মোস্তফা মোহাম্মদ:
FIITS FOUNDATION-এর আমন্ত্রণে ঢাকায় আসলেন, গাইলেন, মাতলেন, মাতালেন–তিনি ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়; ‘পঞ্চকবিকন্যা’খ্যাত ভারতীয় সংগীতশিল্পী। বাবা সত্যপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় আজ থেকে ৮০ বছর আগে ১০ বছর বয়সে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার পালং অর্থাৎ আজকের শরীয়তপুর জেলা সদর থেকে কলকাতায় পাড়ি জমান। ঋদ্ধির বাবা এখনো জীবিত; চোখে কম দেখেন, বয়স ৯০ বছর–বয়সের ভারে কিছুটা ন্যুব্জ।
ঋদ্ধি এর আগেও বহুবার বাংলাদেশে এসেছেন গান গাইতে; কিন্তু এবারের আসাটা মানবিক ও কল্যাণকর কাজে–দূরারোগ্য রোগীর চিকিৎসা-সহায়তা-তহবিল গঠনের নিমিত্তে চ্যারিটি-শো-তে গান গাইতে। ২৬ মে দুপুরে ইন্ডিগো বিমানে এয়ারপোর্টে নেমে সোজা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট সেগুনবাগিচার অডিটোরিয়াম এবং গান পরিবেশন–একটানা রাত ১০টা পর্যন্ত; এই হলো ঋদ্ধির পঞ্চকবিপ্রেম ও দায়িত্ববোধ।
আয়োজকদের ক্লিয়ারেন্সজনিত দেরির জন্যই মূলত এই তাড়াহুড়ো। তবুও শুদ্ধসংগীতচর্চা ও পরিবেশনের গীতিশুদ্ধ কালাকানুনে সমৃদ্ধ অডিয়েন্স। সমাজের বোদ্ধাস্তরের অনেকেই ধন্যবাদ দিয়েছেন শিল্পীকে, আয়োজক-প্রতিষ্ঠানকে। বর্ষীয়ান শিল্পী খুরশিদ আলম, লেখক-রাজনীতিক আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব জনাব কবির বিন আনোয়ার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহীত উল আলমসহ অনেকেই ঋদ্ধির গান পরিবেশনের রীতি ও গায়কীর প্রশংসা করেন।
২৬মে দুপুর থেকে ৩০মে দুপুর পর্যন্ত শিল্পী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশে ছিলেন। ২৭মে ঘুরে দেখেছেন ঢাকা শহর, খেয়েছেন চা-সিঙ্গারা-আইসক্রিম-কফি। ২৮ তারিখ সকালে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ দেখার উদ্দেশ্যে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল হয়ে বঙ্গবন্ধু-যমুনা সেতু পাড়ি দিয়ে দুপুর ৩টায় শাহজাদপুরে গিয়ে পৌঁছান। কাঙ্ক্ষিত সময়ের চেয়ে ২ঘণ্টা দেরি; পথিমধ্যে টাঙ্গাইলের পাতরাইলে টাঙ্গাইলের সূতিশাড়ির নেশায় মূল রাস্তা থেকে প্রায় ৫ কিলোমিটার পশ্চিমে ঢুকে যান। এ-যেন বাঙালি নারীর সহজাত নেশা, দোষেরই-বা-কী! ঋদ্ধি তো বাংলাদেশেরই মেয়ে–তার বাপ-দাদার ভিটে শরীয়তপুর সদর; তাদের বাড়ি-ভিটেমাটি-পুকুরঘাটলার উপর দাঁড়িয়ে আছে শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল। একথা আগে জানতেন না, এবারই প্রথম জানলেন। শুধু পালং বলতে পারেন, কোনোদিন যাননি। আমি শুনে মোবাইলের বদৌলতে যাত্রাকালেই আমার পরিচিতজনদের মাধ্যমে শরীয়তপুরের বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ ও গবেষকদের কাছ থেকে জেনে যাই যে, পালং-এর চট্টোপাধ্যায়দের ভিটেমাটির উপর নির্মিত হয়েছে শরীয়তপুর সদর হাসপাতাল। এই কথা শোনার সাথে সাথে হোয়াটসঅ্যাপ করে বৃদ্ধ বাবাকে জানালেন এই কথা। জেনে খুশি হলেন যে, তাদের পৈত্রিক বাড়ি-ভিটেমাটি আজ হাসপাতাল। মানবিক ও কল্যাণকর কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে জেনে বাবাকে ছবি দেখাবেন বলে অনেকগুলো ছবি তুলিয়ে আনালেন। ওদিকে উত্তরের জেলা রংপুরে তার নানাবাড়ি।
আমরা রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছে দেখি উপাচার্য মহোদয় প্রফেসর মোহাম্মদ আজম লাঞ্চ নিয়ে সকল বিভাগীয় চেয়ারম্যানগণসহ অপেক্ষা করছেন। দূরবর্তী-শাড়িসম্পৃক্তি-অপেক্ষাজনিত ক্ষমা প্রার্থনা করে আমরা ভিসির আপ্যায়নে আপ্যায়িত হয়ে কফি খেয়ে মিউজিক ডিপার্টমেন্টে ঋদ্ধির বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হই; আমিও বলি কিছু কথা। সন্ধ্যা ৭টায় লালন-রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাতের নিমিত্তে আমরা পাবনা হয়ে কুষ্টিয়ার দিকে যাত্রা করি। কিছুটা আলো কিছুটা অন্ধকারে আলো-আঁধারির খেলায় পাবনা-বাইপাস রোডের ধারে বটবৃক্ষের তলার চায়ের দোকানে চা-বিস্কুট খেয়ে আবার যাত্রা শুরু। পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বায়ে রেখে, লালন সেতুর বুকের উপর দিয়ে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ডাইনে ফেলে ছুটে যায় আমাদের হায়েস মাইক্রো। