ঢাকা ২১শে সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ, ৬ই আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৭ই রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিজরি


বাংলা ও বাঙালির বিকল্প উপন্যাস

redtimes.com,bd
প্রকাশিত এপ্রিল ২৮, ২০২৩, ১১:১২ পূর্বাহ্ণ
বাংলা ও বাঙালির বিকল্প উপন্যাস

হরিপদ দত্ত

আহমদ বশীর। আত্ম-পলাতক কথাশিল্পী। তার লেখা একটি উপন্যাসের নাম, ‘তিথিডোর : মুক্তিযুদ্ধের একটি উপন্যাস হতে পারতো’।
বিকল্প গদ্যে, বিকল্প রীতিতে, বিকল্প সাহিত্য দর্শনে লেখা অহমদ বশীরের উপন্যাস। ব্রিটিশ উপনিবেশিক কালোত্তর পাকিস্তানী আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ভাষা সংস্কৃতিভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উত্থানকালের অধীনতা বিরোধী লড়াইয়ের যুগ নিয়ে লেখা এই উপন্যাস। অধীনকালে বসে নয়, বরং স্বাধীন কালের কণ্ঠস্বর। সাংঘর্ষিক নগর পলাতক মানুষের এক অস্থির কাল। আতঙ্ক, ঘৃণা, রক্ত, অশ্রু, প্রতিহিংসা, প্রতিরোধ, উদ্বেগ, স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণের আলো এবং আধাঁরীর কাল।

গতানুগতিক উপন্যাস পাঠের অভ্যাসকে পাশ কাটিয়ে এগোতে না পারলে এই উপন্যাসের ছায়াচ্ছন্ন জটিল অলিগলি পথ পেরিয়ে গুহামুখের তির্যক আলোর কাছে পৌঁছানো যাবে না। লেখার ভেতর ছায়াশরীরে যে লেখক অবস্থান করছেন, কে তিনি? উপন্যাসের ভেতর তিনি কি আত্ম-গোপন করে আছেন একজন লিবারাল মতাদর্শী রাজনীতির কথক? উগ্র জাতীয়তাবাদী বিপ্লববাদী? কেননা একটা অগ্নিগর্ভ সময়ের প্রামাণিক ঐতিহাসিক তথ্য উপন্যাসটির পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে। অন্যদিকে একই সময়াধারে পাই নরমপন্থিদেরও। তাদের পারিবারিক বিপন্নতাও পাঠককে উদ্বেলিত করে।

উপন্যাসটির নাম তিথিডোর, এক অতলস্পর্শী গভীর রহস্যময়তার ইংগিত করে। লেখক জানাচ্ছেন বাড়িটির মালিকানার বদল হলেও আদি নামটি বহাল রয়েছে। তিনি স্পষ্ট জানাননি আদি মালিক কারা এবং কেনইবা এই বাড়িটি পরিত্যাগ করলো তারা। তারপর তারা কোথায় গেল। পাঠকের বুঝতে অসুবিধে হয় না। তাদের মনে পড়বে সৈয়দ ওয়ালিউল্লার একটি তুলসী গাছের কথা গল্পটি। তিথিডোর ঘিরে কত প্রেম, কত মায়া, কত আশা আর স্বপ্ন বৃষ্টি ভেজা মাটির মতো ভেজা ওম ছড়িয়ে আছে। কেবল বর্তমানই নয়। অতীতেরও সেই সাত চল্লিশে বাংলা ভাগের স্মৃতিও। এসব লেখক স্পষ্ট বলেননি, কিন্তু পাঠক বুঝতে পারে। পাঠক হিসেবে আমরা টের পাই তিথিডোর বাড়িটি ঘিরে অতীত এবং বর্তমানের প্রাচীন এবং নবীন মিশেল এক অদৃশ্য বিষণœœতা লেপটে আছে। উপন্যাসটির পরিণতির স্মৃতির যে বিচ্ছেদ বিষাদ তা তো মানুষের অক্ষয় দুঃখেরই মহাশূন্যতা।

