডায় ওঁর উপস্থিতি, সাহিত্য ও রাজনীতি নিয়ে আলোচনা আমাদের পুরো আলোচনাকেই একেবারে ঝর্ণার মতো উজ্জ্বল আনন্দচ্ছটায় ভরিয়ে দেয়। গত তিনটি সপ্তাহ আমরা হাজারটা বিষয় নিয়ে কথা বলেছি, ওঁর কাছে অনেক কিছু শিখেছি। ওঁর কবিতা শুনেছি, সমাজের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ওঁর পর্যবেক্ষণ আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। দেখেছি ওঁর চিন্তায় পুরুষ ও নারী লেখকদের চিন্তা-দেয়াল একেবারেই নেই, নেই আমাদের সমাজের বিভিন্ন সংস্কারাচ্ছন্নতার বিন্দুমাত্র রেশ। একেবারে আধুনিক প্রগতিশীল মননের উজ্জ্বলতায় স্নাত ওঁর ভাবনা। বহু রাজনৈতিক ও সাহিত্যিক বিষয়েই আমি ও মাযহার ডঃ সিদ্দিকার মতের সঙ্গে একমত পোষণ করি।
অভীক, বদরুন, ফারজানা ও নসরত শাহ যোগ দিলেন স্বপন বিশ্বাসের লেখা অসাধারণ কবিতাটি নিয়ে আলোচনায়। আমরা আজকের সামাজিক ও রাজনৈতিক অন্ধকার-ঘেরা সময় বিষয়ে আমাদের হতাশাই শুধু প্রকাশ করে যাচ্ছিলাম গত মাস দেড়েক ধরে, কিন্তু এই সময়ের নোংরা, ক্লেদাক্ত রাজনীতি নিয়ে তেমন কিছু লিখতে পারিনি। কিন্তু স্বপন আজকের অস্থির সময়ের রাজনীতি নিয়ে সত্যিই দারুণ একটি কবিতা পড়ে শোনালেন।
এসময় কী কথা বলতে গিয়ে জীবনানন্দের লেখা বিষয়ে কথা ওঠে। আসলে কথা হচ্ছিলো কবিদের লেখা গদ্য, বিশেষ করে প্রবন্ধ ও কথাশিল্প নিয়ে। জীবনানন্দের প্রবন্ধ আমরা একমাত্র ‘কবিতার কথা’ ছাড়া কম পেয়েছি। বিশেষ করে সত্তর দশকের শেষদিকের আগে আমরা জানতেই পারিনি যে তাঁর এতো বিপুল লেখা অপ্রকাশিত রয়েছে। ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনা অনেকগুলো খণ্ড বের করার আগে আমরা তাঁর কথাশিল্পের বিপুল ভাণ্ডার বিষয়ে কিছুই জানতে পারিনি। কবি বুদ্ধদেব বসু, অম্বুজ বসু, ভুপেন্দ্র গুহ, আবদুল মান্নান সৈয়দ এবং সাম্প্রতিক কালে ফয়জুল লতিফ চৌধুরীসহ আরও অনেকের গবেষণায় জীবনানন্দের অনেক লেখা আমরা জেনেছি। কিন্তু ডঃ সিদ্দিকা তাঁর নিজের একটি গবেষণার বিষয় জানালেন যা দিয়ে আমাদেরকে ভাবালেন এই অমর কবির কথাশিল্পের ওপর এমন এক অজানা আলোর কথা। নব্বই দশকের শেষ দিকে ডঃ ফারজানা সিদ্দিকা এম এ ফাইনালে একটি থিসিস লেখেন জীবনানন্দের গল্প বিষয়ে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খুব বেশি সংখ্যক ছাত্ররা থিসিস অপশনটা নেয় না, কারণ এটি ভীষণ খাটুনির। উল্লেখযোগ্য এম এ-র থিসিস আমাদের দেশে কম হয়েছে। ষাটের দশকের শেষদিকে অধ্যাপক সৈয়দ আকরম হোসেন রবীন্দ্রনাথের ওপর একটি থিসিস লিখেছিলেন, যা সে-সময়ে কিছুটা আলোচনার হিল্লোল তুলেছিলো। পরে আমরা এটি বই আকারে পড়েছি। এই থিসিসের সুপারভাইজিং অধ্যাপক ছিলেন অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী।
