১লা জুন ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ | ১৮ই জ্যৈষ্ঠ ১৪৩০ বঙ্গাব্দ
প্রকাশিত: ৮:৪৫ অপরাহ্ণ, মে ২৫, ২০২৩
মজিদ মাহমুদ
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন পৃথিবীর সবচেয় দুখী কবি। শেলি কীটস বায়রন- এমনকি মধুসূদনের দুঃখ-কষ্টও তাঁর কাছে অল্পই।
শেষ চৌত্রিশ বছরের নির্বাক ও স্থবির মাংসপিণ্ডের জীবন বাদ দিলেও তাঁর কর্মময় সবাক জীবনের কষ্টের পরিমাণও কারো সঙ্গে তুল্য নয়।
নজরুলের জীবদ্দশায় তাঁর চার পুত্রের তিন পুত্রই মারা যান। তিনিও পরপর চার সহোদরের মৃত্যুর পথ ধরে বেঁচে ছিলেন, নাম পেয়েছিলেন দুখু মিয়া, যার নামই দুখু তার দুঃখের নাহি শেষ। তারাখ্যাপার আশীর্বাদে হয়েছিলেন বলে আরেক নাম ছিল তারাখ্যাপা। পুত্র বুলবুলের মৃত্যু তো পিতা হিসাবে তাঁর জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। মাত্র আট বছর বয়সে বাবা মারা যান। মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের কষ্ট কোনোদিন ভুলতে পারেন নি।
আট বছর বয়স থেকে নিজের ভরণপোষণের ভার নিজেকেই তুলে নিতে হয়। বেরিয়ে পড়তে হয় পৃথিবীর পথে পথে। নিজের গ্রাম ছেড়ে লেটোদলে, আসানসোলে রুটির দোকানে, ময়মনসিংহে, মাথরুনের, সিয়ারসোল, বিলাসপুরের পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে নোঙ্গরহীন এই বালককে।
ফিস দিতে না পারায় স্কুলের খাতা থেকে নাম কাটা গেছে বহুবার। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক হিসাবে চাকরি শুরু করতে হয়। অর্থের অভাবে রোগের শুরুতে চিকিৎসা করতে না পারায় চিরদিনের জন্য বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন, মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা হারিয়ে যায়। বেছে নিতে হয় প্রায় বিনা পয়সার কবিরাজি ও হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা।
মাত্র উনত্রিশ বছর বয়সে স্ত্রী প্রমীলা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে চিরদিনের জন্য শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। আর্থিক অনটনে ধারে কেনা গাড়ি, বালিগঞ্জের একটুকরো জমি বেচে দিতে বাধ্য হন। বইয়ের স্বত্ব, গানের রয়্যালিটি সব ছেড়ে দিতে হয় অল্প বিনিময়ে। তাতেও মুক্তি ঘটেনি, চড়াসুদে টাকা ধার নিয়ে কোটে উঠতে হয়েছে বহুবার। পৃত্র বুলবুলের মৃত্যুর দিনেও ছিল না লাশ দাফনের টাকা। মাত্র পাঁচ টাকার জন্য আকুতি জানিয়ে চিঠি লিখতে হয়েছে- প্রকাশক, সম্পাদক বন্ধু-স্বজনদের কাছে একাধিক বার।
স্বামী-স্ত্রী যখন অচল শয্যাশায়ী, সব্যসাচী ও অনিরুদ্ধ নিতান্ত নাবালক, তখন সংসারের একমাত্র কান্ডারি শাশুড়ি গিরিবালা দেবী হঠাৎ মহাদাঙ্গার মধ্যে নিরুদ্দীষ্ট হয়ে যান। এই অসহায় পরিবারটিকে দেখার মতো তখন আর কেউ ছিল না । অসুস্থ নজরুলকে সহাতার জন্য বহু কমিটি গঠন করা হলেও কয়েক মাসের বেশি তার পরিবারকে অর্থ সহয়োগিতা করা সম্ভব হয়নি।
নজরুল পরিবারের নামে তখনো তাঁর তথাকথিত কবি বন্ধুদের অপবাদ থামেনি। অসুস্থ নজরুলের জন্য বরাদ্দ রাষ্ট্রীয় সহযোগিতাও সহজ ছিল না। একাধিকবার তিনি শারীরিকভাবে হামলার শিকার হয়েছেন। পরধর্মে বিয়ে করার কারণে মুসলিম এবং হিন্দু কেউই তাঁকে বাড়িভাড়া দিতে চাইতেন না। মাত্র বাইশ বছরের সচল কোলকাতা জীবনে তিরিশ বারের অধিক বাসা পাল্টাতে হয়েছ। প্রথম বিয়ে বাসর পর্যন্ত গড়ানোর আগেই ভেঙে গিয়েছে।
অধিকাংশ মুসলিম সমাজ তাঁকে কাফের বলে দূরে সরিয়ে রেখেছে, হিন্দুদের কাছেও তিনি বাইরেরর লোক বলে ততোটা প্রশ্রয় পাননি। তিন বারের মাারাত্মক ম্যালেরিয়া মরতে মরতে কোনো রকম বেঁচে যান তিনি।
পুলিশের খাতায় ছিলেন বিদ্রোহী, সন্ত্রাসী; পরপর তার অনেকগুলো বই ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করে। উনচল্লিশ দিন অনশনের ফলে চিরদিনের জন্য তাঁর শরীর ভেঙে পড়ে। তাঁর জীবদ্দশায় তাঁরই কনিষ্ঠ ভাই আবুল হোসেন উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর হাতে নিহত হন।
পরদেশে আত্মীয় স্বজনহীন মৃত্যু ও দাফন বরণ করতে হয়, একমাত্র জীবিত পুত্রের হাতের মাটিও তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। এখনো নজরুল কাফের না মুসলিম সেই বিতর্ক থামেনি, অপরদিকে দুপাতা পড়া কিছু পণ্ডিত নজরুল-সাহিত্য কালোত্তীর্ণ কিনা তার ছবক দিতে থাকেন প্রতিনিয়ত।
এমন দুঃখ দুর্দশার মধ্যেও নিজেকে উজাড় করে দিয়ে বাঙালির সুখ-দুঃখের ভাষা ও সাহসের সংলাপ রচনা করে গেছেন তিনি। নজরুলের দুঃখ কেবল মনোবিলাসের দুঃখ নয়, চরম অপমান আর দারিদ্র্যের সঙ্গে শারীরিক অস্তিত্ব টিকে রাখার লড়াই।
S | M | T | W | T | F | S |
---|---|---|---|---|---|---|
1 | 2 | 3 | ||||
4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 |
11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 |
18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23 | 24 |
25 | 26 | 27 | 28 | 29 | 30 |
RED TIMES LIMITED
116-117, Concord Emporium,
Kataban, Dhaka-1205.
Mobile: 017111-66826
Email: redtimesnews@gmail.com