তিথিডোর। চন্দ্রকলার হ্রাসবৃদ্ধির শুভ তিথির বন্ধন। গার্হস্থ জীবন গন্ধী নিদ্রাবাস। গ্রাম্য নয়, বরং নাগরিক। প্রেম, ভালোবাাসা, সুখ, সুখাভিমান, নর-নারীর যৌথ এক পৃথিবী। রূপকল্পে বলতে হয় নারী পুরুষের রাজনৈতিক বন্ধন মুক্তির অভীক্ষার ভেতর জড়াজড়ি করে আছে মিলন মৈথুন জগতের অত্যাশ্চর্য বিস্ময় এই তিথিডোর। রাষ্ট্র, রাজনীতি, যুদ্ধ, শান্তি, স্বপ্ন. কল্পনা আর ভীতিকর ছায়া বিছিয়ে আছে এখানে। মোট কথা যুদ্ধ, প্রেম, ইতিহাস নিয়ে এই সাহিত্যের আয়োজন। এই ত্রিধারার ভেতর আবর্তিত হয়েছে বইটির আখ্যান। এই আখ্যানের ভেতর আমরা রাজনৈতিক মতাদর্শের দ্বন্দ্বও দেখতে পাই পরিবারের ভেতর। পিতা ও পুত্র যেন পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। নাট্য শিল্পে নয়, বরং উপন্যাসে এমনি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি উপন্যাসটিকে উচ্চতায় পৌছে দিয়েছে।

আমরা যারা গল্প উপন্যাস লিখি তাদের ধারণা কথাকারগণ কবিদের গ্যালাক্সী থেকে বহু আলোকবর্ষ দুরের গ্যালাক্সীতে বসবাস করেন আবেগ প্রকাশের ক্ষেত্রে। ধারণাটি একটি প্রাচীন সংস্কার মাত্র। কবিরা কল্পলোক বিলাসী, কথাকারগন বাস্তববাদীÑধারণাটি কি ঠিক? আসলে কথাকারদের আবেগ লুকিয়ে থাকে আখ্যানের জটাজালে, সহজে তা দৃশ্যমান নয়। কবিদের আবেগ লুকানোর জায়গা নেই, তাদের ভাবের ঘরে চুরী হয়ে যায়। তিথিডোরে আবেগ ছড়িয়ে আছে পাতায় পাতায়্ এই উপন্যাসের শেষ পৃষ্ঠায় বিদায় বেলায় সাইফ বলে শবনমকে, আমি কি একবার শেষ বারের জন্য ‘জয় বাংলা’ বলতে পারি?

এ বাক্য কেবল আবেগই নয়, সাদামাটা কবিতাও নয়, এ যেন মহাকাব্যিক মহাকাশের মহা বিষ্ফোরণের মতো শিহরণ জাগানো বিষণœœঘেরা দুঃখবাদী মানব প্রজাতির ভাষা সৃষ্টির আদি উচ্চারণ। ভাষাবাদী দার্শনিকেরা তাকেই বলেন মানবের ভবিতব্য। তিথি ডোরের ট্র্যাজেডি এখানেই লুকিয়ে। অন্যদিকে ট্রাজেডি আর দ্বন্দ্ব কেবল নাট্যসাহিত্যের ফিলজফি নয়, উপন্যাসেরও। সাতচল্লিশে অখন্ড ভারতবর্ষকে খন্ডায়িতকরণ নিয়ে যেমনি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল, একাত্তরে পাকিস্তান ভাঙা নিয়েও তেমনি দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এই দ্বিমাত্রিক দ্বন্দ্ব উপন্যাসটিকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা উপন্যাসে এমনটা খুব কম মেলে। একই পরিবার কিংবা স্বজনদের ভেতর এই রাজনৈতিক মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব উপনিবেশবাদী দর্শনের সঙ্গে উত্তর উপনিবেশবাদী দর্শনের দ্বন্দ্বকেই স্পষ্ট করে তোলে। পাকিস্তান ভেঙে যাবে বলে উপন্যাসে যে বা যাদের আমরা পাঠকেরা আতঙ্কিত হতে দেখি, আসাম সীমান্তের করিমগঞ্জ নিয়ে তাদের মনোলোকেই লেখকের বিচরণ। কেবল মর্মস্পর্শীই নয়, মানুষের মনকে চেনার লেখকের তৃতীয় নয়নের ক্ষমতা প্রকাশে ও মুগ্ধ হই আমরা।

