ঢাকা ১৩ই অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ২৮শে আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ই রবিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি


বন্ধুত্বের পঞ্চাশ বছর পূর্তি: ভারত-বাংলাদেশ

redtimes.com,bd
প্রকাশিত জুন ২৩, ২০২২, ০১:০১ পূর্বাহ্ণ
বন্ধুত্বের পঞ্চাশ বছর পূর্তি: ভারত-বাংলাদেশ

মোস্তফা মোহাম্মদ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী এবং ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্বের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন অনুষ্ঠান স্থল স্যামসন এইচ চৌধুরী মিলনায়তন,

ঢাকা ক্লাবে পৌঁছতেই একঘণ্টা দেরি–যানজট ঠেলে ছয়টার অনুষ্ঠানে সন্ধ্যা সাতটায় গিয়েই দেখি হলভর্তি দর্শক। গানের বাণী ও শিল্পির কণ্ঠমাধুর্যে কিছুটা স্বস্তি ফিরে পাই জীবনে। বক্তব্যের মাঝে কফি পানের সময় অনিন্দ্য সুন্দর শিল্পি অনিমা রায়ের সান্নিধ্যে জীবনীশক্তি ফিরে পাই দ্বিগুণ–নিজেকে ভাবি জর্জ হ্যারিসন। চোখে ভেসে ওঠে বব ডিলান, এলেন গিন্সবার্গ; সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড-এর গতি সঞ্চারিত হয় মনে ও মগজে। নিজেকে সাংস্কৃতিক যোদ্ধা ভাবতে থাকি–মুক্তিযুদ্ধের পরিপূরক।
আমি, কবিবন্ধু আকমল হোসেন খোকন, কবি-সম্পাদক নাহিদা আশরাফী, কবি-সম্পাদক সৌমিত্র দেব এবং মুক্তিযোদ্ধা, লেখক মনি খোন্দকার গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই চোখে পড়লো বীর মুক্তিযোদ্ধা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু বসে আছেন, পাশেই ডা. মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল। পরের টেবিলেই আশির দশকে ডাক্সুর জিএস ডা.মুশতাক হোসেন । আওয়ামী লীগ নেতা মৃণাল কান্তি ধর এমপি এবং অসীম কুমার উকিল এমপি আলাপে ব্যস্ত। ব্যস্তনেতা, বিতার্কিক সুভাষ সিংহ রায় পায়চারি করে অতিথিদের খোঁজখবর নিচ্ছেন।

উদীয়মান আওয়ামী লীগ নেতা, নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি ও এফবিসিসিআই-এর ডিরেক্টর, কালিহাতি-টাঙ্গালের কৃতি পুরুষ, আমার বন্ধু আবু নাসের খুব মনোযোগ সহকারে অনুষ্ঠানে আসা অতিথিদের সাথে করমর্দন করছেন।
আর চোখ ফিরাতেই বহুবর্ণিল পাঞ্জাবি ও কোটির রঙে চোখ ঝলসে দিয়ে বীরদর্পে প্রবেশ করলেন জাতিসত্তার কবি, বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা–চোখের আকাশে তাঁর সবুজ বাংলাদেশ; বুকে তাঁর সমুদ্রের বিশালতা ।

কয়েক কদম এগোতেই দেখি বেনাপোল পৌরসভার সাবেক মেয়র আশরাফুল আলম লিটনের ছোটভাই স্বপন বসে আছেন। তার ডাকে সাড়া দিয়ে পাশেই বসলাম আমরা চারজন।

 

ঘোষক হাতে তুলে নিলেন মাইক্রোফোন, শুরু হলো অনুষ্ঠান। একের পর এক তেজস্বী বক্তার ওজস্বী বক্তৃতায় চোখে ভেসে উঠলো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের দামামা, ভারতের সহযোগিতার চিত্র–বেনাপোল থেকে হিলি, হিলি থেকে রৌমারী হয়ে কলকাতা-দিল্লি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি সশ্রদ্ধ সম্মান প্রদর্শনপূর্বক আওয়ামী লীগ নেতা খায়রুজ্জামান লিটন বক্তব্যের শুরুতেই বলেন, ‘ভারতের কাছে আমি ব্যক্তিগতভাবে এবং জাতিগতভাবে ঋণী। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন, লক্ষকোটি শরণার্থীদের আশ্রয়-খাদ্য-ওষুধ-চিকিৎসা প্রদানসহ সার্বিক মুক্তি ও কল্যাণের জন্য, ভারতীয় সৈন্যদের জীবনদানসহ নানাবিধ কূটনীতিক সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের অধিবাসী হিসাবে আমি ঋণী। আর যুদ্ধকালেএবং পরবর্তীতে আমাদের দুই ভাইয়ের অর্থনৈতিক সংকটের জন্য কলকাতায় লেখাপড়া বন্ধ হবার খবরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের লেখাপড়ার দায়িত্বভার গ্রহণ করেছিলেন, সেইদিক থেকে আমরা পারিবারিকভাবে, ব্যক্তিগতভাবে ঋণী’—এই দ্বিবিধ বন্ধুত্বের ঋণ একজীবনে শোধ করার মতো নয়। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক রক্তের, মুক্তির, উন্নয়নের; ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক সৎ-প্রতিবেশি-সুলভ উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় এগিয়ে যাবার। আওয়ামী লীগ নেতা, রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন মেয়র ধর্মীয়, মানবিক, ভাষিক দিক তুলে ধরে বলেন, যে জীবন আপনি দিতে পারেন না, সে জীবন আপনি নিতে পারেন না; নেবার অধিকার আপনার নাই। ধর্ম-সংস্কৃতির দিক বিচারে, পাকিস্তানের সাথে আমাদের সম্পর্ক এক হলেও পশ্চিম-পাকিস্তানিরা আমাদের উপর অপশাসন চাপিয়ে দিয়ে, আমাদের সম্পদ লুট করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা আমাদের ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক জাতিগোষ্ঠীকে হত্যা করে, নারী নির্যাতন করে বাঙালি জাতিসত্তা নস্যাৎ করে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে বাঙালি-সংস্কৃতিকে মুছে দেবার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলো। সেই দুর্দিনে ভারত আমাদের পরমবন্ধু হিসাবে পাশে দাঁড়িয়েছে। আমাদের ভালোবাসা রক্তের।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের বন্ধুত্বের কথা স্মরণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু বলেন, গঙ্গা-পদ্মার পললবাহিত উজলধারার সাথে, মাটি ও মানুষের সাথে উভয় দেশের সাংস্কৃতিক

