ইকতিয়ার চৌধুরী
মুক্তিযোদ্ধা কোটা সংস্কার আন্দোলনের তীব্র মেরুকরণ সরকার পতনের এক দফা দাবীতে পরিণত হলে ৫ আগষ্ট ক্ষমতা হতে ছিটকে পড়েন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত তাঁর ষোল বছরের কর্তৃত্ববাদী শাসন বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী আন্দোলনের ফুঁৎকারে উড়ে যাবে তা বোধ হয় কেউই ভাবতে পারেনি। তবে শিক্ষার্থীরা যখন তাদের কোটা সংস্কারের দাবীর বিষয়ে শেখ হাসিনা সরকারের ছাড়ের পরও আন্দোলনে কোন বিরতি না দিয়ে ধাপে ধাপে দাবী আরও তীব্রতর করছিল তখন যারা এই আন্দোলনকে অনুসরণ করছিলেন তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে ছাত্র-জনতার লক্ষ্য ভিন্ন। শিক্ষার্থীদের সাবধানী পদক্ষেপ সত্বেও তা আর অপ্রকাশ্য ছিলনা।
নব্বুইয়ের আন্দোলনের পর দীর্ঘ তিন দশকেরও বেশী সময়ে বাংলাদেশ এমন তীব্র ও বিধবংসী গণঅভ্যুত্থান প্রত্যক্ষ করেনি। আন্দোলনকালে শিক্ষার্থীরা তাদের রাজনৈতিক অবস্থান প্রকাশ করেনি। তাদের মিছিলে কখনও আল্লাহু আকবর কিংবা জয়বাংলা শ্লোগান শোনা যায়নি। লক্ষ্য অর্জনে অর্থাৎ একনায়কবাদী শেখ হাসিনার পতন অবধি তারা কিছুটা সহিষ্ণু ছিলেন। কিন্তু ৫ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন আন্দোলনের তীব্রতায় পদচ্যুত হয়ে ভারতে আশ্রয় নিলেন সেই সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধীদের অবয়ব ষ্পষ্ট হতে থাকল। বিকেলে গণভবন লুট থেকে শুরু করে সারাদেশে স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য-ম্যুরাল ধ্বংসের উৎসব এবং সন্ধ্যায় বাংলার স্বাধীনতার সূতিকাগার বত্রিশ নম্বরে জ্বলে উঠলো আগুন। পুড়তে থাকল বত্রিশ নম্বর- পুড়িয়ে ধবংস করে ফেলা হলো বাংলা বাংলাদেশের ইতিহাস। সারাদেশে মুক্তিযুদ্ধের স্মারক স্থাপনা, বীরশ্রেষ্ঠ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভাস্কর্য পর্যন্ত গুড়িয়ে দেয়া হলো। নিজ জন্মভূমিতে আমাদের সনাতন ভাইবোনেরা পার করতে থাকল আতঙ্কের রাত। ৩৬ জুলাইয়ে তথাকথিত ‘ দ্বিতীয় স্বাধীনতা’র রাতে সারা বাংলায় নির্বিঘ্ন সন্ত্রাস।
শেখ হাসিনার অগণতান্ত্রিক শাসন, আর্থিক খাতে নগ্ন দূর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে যুবশ্রেণির মুখোমুখি। এ ছাড়া সারা দেশে বঙ্গবন্ধুর নামে অসংখ্য ম্যুরাল-ভাস্কর্য নির্মান, দু’বছর ধরে পিতার জন্ম শতবর্ষ উদযাপন, আগষ্ট জুড়ে শোক পালন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে মুজিব কর্নার প্রতিষ্ঠা, সরকারী প্রচারণায় বাংলাদেশকে ‘ল্যান্ড অব মুজিব’ উল্লেখ এবং পরিবারের সদস্যদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরীর মধ্য দিয়ে তাঁর পরিবারকেন্দ্রিক মনোবিকৃতি দেশবাসীর মাঝে শেখ হাসিনার গ্রহণযোগ্যতা হাঁটুর নিচে নামিয়ে আনায় ৫ আগস্ট সারা বাংলায় তাঁর জন্য বুক চিতিয়ে কাউকে আর দাঁড়াতে দেখা গেলনা। বঙ্গবন্ধু কন্যা, এবং স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগের জন্য যা এক চরম বিপর্যয়। বিপর্যয়ের আরও একটি বড় কারণ অনেক দামে পাওয়া এই বাংলা যে কারো দানে পাওয়া নয় তা স্বীকারে কার্পন্য। মনে পড়েনা বঙ্গবন্ধু কিংবা শেখ হাসিনা মুজিবনগর যেখানে ১০ এপ্রিল ১৯৭১ প্রবাসী সরকার গঠিত এবং ১৭ এপ্রিল তাঁদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছিল সেখানে গিয়েছেন কিনা । বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কোন উপযুক্ত স্বীকৃতিও আমাদের গোচরে আসেনা।
