সদরুল আইনঃ
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, ‘কোনো বিদেশি শক্তির চাপে শেখ হাসিনা প্রভাবিত হন না। তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা এবং এটি তাঁর অহংকার। এটাই তাঁর গর্ব এবং এটাই তাঁকে চালিত করে।’
বুধবার (৩১ মে) দৈনিক ইত্তেফাক আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অ্যাট দ্য ক্রসরোড: ইনকনভারসেশন উইথ মো. শাহরিয়ার আলম’ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক, নির্বাচন, বিদেশি চাপ, প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফর, জিডিআই, প্রতিরক্ষা, রোহিঙ্গাসহ বিভিন্ন বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার সময় একথা বলেন তিনি।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন দৈনিক ইত্তেফাকের নির্বাহী পরিচালক ও প্রকাশক তারিন হোসেন।উপস্থিত ছিলেন সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক ও বিভিন্ন দেশের কূটীনতিক প্রতিনিধি।
বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক
বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেন, দু’দেশের মধ্যে পরিপক্ব সম্পর্ক রয়েছে। তবে অন্যান্য যেকোনও সম্পর্কের মতো এখানেও কিছু অস্বস্তিকর উপাদান রয়েছে। এরমধ্যে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় অস্বস্তিকর হচ্ছে— বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত না দেওয়া।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘অবশ্যই আমাদের মধ্যে কিছু সমস্যা আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে— একটি বন্ধুভাবাপন্ন দেশ (যুক্তরাষ্ট্র) বঙ্গবন্ধুর আত্ম-স্বীকৃত খুনিকে আশ্রয় দিয়েছে। এটি সমস্যার একটি বড় উৎস। এর সমাধান হচ্ছে খুনিকে ফেরত পাঠানো।’
তিনি বলেন, ‘সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। কানাডাতেও বঙ্গবন্ধুর আরেকজন খুনি আছে, কিন্তু সেখানকার বিষয়টি ভিন্ন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ফেরত না পাঠানোর বিষয়ে তাদের একটি আইন আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেরকম কোনও আইন নেই।’
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসানীতি
যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত নতুন ভিসানীতি নিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জানান, আমরা আশা করি, ওই নীতির যথেচ্ছ ব্যবহার হবে না। ভিসানীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়া অনুসরণ করার বিষয়টি আমাদেরকে নিশ্চিত করতে হবে।
ভিসানীতির পর সম্ভাব্য নতুন মার্কিন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘আমরা নতুন নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কোনও যুক্তি দেখি না।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘২০২১ সালের পর নতুন কোনও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। আমি কোনও কারণ দেখি না, যার কারণে সামনের বছরগুলোতে কোনও ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।’
নিষেধাজ্ঞার কারণে ব্যবসা ও বাণিজ্য কোনও ক্ষতিগ্রস্ত হবে না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘পৃথিবীর অনেক শক্তিশালী দেশ আরেক দেশের সঙ্গে চরম উত্তেজনার মুহূর্তেও বাণিজ্য বন্ধ করেনি।
এটি যদি সত্যি হবে, তবে বাংলাদেশের নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে বাণিজ্যকে কেন জড়িয়ে ফেলা হবে।’
নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের জন্য আমরা রাজনৈতিকভাবে যোগাযোগ করছি। ২০২১ সালের পর পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে বলে যুক্তরাষ্ট্র নিজেই স্বীকার করে নিয়েছে। এছাড়া আইনি প্রক্রিয়া রয়েছে, যেটি আমরা অনুসরণ করবো বলে জানান শাহরিয়ার আলম।
বাংলাদেশ কোনও বিদেশি চাপে প্রভাবিত হয় না উল্লেখ করে প্রতিমন্ত্রী জানান, কোনও বিদেশি শক্তির চাপে শেখ হাসিনা প্রভাবিত হন না। আমাদের বিদেশি বন্ধুরা যদি এর মানে না বুঝে থাকেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা ও এটি তাঁর অহংকার।
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘যদি বিদেশি চাপ প্রয়োগ করাও হয়, তাহলেও কি শেখ হাসিনাকে সরিয়ে ফেলা যাবে?’