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম চলে আসে চোখে। কুষ্টিয়া পিবিআই-এর এসপি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজ ছড়াকার সারোয়ার এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ পরিচালক ড. আমান-এর আতিথেয়তায় হালকা খাবার খেয়ে আমরা ৬ জন ঘুমিয়ে যাই। সকাল ৭টায় এসপি সারোয়ারের ফোন; ৮টা মানে ৮টায় ‘খেয়া’ রেস্তোরাঁয় যেতে হবে; আমরা সকলেই হাজির। গিয়ে দেখি টেবিলে বসে আছেন এসপি সারোয়ার, ড. আমান এবং কুষ্টিয়া চেম্বার অফ কমার্স-এর সভাপতি সন্তু দা। না চাইতেই জল–এদিকে আমাদের নিতে এসেছিলেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় কুষ্টিয়ার অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম ভাই। সজ্জন অতিথি পরায়ণ ব্যক্তিবর্গের হার্দিক আপ্যায়নে মুগ্ধ কবি-আবৃত্তিশিল্পী জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়। যিনি সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিম বাবুর পঞ্চম-প্রজন্ম। সেই সাথে গুণি আবৃত্তিশিল্পী নিবেদিতা চৌধুরী এবং ইন্দ্রাণী বোস–এরা চারজন কলকাতা থেকে এসেছেন। কিন্তু ঋদ্ধির পূর্বপুরুষের বাড়ি বৃহত্তর ফরিদপুর, নিবেদিতা আর ইন্দ্রাণীর বিক্রমপুর আর বঙ্কিম বাবু চাকরি করেছেন অবিভক্ত পূর্ব্ববঙ্গে–সেদিক বিবেচনায় এরা আমাদের পরম আত্মীয়। একই ভাষা, একই আকাশ, একই নদী, একই বাতাস–পার্থক্য শুধু কাঁটাতারে আর পদ্মার জলে!
খেয়া রেস্তোরাঁয় ২ ঘণ্টার আড্ডা শেষে রেজাউল ভাইয়ের সান্নিধ্যে লালনের আখড়ায় ১ ঘণ্টা গান শুনে শিলাইদহ কুঠিবাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে উঁকিঝুঁকি মারি–দুর্ভাগ্য আমাদের সোমবার, সাপ্তাহিক ছুটির দিন। কাচারিবাড়ির ভগ্নপ্রাসাদ দেখে পদ্মার ঘাটে কিছুক্ষণ পদ্মার পাড়ে ছবি তুলি পটাপট। ১২টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা; রেজাউল ভাই চা-কলা-বিস্কুট খাইয়ে কুষ্টিয়ার দিকে আর আমরা উল্টো রাজবাড়ি হয়ে ঢাকার দিকে। আমি রাজবাড়ির বিখ্যাত মিষ্টির দোকানী নির্মল সাহাকে ফোন করি। ওপার থেকে বলেন বাবা বেঁচে নাই ২ বছর, আমি তার ছেলে। আমি টকদই, রাজভোগ, চিড়া, মুড়ি দিয়ে লাঞ্চ সারার প্রস্তাব দিতেই পুরো টিম রাজি। দ্রুত লাঞ্চ সেরে ফরিদপুর হয়ে পদ্মাসেতু পাড়ি দিয়ে সোনারগাঁয়ের বারোদী মন্দির হয়ে পুরো টিম নিয়ে রাত ৯টায় শিল্পরসিক-গাল্পিক বাদল সৈয়দের দেয়া ডিনারে হাজির হই। ক্লান্তির ডানা বেয়ে নেমে আসে স্মৃতি। ১৮ তলার ছাদের উপরের ভ্যেনুর উপরে অসীম আকাশ আর তারাভরা রাত আমাদের ৪ দিনের ক্লান্তি দূর করে দেয়। ডিনার শেষে আমরা ফিরে আসি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউট-এর গেস্ট হাউজে, আর কবিবন্ধু আকমল ফিরে যায় তৃষ্ণার সান্নিধ্যে তার আজিমপুরের ডেরায়। পরদিন সকাল ৮টায় নিবেদিতা ও জয়দীপকে সোহাগ পরিবহনের বেনাপোল-পেট্রোপোল সীমান্ত অভিমুখী বাসে তুলে দিয়ে গেস্ট হাউজে ফিরে ঋদ্ধি, ইন্দ্রাণীকে নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে ছুটে যাই। গাড়ি থেকে নেমে লাগেজ নিয়ে গেট পেরোনোর আগে হাতে হাত রেখে বাংলাদেশের উন্নয়নের প্রশংসা করেন এই শুদ্ধসংগীতশিল্পী ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়। বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বীরোচিত মনোভাবের ফলে অর্জিত সাফল্য এবং পদ্মাসেতুর রাত্রিকালীন নির্মাণশৈলী দেখার প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন। সেই সাথে একথাও বলেন যে, তার পিতৃভূমি ‘পালং’খ্যাত শরীয়তপুরের মাটিতে পঞ্চকবির গান করবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান কর্তৃক ‘পঞ্চকবিকন্যা’ খেতাবে ভূষিত ঋদ্ধি বন্দ্যোপাধ্যায়।
সংবাদটি শেয়ার করুন