একাত্তরের যুদ্ধটা যে কেবল জাতীয় যুদ্ধ বা জাতির যুদ্ধ ছিল তা যত সত্য, ঠিক ততটা সত্য ব্যক্তিক যুদ্ধ বা ব্যক্তির যুদ্ধ। এ যুদ্ধ কেবল সঙ্ঘবদ্ধ যুদ্ধ নয় ব্যক্তির একাকী যুদ্ধও। এই উপন্যাসের এই দৃষ্টিকোন সাহিত্যের অন্তগৃঢ় সত্যেরই নির্দেশ করে। তিথিডোর নামের বাড়ি থেকে বেরিয়ে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে যে মেয়েটি স্কুলে যায় তার জিজ্ঞাসা, তার মনের অতলের প্রশ্ন পাঠককে বিচলিত করে। আঠার শতকের ঘোড়ার গাড়ির স্মৃতি শতাব্দি পেরিয়ে চলমান বর্তমানের সামনে দাঁড় করায় পাঠককে। সেই মেয়েও যে মুক্তি চায়, অন্য রকম মুক্তি, সেই মনস্তাত্বিক লড়াইটা উপন্যাসের চারপাশের জানালাগুলো খুলে দেয়। সেই মেয়েটিকে যে নদী বুড়িগঙ্গা গোপনে তার পাশে ডেকে নেয়, তার আত্মপ্রশ্ন কি? গোপন জিজ্ঞাসাটা কি ছিল, ও নদী কোথায় তোমার ঘর? উপন্যাসের লেখক পাঠককেরও এক গোলক ধাঁধাঁয় টেনে নেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহিত্যে এমনি একটি বিস্ময়কর বিশ^নির্মাণ খুব কম মেলে।

তিথিডোর উপন্যাসের শুরুতেই আহমদ বশীর পাঠককে হতচকিত করে দেন তোশকের তলায় এক পান্ডুলিপি আবিস্কারের ঘটনার সামনে ঠেলে দিয়ে। এ যেন প্রাচীন কোনো আখ্যানে বর্ণিত হারানো সময়ের পান্থপথিকের আত্মকথন। এমনও তো হয় যে হাজার লক্ষ বছরের প্রাচীন গুহাবাসীর দেহাবশেষের জীবাশ্ম যেন গুহার ভেতর আবিস্কার। কেননা লেখক জানাচ্ছেন, পান্ডুলিপি, ছেঁড়া ছেঁড়া কাগজ। এখানে সেই প্রস্তর যুগের গুহামানবের জীবাস্মের প্রতিকল্প হয়ে দাঁড়ায় এই কাঁচা হাতের লেখা এলোমেলো জীবন পান্ডুলিপি। লেখকের এই শিল্প-কৌশল উপনিবেশ যুগের সাহিত্যকলা রীতিকে ডিঙিয়ে উত্তর-উপনিবেশিক শিল্প স্মৃতির সামনে দাঁড় করায়। আমরা যারা গড়পড়তা পাঠক, তারা বইয়ের পাতায় ঝুঁকে পড়ি। কৌতূহল নাড়া দেয়। আন্দোলিত হই।

