ফেনী-২ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) নিজাম উদ্দিন হাজারীর পদে থাকা নিয়ে মামলাটি ‘অসৎ উদ্দেশ্যে করা’ হয়েছিল বিবেচনা করে খারিজ করে দিয়েছে হাই কোর্টের একটি একক বেঞ্চ।
এক যুবলীগ নেতার করা ওই রিট আবেদনে চার বছর আগে দেওয়া রুলের নিষ্পত্তি করে বিচারপতি মো. আবু জাফর সিদ্দিকীর একক বেঞ্চ বৃহস্পতিবার এই রায় দেয়।
এর ফলে ফেনীর আওয়ামী লীগ নেতা নিজাম হাজারীর এমপি পদে থাকার বৈধতা নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন থাকল না বলে তার আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
আদালতে নিজাম হাজারীর পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ ও নুরুল ইসলাম সুজন। রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন কামরুল হক সিদ্দিকী ও সত্যরঞ্জন মণ্ডল।
‘সাজা কম খেটেই বেরিয়ে যান সাংসদ’ শিরোনামে ২০১৪ সালের ১০ মে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন যুক্ত করে নিজাম হাজারীর এমপি পদে থাকার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদনটি করেন ফেনী জেলা যুবলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সাখাওয়াত।
তার যুক্তি ছিল, সংবিধানের ৬৬ (২) (ঘ) অনুচ্ছেদ অনুসারে, কোনো ব্যক্তি যদি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন তাহলে মুক্তির পর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না।
রায়ে বিচারক বলেছেন, জনস্বার্থে রিট আবেদনটি করার কথা বলা হলেও এর পেছনে ‘অসৎ উদ্দেশ্য ও ব্যক্তিগত স্বার্থ’ ছিল বলে আদালতের মনে হয়েছ। সেই বিবেচনায় এ মামলাকে জনস্বার্থে বলা যায় না। রিট ‘মেনটেইনেবল’ না হওয়ায় রুল খারিজ করা হল।
২০০০ সালের ১৬ অগাস্ট অস্ত্র আইনের এক মামলায় দুটি ধারায় ১০ বছর ও সাত বছর কারাদণ্ড হয়েছিল নিজাম হাজারীর, যা আপিলেও বহাল থাকে। সে হিসেবে নিজাম হাজারী ২০১৫ সালের আগে সংসদ সদস্য পদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য না হলেও তিনি ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে সাংসদ হয়ে যান বলে অভিযোগ করা হয়েছিল রিট আবেদনে।
তিনটি বেঞ্চ ওই মামলা শুনতে বিব্রত বোধ করে। পরে বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার ও বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের হাই কোর্ট বেঞ্চ প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৪ সালের ৮ জুন রুল জারি করে।
নিজাম হাজারী কোন কর্তৃত্ববলে ওই আসনে সংসদ সদস্য পদে আছেন এবং ওই আসনটি কেন শূন্য ঘোষণা করা হবে না- তা জানতে চাওয়া হয় রুলে৷ পাশাপাশি অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনাও দেয় আদালত।
ওই রুলের উপর শুনানি নিতে ২০১৫ সালের ১২ নভেম্বর হাই কোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চের এক বিচারপতি এবং পরে ২ ডিসেম্বর অন্য একটি দ্বৈত বেঞ্চ বিব্রতবোধ করে।
প্রধান বিচারপতি এরপর বিষয়টি শুনানির জন্য বিচারপতি মো. এমদাদুল হকের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চে পাঠান। ২০১৬ সালের ১৯ জানুয়ারি হাই কোর্টে রুলের উপর শুনানি শুরু হয়।