নিউ ইয়র্কের সিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে দেখেছিলাম এখানে এম এ-তে থিসিস লেখা বাধ্যতামূলক। আমি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়া স্টাডিজে এম এ করার সময় বাধ্যতামূলক থিসিস লিখেছিলাম। আমার বিষয় ছিলো ‘Political Constraints of Bangladesh Televison News during 1964-1990’ । এই বিষয়ে গবেষণা করে ও থিসিস লিখে আমি ভীষণ আনন্দ পেয়েছিলাম। সেই থেকে আমার একটি ধারণা হয়েছিলো যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ফাইনালে থিসিস বাধ্যতামূলক হওয়া উচিৎ, কারণ এতে ছাত্ররা গবেষণার ও অভিসন্দর্ভ লেখার একটি ভালো প্রশিক্ষণ পায়, যা পরে তাদের পিএইচ ডি বা আরও উচ্চতর গবেষণায় সাহায্য করে।
যাহোক আমরা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম ডঃ ফারজানার এই থিসিস বিষয়ে আলোচনা। জীবনানন্দের একমাত্র ‘মাল্যবান’ উপন্যাস ও ‘কবিতার কথা’ ছাড়া আমি বাংলাদেশের ছাত্রজীবনে অন্য কোন গদ্য পড়ার সুযোগ পাইনি, সামান্য কিছু চিঠিপত্র ছাড়া। সেসব চিঠিপত্রও সাপ্তাহিক ‘দেশ’ বা অন্যান্য সাহিত্য পত্রিকার বিশেষ সংখ্যাগুলোতে ছাপা হতো তখনকার দিনে। কিন্তু আমি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হওয়ার পর সত্তর দশকের শেষ দিকে ও আশির শুরুতে জীবনানন্দের লেখা নিয়ে অনেকগুলো খণ্ড বের হয়ে ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনা থেকে। আমার মনে আছে কবি আবদুল মান্নান সৈয়দ সত্তর দশকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পি এচ ডির জন্য গবেষণা করছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস নিয়ে। কয়েক মাস পর পর তিনি ঢাকায় এলে আমাদের সঙ্গে তাঁর মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় ছাড়াও জীবনানন্দের বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি তিনি যে তন্ন তন্ন করে খুঁজে ফিরছিলেন বিভিন্ন সূত্রের সন্ধান করে, তা আলোচনা করতেন। সম্ভবত ‘৭৮ সালে একটি বিশেষ সংখ্যা ‘রোববার’ পত্রিকার জন্য তিনি কলকাতার জীবন নিয়ে ‘পার্ক স্ট্রীট’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন, সেটার প্রুফ দেখতাম আমি আর মান্নান ভাই ‘রোববার’ অফিসে বসে, রফিক আজাদ ভাইয়ের টেবিলের উলটো দিকে। সে-সময় মান্নান ভাই জীবনানন্দের পাণ্ডুলিপি সন্ধান বিষয়ে অনেক গল্প শুনিয়েছিলেন। কবির ছোটভাই অশোকানন্দ দাশের সঙ্গে তিনি একাধিকবার দেখা করে জীবনানন্দের পরিবারে গচ্ছিত অনেকগুলো ট্রাঙ্কের সন্ধান পান, যেখানে জীবনানন্দের অনেক গল্প ও উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি ছিলো বলে মান্নান ভাই আমাদের জানিয়েছিলেন।