স্মৃতি। স্মৃতিভ্রষ্ট বাঙালিকে এই উপন্যাস ঝাঁকুনি দিয়ে যায় লেখকের নির্মাণ কৌশল। স্মৃতিকে জাগ্রত করার প্রচেষ্টায়। স্মৃতি হচ্ছে বাস্তব দুনিয়া থেকে হারিয়ে যাওয়া অস্পষ্ট এক প্রকল্প। মানুষের মগজ কোষে স্টোর হওয়া এমন এক বাস্তব যা বিষাদ বিষণœœতায় পরিপূর্ণ। লেখক এমন এক জটিল সময়ে তিথিডোর রচনার প্রকল্প হাতে নেন যখন বাঙালির কাছে মহান সেই মুক্তিযুদ্ধ জনবসতি থেকে দূরবর্তী নীরব নিস্তদ্ধ অস্পষ্ট গোরস্থানের রূপ নেয়। নির্মম এই বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে লেখকের পক্ষে সম্ভব হয়নি কবি মাইকেলের ‘মেঘনাধ বধ’ কাব্যের মতো বীররসের উল্টো করুণরসের সমাপ্তি রীতির বাইরে যাওয়া। পুরাতন ঢাকার যে ভৌগোলিক পরিবেশের ভেতর এই উপন্যাসের সময়াধার বন্দি তা থেকে মুক্তির পথ নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই অলিগলি সব পাল্টে গেছে। রাতভর জেগে থাকে কেবল স্মৃতি। সেই স্থান এবং কালের পুনরুত্থান কোনো দিনই সম্ভব নয়। স্মৃতির ছায়ার পেছনে ছুটেছেন লেখক তার সৃষ্টি চরিত্রের পেছনে পেছনে। অবিরাম চলা।

আহমদ বশীর তার উপন্যাসের দ্বিমাত্রিক দ্বন্দ্বকে স্পষ্ট করে তোলেন সাহিত্যের সাধারণ পাঠক এবং শিল্পের সত্যান্বেষীদের সামনে। তিনি একাত্তরের বাস্তবতায় মানুষকে বিপন্নতার গভীর অন্ধকার খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছেন। আবার কিনা জীবনের অদম্য আকাক্সক্ষাকে তীব্র আগুনের মতো জ¦ালিয়ে দিয়েছেন। পাঠক বিচলিত হয় হত্যা আর রক্তের সামনে। আবার আচমকা অন্ধকার দীর্থ করে জয়বাংলা ধ্বনিতে রক্তবীজ থেকে অঙ্কুরের উদ্ভব দেখতে পেয়ে মুক্তির স্বপ্নে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এই যে বিপরীতধর্মী মানব মন আর মগজের দ্বন্দ্ব তা কেবল এই উপন্যাসের রাজনৈতিক আখ্যানেই নয়, নরনারীর প্রেমানুভুতিতে ও ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক।

সাহিত্যের প্রয়োজনেই রাজনীতি আসবে, মতাদর্শের বির্তকও আসবে। রাজনীতি বিচ্ছিন্ন সাহিত্য কখনো হয় না, কেবল হয় বিনোদন সম্ভোগ। লেখকের মেরুদন্ড সোজা থাকতে হয় অপ্রিয় সত্যের সামনে। তিথিডোরের লেখক সে সাহস দেখিয়েছেন।
– আমরা কি চেয়েছিলাম? একটা আলাদা দেশ, মুসলমানের মাথা তোলার জায়গা। বাঙালি মুসলমানের আর জুতা হাতে নিয়ে যেতে হবে না হিন্দু জমিদার বাড়ির সামনে? (পৃ-১৬)।
– মাত্র বিশটা বছরের মধ্যে আমাদের চাঁদতারা পতাকার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল? (পৃ-১৭)।
– ওরা কোন সাহসে এ দেশে রবীন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথ করে মাথা চাপড়ায়? একদিন দেখবেন এই রবীন্দ্রনাথের গান নিয়েই পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেছে (পৃ-২৭)।