শুনানিকালে হাই কোর্ট নিজাম হাজারীর কারাবাসের সময় ও রেয়াতের বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়। সেইসঙ্গে নিজাম হাজারীর বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে করা মামলার রায় ও নথিপত্র দাখিল করতে বলে।
এরপর ওই বছরের ২৬ মে অন্য এক আদেশে হাই কোর্ট অস্ত্র মামলায় নিজাম হাজারীর কারাবাসের সময় ও রেয়াতের বিষয় তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে কারা মহাপরিদর্শককে (আইজি-প্রিজন্স) নির্দেশ দেয়।
এ নির্দেশনা অনুসারে আইজি-প্রিজন্সের দেওয়া প্রতিবেদনে বলা হয়, ১০ বছরের কারাদণ্ডের মধ্যে নিজাম হাজারী সাজা খেটেছেন ৫ বছর ৮ মাস ১৯ দিন। কারা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সাজা রেয়াত পেয়েছেন ১ বছর ৮ মাস ২৫ (৬২৫ দিন)। রেয়াতসহ মোট সাজা ভোগ করেছেন ৭ বছর ৫ মাস ১৪ দিন। এখনও সাজা খাটা বাকি আছে ২ বছর ৬ মাস ১৬ দিন।
২০১৬ সালের ৩ অগাস্ট এই রিটের রুলের ওপর শুনানি শেষ করে আদালত ১৭ অগাস্ট রায়ের দিন ঠিক করে দিলেও ওইদিন নতুন একটি নথি চাওয়া হলে রায় পিছিয়ে যায় ২৩ অগাস্ট।
সেদিন আদালতে ফের শুনানিতে অংশ নেন আইনজীবীরা। ‘রক্তদান করে’ নিজাম হাজারী কারাবাস রেয়াতের অধিকারী হয়েছেন বলে তার আইনজীবীরা সেদিন আদালতে যুক্তি দেন।
শুনানির পর আদালত ৩০ অগাস্ট রায় দেওয়া শুরু করলেও নিজাম হাজারীর আইনজীবী নুরুল ইসলাম সুজন সেদিন বলেন, নিজাম হাজারী কারাগারে থাকার সময় মোট ১৩ বার রক্ত দিয়েছিলেন। যার বিপরীতে তিনি ৪৮৬ দিনের কারাবাস থেকে রেয়াত পাওয়ার অধিকারী হয়েছেন। এটা ধরা হলে তার সাজার মেয়াদের চেয়ে বেশি সময় তিনি কারাগারে ছিলেন।
তাদের ওই যুক্তির পর ৩১ অগাস্ট আদালত নতুন প্রতিবেদন চায়। নিজাম হাজারী কারাবাসকালে কত ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন, এর ফলে কতদিন কারাবাস রেয়াত পাওয়ার অধিকারী হয়েছেন, ৩০ দিনের মধ্যে তা প্রতিবেদন আকারে দিতে বলা হয় কারা কর্তৃপক্ষকে।
৩ নভেম্বর আবার এ বিষয়ে শুনানি শুরু হলে চট্টগ্রাম কারা কর্তৃপক্ষ আদালতকে জানায়, নিজাম হাজারীর রক্তদানের বিষয়ে কোনো নথি তাদের কাছে নেই।
আরও কয়েক দফা রায়ের তারিখ পেছনোর পর ওই বছরের ৬ ডিসেম্বর বিভক্ত রায় ঘোষণা করে হাই কোর্ট। দ্বৈত বেঞ্চের একজন বিচারক নিজাম হাজারীর সংসদ সদস্য পদ অবৈধ ঘোষণা করলেও অপর বিচারক তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন।
ফলে প্রধান বিচারপতি নিয়ম অনুসারে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য একক বেঞ্চ গঠন করে দেন। সেই দায়িত্ব পায় বিচারপতি সৌমেন্দ্র সরকারের একক বেঞ্চ।
কিন্তু তিনি মামলাটি শুনতে বিব্রতবোধ করেন। পরে বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া, বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ, বিচারপতি এ এফ এম আবদুর রহমান, বিচারপতি ফরিদ আহমেদ ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের একক বেঞ্চে তার পুনরাবৃত্তি হয়।
এরপর রিটের নথি প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানোর পর তিনি বিচারপতি মো.আবু জাফর সিদ্দিকীর বেঞ্চে মামলাটি নিষ্পত্তির জন্য পাঠান। দুই পক্ষের বক্তব্যের শুনানি শেষে বিচারক গত মঙ্গলবার এ বিষয়ে রায়ের জন্য ১ মার্চ দিন নির্ধারণ করে দেন।
সূত্র ঃ বিডি নিউজ ২৪ ডটকম
সংবাদটি শেয়ার করুন