বিএনপি ও জামাত । আদর্শিক অমিল থাকার পরও ভোটের রাজনীতিতে একে অপরের পরিপূরক । বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন দায়িত্বশীল নেতা ও জামায়াত ইসলামীর জাতীয় কর্ম পরিষদের প্রভাবশালী একজন নেতার সঙ্গে আলাপকালে উভয়ের সূরে এমনটাই আভাস মিলেছে।
কিছু অভিমান কিছু চাওয়া পাওয়ার দূরত্বের অবসান ঘটিয়ে শুধুমাত্র নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় একে অপরের পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাদের । শুধু তাই নয়, ২০ দলীয় জোটের বাইরে থাকা সমমনা আরও বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলগুলো আগামী দিনে তাদের পাশে রয়েছে বলে দাবি করছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি বাংলাদেশের একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক দল, আর জামায়াত ইসলামী বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরীক রাজনৈতিক দল। প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের যেমন রাজনৈতিক কর্মপরিধিতে ভিন্নতা রয়েছে তেমনি আদর্শিক পার্থক্যও বিদ্যমান। জামায়াত ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির যে জোট এটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও ভোটের জোট এর বাইরে কিছু দেখা ও বলার সুযোগ নেই।’
আগামীর আন্দোলনে জামাতকে সঙ্গে পাওয়া প্রসঙ্গে খন্দকার মোশারফ বলেন, ‘জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারের (আওয়ামী লীগ) দমন নীতির বিরুদ্ধে শত প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবেলা করেও বিএনপি তার লক্ষ্যে পৌছাতে সার্বিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছে। আর জোটের শরীক দল হিসেবে জামায়াত ইসলামী বিএনপির পাশে রয়েছে কী না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সেই প্রস্তুতি কী সেটা এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না, না বলাটা রাজনৈতিক কৌশল। বরং প্রস্তুতি সম্পর্কে বলে দেয়াটা সমুচিত নয়। সময়েই বলে দেবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট কোন পথে অগ্রসর হতে যাচ্ছে।’
একদিকে ৩ ফেব্রুয়ারি শনিবার বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সভার দিন ধার্য করা হয়েছে। অপরদিকে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি দলটির খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে জিয়া অরফারেনজ ট্রাস্ট মামলায় রায় দেয়ার দিন ধার্য রয়েছে। যার পরিপ্রেক্ষিতেই নতুন করে বিএনপি ও জামায়াত ইসলামীর এই ঐক্যবদ্ধ হওয়ার দাবি জোট নেতাদের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জামায়াত ইসলামীর জাতীয় কর্মপরিষদের একজন দায়িত্বশীল নেতা প্রিয়.কমকে বলেন, ‘রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নাই যেমন সত্য তেমনি জামায়াত ইসলামী যদি কারও সঙ্গে কোনো প্রকার অঙ্গীকারবদ্ধ হয় সেক্ষেত্রে লক্ষ্যে পৌছনোর আগে অতীতেও কখনও পিছু হটেনি, বিশেষ করে সামনের দিনে পিছু হটার প্রশ্নেই আসে না এবং ৮ ফেব্রুয়ারি রাজপথে বিএনপির সঙ্গে একত্রিতভাবে না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে জামায়াত ইসলামীও মাঠে থাকবে। সম্প্রতি দলের পক্ষ থেকে আমাদের অবস্থান জোট প্রধান খালেদা জিয়ার কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে। উনি (খালেদা জিয়া) চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন আমরা শুধুমাত্র নির্দেশনা মোতাবেক জোট গতভাবে পরিচালিত হব।’
এদিকে শুক্রবার বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেছেন, ‘আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দুর্নীতি মামলায় একটি রায়কে ঘিরে যদি কোনো ষড়যন্ত্র করা হয় তা প্রতিহত করতে নেতাকর্মীরা প্রস্তুত। সরকারের ষড়যন্ত্র বানচাল করতে নেতৃত্বদানকারীরা কারাগারে থাকলে প্রয়োজনে নিজ নিজ অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা’