আসল রহস্যটা হচ্ছে পূর্ববঙ্গের জমিদারদের তৈরি করেছে ইংরেজের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত। জমিদারদের সিংহ ভাগই ছিল ব্রাহ্মণবাদী মতাদর্শে বিশ^াসী উচ্চবর্গের হিন্দু। ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক তো বটেই, হিন্দু বর্ণবাদীও। নি¤œবর্গ হিন্দুদেরও সাহস হয়নি ব্রাহ্মণ-কয়েত জমিদার বাড়ির সামনে দিয়ে জুতো চটি পরে হাঁটা। অন্যদিকে রবীন্দ্রবির্তক আরো জটিল। প্রশ্নটা পৌত্তলিক হিন্দুধর্ম আর নিরাকার একেশ^রবাদী ব্রাহ্মধর্মের দ্বন্দের ভেতর। দ্বন্ধ¦ এমন পর্যায়ে পৌছে যে হিন্দু সমাজে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের গান অর্থাৎ রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধ হয়ে যায়। রবীন্দ্র সঙ্গীত নিষিদ্ধ হবার বিষয়টি পাকিস্তান যুগের নয়, উপনিবেশিক যুগেরও ফসল। ভাবতে অবাক লাগে ব্রাহ্ম রবীন্দ্রনাথের নোবেল প্রাইজ প্রাপ্তির সংবাদে উগ্র ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজের একাংশের কাছে পীড়াদায়ক হয়ে ওঠে। কি বিচিত্র এই দেশ সেলুকস।

লেখককে ধন্যবাদ একারণেই যে তিনি বর্ণনা রীতিতে অত্যন্ত সতর্কতার ভেতর স্পর্শকাতর হিন্দু ব্রাহ্মণ্য সম্প্রদায়িক বর্ণবাদ এবং রবীন্দ্র বিতর্ককে উপন্যাসে এনেছেন। আখ্যান তৈরি না করে নাট্যফর্মে ইতিহাসের এই অধ্যায়কে তুলে আনা তার শিল্প দক্ষতারই প্রমাণ।

নারী আর যুদ্ধ, একে অন্যের প্রতিপক্ষ। তিথিডোর উপন্যাসে নারীর সঙ্গে সংঘাতময় রাজনীতির যে দ্বন্দ্বতৈরি হয় তা পাঠকমাত্রকেই নারীর সঙ্গে সংঘাতময় রাজনীতির যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয় তা পাঠকমাত্রকেই বিচলিত করবে। দেখা যায় দ্বন্দ্ব দ্বিমাত্রিক থাকে না, বহুমাত্রিকে ছড়িয়ে যায়। প্রেমের সঙ্গেও এই জটিল দ্বন্দ্ব সাপের মতো কুন্ডলাকার ধারণ করে। ৩০ এবং ৩১ পৃষ্ঠায় খুদে দুটি পত্র আছে। প্রেমপত্র। কিন্তু রস চুইয়ে পড়া আবেগ নেই। যুদ্ধ, প্রেম, আতঙ্ক আর অন্তর্ভেদী কৌতূহল মিলে এক জটিল মহাকাশ তৈরি করেছে এই চিঠি।

তিথিডোর কেবল আঞ্চলিকতার ঘেরাটোপে বন্দি থাকতে চায় না। সে পাখা মেলতে চায় আন্তর্জাতিক আকাশ সীমায়। তাই ভিয়েতনাম যুদ্ধের কথা আসে। সমাজের শ্রেণিও চিহ্নিত হয়। মধ্যবিত্ত চরিত্র শবনমের বাবার দোকানের কথা জানা যায়। ময়নার মায়ের মতো সর্বহারা চরিত্রও ওঠে আসে। অশোক হাজরার মতো দ্বিধা-দ্বন্দ্বের ধর্মীয় সংখ্যালঘু চরিত্ররাও স্থান পায় উপন্যাসে। যে কিনা বলে, হোন মিয়ারা আমাগো কলকাতায়, একজন আওয়ামী লীগার থাকেন ….। অশোকের এমনি উক্তির ভিতর দিয়ে বাংলা ভাগের অভিশপ্ত রক্তে গড়া জটিল এক মানস চৈতন্যের কিংকর্তব্যবিমুঢ় জনগোষ্ঠীর কথাও আমাদের জানিয়ে দেন লেখক।