পরিবারতন্ত্র বা ব্যক্তিপূজা একধরণের মনোরোগ যা বর্তমানে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত। ব্যক্তিপূজার বাইরে নয় দেশের আরেকটি প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি। তারা দীর্ঘদিন হলো একজন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান করে রেখেছেন। বাংলাদেশের মতো উপমহাদেশের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোও এই রোগবালাই থেকে মুক্ত নয়। যেমন ভারতের নেহরু/গান্ধী পরিবার, শ্রীলঙ্কায় শেখ হাসিনার মতো ক্ষমতাচ্যুত রাজাপক্ষ ফ্যামিলি, পাকিস্তানে নওয়াজ কিংবা ভূট্টো পরিবার। অনেকক্ষেত্রে যোগ্যতা না থাকা সত্বেও এই পরিবারগুলো এবং তাদের সাঙ্গপাঙ্গরা বার বার ক্ষমতায় ফিরে আসছে। এর বড় কারণ রাজনৈতিক দলগুলোতে গণতন্ত্রহীনতা। দলগুলোর নেতা কিংবা নেত্রী যদি কাউন্সিলর/সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে নেতৃত্বে আসতেন তবে পরিবারতন্ত্র দীর্ঘকাল স্থায়ী হতো না।
ব্যক্তিপূজার ফাঁদে আটকা আওয়ামী লীগ কি তাদের একনায়কতান্ত্রিক শাসন সৃষ্ট আগষ্ট বিপর্যয় কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? অনেকে বিশ্বাস করেন, যে দলটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা তারা তা পারতে পারে। এই মুহুর্তে দেশে কোন সংগঠিত রাজনৈতিক দল নেই। বিএনপি বড় দল হলেও অতীত অভিজ্ঞতা থেকে দেশবাসী জানেন তাদের শাসনকালও দূর্নীতিমুক্ত নয়। তাছাড়া দলটিতে রয়েছে কোন্দল। গণ আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের করুণ পতন হলেও দলটির গণভিত্তি এখনও অটুট। সেক্যুলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজ এখনও দলটিকে সমর্থন করতে পারে যদি শেখ হাসিনাসহ দুর্নীতিবাজদের সরিয়ে দেয়া হয়। দ্বিমত থাকলেও বলা যায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সুশীল সমাজের কম বেশী প্রভাব রয়েছে। জামায়াত ইসলামী নেতা মরহুম মতিউর রহমান নিজামী একবার বাংলাদেশে ইসলামী বিপ্লবের সাফল্য প্রসংগে বলেছিলেন যতদিন না দেশের সুশীল সমাজ আমাদের আস্থায় নেবে ততদিন এদেশে ইসলামী বিপ্লবের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় রাজনীতিতে যোগ দেবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। তাকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে নিয়ে আসা কোন বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত হবে বলে মনে হয়না। জয়ের সাম্প্রতিক সময়ের বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় সুস্থির চিন্তার বেলায় যথেষ্ঠ দরিদ্র তিনি। এর সমর্থনে কিছু উদ্ধৃতি দেয়া যায়ঃ
শেখ হাসিনা আর রাজনীতিতে ফিরবেন না, তিনি হতাশ- জয়, ৬ আগষ্ট/ বিবিসি।
শেখ হাসিনা মরে যাননি, আমরা কোথায়ও যাইনি- জয়, ৭ আগষ্ট/ ডেইলি স্টার।
শেখ হাসিনা দেশে ফিরবেন- জয়, ৮ আগষ্ট/ কালবেলা।
আমি রাজনীতিতে যোগ দিতে প্রস্তুত- জয়, ৯ আগষ্ট/ ডেইলি স্টার।