ফারজানা তাঁর থিসিসের জন্য ‘প্রতিক্ষণ’ থেকে প্রকাশিত একটি খণ্ডে একশত আটটি গল্প নিয়ে গবেষণা করেন। এছাড়া আরও দুটি গল্প তিনি ভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করেছিলেন সম্ভবত। এই গল্পগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে ডঃ ফারজানা সিদ্দিকা তাঁর অভিসন্দর্ভটি লেখেন। তবে এই খণ্ডের একটি গল্প নিয়েই আড্ডায় মূলত তিনি আলোচনা করেন। গল্পটির শিরোনাম ‘জীবনের অন্তঃপুর ও তেপান্তর’। ডঃ সিদ্দিকা জানান ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত খণ্ডটিতে গল্পটি আমি কখনও পড়িনি মনে হয়। ‘প্রতিক্ষণ’ প্রকাশনী থেকে জীবনানন্দের অধিকাংশ খণ্ডই আমি পড়েছি, তবে এই গল্পটি আমি স্মরণ করতে পারলাম না। ফারজানা জানালেন গল্পটি কবি তাঁর মাকে লেখা একটি চিঠির আকারে লিখেছেন। বাইরের জগতে যদি মা জীবনে অংশ গ্রহণ করতে পারতেন, তাহলে তাঁর মায়ের অন্তর্গত অসীম সম্ভাবনাকে অন্যভাবে তিনি তাঁর চিন্তাজগৎকে রূপায়নে ব্যবহার করতে পারতেন। গল্পটি বিষয়ে ফারজানা বললেন এতে একজন শিল্পীর খোলা মন ও নারী ভাবনা, বিশেষ করে লিঙ্গ-সমতার পারসপ্যাকটিভ থেকে গল্পটিকে বিশ্লেষণ করা সম্ভব। আমার ধারণা ফারজানা যে দৃষ্টিকোণ থেকে গল্পটিকে বিশ্লেষণ করেন সেটি হয়তো বা তাঁদের পারিবারিক সম্পর্ক, মানে একটি শিক্ষিত রুচিশীল ব্রাহ্ম পরিবারের সদস্যদের ইন্টারেকশনেরও ছবি ফুটে উঠে। হিন্দুদের রক্ষণশীলতা ব্রাহ্মদের মধ্যে একেবারে অনুপস্থিত, তাছাড়া জীবনানন্দের মা কুসুমকুমারী নিজে একজন কবি। তাঁদের ভাইবোন ও মা বাবার মধ্যে যে সম্পর্ক তা সাধারণ শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবার থেকে অনেকটাই এগিয়ে, আধুনিক! নিজের ভাইবোন ও মা বাবার সঙ্গে জীবনানন্দের সম্পর্কটি চিঠিপত্রের মাঝে যা পাওয়া যায় তাতে তখনকার মধ্যবিত্ত সমাজের লিঙ্গবৈষম্যের দেয়ালবর্জিত। ফারাজানা আরও জানালেন, স্কুলে পড়ার সময় জীবনানন্দের মা কবিকে অনেক সময় উপদেশ দিতেন স্কুলের বা জেলা শহরের কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কিশোর এই কবি কী কবিতা পড়বেন বা অন্য সাংস্কৃতিক বিষয়ে অংশ নেবেন। এতে মা ও ছেলের মাঝে একটি খোলা সম্পর্কের ছবিও পাওয়া যায়!