লেখক যে একজন উগ্র বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ^াসীÑ এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেখানে ভয় একটাই থাকে, উগ্র জাতীয়তাবাদ ব্যক্তি মানুষকে ভয়ংকর ফ্যাসিবাদী করে তোলে। বইয়ের লেখক এ বিষয়ে সর্তক ছিলেন। তাই তিনি সাম্যবাদী রাজনৈতিক দর্শনে বিশ^াসী সলীল চৌধুরীর গণসংগীতের কথা জানান। কিন্তু লেখক যা জানাননি তা হচ্ছে সেই অগ্নিঝরা দিনে বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের সমান্তরালে রাজপথে লড়াই করেছে সমাজতন্ত্রীরাও। আত্মবলি দান করেছে। মুক্তিযুদ্ধ করেছে। জয়বাংলা স্লোগানের প্রতিস্পধী স্লোগান ওঠেছে জয় সর্বহারা। তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনার পাশাপাশি কি শোনা যায় নি তোমার বাড়ি আমার বাড়ি নকশাল বাড়ি, নকশাল বাড়ি? দেয়ালে কি লেখা হয়নি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববঙ্গ কায়েম কর? জাগো জাগো বাঙালি জাগোর পাশাপাশি কি উচ্চারিত হয়নি, জাগো জাগো সর্বহারা জাগো?

আহমদ বশীর একজন মায়ের আর্তবিলাপের অগ্নিকুন্ডে আমাদের ঠেলে দেন ৭৯ পৃষ্ঠায়, আমার পোলারে ফিরায়া আইনা দাও। আমি সোনার বাংলা চাই না। নৌকা চাই না। আমার পোলারে ওরা গুল্লি কইয়া মারছে।

একটি যুদ্ধ একটি বিজয়, একটি পরাজয়, একটি স্বপ্ন, একটি দুঃস্বপ্ন, একটি মৃত্যু, একটি কবর থেকে পুনরুত্থান, একটি অন্তিম অন্ধকার, একটি উদয়াচল, সব জড়াজড়ি করে উপন্যাসে প্রাচীন কঠিন হিমশিলা হয়ে আছে। স্বাধীনতা আর মুক্তির নামে একজন ব্যক্তি মানুষ আর চলমান সমাজের দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ব্যক্তির শোক আর মর্মবেদনার সঙ্গে সঙ্ঘবদ্ধ সমাজ মানুষের স্বপ্ন-উল্লাসের অসম সংঘাত তৈরি হয়। ব্যক্তি (একজন মা) সর্বহারা হয়, তার হারাবার শোকার্ত সংঘাত কান্না জনতার বিজয় চিৎকারে তলিয়ে যায়। এটিই হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের সর্ববৃহৎ ট্র্যাজেডি। লেখক মাত্র একটি বাক্যে মহাকালের এই নির্মম সত্যকে উৎঘাটন করেছেন। এখানে লুকিয়ে আছে লেখকের শিল্প দক্ষতার গোপন শক্তি।