সম্প্রতি খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করেছে ২০ দলীয় জোটের শীর্ষ নেতারা। জোট নেতারা উক্ত মিটিংয়ে মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে সাজা দিলে রাজপথে সর্বাত্মক আন্দোলনে বিএনপির পাশে থাকার ব্যাপারে অঙ্গিকার করেছেন। বিশেষ করে জামায়াত ইসলামীর কর্মপরিষদের সদস্য মাওলানা আব্দুল হালিম বৈঠকে জোট প্রধান খালেদা জিয়ার কাছে নিজ দলের পক্ষে জোরালো অবস্থান তুলে ধরে যথাযথ ব্যাখা দেন। তিনি (হালিম) খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘জামায়াত ইসলামীর সাথে বিএনপির দূরত্ব আছে এটা যেমন আমরা বিশ্বাস করি না, প্রত্যাশা করি আপনিও (খালেদা) বিশ্বাস করেননি। আমরা আপনাকে (খালেদা জিয়া)কে জেলে নেওয়ার চেষ্টা করা হলে জোটগতভাবে সর্বাত্মক আন্দোলনে নামার জন্য প্রস্তুত আছি।’
সাম্প্রতিক সময়ে জামায়াতের একলা চলো নীতির বিষয়ে বেশ কয়েকজন প্রশ্ন তুললে বৈঠকে উপস্থিত জামায়াতের প্রতিনিধি বলেন, ‘বেগম জিয়ার ইস্যুতে তারা আগের মতোই আন্দোলন-সংগ্রামে ভূমিকা রাখবে। বিগত দিনগুলোতে বিএনপির সাথে জামায়াত যেমন আন্দোলনে সক্রিয় ছিল এবারও থাকবে।’
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘আন্দোলনের পাশাপাশি খালেদা জিয়ার মামলায় আইনিভাবে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে বিএনপির। আন্দোলনের কর্মসূচি নেবেন চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি যে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন জোটের সবদল একত্রে তা বাস্তবায়ন করবেন। খালেদা জিয়া নিজে ঘোষণা করুক বা দলের পক্ষ থেকে যাকেই ঘোষণা দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হোক তার ঘোষণার সাথে সাথে ২০ দলীয় জোট নেতাকর্মীরা জনগণকে সাথে নিয়ে রাস্তায় নেমে আসবে।’
বিএনপির একজন প্রভাবশালী ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ইতোমধ্যে তৃণমূলে যোগাযোগ করে আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির সর্বাত্মক প্রস্তুতির নির্দেশনা দিয়েছেন। ফলে চেয়ারপার্সনের রায় প্রতিকূলে গেলে আইনি মোকাবেলার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে রাজপথে আন্দোলন করতে জোর প্রস্তুতি তারই অংশ। কৌশলগত কারণে কেন্দ্রীয়ভাবে কর্মসূচির ঘোষণা না এলেও নিজ দায়িত্বে কড়া প্রতিক্রিয়া দেখাতে বলা হয়েছে তৃণমূলকে। গোপনে গোপনে কেন্দ্রের নির্দেশনা পৌঁছে দেয়া হয়েছে জেলা-উপজেলায়’
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, খালেদা জিয়ার সর্বোচ্চ সাজা হবে এমনটা মাথায় রেখেই প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি। চেয়ারপার্সনকে জেলে নেয়া হলে দল কীভাবে পরিচালিত হবে, সে ব্যাপারে আগেভাগেই পুরোপুরি প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে দলের সিনিয়র নেতারা সমন্বয় করে যৌথ নেতৃত্বে দলের সব কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। অর্থাৎ দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও সিনিয়র নেতারা যৌথ নেতৃত্বে দল পরিচালনার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
দলটির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, মামলার রায় পরবর্তী দলের কার্যক্রম থেকে শুরু করে আন্দোলনের বিষয়ে সব সিদ্ধান্ত নিয়ে সংশ্লিষ্ট নেতাদের নির্দেশনা দিয়েছেন খালেদা জিয়া। দৃঢ় মনোবল রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুত থাকার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। আগামীকাল ৩ ফেব্রুয়ারি দলের জাতীয় নির্বাহী কমিটির আনুষ্ঠানিক সভা হবে। সেখানে পরবর্তী দিক নির্দেশনামূলক পরামর্শ তুলে ধরবেন চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। যার আলোকেই দলের স্থায়ী কমিটির সঙ্গে বৈঠক, জোট শরিকদের সঙ্গেও সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করে তাদের মনোভাব বুঝতে চেষ্টা করেছেন ।
সংবাদটি শেয়ার করুন