বাঙালি কবিদের সে-সময়ের জীবন ও জীবনানন্দের বেড়ে ওঠা বিষয়ে ফারজানার সঙ্গে আহমাদ মাযহার, প্রাবন্ধিক আদনান সৈয়দ, কবি এবিএম সালেহউদ্দীন, কবি অভীক সোবহান কথাশিল্পী বদরুন নাহার, কবি শামস আল মমীন ও নসরত শাহ অংশ নেন। বরিশালের তখনকার সাংস্কৃতিক আবহ এবং কবির জীবনের নানা দিক নিয়ে ফারজানার সঙ্গে নসরত আলোচনায় অংশ নেন।
আমাদের আলোচনায় অধিকাংশ সময় জীবনানন্দের কবিতা নিয়েই বেশি কথা হয়, তাঁর কথাশিল্প নিয়ে তেমন একটা আলোচনা আমরা করি না। ডঃ ফারজানার আলোচনা বিষয়টা সম্পর্কে আমাদেরকে অনেকটাই ভিন্নভাবে চিন্তা করতে শেখালো। জীবনানন্দের কবিতা আমরা পড়া শুরু করি আমাদের স্কুলের শিক্ষকদের কাছে নাম জেনে, একেবারেই হাই স্কুলের প্রথম দিকে। অন্যদের মতো আমিও এই কবিকে প্রথম চিনি ‘বনলতা সেন’ কবিতার মাধ্যমেই। যে-বয়সে কবিতা পাঠের অভিজ্ঞতা সীমিত, সে বয়সে এই কবিতার ভাষা বালক পাঠককে কিছুটা বিভ্রান্ত যেমন করতে পারে, তাঁর ‘হাঁটিতেছি’, ‘হারায়েছি’, ‘বসিবার’ ইত্যাদি শব্দাবলির দীর্ঘায়িত ধ্বনি ঝঙ্কারে, তা আমাকেও করেছে। প্রতিটি পঙক্তি বাইশ মাত্রার, কিন্তু দ্বিতীয় স্তবকে কিছুটা ছন্দ বা ঝঙ্কারের নিয়মভাঙার রেশ রয়েছে। পঙক্তিগুলো আঠারো, বাইশ, চৌদ্দ, ছাব্বিশ ও বাইশ মাত্রার। তৃতীয় স্তবকেও নিয়মভাঙার পুনরাবৃত্তি। জীবনানন্দের অবসাদ ও প্রতীক্ষার পরিমাপ করতে সারা কবিতাটি জুড়ে বিপন্নতার কথা। কেমন একটা মায়া ও রহস্য ঘেরা স্পন্দন জড়িয়ে আছে বলেই সেই বালক বয়সে আমাদেরকে কবিতাটি মুগ্ধ করতো। কিন্তু পরিণত বয়সে দিনের সকল কাজ সেরে গভীর রাতে একাকী জীবনানন্দ নিয়ে বসলে হয়তো আর এ কবিতা মুগ্ধতা ছড়ায় না, ভালো লাগে ‘গোধূলি সন্ধির নৃত্য’ বা ‘ক্যাম্পে’ কবিতা, অথবা ‘সাতটি তারার তিমির’-এর যে কোন কবিতা। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ নিয়ে বসলে কিছুটা সময় প্রবীণ বয়সেও বেদনা ছড়ায়, কিন্তু কিছুতেই, কেন জানি না, ‘রূপসী বাংলা’ আর টানে না। ঋতুতে ঋতুতেজীবনের অপরাজেয় ঐশ্বর্য যেন সব হারিয়ে যায়! নিজের কম বয়সে জীবনানন্দের ঘোর আমার স্মৃতিতে ভেসে উঠছিলো যখন আমি এক মনে ফারজানার জীবনানন্দ বিষয়ক গল্পের বিশ্লেষণ শুনছিলাম। আগে আমি কোনদিন এভাবে ভাবিনি এই কবির কথাশিল্পকে। প্রায় তিন দশকের কাছাকাছি সময় ধরে এদেশে পড়াচ্ছি সমাজবিজ্ঞানের নারীবাদী তত্ত্ব, সেই আলোকে মাঝে মাঝে ক্লাসে, বিশেষ করে এম এ ক্লাসে গ্রাজুয়েট ছাত্রদেরকে জুডিথ বাটলারের ‘জেন্ডার ট্রাবল’ থেকে টেক্সট নিয়ে সাহিত্যের নানা চরিত্রকে বিশ্লেষণ করা শেখাচ্ছি, কিন্তু ফারজানা জীবনানন্দের এই গল্পটি বিষয়ে যেভাবে বললেন, সেভাবে আমি আগে ভেবে দেখিনি। বাংলাদেশে পড়ালে হয়তো বাংলা সাহিত্যের মহৎ কথাশিল্পীদের বিখ্যাত চরিত্রগুলো এই তত্ত্বের আলোকে ডাইসেকট করা আমার পক্ষে সম্ভব হতো, কিন্তু আমার ছাত্ররা বিভূঁইয়ে বাংলা সাহিত্য বিষয়ে অজ্ঞ, তাই ওদেরকে কখনও সাহিত্যের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে গেলেও ধ্রুপদী ইউরোপীয় ভাষার সাহিত্যকেই উপজীব্য করতে হয়।