উপন্যাসটির ভেতর এমন কিছু মহাসত্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে যা বাংলাদেশের কথাসাহিত্যে মেলে না। পাঠকমাত্রই রক্তে শিহরণ জেগে ওঠে। ৮৪ পৃষ্ঠায় উচ্চারিত হয়, ওই যে বর্ণপ্রথা আর ধর্ম এই দুই দৈত্য এদেশের জনগণের মধ্যে কোনো দিন পারস্পরিক বন্ধুত্ববোধ বা নাগরিক ভ্রাতৃত্ব তৈরি হতে দেবে না। এর পরপরই লেখক বাঙালি নারীর স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলেছেন। প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিকতাকে চপেটাঘাত করেছেন। উপন্যাসে তার এই যে রাষ্ট্রচিন্তা এবং সমাজ ভাবনার স্পষ্টতা, পাঠককে ভাবিত করতে বাধ্য।
তিথিডোর নামের বাড়িটি ঘিরে স্বপ্ন, ভালোবাসা, আনন্দ, প্রেম আর যাযাবর মানুষের চিরস্থায়ী ঠিকানার অদৃশ্যে রয়েছে মানব জীবনের চরম বিষাদের ভৌতিক আধিভৌতিক এক অভিশাপ। পান্থশালার রুপকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দেশভাগ। ইতিহাস কাউকে করুণা করে না। করেনি আদি বাসীন্দাদের। দেশান্তর ঘটে তাদের। নতুন মালিকানাও অদল বদল ঘটে। প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতার স্মৃতি চিহ্নেরই রূপকল্প এই তিথিডোর। সুলতান সাহেবকে কি ক্ষমা করেছিল তার নিয়তি? তিথিডোর তো তার অকালমৃত পুত্র সন্তানের নির্মম মৃত্যু নিয়ে স্মৃতির খেলা করে। আর শবনম বানু? তিথিডোর যেন প্রাচীন ধ্বংসাবশেষের ভেতর লুকিয়ে থাকা একটি জীবাশ্মের প্রতিকল্প হয়ে শবনম বানুর অস্তিত্ববিশেল্প নীরব দীর্ঘশাস ফেলে। এই উপন্যাসের অমৃতরস হচ্ছে লেখকের সৃষ্টির সংবাদ শবনম বানু এখন আর এই বাড়িতে থাকে না (পৃ-১১৭)।

এই সংবাদ শিল্পের এক চরম ট্রাজেডি নির্মাণ করেছে। এ ট্রাজেডি কেবল শবনম বানুর নয়, সমস্ত বাঙালি জাতির। সাহিত্য শিল্প সৃষ্টিতে আহমদ বশীরের এই দক্ষতা আমাদের কেবল মুগ্ধই করে না, নতুন চেতনায় চালিত করে। একাত্তর এবং স্বাধীনতা উত্তর স্মৃতি সাহিত্য শিল্পের মর্মে তরঙ্গ তুলে নিকট অতীতকে উল্টে পাল্টে পাঠক চিত্তে তৃতীয় বোধের এক বিশ^ নির্মাণ করে। শনবমের বাড়ি বদল কি একাত্তরের বাঙালির চৈতন্যের বদল নয়?

রাজনীতি কেবল সাপের মতো কুন্ডলায়িতই হয় না, বটবৃক্ষের জটিল গুচ্ছ শোকড়ের মতো রহস্য নির্মাণ করে। কোনটি আসল বৃক্ষকান্ড কোনগুলো শেকড় বুঝাই যায় না। একাত্তরে ওতো পশ্চিম পাকিস্তানে বাংলাদেেেশর বাঙালি অভিশপ্ত উদ্ধুদ্ধ হয়ে যায়। সাইফ এবং তার পিতা এমনি জটিলতার বন্ধি। সাইফের অব্যক্ত আর্তনাদ, বাবা তোমার ওই (পাকিস্তানী) পতাকার জন্য ভালোবাসা আমার জীবনধ্বংস করেছে। … আমি আমার মাতৃভূমি থেকে বিতাড়িত। অন্যবৃত্তে শবনমের মর্মান্তিক প্রশ্ন সাইফ ভাই, আপনারা আর বাংলাদেশে আসবেন না? এ কেবল পাকিস্তান আর বাংলা ভাগের শিকার উদ্বাস্তু বাঙালি হিন্দু মুসলমানেরই দ্বৈত কণ্ঠস্বর নয়, ইউক্রেনিয়া, ফিলিস্তিনি, রোহিঙ্গা সহ সারা বিশ^ উদ্বাস্তুর কণ্ঠস্বর। এখানেই তিথিডোর উপন্যাস বাংলার সঙ্কীর্ণতা ছড়িয়ে আন্তর্জাতিকতার দিগন্তে উঁকি দিতে চায়। অন্য প্রান্তে যুদ্ধশেষের স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে একি প্রশ্ন শবনমের যুদ্ধ না কি এখনো শেষ হয় নাই?