 

ঐতিহ্য-উত্তরাধিকার জড়িত। শতচেষ্টা করেও ভারত- বাংলাদেশের বন্ধুত্ব নষ্ট করা যাবে না। যুদ্ধদিনের রক্তক্ষরণ স্মরণ করে এই বিশিষ্ট মুক্তযোদ্ধা বলেন, আমাদের ক্রান্তিলগ্নে ভারত সহযোগিতার হাত না-বাড়ালে আমরা নয় মাসের যুদ্ধে দেশকে মুক্ত করতে পারতাম না। আমাদের বন্ধুত্ব অমিয়ধারায় প্রবাহিত হোক পদ্মায়-গঙ্গায়।
যুদ্ধদিনের কূটনৈতিক কর্মের স্মৃতি স্মরণ করে এবং মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী দেশগঠনকালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনসহ ভারত-ফেরত হিন্দু সম্প্রদায়ের দখলকৃত জমিজিরাত-বাড়িঘর ফেরত পাওয়াসহ নানাবিধ জটিলতা ও নিরসনের কালাকানুন বর্ণনা করেন তৎকালীন কূটনীতিবিদ মোহাম্মদ জমির।
আওয়ামী লীগের সভাপতি মণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্বের বহুমাত্রিক কারণ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা নানক জোর দিয়ে বলেন, সংগত কারণেই ভারত আমাদের পরমবন্ধু। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি অকুণ্ঠ ভালোবাসা জানান।
উপস্থিত সুধিজনদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে ভারতীয় হাই কমিশনার মূল্যবান বক্তব্য দেন। তিনি ভারত ও বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ক্ষেত্রে উভয় দেশের মানুষের হার্দিক সহযোগিতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ প্রত্যাশা করেন। আমি খুব আলোকিত হই শুনে যে, হাই কমিশনার শ্রী বিক্রম দোরাইস্বামী’র বাবা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ভারতের পক্ষ থেকে আমাদের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। শ্রদ্ধা সেই বীর সেনানীকে–শ্রদ্ধা জানালেন অনেক বক্তাই।
আজকের অনুষ্ঠানের সভাপতি এবং ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘ-এর কার্যকরী সভাপতি শ্রী শিশির বাজোরিয়া উপস্থিত সম্মানিত অতিথিদের নামোচ্চারণসহ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। এই আয়োজনের মুখ্য সমন্বয়ক অধ্যাপক আব্দুল মান্নান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে কথা বলেন। জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং জননেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন ও উৎপাদমুখিন রাজনীতির ভূয়সী প্রশংসা করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনকে সাধুবাদ জানান।

‘আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্যসুন্দর’র অমিয় বাণী ও বৈভবে প্রথমেই সিক্ত হই সুরেলা-কণ্ঠমাধুর্যধারায়।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনায় ছিলেন এটিএন নিউজ প্রেজেন্টার নেহরিন মুস্তফা। তার সঞ্চালনায় রবীন্দ্রনাথ-লালনের একাধিক গান গেয়ে মঞ্চে প্রাণসঞ্চার করেন বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পি এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক অনিমা রায় এবং লালনকন্যা অনিমা বড়ুয়া।
মাননীয় নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, মানিনীয় এমপি মৃণাল কান্তি ধর, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মহাশয়ের জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় নিজেকে সমৃদ্ধ করে ঢাকা ক্লাবের আড়ম্বরহীন স্মার্ট রান্নায় তৃপ্ত হয়ে রাত দশটায় বাড়ির দিকে পা বাড়াই।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক বাস্তবতার আলেখ্য এবং স্মৃতিবহুল ঘটনাপঞ্জির আলোয় আলোকিত হই সেই সময়ের দেওয়া বঙ্গবন্ধু-ইন্দ্রিরা গান্ধীর ভাষণ, আবেগপূর্ণ সহমর্মিতার বাণীবন্ধ ভিডিও-ক্লিপের প্রচার নিপুণতায়। জাতির পিতার ভাষণ, ভূপেন হাজারিকার মর্মস্পর্শী গানের সুরে দেশচেতনা ও সমাজভাবনায় উদ্বুদ্ধ হই। ভালোবাসার, দেওয়া-নেওয়ার তথ্য ও তত্ত্ববহুল অনুষ্ঠান আয়োজনে ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী হলে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণে প্রাণের বন্যা ধরা দেয় এক অসীমান্তিক মোহনায়।
ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী সংঘ’র বন্ধুত্বপূর্ণ এবং সহানুভূতিশীল মনোভাব পোষণের মধ্যদিয়ে আমাদের আগামির পথচলার হোক শুরু–জয় বাংলা; ভারত আমাদের বন্ধু, আমাদের উন্নয়নের সখা।

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

October 2024
S M T W T F S
 12345
6789101112
13141516171819
20212223242526
2728293031