কথাশিল্পের আলোচনায় মাযহার, ফারজানা, আদনান ও বদরুন সত্যিই বিভোর হয়ে ছিলেন অনেকটা সময়। মাঝে মাঝে অভীক মন্তব্য করেন নব্বই দশকের তরুণরা যেভাবে সাহিত্যকে বুঝতে চাইতেন। বদরুন আড্ডাটাকে কিছুটা হালকা করার জন্য অনেকদিন আগে তাঁর লেখা ‘আরার ইউনুস’ শিরোনামের একটি গল্প পাঠ করে শোনালেন। গল্পটা আমার সত্যিই ভালো লেগেছে। ডঃ ইউনুসের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির পর চট্টগ্রামের এক নারীর আঞ্চলিক ভাষায় ইউনুসকে নিয়ে কিছু ভাবনা গল্পটায় চিত্রিত, সত্যিই ভিন্ন মেজাজের, ভিন্ন স্বাদের! জীবনানন্দের লেখা নিয়ে ভারী আলোচনার পর গল্প পাঠও আমাদের আড্ডাকে কিছুটা ঘনবদ্ধ মেজাজ এনে দিয়েছিলো। এসময় আমরা আমাদের বাঙালি মুসলমান লেখকদের ক্ষমতা বা প্রতাপকে ‘তৈলাক্তকরণ’-এর স্বভাব নিয়ে কিছুটা পরচর্চা ধরনের আড্ডায় মেতে ছিলাম।
ফারজানা জানালেন, তিনি তখন শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে চেয়ারের দায়িত্বে। সিলেটে কী একটা কাজে গিয়েছেন আমাদের দেশের আওয়ামীবাজ এক নামী কথাসাহিত্যিক। সঙ্গে রয়েছেন কলকাতার অধ্যাপক পবিত্র সরকার। তাঁদেরকে নিমন্ত্রণ করা হলে কিছু সময়ের জন্য ফারজানার বিভাগে তাঁরা গেলেন। এই কথাসাহিত্যিক হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের ‘ওই মহামানব আসছে’ ধরনের একটি বাক্যকে উদ্ধৃত করে মন্তব্য করেন যে রবি ঠাকুর সম্ভবত বঙ্গবন্ধুর জন্ম হবে ভেবেই এই কথা লিখেছিলেন! আমাদের আড্ডায় এই তৈলাক্তকরণের নমুনা শুনে সবাই হেসে উঠলেন।
আমাদের আড্ডায় এসময় আরেকজন সদস্য জানালেন বাংলা একাডেমীর এক সময়ের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান এর চেয়েও এগিয়ে থাকা তেলবাজ ছিলেন, তিনি শেখ রাসেলের স্মৃতি আলোচনা করতে গিয়ে বলেছিলেন যে বেঁচে থাকলে শেখ রাসেল বারট্রানড রাসেলের চেয়েও বড় দার্শনিক হতেন! এবার আমাদের সত্যিই মূর্ছা যাবার দশা হচ্ছিলো।
রাত গভীর হয়েছে, সবাই বাড়ি ফিরবেন, আমরা কিছুটা বিষণ্ণ মনেই ডঃ ফারজানা সিদ্দিকাকে বিদায় দিলাম। আগামী আড্ডার আগের দিন তিনি দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু গত কয়েকটা সপ্তাহ তিনি আড্ডায় যেভাবে আমাদেরকে সাহিত্যের ও সমাজ-সমস্যার হাজারটা বিষয়ে আলোচনা করে মুগ্ধ করে রেখেছেন, শিখিয়েছেন অনেক কিছু তাঁর কিছু মৌলিক পর্যবেক্ষণ দিয়ে, তা আমাদের অনেকদিন মনে থাকবে। আমরা ওঁকে খুব মিস করবো আগামী আড্ডাগুলোতে।
সবাই বিদায় নেয়ার পর আমি নীরবে আমার প্রিয় কিছু কালোয়াতি গান শুনে কাটালাম অনেকটা সময় ধরে!
সংবাদটি শেয়ার করুন