আহমদ বশীর তার পাঠককে নিষ্ঠুর নির্মম সত্যের সামনে ঠেলে দেন। রক্ত হিম হয়ে আসে, সাতচল্লিশের পর … ওরা (হিন্দুরা) চলে না গেলে তোমার বাবা কিংবা আমার বাবা এই ঢাকা শহরে বাড়ি বানাতে পারত না, তাইনা? (পৃঃ১৫১)। আমরা বঙ্গভঙ্গের ফলে সৃষ্ট বাংলাদেশের নেতা বুদ্ধিজীবী গ্রন্থকার (পৃঃ১৫২)। বাংলা সাহিত্যে আহমদ বশীরই বোধ করি একমাত্র কথাশিল্পী যিনি সাহসের সঙ্গে এমনি প্রশ্ন করতে পারেন। আশ্চর্য এটাই যে যুদ্ধ শেষে বাংলাদেশ স্বাধীন হয় । কিন্তু ব্যক্তি শবনমের যুদ্ধ শেষ হয় না। কেন হয় না, এর উত্তর বড় সহজ নয়। কেন না প্রশ্নটি রাজনীতির মতাদর্শের।

আমাদের বিশ^াস উপন্যাসটির নির্মাণ কৌশলে লেখক যে সনাতনীরীতিকে আঘাত করেছেন তাতে আচমকা পাঠে আমাদের মেরুদন্ডের ভিতর দিয়ে ঠান্ডা ¯্রােত বয়ে যাবে। রাজনৈতিক আখ্যানের আড়ালে চাপা পড়েনি নন্দন তাত্ত্বিক উপমা, অলঙ্কার, চিত্রকল্প এসেছে বিষয়কে চিহ্নিত করে। যেমন-
ক. কোটি প্রাণ এক সাথে জেগেছে অন্ধরাতে, নতুন সূর্য ওঠার এই তো সময় (পৃ-৬০)।
খ. মোমবাতির আলোর পেছনে বাবার বিশাল একটা ছায়া। মোমবাতির আলোতে ছায়াটা কাঁপছে। (পৃ-১১১)।
গ. নদীর পার ছুঁয়ে আসা বাতাস, বকের পালক চুরি করে আসা বাতাস শবনমের ওড়নার প্রান্ত উড়িয়ে আনে সাইফের আঙ্গুলের কাছাকাছি। পৃ-১১৩।
ঘ. জানালার নীলাভ পর্দা বেয়ে একটা সাদা আলোতে ঘরটা ভরেছিল। (পৃ-১২৪)।
ঙ. মসজিদের মিনারে চাঁদ তারায় শেষ সূর্যাস্ত ছায়া ফেলেছে (পৃ-১৩২)।

মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বিষন্ন সময়ে রচিত তিথিডোর যুদ্ধ আখ্যানকে আচমকা ধাক্কা দিয়ে স্মৃতি ও ধূসর কালকে উত্তুংগ ঢেউয়ের সামনে দাঁড় করিয়েছে। উপন্যাসের শেষ বা অন্তিম স্তবকটি কার কণ্ঠস্বর? সে কি কোনো উদ্বাস্তু? সে কি কোনো অচরিতার্থ প্রেম? সে কি অস্পর্শ অদৃশ্য অনাগত কোনো সময়? না কি অসমাপ্ত আর একটি যুদ্ধ?

হরিপদ দত্ত : কথাসাহিত্যে বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত একজন লেখক

সংবাদটি শেয়ার করুন

September 2024
S M T W T F S
1234567
891011121314
15161718192021
22232425262728
2930