অন্তর্বতী সরকার নির্বাচনের ঘোষনা দিলে দেশে ফিরবেন শেখ হাসিনা-জয়, ৯ আগষ্ট/ প্রথম আলো।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেননি, তিনি এখনও প্রধানমন্ত্রী- জয়, ১০ আগষ্ট/ ইত্তেফাক।
বাংলাদেশের মানুষের নাড়ীর স্পন্দন বুঝতেও সজীব ওয়াজেদ জয়ের যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে তিনি উল্লেখ করেছেন ভারত অন্তর্বতী সরকারকে দিয়ে বাংলাদেশে তিন মাসের মধ্যে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করবে(সুত্রঃ প্রথম আলো)। তার এই মন্তব্য এক প্রকার রাজনৈতিক আত্মহত্যার মতো। কেননা দেশের কোন মানুষই এমনকি আওয়ামী লীগ সমর্থকও বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতের মোড়লি পছন্দ করেননা। আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, ভাষা সংগ্রামী মাওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ যে সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু যে দলকে নিয়ে গেছেন শেকড় থেকে শিখরে- লক্ষ লক্ষ মানুষের রক্ত আর মৃত্যুতে জন্ম হয়েছে জাতি রাষ্ট্র বাংলাদেশের সে দলটি এখন কর্তৃত্ববাদী শাসনে নেতৃত্ব শূণ্য।
অন্তর্বর্তী সরকার দেশের জনগনকে রাষ্ট্র সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাদের লক্ষ্য ফ্যাসিজমের মূলোৎপাটন করে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। একটি অবাধ জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে তারা ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলোচনা শুরু করেছেন। জাতির প্রত্যাশা নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত সব দলের অংশগ্রহণে একটি অংশদারিত্বমুলক নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন অবধি রাজনৈতিক দলগুলোর সংগে আলোচনায় সরকার সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকে আমন্ত্রণ জানায়নি। ইতিমধ্যে ১ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালতে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার একটি আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলও ষ্পষ্ট করে বলেছেন কোন ব্যক্তি কিংবা সংগঠনকে রাজনৈতিক অধিকার থেকে নিবৃত করা যায়না। রাজনৈতিক অধিকার/মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া অসাংবিধানিক। অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করছেন সেহেতু তাদের উচিৎ হবে যাতে আওয়ামী লীগও নির্বাচন এবং রাষ্ট্র সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত হবার সুযোগ পায়। আমরা বর্তমানে একটি সংঘাতপূর্ণ সময় অতিক্রম করছি। জাতীয় অগ্রগতির প্রয়োজনে এখন দরকার বিবাদ কমিয়ে আনা। ‘ন্যাশনাল রিকন্সিলিয়েশন’ নতুন কোন ধারণা নয়। রাজনীতিতে আদর্শিক সংঘাত ইউরোপ থেকে আমেরিকা কমবেশি অনেক দেশেই রয়েছে। যেমন ইউএসএ, স্পেন প্রভৃতি। আমরাও তার বাইরে নই। কাজেই দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার উদ্যোগ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে।
(ইকতিয়ার চৌধুরীঃ সাবেক রাষ্ট্রদূত, মুক্তিযোদ্ধা ও বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক)
সংবাদটি শেয়ার করুন