এ সময় বাংলাদেশ ও জাপানের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের প্রশংসা করেন শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাম্প্রতিক জাপান, যুক্তরাষ্ট্র ও কাতার সফর অত্যন্ত সফল হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরের বিষয়ে এখনও কিছু ঠিক হয়নি জানিয়ে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী চীন যাবেন কিনা, জানি না। একটি বন্ধু দেশে তিনি যেতেই পারেন। আমরা বিভিন্ন দেশে যেতে পারি নির্বাচনের আগে। আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়া নির্বাচনের কারণে থেমে থাকবে না। সফরই দেশের জন্য ভালো কিছু নিয়ে আসে।’
তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশ চীনের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোডে’ যুক্ত হয়েছে এবং আরও অনেক দেশ এর সঙ্গে যুক্ত। কিন্তু গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) নতুন উদ্যোগ।’’ এটি নিয়ে আলোচনা হওয়া ভালো। কারণ আমরাও জানি না— এটিতে যুক্ত না হওয়ার মতো কোনও উপাদান আছে কিনা বলে তিনি জানান।
শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সব রাজনৈতিক দলের সমান রাজনৈতিক অঙ্গীকার প্রয়োজন। আমরা আশা করি সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি বলেছে, পুলিশ, প্রশাসন এবং যারা নির্বাচনের সঙ্গে জড়িত, তাদেরকে দেখে নেওয়া হবে এবং এটি বড় ধরনের হুমকি। আমি আশা করবো, যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি বিবেচনা করবে। তবে আমরা আশা করি, বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে।’
‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকার’ বিষয়টি শেষ হয়ে গেছে উল্লেখ করে শাহরিয়ার আলম বলেন, আমরা সেটিতে ফিরে যাবো না।’
তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দাবি করাটা এখন হবে অবৈধ এবং এটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা হিসেবে বিবেচিত হবে।’
গ্লোবাল ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ (জিডিআই) নিয়ে বাংলাদেশের ওপর চীনের কোন চাপ আছে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে যোগ দিয়েছে। তবে জিডিআই একটি নতুন আইডিয়া-প্রজেক্ট।’
প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত না নেওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে বলার মতো কিছু নেই। এ বিষয়ে একটি কমিটি করা হয়েছে, যারা বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন।’
তিনি বলেন, আমরা কারও চাপে নেই। আমরা বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করি- ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়।’
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে (বিআরআই) বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেন প্রতিমন্ত্রী।
রোহিঙ্গা সংকট প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সংকট সমাধানে সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।’ এ ব্যাপারে বড় বড় দেশগুলোর সহযোগিতাও আশা করেন তিনি।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা চুক্তির বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী জানান, নিরাপত্তা সহযোগিতা মানে এই নয় যে, আমরা কোনও স্ট্র্যাটেজিক অ্যালায়েন্সে যুক্ত হয়ে গেছি। প্রতিরক্ষা চুক্তি মানে এই নয় যে, আমরা কারও সঙ্গে মিলে যুদ্ধ করবো।
বাংলাদেশ যুদ্ধ চায় না এবং যুদ্ধ করবে না। কিন্তু বাংলাদেশের স্বাধীনতায় আঘাত আসলে, সার্বভৌমত্বে আঘাত আসলে, সেটিকে প্রতিরোধের জন্য আমাদের সরঞ্জাম লাগবে।
তিনি বলেন, ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০ এর অংশ হিসেবে বাংলাদেশের কিছু কৌশলগত পরিকল্পনা আছে এবং এটি শেষ হওয়ার জন্য আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।’
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম বলেছেন, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করছে বাংলাদেশ। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে বড় ধরনের কোনও সরঞ্জাম ক্রয় করবে না দেশ।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘‘নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমাদেরকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম ক্রয় করতে হয়। আমাদের ‘ফোর্সেস গোল ২০৩০’ রয়েছে। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে হয়তো বড় যে ক্রয়াদেশ রয়েছে, সেগুলো শ্লথ হয়ে যাবে। যতদিন না পরিস্থিতি ভালো হচ্ছে, এই ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে।’’
সংবাদটি শেয়ার করুন